নির্বাচনের সবচেয়ে যৌক্তিক মাসটি ফেব্রুয়ারি
Published: 12th, June 2025 GMT
এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুন, কখন হবে জাতীয় নির্বাচন—এই আলোচনা ও বিভ্রান্তির আপাত অবসান ঘটিয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস। তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে।
এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়া হয়েছে মিশ্র। তবে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনের এ সময় মেনে নেয়নি। আবার অধ্যাপক ইউনূস এপ্রিলের সময়সীমাতেই অনড় থাকবেন—এমন ধারণার মধ্যেই তাঁর সঙ্গে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক বা সাক্ষাৎকে অনেকেই নতুন আশাবাদ হিসেবে বিবেচনা করছেন।
বিএনপি কেন নির্বাচনের সময় হিসেবে এপ্রিলকে গ্রহণ করছে না, তার ব্যাখ্যা দলটি দিয়েছে। বিএনপি মনে করে, এ সময়ের আবহাওয়া নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত নয়। তা ছাড়া রোজার মাসে নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা ও রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা নিয়েও তাদের সংশয় ও আপত্তি আছে। তাদের মনে শঙ্কা, সবকিছু মিলিয়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, যা নির্বাচনকে আরও পিছিয়ে দেওয়ার পথ তৈরি করে দিতে পারে।
আরও পড়ুননির্বাচন যতটা সম্ভব এগিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে১২ ঘণ্টা আগেসাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনের সময় নিয়ে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের মধ্যে এমন শঙ্কাজনক প্রশ্নও অনেকের মধ্যে আছে যে আদৌ নির্বাচন হবে তো? বিএনপির নেতারাও অব্যাহতভাবে তাঁদের দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করে আসছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি বলেছেন, ‘সংস্কার নিয়ে সময়ক্ষেপণের আড়ালে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে ও বাইরে কারও কারও মনে হয় ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।’ তারেক রহমানের ইঙ্গিতটি স্পষ্ট।
দেশের সংকটময় বা বিশেষ পরিস্থিতি উগ্র ও হঠকারী রাজনৈতিক শক্তিকে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ করে দেয়। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এমন অনেক শক্তি তৎপর হওয়ার অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে। নানা ধরনের উগ্রবাদ, নৈরাজ্যবাদ বা হঠকারিতা, যা-ই বলা হোক—এগুলো রাজনীতিরই বিশেষ বিশেষ পথ।
আমাদের দেশের রাজনীতির ইতিহাসে সংকটময় পরিস্থিতিতে এমন শক্তি বিভিন্ন সময় তৎপর হওয়ার চেষ্টা করেছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতেও এ ধরনের শক্তি বা গোষ্ঠীর তৎপরতার কথা শোনা যায়। রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে এসব গোষ্ঠীর প্রভাব ও তৎপরতা নিয়ে অনেকের মধ্যে উদ্বেগ ও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুন নির্বাচন এপ্রিলে কি আসলেই হবে১১ জুন ২০২৫মাঝে দেশের রাজনীতি বেশ অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়ে যমুনা ঘেরাও, নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা, মিয়ানমারের করিডর ও চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল বিদেশিদের ইজারা দেওয়া নিয়ে সেনাপ্রধানের অবস্থান, ইশরাক ইস্যুতে বিএনপি ও এনসিপির শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা এবং কয়েকজন উপদেষ্টার পাল্টাপাল্টি পদত্যাগ দাবি ও এসব নিয়ে বিরক্ত অধ্যাপক ইউনূসের ‘পদত্যাগ ভাবনা’ দেশকে সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছিল।
এমন একটি জটিল পরিস্থিতিতে সংকট সমাধানের পথ হিসেবে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জোরালো হতে শুরু করে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত বলে সেনাবাহিনী প্রধান তাঁর মত দিয়েছেন। বিএনপিও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে তাদের অবস্থান জোরদার করতে শুরু করে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পরিষ্কার করে বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। এ বাস্তবতায় অধ্যাপক ইউনূসের এপ্রিলের প্রথম ভাগে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা ‘ডিসেম্বর-জুন’ বিভ্রান্তির অবসান ঘটিয়েছে ঠিকই কিন্তু সংকট কতটা কাটল, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
আরও পড়ুনজনগণের স্বার্থেই শীত মৌসুমে নির্বাচন হওয়া উচিত১১ জুন ২০২৫এপ্রিলে নির্বাচন নিয়ে বিএনপি তাদের নেতিবাচক অবস্থানের কথা জানিয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস ঘোষিত ডিসেম্বর-জুন সময়সীমার মধ্যে ডিসেম্বরে না হলেও অধিকাংশ দলেরই সাধারণ চাওয়া ছিল রোজার আগে নির্বাচন। এর কিছু বাস্তব কারণ রয়েছে। আর বর্তমানে এপ্রিলের প্রথম ভাগে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তার অনেক সমস্যার দিকও স্পষ্ট।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝির পর আনুমানিক ১৭ তারিখ থেকে (চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল) রোজা শুরু হওয়ার কথা। সেই হিসাবে ঈদ হবে মার্চের ১৯-২০ তারিখের দিকে। ছুটিছাটা মিলিয়ে চলে যাবে আরও কয়েক দিন। এপ্রিলের প্রথম ভাগে নির্বাচন হলে হাতে সময় পাওয়া যাবে সর্বোচ্চ দিন বিশেক। রোজার মাস ও ঈদের সময়টা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার জন্য খুব সুবিধাজনক কিছু নয়। আবার ৯ এপ্রিল থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা, মার্চের মাঝামাঝি থেকে গরম বাড়তে শুরু করে এবং এপ্রিলে তা বেশ চরমে পৌঁছে। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, ২০০৮ সালের পর দেশে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গিয়েছে নির্বাচন নামের ‘উৎসব’। শীত থাকতে থাকতে নির্বাচন আয়োজন করা গেলে তা সত্যিকার উৎসবে রূপ পেতে পারে। এসব বিবেচনায় রোজার আগে নির্বাচন অনুষ্ঠানই সবচেয়ে সুবিধাজনক।
সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম ভাগ সময়টিকেই সবচেয়ে যৌক্তিক বলে মনে হয়। এ রকম একটি সময় নির্ধারিত হলে বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল তা মেনে নেবে বলে আমরা ধারণা করি। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের রাজনীতিতে একটি সামগ্রিক সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। রোজার আগে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ সেই সমঝোতার পথ তৈরি করতে পারে।বাংলাদেশের একটা বড় জনগোষ্ঠী প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং এর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসেরও চাওয়া যত বেশি সম্ভব তরুণ ভোটারদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া। এবারের গণ-অভ্যুত্থানের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে ছাত্র ও তরুণেরা। নতুন ও তরুণদের ভোটার তালিকায় যুক্ত করার বিষয়টি গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
রোজার আগে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনটি হলেও নতুন ভোটারদের ভোটার তালিকায় যুক্ত করতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ভোটার তালিকা আইন ২০০৯ অনুয়ায়ী, কম্পিউটার ডেটাবেজ সংরক্ষিত বিদ্যমান সব ভোটার তালিকা প্রতিবছর ২ জানুয়ারি হতে ২ মার্চের মধ্যে হালনাগাদ করা যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২ জানুয়ারির পর স্বল্পতম সময়ের মধ্যে (সপ্তাহখানেক) নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা সম্ভব। তা ছাড়া এ জন্য যদি আইনের সংশোধন বা অধ্যাদেশ জারি করতেও হয়, তা সহজেই করা যাবে।
সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম ভাগ সময়টিকেই সবচেয়ে যৌক্তিক বলে মনে হয়। এ রকম একটি সময় নির্ধারিত হলে বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল তা মেনে নেবে বলে আমরা ধারণা করি। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের রাজনীতিতে একটি সামগ্রিক সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। রোজার আগে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ সেই সমঝোতার পথ তৈরি করতে পারে।
একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিল যখনই নির্বাচন হোক, নির্বাচনের আগে গণ-অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হলে গণ-অভ্যুত্থান, এর মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এবং ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারের নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
এপ্রিল থেকে এগিয়ে নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে আনতে হলে জুলাই চার্টারসহ এসব ইস্যুতে সমঝোতা ও ঐকমত্যে আসার কাজটিও দ্রুত সারতে হবে। সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাবিত মূল ইস্যুগুলোতেও রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে আসতে হবে। এসব ক্ষেত্রে বিএনপির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জনমনে বিএনপি সম্পর্কে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে দলটি সংস্কারে আগ্রহী নয়। বিএনপিকে তাই এ ক্ষেত্রে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনায় নিয়ে যৌক্তিক ও বাস্তব অবস্থান নিতে হবে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হবে—শুধু এই বিবেচনা মাথায় রেখে বিএনপি যদি সংস্কার প্রশ্নে পরবর্তী শাসক দল হিসেবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার অবস্থানে অটল থাকে, তবে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক।
গণ-অভ্যুত্থান মৌলিক কিছু পরিবর্তনের যে সুযোগ তৈরি করেছে, বিএনপিকে তার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক আসন বা প্রধানমন্ত্রী পদে দুই মেয়াদের বেশি নয়—এমন ইস্যুতে বিএনপির নেতিবাচক অবস্থান ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিকেই তুলে ধরে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে আজ লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে এসব বিষয়ে সমঝোতা হোক, বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ার সুযোগ তৈরি হোক সেটাই প্রত্যাশা করি।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ শ র র জন ত র প রথম ভ গ ত র ক রহম ন পর স থ ত র জ র আগ ড স ম বর অবস থ ন ব এনপ র সমঝ ত র ঐকমত য র জন য ন র জন র সময় আরও প সরক র র অবস সবচ য় হওয় র
এছাড়াও পড়ুন:
বাবা দিবসের গানের মডেল আবুল হায়াত ও রিচি
বাবা দিবসের বিশেষ গানচিত্রে হাজির হচ্ছেন বরেণ্য অভিনেতা আবুল হায়াত ও তারকা অভিনেত্রী রিচি সোলায়মান। এমন কাজে দু’জনে এবারই প্রথম একসঙ্গে। দুই গুণীকে এক করে গানচিত্রটি নির্মাণ করেছেন চয়নিকা চৌধুরী।
‘বাবা শুনতে কি পাও’ শিরোনামের এই গানটি তৈরি করেছেন প্রান্তিক সুর। আর তাতে কণ্ঠ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী গজল ঘরানার শিল্পী শিরিন চৌধুরী। গানটির কথাও লিখেছেন শিল্পী নিজেই। গানের কথার সূত্র ধরে গল্পনির্ভর ভিডিওটিতে আবুল হায়াত অভিনয় করেছেন বাবার চরিত্রে। আর রিচিকে দেখা যাবে মেয়ের চরিত্রে। এতে আরও একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন হুমায়ুন চৌধুরী।
এতে অভিনয় প্রসঙ্গে আবুল হায়াত বলেন, ‘সাধারণত গানচিত্রে কমই কাজ করেছি। এটি বাবা দিবসের কাজ। এ কারণে এতে অভিনয়ে আগ্রহী হয়েছি। গানটিতে বক্তব্য আছে। সহশিল্পী রিচির পারফরম্যান্সও অসাধারণ ছিল। আশা করছি, গানটি দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে।’
চয়নিকা চৌধুরী বলেন, ‘গানটির যখন শুটিংয়ের পরিকল্পনা করি তখন হায়াত আংকেল [আবুল হায়াত] খানিকটা অসুস্থ ছিলেন। তবুও আমার অনুরোধে এবং গানের গল্প শুনে তিনি সময় দিয়েছেন আমাকে। রিচিও বেশ আগ্রহ নিয়ে কাজটি করেছে। গানচিত্রে একটি সুন্দর সামাজিক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিয়ের পর একটা মেয়ের স্বপ্ন যেন মরে না যায়– এবং শুধু মানুষটাকে নয়, তার স্বপ্নকেও ভালোবাসার সংবেদনশীল এবং হৃদয়স্পর্শী বাবার অনুরোধের বার্তা থাকছে এতে। আমার বিশ্বাস এই গানের গল্প দর্শকদের কাঁদাবে, ভাবাবে।’
গানটি প্রকাশ পাবে এবারের বাবা দিবসে ১৫ জুন সিংগিস্টিক-এর ব্যানারে প্রতিষ্ঠানটির ইউটিউব চ্যানেলে।