জলাবদ্ধতা এখন শুধু বড় শহরগুলোর সমস্যা নয়, এটি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের জেলা–উপজেলা ও পৌর শহরগুলোতেও। বৃষ্টির মৌসুম শুরু হলেই জলাবদ্ধতার কারণে শহর অচল হয়ে পড়ার পর এ নিয়ে হইচই শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এ সমস্যা নিরসনে যে পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন আছে, সেদিকে খেয়ালই রাখা হয় না। যে কারণে ভুগছে মৌলভীবাজারের মতো ছোট শহরগুলোও। বৃষ্টির পানি নেমে না যেতে পারায় পৌর শহরটির অনেক এলাকা এখন নিয়মিতই ডুবছে। বিষয়টি দুঃখজনক।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, টানা বৃষ্টির ফলে মৌলভীবাজারের অনেক এলাকা ডুবে যাচ্ছে। কারণ, বেশি বৃষ্টি হলে সেই বৃষ্টির পানি ধারণ করার মতো জলাধার এখন আর শহরে নেই। অন্যদিকে নালাগুলোরও একসঙ্গে বেশি পানি টেনে নেওয়ার সক্ষমতা নেই। একটা সময় শহরের পূর্বাঞ্চলে ফাটাবিলের বিশাল এলাকা অনেক পানি ধারণ করতে পারত। আশপাশের বৃষ্টির পানি দ্রুত ফাটাবিলে এসে জমা হতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ফাটাবিলের সেই প্রকৃতি-পরিবেশ সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। নিচু এলাকা ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে বাসাবাড়ি গড়ে তোলা হয়েছে। এতে একদিকে জল ধারণের জায়গা কমে গেছে, অন্যদিকে পানিনিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। এতে পানি ফুলে-ফেঁপে উঠছে। আর বৃষ্টির মৌসুমে পৌরবাসীর ভোগান্তিও বাড়ছে।
এখানে বর্জ্য অব্যবস্থাপনা গুরুতর প্রভাব ফেলছে। শহরের বিভিন্ন নালায় নিজেদের খুশিমতো ফেলা হচ্ছে পলিথিনসহ ময়লা-আবর্জনা। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নানা রকম বর্জ্য এসব নালায় ফেলা হচ্ছে। আবাসিক এলাকার লোকজনও বাসাবাড়ির বর্জ্য নালার মধ্যে ফেলছেন। এতে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পানি নালা উপচে সড়কের ওপর চলে আসছে; নিচু বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়ছে। এ ছাড়া কোদালীছড়া হচ্ছে জেলা শহরের পানিনিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম। বর্ষিজোরা পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা কোদালীছড়াটি প্রায় ১৭ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে হাইল হাওরে গিয়ে মিশেছে। এর মধ্যে প্রায় চার কিলোমিটার পড়েছে শহরের অংশে। কোদালীছড়ার ভাটির দিকে (শহরের বাইরে) শুকনা মৌসুমে বোরো চাষে সেচের জন্য বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দেওয়া হয়ে থাকে। এই বাঁধ পরে অপসারণ করা হয় না।
অনেকে মাছ ধরতে কোদালীছড়ার নানা স্থানে ফাঁদ পেতে থাকেন। এসব কারণে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে। এ ছাড়া কোদালীছড়ার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের আজমেরুতে একটি জলকপাট (স্লুইসগেট) আছে। এই জলকপাটের মধ্যে কচুরিপানাসহ নানা রকম বর্জ্য আটকে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে।
মৌলভীবাজারের প্রশাসন জলাবদ্ধতা নিরসনে যথেষ্ট চেষ্টা করছে। কিন্তু বৃষ্টির মৌসুম শুরু হওয়ার আগে বাঁধগুলো অপসারণ না করলে এ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিবছর পরিকল্পনা করেই কয়েক মাস আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। এখানে পৌর কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনকে সমন্বয়ের সঙ্গে কাজ করতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
অনশনের পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পেলেন ছয় সমন্বয়ক
নিরাপত্তার অজুহাতে গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির ছয়জন সমন্বয়ককে। আটক থাকার এক পর্যায়ে তাঁরা অনশন শুরু করেন। ৩২ ঘণ্টা অনশনের পর ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) দুপুরে ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের দুটি গাড়িতে করে যাঁর যাঁর ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়।
সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে ছয় দিন; সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে পাঁচ দিন এবং নুসরাত তাবাসসুমকে চার দিন ডিবি কার্যালয়ে তখন আটক রাখা হয়েছিল। এই ছয় সমন্বয়কের মধ্যে নাহিদ এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক। আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। সারজিস, হাসনাত ও নুসরাত এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আবু বাকের এখন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক।
ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পাওয়ার সেই ঘটনা সম্পর্কে সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমার বোনের বাসার লোকেশন (ঠিকানা) দিয়েছিলাম ডিবিকে। ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) ডিবি তাদের তত্ত্বাবধানেই আমাদের ছয়জনকে যার যার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। বোনের বাসায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর আমি প্রথমে আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানিকনগরের একটা জায়গায় দেখা করি। আমরা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। কীভাবে এক দফার (সরকার পতনের) ঘোষণায় যাওয়া যায়, সে বিষয়েও সেদিন আমরা চিন্তা করি।’
সেদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচির আওতায় গণসংগীত, পথনাটক, দেয়াললিখন, স্মৃতিচারণা ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয় রাজধানী ঢাকাসহ অন্তত ১৬টি জেলা ও মহানগরে। এসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কিছু জায়গায় শিক্ষক ও আইনজীবীরা অংশ নেন। তবে কোথাও কোথাও কর্মসূচিতে বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। অনেক জায়গায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়।
প্রতিবাদ, বিক্ষোভসেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উদ্যোগে পৃথক সমাবেশ-মানববন্ধন ও মিছিল করা হয়। পাশাপাশি সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করে ছাত্র-জনতা।
‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের কঠোর দমনপ্রক্রিয়া ও গুলিতে ছাত্র-জনতা হত্যা’র প্রতিবাদে ১ আগস্ট বেলা ১১টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় সংসদের সামনে সমাবেশের কর্মসূচি ছিল শিল্পী ও কলাকুশলীদের। ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে তাঁরা প্রথমে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ–সংলগ্ন ইন্দিরা রোডের প্রান্তে সমবেত হন। সেদিন সকাল থেকেই প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিল্পীরা ব্যানার-পোস্টার নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন।
পরে শিল্পীরা ইন্দিরা রোড দিয়ে শোভাযাত্রা করে ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমা হলের কাছে সমবেত হন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই তাঁরা সেখানে সড়কের পাশে ব্যানার-পোস্টার নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীরা ছাত্র-জনতার হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, যে বর্বর পন্থায় শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে দমন করা হচ্ছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না।
দৃশ্যমাধ্যমের শিল্পীদের সমাবেশ থেকে সেদিন শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের বিচার, গণগ্রেপ্তার, মামলা ও হয়রানি বন্ধের দাবি করা হয়। সমাবেশ থেকে আরও জানানো হয়, শিল্পীরা তাঁদের প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন।
সেদিন বিকেলে ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ের সামনে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর ব্যানারে মানববন্ধন করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। মানববন্ধনে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, গুলি করে শিশুসহ নির্বিচার মানুষ হত্যার তদন্ত জাতিসংঘের অধীনে করতে হবে।
সেই মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল (এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) বলেন, হত্যার বিচার করতে হবে। হুকুমদাতাদেরও বিচার করতে হবে।
কূটনীতিকদের ‘ব্রিফ’জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করে ১ আগস্ট বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিন বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফ করা হয়। সেই ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকেরা সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি জানান।