পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত মৌলিক কিছু কার্যক্রমের উদ্যোগ নেবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

আজ শুক্রবার রাজধানীর ধানমন্ডির ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এই আশা প্রকাশ করেছেন ইফতেখারুজ্জামান। ‘সাম্প্রতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও পার্বত্য চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক এই আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম।

ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের অধিকার হরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও আমলাদের মধ্যে একধরনের ঐকমত্য আছে। সেটার সঙ্গে যোগ হয়েছে সামরিক প্রচেষ্টা। এসবের বাস্তবতা হলো বর্তমান পাহাড়ের পরিস্থিতি।

গণমাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে তেমন প্রতিবেদন উঠে আসে না বলে মন্তব্য করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, এর কারণও সবার জানা। গণমাধ্যম যতই স্বাধীন হোক, কিন্তু সেখানে কিছু নিয়ন্ত্রণ আছে।

দেশে ‘আদিবাসী’ শব্দ নিয়ে গবেষণা করা দরকার বলে উল্লেখ করেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, আদিবাসী শব্দ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভিন্ন তথ্য দেওয়া হয়। শব্দটির অর্থ কোনো বসতির সময়কাল নাকি জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সেটা খুঁজে দেখতে হবে।

চব্বিশের জুলাইয়ে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও জনতার হাতে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের ব্যানার ছিল বলে উল্লেখ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, এখানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল অবিস্মরণীয়। একইভাবে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। জুলাইয়ে পরে তাঁরা পরিবর্তনে আশা দেখলেও বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি।

অন্তর্বর্তী সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে অন্তত মৌলিক কিছু কার্যক্রমের উদ্যোগ নেবে বলে আশা প্রকাশ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের পেছনে যে রাজনৈতিক শক্তি আছে, তাদের কাছে আদিবাসী শব্দ কতটা গ্রহণীয়, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাই এখানে চ্যালেঞ্জ অনেক বড়।

নিজেদের অধিকার রক্ষায় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা শুধু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের অধিকার নয়। এটা সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের অধিকার। এই বোধ জাগ্রত করতে হবে। সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান আদায় করে নেওয়ার বিকল্প নেই।

আলোচনা সভায় নির্ধারিত বিষয়বস্তুর ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আদিবাসী অধিকারকর্মী সতেজ চাকমা। সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহসাধারণ সম্পাদক গজেন্দ্রনাথ মাহাতো। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পর ২৮ বছর পার হয়েছে। কিন্তু এখনো সেই চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামকে বেসামরিক প্রশাসনে ন্যস্ত করতে হবে।

জুলাই সনদে পাহাড়ি ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য রক্ষাকবচ তৈরির আহ্বান জানান বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। তিনি বলেন, একটা দেশ কতটা সভ্য, গণতান্ত্রিক ও মানবিক, তা তার সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর ভালো থাকার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র গোষ্ঠীরা ভালো নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করতেই হবে। পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য ও সংস্কৃতি রক্ষায় এটা জরুরি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ৫৪ বছর পরে এসে বুঝতে পারছেন, এখানে বারবার স্বৈরতন্ত্র উত্থিত হচ্ছে। একদল যায়, একদল আসে। কিন্তু সংবিধান, রাষ্ট্রনীতিসহ কোনো কিছুতেই ঐকমত্য দেখা যায় না। একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে কী ধরনের শাসনকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির মধ্যে কখনো ঐকমত্য দেখা যায়নি। সেখানে চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে বাঙালি মুসলমানদের মনস্তাত্ত্বিক দিক ও কিছু সামরিক প্রেক্ষাপট দায়ী। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সেখানকার অধিবাসীদের সংগঠিত হতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে করণীয়সহ সেখানকার বাস্তবতা সম্পর্কে সব রাজনৈতিক দলের কাছে ব্যাপক প্রচারের আহ্বান জানান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, তাঁরা ছাত্রজীবনে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যেসব দাবি করেছিলেন, তা এখনো করছেন। অর্থাৎ বিগত তিন দশকে সেখানে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই পরিবর্তনের জন্য সবার সচেতনভাবে কাজ করা জরুরি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য একটি ইতিবাচক পথরেখা তৈরি করে যাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত বলে মন্তব্য করেন রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় অন্যতম গুরুত্ব বহন করে। কাজেই সরকারকে সে বিষয়ে মাখায় রেখে পদক্ষেপ নিতে হবে।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান তাঁদের ভীষণ আশাবাদী করেছিল। কিন্তু তারপরে সেই আশা কিছুটা হতাশায় পরিণত হয়। বিগত সরকার ক্ষুদ্রগোষ্ঠীদের নিয়ে অনেক ধরনের আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু তারা সেটা বাস্তবায়ন করেনি। পার্বত্য ভূমি বিরোধ কমিশনকে পুনরায় সক্রিয় করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আশা করেছিলেন, তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সেখানকার মতো করে দেখবে। কিন্তু তারা সেটা করেনি। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষদের এখনো আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। অন্তত বর্তমান সরকারের কাছে এই অবস্থার পরিবর্তন আশা করেছিলেন তাঁরা। যেহেতু অধিকার আদায় হয়নি, তাই পাহাড়ের অধিবাসীদের অধিকার আদায়ে বহুদূর যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ে বিভিন্ন মতামত, উদ্যোগের কথা বলা হলেও বিগত সরকারগুলোর পক্ষ থেকে তা তেমন আমলে নেওয়া হয়নি বলে মন্তব্য করেন সাবেক সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সামরিক-বেসামরিক অনেক ধরনের বাধা আছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে তাঁরা সবার সহযোগিতা চান। কিছু খারাপ আমলা, রাজনীতিবিদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির কারণে গত ২৮ বছরেও এই চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। এই চুক্তি অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষার ছিল। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের সঙ্গে বেইমানি করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে অন্তত একটি পথরেখা প্রদান করতে পারে। তাঁরা এটুকু অনুরোধ জানান।

আলোচনা সভার সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম সহসভাপতি অজয় এ মৃ। সঞ্চালনা করেন সংগঠনটির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক হিরণ মিত্র চাকমা। উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সদস্যরা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক ষ দ র জনগ ষ ঠ র ইফত খ র জ জ ম ন র জন ত ক সরক র র সব র জ র জন য কর ছ ল ট আইব

এছাড়াও পড়ুন:

আমানত রক্ষা করা ইসলামের সামাজিকতার সৌন্দর্য

আধুনিক বিশ্বে ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিকতার প্রভাবে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও দায়িত্ববোধ দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামের একটি মৌলিক মূল্যবোধ—‘আমানত’—চিন্তা ও চর্চা থেকে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে।

অথচ আমানত শুধু একটি সামাজিক বা অর্থনৈতিক ধারণা নয়, বরং এটি একটি বিস্তৃত আত্মিক ও নৈতিক দায়িত্ব, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষের ওপর অর্পণ করেছেন।

পবিত্র কোরআনে এই আমানতের গুরুত্ব অত্যন্ত জোরালোভাবে বর্ণিত হয়েছে: ‘নিশ্চয়ই আমরা আমানত পেশ করেছিলাম আসমান, জমিন ও পাহাড়ের সামনে, তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানাল এবং তা হতে ভীত ছিল; কিন্তু মানুষ তা বহন করল। নিশ্চয়ই সে ছিল অত্যন্ত জুলুমকারী ও মূর্খ।’ (সুরা আহযাব, আয়াত: ৭২)

এই আয়াতে আমানতের মর্যাদা ও এর ওজনের গভীরতা প্রকাশ পায়। আল্লাহর এই দায়িত্ব মানুষের ওপর অর্পিত হওয়া তার বিশেষত্বের প্রমাণ, তবে এটি একই সঙ্গে তার জন্য একটি বড় পরীক্ষা।

নিশ্চয়ই আমরা আমানত পেশ করেছিলাম আসমান, জমিন ও পাহাড়ের সামনে, তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানাল এবং তা হতে ভীত ছিল। কিন্তু মানুষ তা বহন করল।সুরা আহযাব, আয়াত: ৭২আমানতের ব্যাপকতা

‘আমানত’ শব্দটির অর্থ শুধু আর্থিক বা সামাজিক বিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি ব্যাপক ধারণা, যা মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমানতের মধ্যে রয়েছে:

ব্যক্তিগত আচরণে সততা: কথায়, কাজে ও প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সত্যবাদিতা।

সামাজিক দায়িত্ব: পরিবার, সমাজ ও সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন।

পরিবেশের প্রতি যত্ন: আল্লাহর সৃষ্টির খিলাফা হিসেবে প্রকৃতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকা।

আধ্যাত্মিক আনুগত্য: আল্লাহর প্রতি পূর্ণ সমর্পণ ও তাঁর আদেশ পালন।

আমানত একটি ইবাদতের অংশ, যা শুধু দুনিয়ার জন্য নয়, বরং আখিরাতের জবাবদিহির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানুষের নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা ও সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তোলে।

আরও পড়ুনইসলামে আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার গুরুত্ব২২ জুলাই ২০২২নবী–যুগে আমানতের উদাহরণ

ইসলামের প্রাথমিক যুগে নবীজি (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত মদিনার সমাজ আমানতের একটি জীবন্ত উদাহরণ। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে অভূতপূর্ব ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠেছিল, তা আমানতের বাস্তব প্রয়োগ। আনসাররা তাদের ঘরবাড়ি, সম্পদ এবং এমনকি হৃদয়ের ভালোবাসা মুহাজিরদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন।

এই সম্পর্ক শুধু সম্পদের বণ্টন নয়, বরং পারস্পরিক দায়িত্ব ও বিশ্বাসের একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এমনকি আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর সঙ্গে তাঁর আনসারি ভাই সা’দ ইবনে রাবী (রা.) তাঁর সম্পদের অর্ধেক এবং এমনকি তাঁর স্ত্রীদের একজনকে তালাক দিয়ে তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই ত্যাগ ও বিশ্বাস আমানতের প্রকৃত চিত্র। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৭৮০)

মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে অভূতপূর্ব ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠেছিল, তা আমানতের বাস্তব প্রয়োগ। আনসাররা তাদের ঘরবাড়ি, সম্পদ এবং এমনকি হৃদয়ের ভালোবাসা মুহাজিরদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন।

এই ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে মদিনার সমাজে একতা, সহানুভূতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তি গড়ে উঠেছিল, যা আজও মুসলিম সমাজের জন্য একটি আদর্শ।

আধুনিক সমাজে আমানতের অবক্ষয়

দুর্ভাগ্যবশত, আজকের সমাজে আমানতের চর্চা দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে অভিবাসী মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, গোষ্ঠীবদ্ধতা ও সংকীর্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মসজিদগুলোতে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বিভেদ, পারিবারিক স্বার্থপরতা এবং একে অপরের প্রতি সন্দেহ সমাজের ঐক্যকে ভঙ্গ করছে। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও প্রায়ই দেখা যায়, অসৎ আচরণ, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও বিশ্বাসের অপব্যবহার।

এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও ‘নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা’ একটি নতুন সামাজিক আদর্শ হয়ে উঠেছে। মানুষ অন্যের প্রতি দায়িত্ব পালনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এটি শুধু সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, বরং পরিবেশের প্রতি দায়িত্ববোধ: আল্লাহ তা’আলা মানুষকে এই পৃথিবীর খলিফা বানিয়েছেন, যার মধ্যে পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বও অন্তর্ভুক্ত।

কিন্তু আজকের উন্নয়নের নামে বনভূমি ধ্বংস, নদী ও বাতাসের দূষণ এবং প্রাণপ্রবাহের ক্ষতি আমানতের এই দিকটিকে উপেক্ষা করছে। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার পর পৃথিবীতে পুনরায় বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৫৬)

প্রকৃতির প্রতি আমাদের দায়িত্ব হলো এটিকে সংরক্ষণ করা, অপচয় রোধ করা এবং সৃষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখা।

আরও পড়ুনপ্রলোভনের এই যুগে নিজেকে রক্ষার উপায়০২ আগস্ট ২০২৫আমানতের নষ্টের ভবিষ্যদ্বাণী

নবীজি (সা.) আমানতের অবক্ষয় সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন: ‘মানুষ ঘুমাবে আর আমানত তার হৃদয় থেকে উঠিয়ে নেওয়া হবে...এমন সময় আসবে যখন বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন বিশ্বস্ত মানুষ আছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭০৮৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪৫)

এই হাদিসটি একটি গভীর সতর্কবাণী। এটি ইঙ্গিত করে যে একটি সময় আসবে যখন বিশ্বস্ততা এতটাই বিরল হয়ে পড়বে যে একজন আমানতদার ব্যক্তিকে ব্যতিক্রম হিসেবে গণ্য করা হবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী আধুনিক সমাজের বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে স্বার্থপরতা ও অবিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মানুষ ঘুমাবে আর আমানত তার হৃদয় থেকে উঠিয়ে নেওয়া হবে...এমন সময় আসবে যখন বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন বিশ্বস্ত মানুষ আছে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭০৮৬আমানতের পুনর্জাগরণের উপায়

আমানতের মূল্যবোধকে পুনরায় জীবন্ত করতে হলে আমাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে:

সত্যবাদিতা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা: কথা ও কাজে সততা বজায় রাখা এবং প্রতিশ্রুতি পূরণ করা।

দায়িত্বশীলতা ও সততা: পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আচরণ।

ন্যায়পরায়ণ আর্থিক আচরণ: ব্যবসা ও আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা ও বিশ্বস্ততা।

প্রকৃতির প্রতি যত্ন: পরিবেশ সংরক্ষণ, অপচয় রোধ ও সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষা।

পারস্পরিক সহযোগিতা: সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য গড়ে তোলা।

আমানত শুধু একটি সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি একটি ইবাদত, যা আল্লাহর প্রতি আমাদের আনুগত্যের প্রকাশ। এটি ব্যক্তি, সমাজ ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। আমানতের চর্চাকে পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে আমরা একটি দয়ালু, ন্যায়ভিত্তিক ও ঐক্যবদ্ধ মুসলিম সমাজ গড়ে তুলতে পারি। এটি আমাদের দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের সাফল্যের পথ প্রশস্ত করবে।

আরও পড়ুনআখিরাতে বিশ্বাস সত্কর্মের অনুপ্রেরণা০৪ মে ২০১৮

সম্পর্কিত নিবন্ধ