চালাক লোক দিয়ে কি পুঁজিবাজারের উন্নয়ন সম্ভব
Published: 4th, June 2025 GMT
সম্প্রতি পুঁজিবাজারের উন্নয়ন নিয়ে এক আলোচনায় একজন মুখ্য আলোচকের কাছে শুনলাম, পুঁজিবাজারের দৈন্য ঘোচাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় ‘চালাক লোক’ নিয়োগ দিতে হবে।
প্রায় ১০ বছর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের মনোনীত পরিচালক পদে থেকে আমার পুঁজিবাজারের নিবন্ধিত ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স আর মার্চেন্ট ব্যাংকের বোর্ডের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। গ্রামীণফোনের আইপিও কাজে আমার ও আমাদের প্রতিষ্ঠানের কাজ করার অভিজ্ঞতা পুঁজিবাজারের উন্নয়নে দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করি। তা ছাড়া পুঁজিবাজারের উন্নয়নে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের নির্দিষ্ট প্রকল্পে কাজের সুযোগও হয়েছে।
সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীনির্ভর ও দুষ্টজন প্রভাবিত বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সমস্যার গভীরে না গিয়ে বা রোগের কারণ নির্ণয় না করে টোটকা সমাধান দিলে কোনো সুফল আসবে না।
২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে নরওয়ের অসলোয় গ্রামীণফোনের মালিকানা প্রতিষ্ঠান টেলিনরের প্রধান কার্যালয়ে তাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সব ব্যক্তি এবং এশীয় বিভাগের প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। আমরা প্রথমত চেষ্টা করছিলাম, গ্রামীণফোনের সাফল্যকে যদি বাজারে বিকাতে হয়, তাহলে তাঁরা ঢাকার সঙ্গে সঙ্গে যুগপৎভাবে লন্ডনে কিংবা সিঙ্গাপুরে এমনকি নিউইয়র্কের শেয়ারবাজারে গ্রামীণফোনকে যৌথ তালিকাভুক্তি করার কথা ভাবতে পারেন।
এটি ছিল একটি অত্যন্ত দুরূহ কাজ। বাংলাদেশে এর আগে এত বড় কোনো শেয়ার (প্রায় ১০০০ কোটি টাকা) কখনো তালিকাভুক্তি হয়নি। আমরা সংগত কারণেই ধারণা করেছিলাম, গ্রামীণফোনের তালিকাভুক্তি বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে আমরা ও কর্তাব্যক্তিরা অত্যন্ত সজাগ ছিলাম, যাতে একে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি না হতে পারে।
গ্রামীণফোনের শেয়ার কি ১ টাকা, নাকি ১০ টাকা, নাকি ১০০ টাকা অভিহিত মূল্যে বাজারে তালিকাভুক্ত করব, সেটি আমাদের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল।
তৃতীয় চ্যালেঞ্জটি ছিল গ্রামীণফোনের শেয়ারের প্রাইজ ডিসকভারি কিংবা গ্রামীণফোনের ভ্যালুয়েশন।
চতুর্থ চ্যালেঞ্জ, মূলত গ্রামীণফোনের আকাঙ্ক্ষা অনুসারে গ্রামীণফোন যদি বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে তাদের সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হবে কি না কিংবা সরকারের করহারে কোনো ধরনের অব্যাহতি দেওয়া হবে কি না কিংবা করহার কমিয়ে আনা হবে কি না।
পঞ্চম চ্যালেঞ্জ ছিল, সব ধরনের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের বাইরে থেকে গ্রামীণফোনের তালিকাভুক্তিকে বিবেচনায় আনা। ষষ্ঠ চ্যালেঞ্জ ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ব্রোকার কিংবা ব্যক্তিদের কোনো সুযোগ-সুবিধার বিবেচনায় না নিয়ে কীভাবে গ্রামীণফোনের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে।
প্রথম দিকে গ্রামীণফোনের প্রাইজ ডিসকভারি, ইনফরমেশন মেমোরেন্ডাম বিবেচনায় গ্রামীণফোনকে তালিকাভুক্ত করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক অনুমোদন পাওয়া যাচ্ছিল না। সে ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা তিনটি বিষয় বিবেচনায় নিয়েছিল। তার মধ্যে একটি হচ্ছে শেয়ারের অভিহিত মূল্য কী হবে। দ্বিতীয় যে জিনিসটি আমরা লক্ষ করেছি, সেটি হচ্ছে বিভিন্ন ফায়ারওয়াল কীভাবে কার্যকর করা হবে।
এখানে মনে করা হয়েছিল, প্রবাসী বাংলাদেশিদের কীভাবে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যাবে; গ্রামীণফোনের কর্মকর্তাদের কীভাবে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যাবে; গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের কীভাবে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে, তথা বাংলাদেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কীভাবে আরও সম্পৃক্ত করা যাবে।
এ ধরনের বড় শেয়ারকে বাজারে এনে বাজারের মধ্যে গভীরতা এমনকি ক্ষুদ্র ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা অগ্রাধিকারে ছিল। সে ক্ষেত্রে সংগত কারণেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে অনুমোদনপ্রাপ্তি বিরাট সমস্যা ছিল। তার সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে গ্রামীণফোনের জন্য তালিকাভুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের করহার কমানোর ব্যবস্থা করাও ছিল আরেকটি চ্যালেঞ্জ।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ২০০৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে গ্রামীণফোনের আইপিও পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা সম্ভব হয়।
এ ক্ষেত্রে আরও যে বিষয়ের ওপর নজর আনতে চাই, সেটি হলো বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের বাজারে আনার ক্ষেত্রে, তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে কীভাবে প্রণোদনা দেওয়া হবে, তা ঠিক করা। সেটি এনবিআরের প্রণোদনা, শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রণোদনা, শেয়ারবাজার সম্পর্কে বিজ্ঞ আইনজীবীর সহায়তা, এমনকি আমাদের মন্ত্রী বা উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সহায়তা, যা–ই হোক না কেন। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যে প্রতিষ্ঠানকে চেষ্টা-তদবির করে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা হচ্ছে, সেই প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কী; প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ নগদ অর্থ সঞ্চালনের সক্ষমতা কী; তারা তাদের কর্মীদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করে; তাদের সাপ্লায়ারদের সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করে; তারা তাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কী ধরনের স্বচ্ছতা ও নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখছে, সেগুলো নজরদারিতে আনা।
যদি কোনো বড়, বহুজাতিক ও নামকরা প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে আনতে হয়, তাহলে তাদের কোন কোন জায়গায় ছাড় দেওয়া যেতে পারে; সাধারণ মানুষ ও বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি না করে কীভাবে আরও সক্রিয়ভাবে বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা যেতে পারে, সেটি ভাবতে হবে এবং গুরুত্ব দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে পুঁজিবাজারে কীভাবে গভীরতা সৃষ্টি করতে পারি, স্বচ্ছতা সৃষ্টি করতে পারি, তা নিয়েও ভাবতে হবে।
বাংলাদেশের বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অনেককেই ব্রোকারেজ লাইসেন্সের জন্য দৌড়াতে দেখেছি, কিন্তু নিজের প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে আনার কোনো ইচ্ছা দেখিনি। অনেক লাভজনক কোম্পানি এত মুনাফা করে যে তারা অনেক দামে বা ডিভিডেন্ড দিয়ে পুঁজি সংগ্রহের চেয়ে ব্যাংকঋণনির্ভর থাকাটাই বেশি পছন্দ করে কিংবা তাদের সাফল্য সাধারণের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে রাজি হয় না।
বাংলাদেশে ব্যাংকের ঋণসীমা তাদের পুঁজিনির্ভর হলেও ঋণগ্রহীতার ঋণের পরিমাণ তার পুঁজিনির্ভর নয়। তাই তাদের পুঁজি বাড়ানোর চাপ নেই। অন্যদিকে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানকে অনেক ছাড় দিয়েও অন্যদের পুঁজিবাজারে আনা যায়নি।
এ ছাড়া পুঁজিবাজারের বিভিন্ন অংশীজনের নিয়ে সমস্যা রয়েছে। তাদের অনেকেই পুঁজিবাজারের সঙ্গে ভুলে জুয়া খেলাকে মাখিয়ে ফেলেন কিংবা দীর্ঘকালীন বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে চান না। চেষ্টাচরিত্র ছাড়াই মওকায় টাকা বানানোর সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে চান। পুঁজিবাজার নিয়ে সঠিক জ্ঞানের অভাবও এখানে প্রতিবন্ধক। বাজারের অপারেটরদের অপরিপক্বতা আর সহজেই ঘুষ-দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতাও বাজার উন্নয়নে বিরাট বাধা।
আরেকটি নির্মম সত্যি হচ্ছে, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কখনোই পুঁজিবাজার নিয়ে আশাবাদী ছিলেন না, যদিও জনসমক্ষে তাদের অনেকেই আশ্বাসবাণী শুনিয়ে থাকেন। তাই চালাক লোক নয়, পুঁজিবাজারের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন অপরাপর দেশের মতো সঠিক দিকনির্দেশনা, নির্মোহ বাস্তবায়ন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ সহজীকরণ আর নিয়মিত নজরদারির। এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা।
মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ য় রব জ র ক ত কর র জন য আম দ র ন র ভর ধরন র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
কৃষি বিবর্তনের গল্প বলে যে জাদুঘর
বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির মূলে রয়েছে কৃষি। এই কৃষির বিবর্তনের গল্প, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের জীবন, প্রযুক্তির বিকাশ এবং গ্রামীণ সমাজের ঐতিহ্য যেন এক অমূল্য উত্তরাধিকার।
সময়ের প্রবাহে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সেই হারানো ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও তুলে ধরার প্রয়াসেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম কৃষি জাদুঘর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি জাদুঘর।
আরো পড়ুন:
জাপানের এনইএফ বৃত্তি পেলেন বাকৃবির ২০ শিক্ষার্থী
গোপনে বাকৃবি ছাত্রীদের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তুলে সাবেক ছাত্রকে দিতেন আরেক ছাত্রী
বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে, বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) ঠিক সামনেই সবুজ দেবদারু গাছে ঘেরা এক মনোরম পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে এই কৃষি জাদুঘর। প্রকৃতির কোলে যেন কৃষির ইতিহাস কথা বলে এখানে।
২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মু. মুস্তাফিজুর রহমানের হাত ধরে জাদুঘরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়, যার মূল স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ হোসেন। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম এর উদ্বোধন করেন।
নানা প্রতিবন্ধকতা ও জনবল সংকটের কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও, ২০০৭ সালের ৩০ জুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসাইন মিঞাঁ এটি পুনরায় দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এটি দেশের কৃষি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির এক জীবন্ত সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত।
৫ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত এই অষ্টভুজ আকৃতির ভবনটি স্থাপত্যগত দিক থেকেও দারুণ দৃষ্টিনন্দন। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে রঙিন মাছের অ্যাকুয়ারিয়াম, পাশে প্রাচীন সাতটি খনার বচন। প্রবেশমুখের ঠিক পরেই দুটি অফিস কক্ষ, আর একটু ভেতরে এগোলেই দেখা যায় একটি ছাদহীন বৃত্তাকার বাগান, যা প্রাকৃতিক আলোর ছোঁয়ায় উজ্জ্বল। সেই বাগানের চারপাশেই রয়েছে সংরক্ষণশালার বিভিন্ন কক্ষ। প্রতিটি কক্ষই যেন কৃষির একেকটি অধ্যায়।
জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো বীজ সংগ্রহশালা। এখানে রয়েছে ধান, গম, ভুট্টা, তিসি, চিনাবাদাম, কাউনধান, ফ্রেঞ্চ বিন, ফাবা বিনসহ নানা ফল ও সবজির বীজ। দেখা মেলে বিরল প্রজাতির তৈকর ফলের বীজ, যা একসময় আচার ও জেলি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। রয়েছে বহুল পরিচিত ভ্যান্না বীজ, যার তৈল দিয়ে কসমেটিক ও ঔষধি পণ্য তৈরি হয়।
মাটির নানা প্রকার নমুনা, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সার, এমনকি পাহাড়ি চাষাবাদের মডেলও স্থান পেয়েছে এখানে।
শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও দর্শনার্থীদের শিক্ষার জন্য প্রদর্শিত হয়েছে বিভিন্ন ফসল রোগের চিত্র, আক্রান্ত বীজ, ও ব্যাকটেরিয়ার নমুনা। এ অংশের এক বিশেষ আকর্ষণ আড়াই কেজি ওজনের এক বিশাল মিষ্টি আলু, যা দর্শনার্থীদের বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
জাদুঘরের আরেক অংশ যেন এক ক্ষুদ্র প্রাণিবিজ্ঞান জাদুঘর। এখানে প্রদর্শিত আছে বুনো মহিষ, হরিণের শিং, গরু, অজগর ও গোখরা সাপের কংকাল। রয়েছে সংরক্ষিত কালো মেটো ইঁদুর, ধারাই সাপ, এবং কচ্ছপের খোল ও কঙ্কাল।
উপরে তাকালে দেখা যায় এক বিশাল প্রিজার্ভড শকুন, সে যেন আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। রয়েছে প্লাটিপাসের কংকালও, যা এক বিরল প্রাণীর বাস্তব নিদর্শন। প্রতিটি নমুনাই যেন দর্শনার্থীকে স্মরণ করিয়ে দেয়, কৃষি কেবল ফসল বা জমির নয়, এটি প্রকৃতি ও প্রাণের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
গ্রামীণ জীবনের বৈচিত্র্যও এখানে তুলে ধরা হয়েছে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। এক কক্ষে সাজানো আছে ঢেকি, কুলা, পানের ডাবর, হুকা, হারিকেন, কুপি বাতি, গরুর গাড়ির মডেল, এমনকি মাছ ধরার পুরোনো যন্ত্রও। রয়েছে তবলা, বেহালা, আদুরী, ক্রাম ও নাতকসহ বিভিন্ন দেশীয় বাদ্যযন্ত্র।
এক পাশে দেখা যায় ‘গিলা’, যা একসময় বর-কনের গোসল অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো। এখনকার তরুণ প্রজন্ম হয়তো নামটিও জানে না, অথচ এটি ছিল গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ।
আরো রয়েছে কৃষকের বসতবাড়ির পূর্ণাঙ্গ মডেল, যা দেখতে যেন একেবারে বাস্তব কৃষকের ঘর। এখানে দেখা যায় কৃষকের হালচাষের দৃশ্য, রান্নাঘর, ধান রাখার গোলা, গরুর খোঁয়াড় এবং গৃহিণীর সাজানো রান্নার জায়গা। যেন একবারে গ্রামের জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে দেয়াল আর মডেলের মধ্যে।
প্রযুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য জাদুঘরে স্থান পেয়েছে পুরনো মাইক্রো কম্পিউটার, ডট প্রিন্টার, পাওয়ার টিলার, ধান মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্র, ঘাণি, ডিঙি নৌকা, কাঁঠের তৈরি গরুর গাড়ি, তালগাছের কুন্দা ও উপজাতিদের পোশাক। এক পাশে ঝুলছে হরিণের চামড়া, অন্য পাশে সাজানো উপজাতীয় কৃষি উপকরণ, যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
এই উপকরণগুলো কেবল প্রযুক্তির বিবর্তনের ইতিহাস নয়, বরং কৃষির সঙ্গে মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনধারার মেলবন্ধনের প্রতীক।
জাদুঘরের আরেক বিশেষ প্রদর্শনী হলো প্রাচীন থেকে আধুনিক সময়ের মুদ্রার সংগ্রহ। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রা এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এগুলো দেখে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বিকাশ ও সামাজিক পরিবর্তনের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জাদুঘরের প্রতিটি কোণ যেন বলে, কৃষিই বাংলাদেশের প্রাণ। এখানকার প্রতিটি উপকরণ, প্রতিটি মডেল, প্রতিটি নমুনা কৃষির বিকাশ ও মানুষের সংগ্রামের গল্প বহন করে। দর্শনার্থীরা এখানে এসে কৃষির অতীত ঐতিহ্য থেকে বর্তমান প্রযুক্তির রূপান্তর পর্যন্ত এক নজরে দেখতে পান।
বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, “এটি দেশের প্রথম এবং সবচেয়ে উপকরণসমৃদ্ধ কৃষি জাদুঘর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে এটিকে দোতলা ভবনে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছে, যেখানে কৃষি ভিত্তিক ১৪টি জেলার ঐতিহ্যবাহী কৃষি উপকরণ সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে।”
তিনি আরো বলেন, “দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য ভবিষ্যতে টিকিট ব্যবস্থা চালুর কথাও ভাবা হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং জাদুঘরের রক্ষণাবেক্ষণেও ভূমিকা রাখবে।”
এই কৃষি জাদুঘর শুধু কৃষি উপকরণের প্রদর্শনী নয়, বরং এটি বাংলাদেশের কৃষি সভ্যতার ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও মানুষের সম্পর্কের এক সজীব দলিল। শহরের কোলাহল আর কংক্রিটের ভিড় থেকে বেরিয়ে কেউ যদি এখানে আসে, তবে মুহূর্তেই যেন হারিয়ে যায় মাটির গন্ধে, কৃষকের ঘামে, বাংলার গ্রামীণ জীবনের সহজ সরল সৌন্দর্যে।
জাদুঘরটি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে এবং প্রতি শনিবার বন্ধ থাকে। সময় সুযোগে একবার ঘুরে গেলে দেখা মিলবে বাংলাদেশের কৃষির হাজার বছরের গল্প, যা মাটি, ঘাম, বীজ আর ঐতিহ্যের বন্ধনে গাঁথা এক অনবদ্য ইতিহাস।
ঢাকা/মেহেদী