গাজার অভুক্ত মানুষের জন্য আন্তর্জাতিক সংগঠন ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের (এফএফসি) ত্রাণবাহী জাহাজ নিজেদের জলসীমায় প্রবেশ করতে দেবে না ইসরায়েল। গত মঙ্গলবার ইসরায়েলের সেনাবাহিনী এ হুমকি দিয়েছে।

রোববার ইতালির সিসিলি দ্বীপ থেকে এফএফসির ত্রাণবাহী জাহাজ ‘ম্যাডলানে’ চড়ে রওনা হয়েছেন গ্রেটা থুনবার্গসহ ১১ মানবাধিকারকর্মী। পুরো কার্যক্রমটি পরিচালনা করছে এফএফসি। আগামী শনিবার জাহাজটি গাজা উপকূলে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

আরও পড়ুনগাজায় আজ ত্রাণ দিচ্ছে না হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন, যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে জাতিসংঘে ভোটাভুটি৩ ঘণ্টা আগে

দুই মাসের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় ত্রাণবাহী কোনো ট্রাক প্রবেশ করতে দেয়নি ইসরায়েল। এতে গাজায় ওষুধ, খাবার, পানিসহ জরুরি পণ্যের ব্যাপক সংকট দেখা দেয়। মারাত্মক মানবিক সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ে ইসরায়েল। এমন পরিস্থিতিতে গাজার অভুক্ত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় এফএফসি।

গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে ফ্রিডম ফ্লোটিলা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন বলেন, ‘ইসরায়েলের সামুদ্রিক অঞ্চল ও সমুদ্রসীমা রক্ষার জন্য নৌবাহিনী দিনরাত কাজ করছে। এ ক্ষেত্রেও আমরা প্রস্তুত। গত কয়েক বছরে আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি এবং সে অনুযায়ীই পদক্ষেপ নেব।’ তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে রাজি হননি তিনি।

আরও পড়ুনগাজায় ত্রাণকেন্দ্রে আবার ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি হামলায় ২৭ জন নিহত০৩ জুন ২০২৫

এফএফসি ২০১০ সালে যাত্রা শুরু করে। ওই বছর তুরস্ক থেকে ত্রাণ নিয়ে গাজার উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন ফ্রিডম ফ্লোটিলার কর্মীরা। মাভি মারমারা নামের ওই জাহাজে একপর্যায়ে হামলা চালিয়েছিলেন ইসরায়েলি সেনারা। তাতে ১০ জন নিহত ও ২৮ জন আহত হয়েছিলেন। এবার ‘ম্যাডলানে’ নামের ছোট একটি জাহাজে গাজাবাসীর জন্য ফলের রস, দুধ, চাল, টিনজাত খাবার ও আমিষজাত খাবার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

মঙ্গলবার এক্সে (সাবেক টুইটার) ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন লিখেছে, ‘আমরা একসঙ্গে গাজার জন্য একটি সামুদ্রিক করিডর খুলে দিতে পারি।’

গত মাসের শুরুতে মানবিক সহায়তা নিয়ে ফিলিস্তিনের গাজার অভিমুখে থাকা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের একটি জাহাজে ড্রোন দিয়ে বোমা হামলা চালানো হয়েছে। মাল্টা উপকূলে আন্তর্জাতিক জলসীমায় এ হামলা চালানো হয়। হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করা হয়েছিল।

গাজায় জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণ বন্ধ

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল পরিচালিত বিতর্কিত সহায়তা সংস্থা গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) গাজায় তাদের সহায়তাকেন্দ্রগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। আজ বুধবার এ ঘোষণা দেয় তারা। এদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সতর্ক করে জানিয়েছে, ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রগুলোর পথে যাওয়া রাস্তাগুলো এখন যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ত্রাণ আনতে গিয়ে ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হওয়ার কয়েকটি ঘটনার পর বিতরণকেন্দ্রগুলো বন্ধের ঘোষণা দিল জিএইচএফ। গত কয়েক দিনে তাদের পরিচালিত সহায়তাকেন্দ্রের আশপাশে হামলায় শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহতের ঘটনা ঘটে। প্রাণহানির এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ।

সমালোচনার মধ্যেই আজ ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজায় কমপক্ষে ১৬ জন নিহত হয়েছেন। এর আগে মঙ্গলবার গাজা সরকারের জনসংযোগ দপ্তর এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, ত্রাণ নিতে গিয়ে আট দিনে ইসরায়েলের হামলায় ১০২ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

আরও পড়ুন৬০০ দিন যুদ্ধের পরও গাজায় ইসরায়েল কেন বিজয়ী হতে পারেনি০২ জুন ২০২৫

জাতিসংঘে ভোটাভুটি

গাজায় যুদ্ধবিরতি ও ত্রাণসহায়তা প্রবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আজ একটি প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি হওয়ার কথা। তবে এতে ভেটো দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জ এইচএফ ইসর য় ল সহ য ত র জন য ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় ত্রাণের নামে গণহত্যা

মঙ্গলবার গাজার দক্ষিণ শহর রাফায় ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের পাশে ইসরায়েলি অগ্নিকাণ্ডে ২৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও কয়েক ডজন আহত হন। এই হামলা এমন সময়ে হয়েছে, যার দুই দিন আগে একই স্থানে ইসরায়েলি ট্যাঙ্কের হামলার শিকার হন হাজারো উদ্বিগ্ন ও ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি। সেখানে প্রাণ হারান ৩১ ফিলিস্তিনি। একই দিনে মধ্য গাজার নেটজারিক মরিডোরের কাছে ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে আরেকজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।  

গাজার ২০ লাখ অনাহারী মানুষকে এখন মাত্র চারটি স্থানে খাবার বিতরণ করা হয়। তারা প্রায় তিন মাস ইসরায়েলি এমন ব্লকেডের মধ্যে ছিলেন, যেখানে ত্রাণ সহায়তা প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। ১৯ মে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় ‘সীমিত’ ত্রাণ সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেন। তাও তখন এই অনুমতি আসে যখন গণঅনাহার পরিস্থিতি এমন ‘লাল রেখা’য় পৌঁছে, যার পর যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন সংকটে পড়তে পারে; বস্তুত ইসরায়েলি অপরাধ ও গণহত্যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে যুক্তরাষ্ট্র।

এখনও এমন গণহত্যার কারণ হলো, ‘সীমিত’ পর্যায়ে ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি, যার কারণে ফিলিস্তিনিরা এমন ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন, হয় ক্ষুধায় মারা যাবে, না-হয় খাবার না পাওয়ার জন্য মারা যাবে। শুধু এ দুই কারণে তারা মারা যাচ্ছে না। বরং ইসরায়েলি জেনোসাইডে যখন দেশটি নির্বিচারে হাসপাতাল, শরণার্থী শিবিরে এবং এর বাইরেও বোমা মারছে তখন ফিলিস্তিনি মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৫৪ হাজার চার শতাধিক।

ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলো গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামে নতুন একটি সংগঠন পরিচালনা করে। এটি মূলত ইসরায়েলি উদ্ভাবিত বেসরকারি সংগঠন, যা সুইজারল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেলওয়ার রাজ্যে নিবন্ধিত। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে, জিএইচএফের ‘দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে খাদ্য বিতরণের কোনো অভিজ্ঞতা নেই।’ অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সরকারের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, যেখানে সংগঠনটি সাবেক মার্কিন সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নিয়োগ করে।

সে জন্যই গাজায় খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলো এখন সশস্ত্র মার্কিন নিরাপত্তা ঠিকাদারদের তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হয়, যেখানে এগুলোর অবস্থান ইসরায়েলি সামরিক ঘাঁটির কাছাকাছি সুবিধাজনক জায়গায়। বর্তমানে যে চারটি জায়গায় ত্রাণ বিতরণ করা হয়, সেগুলো মধ্য ও দক্ষিণ গাজায় অবস্থিত। অথচ গাজার উল্লেখযোগ্য মানুষ বাস করে উত্তর দিকে। ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে পৌঁছানোর জন্য অনেক ফিলিস্তিনিকে দীর্ঘ পথ হেঁটে ইসরায়েলি সামরিক সীমানা অতিক্রম করে যেতে হয়, যা তাদের জীবনকে আরও ঝুঁকিতে ফেলে। সেখানে বয়স্ক, অসুস্থ বা আহত ফিলিস্তিনিদের খাবার বিতরণের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। আর শারীরিক পরিশ্রম করতে অক্ষম, যারা এতদূর যেতে পারেন না, এমন ক্ষুধার্ত মানুষের কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না।

অধিকন্তু জিএইচএফের উদ্যোগ ইসরায়েলের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতকরণ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কাজ করছে। তারা জীবিত ফিলিস্তিনিদের গাজার দক্ষিণাঞ্চলে জড়ো করার চেষ্টা করছে, যাতে পরে তাদের স্থায়ীভাবে বিতাড়ন সহজ হয়। এটি করা হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাবিত নতুন গাজা পরিকল্পনা অনুসারে, যে পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনি ব্যতীত অন্যদের নিয়ে অঞ্চল গড়ার লক্ষ্য রয়েছে। অন্যভাবে বললে, জিএইচএফ গাজার মানুষের ক্ষুধা নিবারণ বা স্থানীয়দের চাহিদা পূরণে কাজ করছে না; বরং তাদের খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলো এমন এক চমকপ্রদ প্রচারণার আয়োজন, যা মানবিক বিপর্যয়ের নামে ইচ্ছাকৃত অনাহার ও গণহত্যা থেকে মনোযোগ সরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে কাজ করছে।
জাতিসংঘ ও বিভিন্ন ত্রাণ সহায়তাকারী সংস্থা মানবিক সহায়তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কড়া সমালোচনা করেছে। এমনকি এই পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে, জিএইচএফের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক মার্কিন মেরিন স্নাইপার জেক উড পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। 

বেলেন ফার্নান্দেজ: আলজাজিরার কলাম লেখক; ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর 
মাহফুজুর রহমান মানিক
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজা অভিমুখী ত্রাণবাহী জাহাজে কারা আছেন, এতে কী ত্রাণ আছে
  • গাজায় আজ ত্রাণ দিচ্ছে না হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন, যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে জাতিসংঘে ভোটাভুটি
  • গাজায় ত্রাণের নামে গণহত্যা
  • গাজায় ত্রাণকেন্দ্রে আবার ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি হামলায় ২৭ জন নিহত
  • গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের কাছে ফিলিস্তিনিদের হত্যার ঘটনায় স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জাতিসংঘের
  • ত্রাণ বিতরণের সময় ফিলিস্তিনিদের হত্যা: স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জাতিসংঘের