গত এক দশকে চামড়াজাত পণ্যের দাম বাড়লেও কাঁচা চামড়ার দাম কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি গত অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি কাঁচা চামড়া ও ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানিরও অনুমতি দিয়েছে সরকার।

প্রত্যাশা ছিল, কাঁচা চামড়ার দাম আগের চেয়ে বেশি পাওয়া যাবে। কিন্তু গত কয়েক বছরের মতো এবারও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন।

প্রথম আলোর সংবাদ অনুসারে, এ বছর ঢাকায় বেশির ভাগ গরুর কাঁচা চামড়া ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। আর ছোট চামড়ার দাম উঠেছে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া ছাগলের চামড়া প্রতিটি বিক্রি হয়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা দরে। গত বছরও ঢাকায় গরু ও ছাগলের কাঁচা চামড়ার এ রকম দাম ছিল। (‘ঢাকায় সরকার নির্ধারিত দরে বিক্রি হচ্ছে না চামড়া, দাম ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা’, প্রথম আলো, ৭ জুন ২০২৫) ঢাকার বাইরে চামড়া আরও কম দামে বিক্রির খবর পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামে চামড়ার দাম না পাওয়ার কারণে িবপুলসংখ্যক চামড়া রাস্তায় ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। (চট্টগ্রামে চামড়া কেউ পুঁতে ফেললেন, কেউ রাস্তায় ফেলে গেছেন, প্রথম আলো, ৮ জুন ২০২৫)

অথচ সরকার ঢাকায় সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। আর ঢাকার বাইরের গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। এ ছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২২ থেকে ২৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ২০ থেকে ২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

বরাবরের মতো অন্তর্বর্তী সরকারও চামড়ার দাম নির্ধারণ করেই দায় সেরেছে। আড়তগুলোয় নির্ধারিত দরে চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে কি না, তার তদারকির কোনো ব্যবস্থা করেনি। যে কারণে বাজারে সরকারের বেঁধে দেওয়া দরের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।

কোরবানির মৌসুমে সারা বছরের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ হয়। কোরবানিদাতা ও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের পক্ষে বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করা কঠিন। চামড়ার বড় ব্যবসায়ী, আড়তদার ও ট্যানারিমালিকেরা এ সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে চামড়ার দাম কমিয়ে রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া চামড়া বিক্রির টাকা দরিদ্র ও এতিমদের দান করে দেওয়া হয় বলে এর দাম নিয়ে অনেকেরই মাথাব্যথা থাকে না। কাঁচা চামড়ার কম মূল্যের পেছনে আড়তদার ও ট্যানারিমালিকদের সিন্ডিকেট ছাড়াও আরও যে সমস্যাটি দায়ী, তা হলো চামড়াশিল্পের পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স সমস্যা। স্বাধীনতার এত বছর পরও দেশের চামড়াশিল্প পরিবেশ দূষণমুক্ত হতে না পারায় ইউরোপের লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পাচ্ছে না। এ কারণে প্রক্রিয়াজাত চামড়া ইউরোপের বদলে চীনের বাজারে কম দামে রপ্তানি করতে হচ্ছে। এভাবে প্রক্রিয়াজাত চামড়া পর্যাপ্ত রপ্তানি না হওয়া এবং রপ্তানিতে ভালো দাম না পাওয়ার কারণে কাঁচা চামড়ার মূল্য হ্রাস পাচ্ছে।

চামড়াশিল্পের দূষণের এই সমস্যা আজকের নয়। হাজারীবাগে থাকাকালে ট্যানারিগুলো বুড়িগঙ্গা দূষণ করত। বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করতে সাভারের হেমায়েতপুরে ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা হয় চামড়া শিল্পনগর, যার মধ্যে ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার বা সিইটিপি নির্মাণে। ২০১৭ সালে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সাভারের চামড়াশিল্প নগরে সরিয়ে নেওয়া হলেও চামড়াশিল্প দূষণমুক্ত হয়নি। কারণ, বিগত সরকারের আমলে বিপুল অর্থ ব্যয় করে নির্মিত সিইটিপি চামড়াশিল্পের সব ধরনের বর্জ্য পূর্ণমাত্রায় পরিশোধনে সক্ষম নয়।

কাগজে–কলমে সিইটিপির দৈনিক পরিশোধন ক্ষমতা ২৫ হাজার ঘনমিটার বলা হলেও প্রকৃত পরিশোধনের ক্ষমতা মাত্র ১৪ হাজার ঘনমিটার। অথচ পবিত্র ঈদুল আজহার–পরবর্তী তিন মাসে দৈনিক ৪০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপাদিত হয়। সিইটিপির সক্ষমতার অতিরিক্ত তরল বর্জ্য তখন পরিশোধন ছাড়াই নালার মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীতে নির্গমন করা হয়। কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ব্যবহৃত বিষাক্ত ভারী ধাতু ক্রোমিয়াম পরিশোধনের জন্য যে কমন ক্রোমিয়াম রিকভারি ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে, সেটাও কার্যকর নয়। এ ছাড়া উৎপাদিত কঠিন বর্জ্য সঠিকভাবে প্রক্রিয়াকরণ না করে খোলা জায়গায় ফেলা হয়।

তবে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সার্টিফিকেট না পাওয়ার ক্ষেত্রে সিইটিপি বা বিসিকের সক্ষমতার সমস্যা ছাড়াও ট্যানারিমালিকদেরও দায় রয়েছে। বিসিক ও বিডার গবেষণা অনুসারে, এলডব্লিউজি কর্তৃক চামড়াশিল্পের পরিবেশগত মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ১৭টি বিষয়ে ১ হাজার ৭১০ নম্বর রয়েছে, যার মধ্যে ৩০০ নম্বর কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা–সংক্রান্ত। বাকি ১ হাজার ৪১০ নম্বর রয়েছে জ্বালানি খরচ, পানির ব্যবহার, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা, চামড়ার উৎস শনাক্তকরণ, দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার মান ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়, যেগুলোর মানদণ্ড রক্ষা করা ট্যানারিমালিকদের দায়িত্ব।

দেশের চামড়াশিল্পের টেকসই বিকাশ না হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, শ্রমিকদের জন্য যথাযথ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারা। হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়াশিল্প স্থানান্তরে পরিবেশদূষণের সমস্যার মতো কর্মপরিবেশের সমস্যারও সমাধান হয়নি। পরিবেশদূষণের প্রভাব পড়ছে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, জীবনযাপন, আয় ও কর্মপরিবেশের ওপর। শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন সলিডারিটি সেন্টারের এক গবেষণা অনুসারে, পরিবেশগত দূষণের জন্য ৭০ ভাগের বেশি শ্রমিক নানা সমস্যায় ভোগেন।

ট্যানারিমালিকেরা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে নিজেদের আওতার মধ্যে থাকা পরিবেশ ও শ্রম অধিকারবিষয়ক কমপ্লায়েন্সগুলো রক্ষায় যথেষ্ট সচেতন হলে তা এলডব্লিউজির সার্টিফিকেট পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হতো। ট্যানারিগুলো নিজস্ব ইটিপি বসিয়েও পরিবেশসম্মতভাবে চামড়া উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে পারে।

বিগত সরকারের সময়ে পরিবেশকর্মীদের প্রতিবাদ ও আন্দোলন সত্ত্বেও চামড়াশিল্পের এসব সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে এসব বিষয়ে সোচ্চার একাধিক উপদেষ্টা রয়েছেন। আশা করা হয়েছিল, তাঁরা দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে, দীর্ঘদিনের সমস্যা রাতারাতি পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব না হলেও অন্তত সমাধানের পথরেখা তৈরি হবে, দূষণ কিছুটা হলেও কমবে। কিন্তু দশ মাসেও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি।

বাংলাদেশের চামড়ার গুণগত মান ভালো। এখানে শ্রম তুলনামূলক সস্তা। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের প্রধান কাঁচামাল তুলা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু চামড়াশিল্পের কাঁচামাল কাঁচা চামড়া দেশেই উৎপাদিত হয়। আমদানিনির্ভর পোশাক খাত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হয়েছে, ফলে বাংলাদেশ আজ পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ। অথচ রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও অদূরদর্শিতার কারণে দেশে উন্নত মানের কাঁচা চামড়ার বিপুল সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও চামড়াশিল্প বিকশিত হতে পারেনি।

এ কারণে এমন একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে একদিকে দেশে বিপুল পরিমাণ উন্নত মানের কাঁচা চামড়ার সরবরাহ রয়েছে, কিন্তু তার দাম পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে রপ্তানিমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পকারখানাগুলোকে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সনদপ্রাপ্ত ফিনিশড চামড়া আমদানি করতে হয়, যা কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। এভাবে দীর্ঘ মেয়াদে দেশীয় চামড়াশিল্পের যে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে, দরিদ্র মানুষকে চামড়ার দামে ঠকিয়ে তা পোষানো যাবে না। সরকার ও চামড়াশিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী ও ট্যানারিমালিকেরা যত দিন না তা উপলব্ধি করছেন, তত দিন চামড়াশিল্পের এই সমস্যার কোনো টেকসই সমাধান হবে না।

কল্লোল মোস্তফা লেখক ও বিশ্লেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রক র য় র সমস য সরক র র সমস য র ব যবস য় বর জ য স ইট প পর ব শ উৎপ দ ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

এবারও কেন চামড়ার ন্যায্য দাম মিলল না

গত এক দশকে চামড়াজাত পণ্যের দাম বাড়লেও কাঁচা চামড়ার দাম কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি গত অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি কাঁচা চামড়া ও ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানিরও অনুমতি দিয়েছে সরকার।

প্রত্যাশা ছিল, কাঁচা চামড়ার দাম আগের চেয়ে বেশি পাওয়া যাবে। কিন্তু গত কয়েক বছরের মতো এবারও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন।

প্রথম আলোর সংবাদ অনুসারে, এ বছর ঢাকায় বেশির ভাগ গরুর কাঁচা চামড়া ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। আর ছোট চামড়ার দাম উঠেছে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া ছাগলের চামড়া প্রতিটি বিক্রি হয়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা দরে। গত বছরও ঢাকায় গরু ও ছাগলের কাঁচা চামড়ার এ রকম দাম ছিল। (‘ঢাকায় সরকার নির্ধারিত দরে বিক্রি হচ্ছে না চামড়া, দাম ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা’, প্রথম আলো, ৭ জুন ২০২৫) ঢাকার বাইরে চামড়া আরও কম দামে বিক্রির খবর পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামে চামড়ার দাম না পাওয়ার কারণে িবপুলসংখ্যক চামড়া রাস্তায় ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। (চট্টগ্রামে চামড়া কেউ পুঁতে ফেললেন, কেউ রাস্তায় ফেলে গেছেন, প্রথম আলো, ৮ জুন ২০২৫)

অথচ সরকার ঢাকায় সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। আর ঢাকার বাইরের গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। এ ছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২২ থেকে ২৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ২০ থেকে ২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

বরাবরের মতো অন্তর্বর্তী সরকারও চামড়ার দাম নির্ধারণ করেই দায় সেরেছে। আড়তগুলোয় নির্ধারিত দরে চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে কি না, তার তদারকির কোনো ব্যবস্থা করেনি। যে কারণে বাজারে সরকারের বেঁধে দেওয়া দরের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।

কোরবানির মৌসুমে সারা বছরের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ হয়। কোরবানিদাতা ও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের পক্ষে বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করা কঠিন। চামড়ার বড় ব্যবসায়ী, আড়তদার ও ট্যানারিমালিকেরা এ সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে চামড়ার দাম কমিয়ে রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া চামড়া বিক্রির টাকা দরিদ্র ও এতিমদের দান করে দেওয়া হয় বলে এর দাম নিয়ে অনেকেরই মাথাব্যথা থাকে না। কাঁচা চামড়ার কম মূল্যের পেছনে আড়তদার ও ট্যানারিমালিকদের সিন্ডিকেট ছাড়াও আরও যে সমস্যাটি দায়ী, তা হলো চামড়াশিল্পের পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স সমস্যা। স্বাধীনতার এত বছর পরও দেশের চামড়াশিল্প পরিবেশ দূষণমুক্ত হতে না পারায় ইউরোপের লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পাচ্ছে না। এ কারণে প্রক্রিয়াজাত চামড়া ইউরোপের বদলে চীনের বাজারে কম দামে রপ্তানি করতে হচ্ছে। এভাবে প্রক্রিয়াজাত চামড়া পর্যাপ্ত রপ্তানি না হওয়া এবং রপ্তানিতে ভালো দাম না পাওয়ার কারণে কাঁচা চামড়ার মূল্য হ্রাস পাচ্ছে।

চামড়াশিল্পের দূষণের এই সমস্যা আজকের নয়। হাজারীবাগে থাকাকালে ট্যানারিগুলো বুড়িগঙ্গা দূষণ করত। বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করতে সাভারের হেমায়েতপুরে ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা হয় চামড়া শিল্পনগর, যার মধ্যে ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার বা সিইটিপি নির্মাণে। ২০১৭ সালে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সাভারের চামড়াশিল্প নগরে সরিয়ে নেওয়া হলেও চামড়াশিল্প দূষণমুক্ত হয়নি। কারণ, বিগত সরকারের আমলে বিপুল অর্থ ব্যয় করে নির্মিত সিইটিপি চামড়াশিল্পের সব ধরনের বর্জ্য পূর্ণমাত্রায় পরিশোধনে সক্ষম নয়।

কাগজে–কলমে সিইটিপির দৈনিক পরিশোধন ক্ষমতা ২৫ হাজার ঘনমিটার বলা হলেও প্রকৃত পরিশোধনের ক্ষমতা মাত্র ১৪ হাজার ঘনমিটার। অথচ পবিত্র ঈদুল আজহার–পরবর্তী তিন মাসে দৈনিক ৪০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপাদিত হয়। সিইটিপির সক্ষমতার অতিরিক্ত তরল বর্জ্য তখন পরিশোধন ছাড়াই নালার মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীতে নির্গমন করা হয়। কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ব্যবহৃত বিষাক্ত ভারী ধাতু ক্রোমিয়াম পরিশোধনের জন্য যে কমন ক্রোমিয়াম রিকভারি ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে, সেটাও কার্যকর নয়। এ ছাড়া উৎপাদিত কঠিন বর্জ্য সঠিকভাবে প্রক্রিয়াকরণ না করে খোলা জায়গায় ফেলা হয়।

তবে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সার্টিফিকেট না পাওয়ার ক্ষেত্রে সিইটিপি বা বিসিকের সক্ষমতার সমস্যা ছাড়াও ট্যানারিমালিকদেরও দায় রয়েছে। বিসিক ও বিডার গবেষণা অনুসারে, এলডব্লিউজি কর্তৃক চামড়াশিল্পের পরিবেশগত মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ১৭টি বিষয়ে ১ হাজার ৭১০ নম্বর রয়েছে, যার মধ্যে ৩০০ নম্বর কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা–সংক্রান্ত। বাকি ১ হাজার ৪১০ নম্বর রয়েছে জ্বালানি খরচ, পানির ব্যবহার, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা, চামড়ার উৎস শনাক্তকরণ, দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার মান ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়, যেগুলোর মানদণ্ড রক্ষা করা ট্যানারিমালিকদের দায়িত্ব।

দেশের চামড়াশিল্পের টেকসই বিকাশ না হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, শ্রমিকদের জন্য যথাযথ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারা। হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়াশিল্প স্থানান্তরে পরিবেশদূষণের সমস্যার মতো কর্মপরিবেশের সমস্যারও সমাধান হয়নি। পরিবেশদূষণের প্রভাব পড়ছে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, জীবনযাপন, আয় ও কর্মপরিবেশের ওপর। শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন সলিডারিটি সেন্টারের এক গবেষণা অনুসারে, পরিবেশগত দূষণের জন্য ৭০ ভাগের বেশি শ্রমিক নানা সমস্যায় ভোগেন।

ট্যানারিমালিকেরা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে নিজেদের আওতার মধ্যে থাকা পরিবেশ ও শ্রম অধিকারবিষয়ক কমপ্লায়েন্সগুলো রক্ষায় যথেষ্ট সচেতন হলে তা এলডব্লিউজির সার্টিফিকেট পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হতো। ট্যানারিগুলো নিজস্ব ইটিপি বসিয়েও পরিবেশসম্মতভাবে চামড়া উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে পারে।

বিগত সরকারের সময়ে পরিবেশকর্মীদের প্রতিবাদ ও আন্দোলন সত্ত্বেও চামড়াশিল্পের এসব সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে এসব বিষয়ে সোচ্চার একাধিক উপদেষ্টা রয়েছেন। আশা করা হয়েছিল, তাঁরা দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে, দীর্ঘদিনের সমস্যা রাতারাতি পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব না হলেও অন্তত সমাধানের পথরেখা তৈরি হবে, দূষণ কিছুটা হলেও কমবে। কিন্তু দশ মাসেও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি।

বাংলাদেশের চামড়ার গুণগত মান ভালো। এখানে শ্রম তুলনামূলক সস্তা। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের প্রধান কাঁচামাল তুলা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু চামড়াশিল্পের কাঁচামাল কাঁচা চামড়া দেশেই উৎপাদিত হয়। আমদানিনির্ভর পোশাক খাত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হয়েছে, ফলে বাংলাদেশ আজ পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ। অথচ রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও অদূরদর্শিতার কারণে দেশে উন্নত মানের কাঁচা চামড়ার বিপুল সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও চামড়াশিল্প বিকশিত হতে পারেনি।

এ কারণে এমন একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে একদিকে দেশে বিপুল পরিমাণ উন্নত মানের কাঁচা চামড়ার সরবরাহ রয়েছে, কিন্তু তার দাম পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে রপ্তানিমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পকারখানাগুলোকে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সনদপ্রাপ্ত ফিনিশড চামড়া আমদানি করতে হয়, যা কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। এভাবে দীর্ঘ মেয়াদে দেশীয় চামড়াশিল্পের যে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে, দরিদ্র মানুষকে চামড়ার দামে ঠকিয়ে তা পোষানো যাবে না। সরকার ও চামড়াশিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী ও ট্যানারিমালিকেরা যত দিন না তা উপলব্ধি করছেন, তত দিন চামড়াশিল্পের এই সমস্যার কোনো টেকসই সমাধান হবে না।

কল্লোল মোস্তফা লেখক ও বিশ্লেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ