এবারও কেন চামড়ার ন্যায্য দাম মিলল না
Published: 9th, June 2025 GMT
গত এক দশকে চামড়াজাত পণ্যের দাম বাড়লেও কাঁচা চামড়ার দাম কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি গত অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি কাঁচা চামড়া ও ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানিরও অনুমতি দিয়েছে সরকার।
প্রত্যাশা ছিল, কাঁচা চামড়ার দাম আগের চেয়ে বেশি পাওয়া যাবে। কিন্তু গত কয়েক বছরের মতো এবারও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন।
প্রথম আলোর সংবাদ অনুসারে, এ বছর ঢাকায় বেশির ভাগ গরুর কাঁচা চামড়া ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। আর ছোট চামড়ার দাম উঠেছে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া ছাগলের চামড়া প্রতিটি বিক্রি হয়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা দরে। গত বছরও ঢাকায় গরু ও ছাগলের কাঁচা চামড়ার এ রকম দাম ছিল। (‘ঢাকায় সরকার নির্ধারিত দরে বিক্রি হচ্ছে না চামড়া, দাম ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা’, প্রথম আলো, ৭ জুন ২০২৫) ঢাকার বাইরে চামড়া আরও কম দামে বিক্রির খবর পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামে চামড়ার দাম না পাওয়ার কারণে িবপুলসংখ্যক চামড়া রাস্তায় ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। (চট্টগ্রামে চামড়া কেউ পুঁতে ফেললেন, কেউ রাস্তায় ফেলে গেছেন, প্রথম আলো, ৮ জুন ২০২৫)
অথচ সরকার ঢাকায় সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। আর ঢাকার বাইরের গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। এ ছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২২ থেকে ২৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ২০ থেকে ২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
বরাবরের মতো অন্তর্বর্তী সরকারও চামড়ার দাম নির্ধারণ করেই দায় সেরেছে। আড়তগুলোয় নির্ধারিত দরে চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে কি না, তার তদারকির কোনো ব্যবস্থা করেনি। যে কারণে বাজারে সরকারের বেঁধে দেওয়া দরের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।
কোরবানির মৌসুমে সারা বছরের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ হয়। কোরবানিদাতা ও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের পক্ষে বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করা কঠিন। চামড়ার বড় ব্যবসায়ী, আড়তদার ও ট্যানারিমালিকেরা এ সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে চামড়ার দাম কমিয়ে রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া চামড়া বিক্রির টাকা দরিদ্র ও এতিমদের দান করে দেওয়া হয় বলে এর দাম নিয়ে অনেকেরই মাথাব্যথা থাকে না। কাঁচা চামড়ার কম মূল্যের পেছনে আড়তদার ও ট্যানারিমালিকদের সিন্ডিকেট ছাড়াও আরও যে সমস্যাটি দায়ী, তা হলো চামড়াশিল্পের পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স সমস্যা। স্বাধীনতার এত বছর পরও দেশের চামড়াশিল্প পরিবেশ দূষণমুক্ত হতে না পারায় ইউরোপের লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পাচ্ছে না। এ কারণে প্রক্রিয়াজাত চামড়া ইউরোপের বদলে চীনের বাজারে কম দামে রপ্তানি করতে হচ্ছে। এভাবে প্রক্রিয়াজাত চামড়া পর্যাপ্ত রপ্তানি না হওয়া এবং রপ্তানিতে ভালো দাম না পাওয়ার কারণে কাঁচা চামড়ার মূল্য হ্রাস পাচ্ছে।
চামড়াশিল্পের দূষণের এই সমস্যা আজকের নয়। হাজারীবাগে থাকাকালে ট্যানারিগুলো বুড়িগঙ্গা দূষণ করত। বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করতে সাভারের হেমায়েতপুরে ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা হয় চামড়া শিল্পনগর, যার মধ্যে ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার বা সিইটিপি নির্মাণে। ২০১৭ সালে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সাভারের চামড়াশিল্প নগরে সরিয়ে নেওয়া হলেও চামড়াশিল্প দূষণমুক্ত হয়নি। কারণ, বিগত সরকারের আমলে বিপুল অর্থ ব্যয় করে নির্মিত সিইটিপি চামড়াশিল্পের সব ধরনের বর্জ্য পূর্ণমাত্রায় পরিশোধনে সক্ষম নয়।
কাগজে–কলমে সিইটিপির দৈনিক পরিশোধন ক্ষমতা ২৫ হাজার ঘনমিটার বলা হলেও প্রকৃত পরিশোধনের ক্ষমতা মাত্র ১৪ হাজার ঘনমিটার। অথচ পবিত্র ঈদুল আজহার–পরবর্তী তিন মাসে দৈনিক ৪০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপাদিত হয়। সিইটিপির সক্ষমতার অতিরিক্ত তরল বর্জ্য তখন পরিশোধন ছাড়াই নালার মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীতে নির্গমন করা হয়। কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ব্যবহৃত বিষাক্ত ভারী ধাতু ক্রোমিয়াম পরিশোধনের জন্য যে কমন ক্রোমিয়াম রিকভারি ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে, সেটাও কার্যকর নয়। এ ছাড়া উৎপাদিত কঠিন বর্জ্য সঠিকভাবে প্রক্রিয়াকরণ না করে খোলা জায়গায় ফেলা হয়।
তবে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সার্টিফিকেট না পাওয়ার ক্ষেত্রে সিইটিপি বা বিসিকের সক্ষমতার সমস্যা ছাড়াও ট্যানারিমালিকদেরও দায় রয়েছে। বিসিক ও বিডার গবেষণা অনুসারে, এলডব্লিউজি কর্তৃক চামড়াশিল্পের পরিবেশগত মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ১৭টি বিষয়ে ১ হাজার ৭১০ নম্বর রয়েছে, যার মধ্যে ৩০০ নম্বর কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা–সংক্রান্ত। বাকি ১ হাজার ৪১০ নম্বর রয়েছে জ্বালানি খরচ, পানির ব্যবহার, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা, চামড়ার উৎস শনাক্তকরণ, দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার মান ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়, যেগুলোর মানদণ্ড রক্ষা করা ট্যানারিমালিকদের দায়িত্ব।
দেশের চামড়াশিল্পের টেকসই বিকাশ না হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, শ্রমিকদের জন্য যথাযথ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারা। হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়াশিল্প স্থানান্তরে পরিবেশদূষণের সমস্যার মতো কর্মপরিবেশের সমস্যারও সমাধান হয়নি। পরিবেশদূষণের প্রভাব পড়ছে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, জীবনযাপন, আয় ও কর্মপরিবেশের ওপর। শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন সলিডারিটি সেন্টারের এক গবেষণা অনুসারে, পরিবেশগত দূষণের জন্য ৭০ ভাগের বেশি শ্রমিক নানা সমস্যায় ভোগেন।
ট্যানারিমালিকেরা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে নিজেদের আওতার মধ্যে থাকা পরিবেশ ও শ্রম অধিকারবিষয়ক কমপ্লায়েন্সগুলো রক্ষায় যথেষ্ট সচেতন হলে তা এলডব্লিউজির সার্টিফিকেট পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হতো। ট্যানারিগুলো নিজস্ব ইটিপি বসিয়েও পরিবেশসম্মতভাবে চামড়া উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে পারে।
বিগত সরকারের সময়ে পরিবেশকর্মীদের প্রতিবাদ ও আন্দোলন সত্ত্বেও চামড়াশিল্পের এসব সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে এসব বিষয়ে সোচ্চার একাধিক উপদেষ্টা রয়েছেন। আশা করা হয়েছিল, তাঁরা দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে, দীর্ঘদিনের সমস্যা রাতারাতি পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব না হলেও অন্তত সমাধানের পথরেখা তৈরি হবে, দূষণ কিছুটা হলেও কমবে। কিন্তু দশ মাসেও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বাংলাদেশের চামড়ার গুণগত মান ভালো। এখানে শ্রম তুলনামূলক সস্তা। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের প্রধান কাঁচামাল তুলা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু চামড়াশিল্পের কাঁচামাল কাঁচা চামড়া দেশেই উৎপাদিত হয়। আমদানিনির্ভর পোশাক খাত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হয়েছে, ফলে বাংলাদেশ আজ পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ। অথচ রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও অদূরদর্শিতার কারণে দেশে উন্নত মানের কাঁচা চামড়ার বিপুল সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও চামড়াশিল্প বিকশিত হতে পারেনি।
এ কারণে এমন একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে একদিকে দেশে বিপুল পরিমাণ উন্নত মানের কাঁচা চামড়ার সরবরাহ রয়েছে, কিন্তু তার দাম পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে রপ্তানিমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পকারখানাগুলোকে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সনদপ্রাপ্ত ফিনিশড চামড়া আমদানি করতে হয়, যা কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। এভাবে দীর্ঘ মেয়াদে দেশীয় চামড়াশিল্পের যে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে, দরিদ্র মানুষকে চামড়ার দামে ঠকিয়ে তা পোষানো যাবে না। সরকার ও চামড়াশিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী ও ট্যানারিমালিকেরা যত দিন না তা উপলব্ধি করছেন, তত দিন চামড়াশিল্পের এই সমস্যার কোনো টেকসই সমাধান হবে না।
কল্লোল মোস্তফা লেখক ও বিশ্লেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রক র য় র সমস য সরক র র সমস য র ব যবস য় বর জ য স ইট প পর ব শ উৎপ দ ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপির নির্বাচনী যাত্রা শুরু
সব জল্পনার অবসান হলো—বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন করছেন। তিনি ফেনী-১, বগুড়া-৭ ও দিনাজপুর-৩ আসনে প্রার্থী হবেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সোমবার বিএনপি ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। তাতে দলের দুই শীর্ষ নেতার নির্বাচন করা এবং তাঁদের নির্বাচনী আসনগুলো নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁও-১ আসনে নির্বাচন করবেন।
তারেক রহমান বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন, অনেক আগে থেকেই এমন আলোচনা আছে। তবে অসুস্থতার কারণে এবার খালেদা জিয়ার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংশয় ছিল। আবার তাঁর নিজেরও নির্বাচন করার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না।
দলীয় সূত্র বলছে, নির্বাচন ঘিরে নানামুখী শঙ্কা, বিশেষ করে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে নেতৃত্ব দিতে রাজি করানো হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রার্থী হওয়ার ঘোষণায় নেতা-কর্মীরা আনন্দিত।
স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, নানা কারণে আসন্ন নির্বাচন বিএনপির জন্য খুব স্বস্তিদায়ক না-ও হতে পারে। খালেদা জিয়াকে নির্বাচন করতে রাজি করানোর মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে নির্বাচনের গুরুত্বটা আরও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে নতুন কোনো জটিলতার উদ্ভব হলে, সেটা মোকাবিলায়ও তাঁর ভোটে অংশগ্রহণ পরিস্থিতির ওপর একটা প্রভাব ফেলবে।
জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে সোমবার ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। বাকি ৬৩টি আসনে প্রার্থিতা পরে ঘোষণা করা হবে।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, স্থগিত রাখা কিছু আসনে প্রার্থিতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যা আছে। আর কিছু আসন জোট ও সমমনা দলগুলোর প্রার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে, যাদের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে।
ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী, বিএনপির চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির ১২ জন সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। অন্যরা হলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন (কুমিল্লা-১), মির্জা আব্বাস উদ্দিন আহমেদ (ঢাকা-৮), গয়েশ্বর চন্দ্র রায় (ঢাকা-৩), আবদুল মঈন খান (নরসিংদী-২), আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১০), ইকবাল হাসান মাহমুদ (সিরাজগঞ্জ-২), সালাহউদ্দিন আহমদ (কক্সবাজার-১), হাফিজ উদ্দিন আহমদ (ভোলা-৩) এবং এ জেড এম জাহিদ হোসেন (দিনাজপুর-১)।
স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। তবে তিনি বলেছেন, এটি প্রাথমিক তালিকা। প্রয়োজন বোধ করলে স্থায়ী কমিটি প্রার্থিতা পরিবর্তন করতে পারবে।
সোমবার বিকেল পাঁচটার দিকে প্রার্থী ঘোষণার আগে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি সভা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী সভা হয়। সেখানে জুলাই সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়েও আলোচনা হয়। পরে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকেরাও উপস্থিত ছিলেন।
এবারের প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। তাঁকে ফেনী-৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রথম আলোকে বলেন, ‘জীবনে প্রথম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছি। দল আমার ওপর আস্থা রেখেছে, সে আস্থা রাখার জন্য ধন্যবাদ। আমি আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সঙ্গে দেখা করব, সালাম জানাব।’
যে কারণে ঢাকার সাতটি আসন ফাঁকাঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে ১৩টিতে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সাতটি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে। নেতা-কর্মীরা বলছেন, ঢাকায় প্রার্থিতা নিয়ে মারাত্মক পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই। তাঁদের ধারণা, নির্বাচনী সমঝোতার জন্য আসনগুলোতে প্রার্থিতা স্থগিত রাখা হয়েছে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সাতটি আসনের মধ্যে জাতীয় নাগরিক পাটির (এনসিপি) সঙ্গে সমঝোতা হলে তাদের জন্য অন্তত তিনটি আসন ছাড় দেওয়া হতে পারে। এ তালিকায় গণতন্ত্র মঞ্চ, বিজেপি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নামও আছে।
তবে এনসিপির নেতারা যেসব আসনে নির্বাচন করতে চান বলে আলোচনা আছে, সে আসনগুলোর একটি (ঢাকা-৯) ছাড়া বাকিগুলোতে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম (ঢাকা-১১), সদস্যসচিব আখতার হোসেন (রংপুর-৪), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা (ঢাকা-৯), দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (কুমিল্লা-৪), উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (পঞ্চগড়-১) ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের (নোয়াখালী-৬) স্ব স্ব আসনে তাঁদের কমবেশি তৎপরতা আছে।
ঢাকা-৯ আসন স্থগিত রাখা হলেও সেটা কার জন্য, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সেখানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবীব উন নবী খানকে (সোহেল) প্রার্থী করা হতে পারে বলে দলে আলোচনা আছে।
ঢাকা-১৪: মায়ের ডাক-এর সানজিদাঢাকা-১৪ আসনে এবার প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়লেন এস এ খালেকের ছেলে এস এ সিদ্দিক (সাজু)। সেখানে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের ব্যক্তিদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সংগঠক সানজিদা ইসলামকে (তুলি) প্রার্থী মনোনীত করেছে বিএনপি। এই আসনে ইতিমধ্যে জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের শিকার মীর আহমদ বিন কাসেমকে (আরমান)। তিনি আট বছর গুম ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পান।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে দলটি অভ্যন্তরীণ জরিপসহ সাংগঠনিক উপায়ে প্রার্থী বাছাই সম্পন্ন করেছে। সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের নাম প্রকাশ করে নির্বাচনের পথে যাত্রা শুরু করল বিএনপি।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বিগত ১৫-২০ বছর ভোট দিতে পারেনি। এখন জাতি উৎসাহিত হচ্ছে ভোটের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। তিনি বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটি পূরণ করার লক্ষ্যে বিএনপি প্রার্থী মনোনয়ন ঘোষণা করে একটা বড় পদক্ষেপ নিল। ইতিমধ্যে অনেকে মাঠে চলে গেছেন, এ ঘোষণার পর বাকিরাও মাঠে যাবেন। এর মাধ্যমে ভোটের একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হবে।
১০ নারী প্রার্থীঘোষিত ২৩৭ আসনের প্রার্থী তালিকায় নারী রয়েছেন দশজন। এর মধ্যে অন্যতম বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বাকিরা হলেন সিলেট-২ আসনে তাহসিনা রুশদীর, ফরিদপুর-২ আসনে শামা ওবায়েদ ইসলাম, ফরিদপুর-৩ আসনে নায়াব ইউসুফ আহমেদ, মানিকগঞ্জ-৩ আসনে আফরোজা খান রিতা, শেরপুর-১ আসনে সানসিলা জেবরিন, ঝালকাঠি-২ আসনে ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো, যশোর–২ আসনে সাবিরা সুলতানা, ঢাকা-১৪ আসনে সানজিদা ইসলাম ও নাটোর-১ আসনে ফারজানা শারমিন।
মনোনয়ন না পেয়ে দুই মহাসড়ক অবরোধমাদারীপুর-১ আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করে কামাল জামান মোল্লাকে। এর প্রতিবাদে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী সাজ্জাদ হোসেন লাভলু সিদ্দিকীর অনুসারীরা রাত আটটার দিকে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন।
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তাঁর অনুসারীরা সন্ধ্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।