চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটটি শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে ফিরে গেল। শহরের কেন্দ্রস্থলে যে মনোরম স্থানটিতে এর অবস্থান ছিল, তার একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের প্রধান দেশের অগ্রগণ্য শিল্পী রশিদ চৌধুরীর উদ্যোগে ও চট্টগ্রামের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ এ স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়। 

সদ্য স্বাধীন দেশ নিজস্ব নানান সংকট ও সমস্যায় তখন জর্জরিত। সে পরিস্থিতিতে চারুকলা শিক্ষার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চালু রাখা ছিল একটি নিত্যদিনের সংগ্রাম। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য ব্যয়ের জন্য ন্যূনতম অর্থ সংগ্রহ করতেও বেগ পেতে হতো। তার ওপর কলেজের জায়গাটার ওপর ছিল বিত্তশালী ও ক্ষমতাবান বিভিন্ন মহলের লোলুপ দৃষ্টি। কলেজটিকে সরকারি করেও সমস্যা মিটল না। নিয়োগবিধির অনতিক্রম্য বাধায় শিক্ষক নিয়োগও সম্ভব হলো না। 

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে শিক্ষক কম না থাকলেও অবকাঠামোর অবস্থা ছিল হতাশাজনক। ছোট ছোট অন্ধকার শ্রেণিকক্ষ আর অপ্রতুল সেমিনার-শিক্ষককক্ষ-অফিসকক্ষ নিয়েই চলছিল বিভাগটি। এর বিস্তার বা উপযোগী কাঠামো নির্মাণ সম্ভব ছিল না, এটি কর্তৃপক্ষের ভাষ্যেও বোঝা যাচ্ছিল। 

সহজ সমাধান ছিল বিভাগের শিক্ষকসংখ্যা আর কলেজের অবকাঠামোকে মিলিত করে একটি একক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এই নান্দনিক পরিসরে গড়ে তোলা সম্ভব ছিল চমৎকার স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি শিল্পশিক্ষালয়। আর তা হতে পারত শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। 

এমনকি স্থানটির সঙ্গে আশপাশের কিছু জমি যুক্ত করে একটি পরিপূর্ণ সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয় বা ‘ইউনিভার্সিটি অব কালচার’ প্রতিষ্ঠার সুদূরবর্তী স্বপ্নও  কারও কারও মাথায় দানা বাঁধছিল। চারুকলার, সে অর্থে সংগীত, নাট্যকলা বা চলচ্চিত্রের, শিক্ষা ও অনুশীলন কেবল শ্রেণিকক্ষের পাঠের সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকলে চলে না। সার্বক্ষণিক বিনিময় ও কর্মকাণ্ডের দ্বারা একটি সার্বিক সৃজনশীল ও প্রাণচঞ্চল আবহ নির্মাণ করতে না পারলে তা সম্ভব নয়। এ জন্য পাশ্চাত্যে, এমনকি ভারতেও, সৃজনশীল বিষয়সমূহের জন্য স্বতন্ত্র স্থান ও ভবন বরাদ্দ রয়েছে। বলা বাহুল্য, সুযোগ সৃষ্টি করেও সেটি আমরা সেভাবে করতে পারিনি। এর দায় আমাদের সবার। শিক্ষক ও ছাত্র সবার মিলিত উদ্দীপনাই একে বাস্তবায়িত করতে পারত। 

চট্টগ্রাম থেকেই সত্তরের দশকে স্বাধীনতা-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের নব্য শিল্পধারার জাগরণ সূচিত হয়েছিল, চট্টগ্রাম আবারও সেই পুরোনো গৌরবের স্থানটি ফিরে পাক, সেটি নিশ্চয় আমাদের সবারই অভিপ্রায়। তবে শহরের বাদশাহ মিয়া সড়কের এই স্থান বহু স্মরণীয় মানুষের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। বিগত ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে কীর্তিমান ও উদীয়মান বহু প্রতিভার পদচারণের স্মৃতি ধারণ করে আছে সে। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের একটি প্রধান কেন্দ্ররূপে সেটির চরিত্রটি যাতে অব্যাহত থাকে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যাতে সে ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্নœ রাখেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে সেটি শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী এবং সার্বিকভাবে চট্টগ্রামবাসীর প্রত্যাশা থাকবে।  

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এই জমি ও ভবন চারুকলা ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনায় আধুনিক সুযোগ–সুবিধাসংবলিত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা কঠিন নয়। এখানে একটি আধুনিক শিল্প সংগ্রহালয় ও প্রদর্শনীর যথাযথ ব্যবস্থাসংবলিত গ্যালারি সহজেই করা যায়। তেমনি মিলনায়তন ও আধুনিক সেমিনার কক্ষ তো রয়েছেই, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র-শিক্ষকের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগারের, চিকিৎসাব্যবস্থারও সম্প্রসারিত কিছু সুবিধা এখানে সহজেই চালু করা যায়। ছাত্রদের সুবিধার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান দাপ্তরিক কাজের একটি সমন্বিত ওয়ান–স্টপ সেবাও এখানে চালু করা যেতে পারে। নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের নানা আয়োজন অনায়াসেই এখানে হতে পারে। 

স্থানটির অতীত ভূমিকার সঙ্গে সংগতি রেখে বিদ্যায়তনিক সীমানার বাইরে শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চার একটি মিলনক্ষেত্র হিসেবে এটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকে অনেকটাই উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রমী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের এটুকুই প্রত্যাশা।

আবুল মনসুর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, চারুকলা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চ র কল স থ নট র একট

এছাড়াও পড়ুন:

পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে বংশে তিনি প্রথম, তাই এত আয়োজন

চীনে উচ্চশিক্ষার জন্য অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে বেইজিংয়ের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া দেশটির যেকোনো শিক্ষার্থীর জন্য দারুণ সম্মানের। এ বছর পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন লি গুওইয়াও।

লির বাড়ি জেজিয়াং প্রদেশের ওয়েনজউ শহরে। এর আগে তাঁর বংশে শত বছরের ইতিহাসে কেউ পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাননি। এত বড় সম্মানের উপলক্ষ উদ্‌যাপন করতে তাই বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি লির পরিবার ও গ্রামের বাসিন্দারা। রীতিমতো লালগালিচা বিছিয়ে, মোটর শোভাযাত্রা করে, ব্যান্ড বাজিয়ে পরিবার ও গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করা লিকে সংবর্ধনা দেন তাঁরা, সঙ্গে ছিল ভূরিভোজের ব্যবস্থা। চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইবোতে এই সংবর্ধনার ছবি ও ভিডিও রীতিমতো ভাইরাল হয়ে যায়।

চীনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। যেটি ‘গাওকাও’ নামে পরিচিত। তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই পরীক্ষা বেশ কঠিন। পরীক্ষায় মোট ৭৫০ নম্বরের মধ্যে লি পেয়েছেন ৬৯১।

লির গ্রামের এক প্রতিবেশী জানান, লির বাবা নির্মাণশ্রমিক। লির মা মাত্র ২ হাজার ৮০০ ইউয়ান বেতনে একটি সুপারশপে কাজ করেন। সত্যি বলতে, ছেলেটি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমে এটা অর্জন করেছেন।

প্রতিবেশী আরেক গ্রামবাসী বলেন, লি তাঁর বাবার কাছ থেকে পাওয়া একটি পুরোনো মুঠোফোন দিয়ে প্রশ্নোত্তর অনুশীলন করতেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় গ্রামের গ্রন্থাগারে বসে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতে লিখে তারপর সেগুলো অনুশীলন করতেন। মাধ্যমিকে তিনি কখনো কোনো প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়েননি।

লিকে সংবর্ধনা দিতে শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য ভেঙে তাঁদের গ্রামের পূর্বপুরুষদের মন্দিরের প্রধান ফটক খোলা হয়, যা একটি বিশেষ সম্মানের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।

লিকে সংবর্ধনা দেওয়ার ছবি ও ভিডিও চীনজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

অনলাইনে একজন লেখেন, ‘পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ৬৯১ নম্বর! এটা অবিশ্বাস্য। সত্যিই পুরো পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করেছে!’

তবে কেউ কেউ এই জমকালো উদ্‌যাপন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

তাঁরা বলেছেন, এটা কি একটু বাড়াবাড়ি নয়? উৎসবটা খুবই জাঁকজমকপূর্ণ, এতে ছেলেটার ওপর অকারণ চাপ তৈরি হতে পারে। স্নাতক হওয়ার পর কি পরিবার তাঁর কাছ থেকে অনেক বেশি কিছু প্রত্যাশা করবে না?

সম্পর্কিত নিবন্ধ