লাউয়াছড়ায় পর্যটকের ভিড়ে ‘বিঘ্নিত’ বন্য প্রাণীর জীবন
Published: 18th, June 2025 GMT
ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার জনপ্রিয় গন্তব্য মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। বিরল প্রজাতির নানা জাতের গাছ ও প্রাণীতে ভরা সংরক্ষিত বন এটি। তবে পর্যটকের অনিয়ন্ত্রিত ভিড় ও হইহুল্লোড় ‘উৎপাত’ হিসেবে দেখা দেয়।
বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, লাউয়াছড়া সহব্যবস্থাপনা কমিটি, ট্যুর গাইড ও স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেছে, চা-বাগান, পাহাড়-প্রকৃতি, হাওর-বাঁওড়ের কারণে মৌলভীবাজার একটি পর্যটন জেলা হিসেবে পরিচিত। তবে কিছু এলাকা আছে বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য স্পর্শকাতর। এর মধ্যে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান একটি। এবারের দীর্ঘ ছুটিতে ৭ থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত সাত দিনে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ৭ হাজার ৫৮১ জন দর্শনার্থী ঘুরতে গেছেন। এতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮ লাখ ৪৫ হাজার ১৩৫ টাকা।
বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের আয়তন ১ হাজার ২৫০ হেক্টর। সরকার ১৯৯৬ সালে লাউয়াছড়াকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। উদ্যানটি ১৬৭ প্রজাতির গাছ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৫৯ প্রজাতির সরীসৃপ (৩৯ প্রজাতির সাপ, ১৮ প্রজাতির লিজার্ড, ২ প্রজাতির কচ্ছপ), ২২ প্রজাতির উভচরসহ অসংখ্য বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র।
লাউয়াছড়া সহব্যবস্থাপনা কমিটির মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, পর্যটনের ক্ষেত্রে লাউয়াছড়ার বন্য প্রাণী, পরিবেশ-প্রকৃতির এই বাস্তবতাকে অনেকটাই বিবেচনায় রাখা হয় না। পর্যটকেরা অন্য স্থানের মতো এখানেও ঘোরার আনন্দতে হইহুল্লোড় করেন। বেশির ভাগ পর্যটকদের মধ্যে গাইড সঙ্গে নিতে অনীহা আছে। বনের ভেতর করণীয় আচরণ অনুসরণ করেন না অনেকে। অনেক পর্যটক ব্লুটুথ স্পিকারে গান বাজিয়ে বনে ঘুরেন। বন্য প্রাণী বিশেষ করে বানরকে উত্ত্যক্ত করার প্রবণতা দেখা যায় অনেকের মধ্যে। প্লাস্টিক প্যাকেট নির্ধারিত স্থানে না ফেলে যেখানে-সেখানে ফেলে রাখেন। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে যাওয়া শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়কে গাড়িগুলো উচ্চ গতিতে হর্ন বাজিয়ে চলাচল করে। সব মিলিয়ে বনের নির্জনতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
পর্যটকের ভিড়, হইহল্লোড়ের কারণে যে প্রাণীদের অসুবিধা হয়, সেটা স্বীকার করে নিলেন পর্যটক সুভাষ বড়ুয়া।
পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, মানুষের উপস্থিতি, শব্দ—এসবে আতঙ্কিত বন্য প্রাণী অনেকটাই দিশাহারা হয়ে পড়ে। গভীর বনের মধ্যে আত্মগোপনে চলে যায়। কিছু বানর ছাড়া আর তেমন কোনো প্রাণীর দেখা মিলে না। তাদের স্বাভাবিক চলাফেরা ব্যাহত হয়।
প্রাণপ্রকৃতি গবেষক পাভেল পার্থ ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের পরবর্তী সময়ের একজন নিবিড় পর্যবেক্ষক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের পর লাউয়াছড়ার আরেক সর্বনাশ করেছে অপরিকল্পিত বাণিজ্যিক পর্যটন। এই বনের পর্যটক ধারণক্ষমতাকে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে বিপুল পরিমাণে মানুষ ঢুকেন এখানে। এটি এখানকার বন্য প্রাণীর খাদ্যাভ্যাস, চলাচল ও প্রজননে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। একই সঙ্গে বনের ভেতর রেলপথ, ব্যস্ত সড়কপথ প্রতিদিন বন্য প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাউয়াছড়া কোনো একক বিচ্ছিন্ন বাস্তুতন্ত্র নয়। এর আশপাশের চা-বাগান, জলাভূমি, গ্রাম, বন—সবকিছু মিলিয়েই এর সীমানা নির্ধারণ এবং স্থানীয় বননির্ভর জনগণকে সমন্বয় করে বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক বনব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা দরকার।
লাউয়াছড়া সহব্যবস্থাপনা কমিটির কোষাধ্যক্ষ ও মনিটরিং দলের সদস্য জনক দেববর্মা মনে করেন, বনে গণপর্যটন বন্ধ করলে বনের উপকার হবে। আর পর্যটকদেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ শ্রীমঙ্গলের রেঞ্জার কাজী নাজমুল হক বলেন, লাউয়াছড়ায় পর্যটক সীমিত করতে টিকিটের ফি বাড়ানো হয়েছে। কীভাবে পর্যটক সীমিত করা যায়, বিকল্প কী তা নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মধ্যে চিন্তাভাবনা আছে। সড়কে ২০ কিলোমিটার গতি নির্ধারণ করা, কিন্তু তা কেউ মানতে চান না। এখানে হাইওয়ে পুলিশ নিয়োগ দরকার। বন্য প্রাণী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানুষের বিচরণে বন্য প্রাণীরা একটু আড়ালে থাকে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র বন য প র ণ বন য প র ণ র প রক ত স রক ষ
এছাড়াও পড়ুন:
হাওরের স্বচ্ছ জলে মুগ্ধ পর্যটক, বাড়ছে ভিড়
চলছে বর্ষা মৌসুম। বর্ষা ও জোয়ারের পানিতে টইটম্বুর কিশোরগঞ্জের হাওর-বাওর। মিঠামইন ও বালিখলায় চোখ যতদূর যায় কেবই জলরাশি। স্বচ্ছ জলের চোখ-জুড়ানো দৃশ্য উপভোগ করতে ভিড় করছেন হাজারো পর্যটক। ঈদের ছুটিতে পরিবার নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন অনেকে। পর্যটকের স্রোত এখনো বাড়ছেই। তীব্র গরম উপেক্ষা করে প্রতিদিন দেশের নান প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসছেন এই অঞ্চলে।
রোববার বালিখলা ও মিঠামইন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পর্যটকদের প্রাণবন্ত ভিড়। অনেকে পরিবার নিয়ে, কেউ বন্ধুবান্ধব মিলে বেড়াতে এসেছেন। বর্ষার পানি বাড়তে থাকায় হাওরের সৌন্দর্য ধরা দিয়েছে নবরূপে। স্থানীয় মাঝি, দোকানি, হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের মুখে হাসির ঝিলিক। পর্যটকদের আগমনে জমে উঠেছে তাদের ব্যবসা।
পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে মিঠামইন-নিকলী বেড়িবাঁধ এলাকা। ২০২০ সালে এই বেড়িবাঁধ নির্মাণের পর থেকে এটি ধীরে ধীরে দর্শনার্থীদের প্রধান গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে ছুটে আসে। ছাতিরচর এলাকায় ভাঙন রোধে রোপণ করা হয়েছে হাজার হাজার করচগাছ, যা হাওরের পরিবেশকে আরও শোভাময় করে তুলেছে।
স্থানীয় মাঝি সুমন মিয়া বলেন, বর্ষা এলে আমাদের রোজগার বাড়ে। তাই সারাবছর এই সময়টার অপেক্ষায় থাকি। পর্যটকদের ঘুরিয়ে বেড়ানো আমাদের মূল জীবিকা। কয়েকদিনের বৃষ্টিতে হাওরের পানি বাড়ছে, ফলে নৌভ্রমণের চাহিদাও বাড়ছে, যোগ করেন তিনি।
ঈদের ছুটিতে ১০টি বাইকে ২০ বন্ধুর টিম এসেছেন হাওর দেখতে। নরসিংদী থেকে আসা পর্যটক দলটির একজন হাসানুল শুভ। তিনি বলেন, নতুন পানি এসেছে হাওরে। ট্রলারে ঘুরেছি। খুব ভালো লেগেছে।
স্থানীয়রা জানান, বর্ষাকালে এই অঞ্চলে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ পর্যটনকেন্দ্রিক আয়-রোজগারে যুক্ত থাকেন। ফলে পর্যটকদের উপস্থিতি শুধু বিনোদন নয় বরং অনেকের জীবিকার উৎসও বটে। হাওরের সৌন্দর্য রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সজাগ দৃষ্টি রাখছে বলেও জানান তারা।
মিঠামইন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর কবির জানান, ঈদের পর থেকেই হাওরে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। পর্যটকদের নিরাপত্তায় জিরো পয়েন্ট এলাকায় পোশাকধারী ও সিভিল পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে। এছাড়া হাওরের পথে দুটি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে যাতে দর্শনার্থীরা নির্বিঘ্নে ভ্রমণ করতে পারেন।
হাওরের জলে যখন প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি পড়ে, তখন যেন মানুষ নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়—কিশোরগঞ্জের হাওর আজ শুধুই আর জলাভূমি নয়, এটি হয়ে উঠেছে স্বস্তির এক নৈসর্গিক ঠিকানা।