আধুনিক প্রযুক্তির যুগে স্ক্রিন টাইম আমাদের জীবনেরই অংশ হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তি এবং কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণার একটি সাধারণ পদ্ধতি হলো জনসংখ্যাগত গবেষণা। ২০১৯ থেকে ’২১ সালের মধ্যে প্রকাশিত ২৫টি পর্যালোচনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেশির ভাগ গবেষণায় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার এবং কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে দুর্বল বা অস্থিতিশীল সম্পর্ক পাওয়া গেছে, যদিও কিছু গবেষণায় এই সম্পর্ককে যথেষ্ট এবং ক্ষতিকর হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নির্ধারণ করা কখনোই শেষ হওয়া উচিত নয়। যেসব স্কুল এখন ফোন নিষিদ্ধ করছে, সেগুলো একটি প্রাকৃতিক পরীক্ষা হতে পারে, যা দেখবে এই নিষেধাজ্ঞা শিক্ষার ফলাফল এবং মানসিক স্বাস্থ্যে কী প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, ইংল্যান্ডের ৩০টি মাধ্যমিক স্কুলের একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে, সীমাবদ্ধ ফোন-নীতি ফোন ব্যবহারের পরিমাণ কমানো বা মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে কোনো প্রভাব ফেলেনি।

বর্তমানে, স্ক্রিন তরুণদের জীবনে এত গভীরভাবে প্রোথিত, কিশোর-কিশোরীদের সম্পূর্ণ  স্ক্রিন-ফ্রি জীবন কাটানো সম্ভব নয়। তবে বিজ্ঞানীরা ছোট আকারে কার্যকর কিছু পদ্ধতি পরীক্ষা করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ তারা কিছু এলোমেলোভাবে নির্বাচিত পরিবারকে অনুরোধ করতে পারেন, যেন তারা তাদের কিশোর-কিশোরীর ফোন রাতে শোবার ঘরে না রাখে। বয়ঃসন্ধিকালে দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্য ঘুম, শারীরিক কার্যকলাপ এবং পড়াশোনার পারফরম্যান্সকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে এবং কেউ কেউ মোবাইল ফোনের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য দায়ী করেন।
স্ক্রিন টাইমের সবচেয়ে গভীর প্রভাব পড়ছে মানসিক সুস্থতার ওপর। সামাজিক মাধ্যমের ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’ এবং ‘ভাইরাল’ হওয়ার প্রতিযোগিতা তরুণদের মধ্যে উদ্বেগ, আত্মসম্মানবোধের সংকট ও ডিপ্রেশন তৈরি করছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে ৫ ঘণ্টার বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৩৪% হতাশা বা মানসিক চাপের লক্ষণ রয়েছে। এ ছাড়া গেমিং বা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের প্রতি আসক্তি পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও একাকিত্বকে তীব্র করছে। স্ক্রিন টাইমের প্রভাবে শারীরিক স্বাস্থ্যও ঝুঁকিতে। বাচ্চাদের খেলাধুলা বা বাইরের কার্যক্রম কমে যাওয়ায় স্থূলতা ও ডায়াবেটিসের মতো রোগ বাড়ছে। নিউরোসায়েন্স গবেষণা বলছে, দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিন এক্সপোজার মস্তিষ্কের ডোপামিন নিঃসরণের ভারসাম্য নষ্ট করে, যা এডিএইচডি (মনোযোগের ঘাটতি) এবং ঘুমের ব্যাধির সঙ্গে যুক্ত।
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে বাইরের গবেষকদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে, যাতে তারা এমন প্ল্যাটফর্মগুলো তৈরি করতে পারে, যা কিশোর-কিশোরীদের অনলাইনে সহায়তা করবে, যেমন সহজে বন্ধ করা যায় এমন সোশ্যাল মিডিয়া সাইট। এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন তরুণদের তৈরি করা, যারা সুস্থভাবে বেড়ে উঠবে, নিজেদের প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এবং স্ক্রিন সময়, ঘুম, ব্যায়াম ও অন্যান্য বাস্তব আনন্দের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রাখতে সক্ষম হবে। এর মাধ্যমে তারা বড়দেরও এই ভারসাম্য খুঁজে বের করতে সাহায্য করতে পারবে। 

বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে ৭০-৭৫% ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং ৬৫-৭০% স্মার্টফোনের মালিক (জিএসএমএ, ইউনিসেফ)। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারও ব্যাপক– ফেসবুক (৩৫-৪০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী), ইউটিউব (৫০ মিলিয়ন) এবং টিকটক (২৫-৩০ মিলিয়ন) তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। তবে দৈনিক ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা স্ক্রিন টাইম, ক্ষতিকর কনটেন্ট, সাইবার বুলিং, কিশোর গ্যাং এবং ভুয়া খবরের প্রভাব তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উচিত স্কুলে ডিজিটাল সাক্ষরতা কর্মসূচি চালু করে নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার শেখানো। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৮০% তরুণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হবে। তাদের সুস্থ মানসিকতা নিশ্চিত করতে এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। 

তোফাজ্জল ইসলাম: ফেলো, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি এবং অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই), গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
tofazzalislam@gau.

edu.bd

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব যবহ র

এছাড়াও পড়ুন:

স্ক্রিন টাইম ও মানসিক স্বাস্থ্য

আধুনিক প্রযুক্তির যুগে স্ক্রিন টাইম আমাদের জীবনেরই অংশ হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তি এবং কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণার একটি সাধারণ পদ্ধতি হলো জনসংখ্যাগত গবেষণা। ২০১৯ থেকে ’২১ সালের মধ্যে প্রকাশিত ২৫টি পর্যালোচনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেশির ভাগ গবেষণায় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার এবং কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে দুর্বল বা অস্থিতিশীল সম্পর্ক পাওয়া গেছে, যদিও কিছু গবেষণায় এই সম্পর্ককে যথেষ্ট এবং ক্ষতিকর হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নির্ধারণ করা কখনোই শেষ হওয়া উচিত নয়। যেসব স্কুল এখন ফোন নিষিদ্ধ করছে, সেগুলো একটি প্রাকৃতিক পরীক্ষা হতে পারে, যা দেখবে এই নিষেধাজ্ঞা শিক্ষার ফলাফল এবং মানসিক স্বাস্থ্যে কী প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, ইংল্যান্ডের ৩০টি মাধ্যমিক স্কুলের একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে, সীমাবদ্ধ ফোন-নীতি ফোন ব্যবহারের পরিমাণ কমানো বা মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে কোনো প্রভাব ফেলেনি।

বর্তমানে, স্ক্রিন তরুণদের জীবনে এত গভীরভাবে প্রোথিত, কিশোর-কিশোরীদের সম্পূর্ণ  স্ক্রিন-ফ্রি জীবন কাটানো সম্ভব নয়। তবে বিজ্ঞানীরা ছোট আকারে কার্যকর কিছু পদ্ধতি পরীক্ষা করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ তারা কিছু এলোমেলোভাবে নির্বাচিত পরিবারকে অনুরোধ করতে পারেন, যেন তারা তাদের কিশোর-কিশোরীর ফোন রাতে শোবার ঘরে না রাখে। বয়ঃসন্ধিকালে দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্য ঘুম, শারীরিক কার্যকলাপ এবং পড়াশোনার পারফরম্যান্সকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে এবং কেউ কেউ মোবাইল ফোনের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য দায়ী করেন।
স্ক্রিন টাইমের সবচেয়ে গভীর প্রভাব পড়ছে মানসিক সুস্থতার ওপর। সামাজিক মাধ্যমের ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’ এবং ‘ভাইরাল’ হওয়ার প্রতিযোগিতা তরুণদের মধ্যে উদ্বেগ, আত্মসম্মানবোধের সংকট ও ডিপ্রেশন তৈরি করছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে ৫ ঘণ্টার বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৩৪% হতাশা বা মানসিক চাপের লক্ষণ রয়েছে। এ ছাড়া গেমিং বা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের প্রতি আসক্তি পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও একাকিত্বকে তীব্র করছে। স্ক্রিন টাইমের প্রভাবে শারীরিক স্বাস্থ্যও ঝুঁকিতে। বাচ্চাদের খেলাধুলা বা বাইরের কার্যক্রম কমে যাওয়ায় স্থূলতা ও ডায়াবেটিসের মতো রোগ বাড়ছে। নিউরোসায়েন্স গবেষণা বলছে, দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিন এক্সপোজার মস্তিষ্কের ডোপামিন নিঃসরণের ভারসাম্য নষ্ট করে, যা এডিএইচডি (মনোযোগের ঘাটতি) এবং ঘুমের ব্যাধির সঙ্গে যুক্ত।
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে বাইরের গবেষকদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে, যাতে তারা এমন প্ল্যাটফর্মগুলো তৈরি করতে পারে, যা কিশোর-কিশোরীদের অনলাইনে সহায়তা করবে, যেমন সহজে বন্ধ করা যায় এমন সোশ্যাল মিডিয়া সাইট। এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন তরুণদের তৈরি করা, যারা সুস্থভাবে বেড়ে উঠবে, নিজেদের প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এবং স্ক্রিন সময়, ঘুম, ব্যায়াম ও অন্যান্য বাস্তব আনন্দের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রাখতে সক্ষম হবে। এর মাধ্যমে তারা বড়দেরও এই ভারসাম্য খুঁজে বের করতে সাহায্য করতে পারবে। 

বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে ৭০-৭৫% ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং ৬৫-৭০% স্মার্টফোনের মালিক (জিএসএমএ, ইউনিসেফ)। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারও ব্যাপক– ফেসবুক (৩৫-৪০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী), ইউটিউব (৫০ মিলিয়ন) এবং টিকটক (২৫-৩০ মিলিয়ন) তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। তবে দৈনিক ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা স্ক্রিন টাইম, ক্ষতিকর কনটেন্ট, সাইবার বুলিং, কিশোর গ্যাং এবং ভুয়া খবরের প্রভাব তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উচিত স্কুলে ডিজিটাল সাক্ষরতা কর্মসূচি চালু করে নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার শেখানো। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৮০% তরুণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হবে। তাদের সুস্থ মানসিকতা নিশ্চিত করতে এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। 

তোফাজ্জল ইসলাম: ফেলো, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি এবং অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই), গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
tofazzalislam@gau.edu.bd

সম্পর্কিত নিবন্ধ