অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সামুদ্রিক এক ছত্রাকের সন্ধান পেয়েছেন, যা প্লাস্টিক খেয়ে ফেলে; অর্থাৎ এটি প্লাস্টিককে ভেঙে প্রোটিনসমৃদ্ধ জৈব পদার্থে রূপান্তর করতে পারে। অন্ধকার ঘরের ভেতর, শুধু প্লাস্টিক আর কিছুটা সময় দিলে এটি তার কাজ শুরু করে দেয়। বিশেষভাবে চিহ্নিত এই ছত্রাকের নাম ‘অ্যাসপারগিলাস টেরিয়াস’। এটি প্লাস্টিক পুরোপুরি খেয়ে প্রোটিনসমৃদ্ধ ফাঙ্গাল বায়োমাসে রূপান্তর করে; যা ভবিষ্যতে খাবার বা পশুখাদ্য হিসেবেও ব্যবহারযোগ্য হতে পারে।
অধ্যাপক আলি আব্বাসের নেতৃত্বে গবেষক দল সামুদ্রিক পরিবেশ থেকে নতুন এ ছত্রাক শনাক্ত করেছে, যা পরিবেশে সবচেয়ে জটিল ও পুনর্ব্যবহারযোগ্যতা কম এমন প্লাস্টিক–পলিপ্রোপিলিন (পিপি৫) ভাঙতে সক্ষম। পলিপ্রোপিলিন সাধারণত খাবারের মোড়ক, বোতলের ঢাকনা বা কাপড়ের হ্যাঙ্গারে ব্যবহৃত হয়। এটি বিশ্বব্যাপী বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে অভূতপূর্ব অগ্রগতি দেখা গেছে। অধ্যাপক আব্বাস জানান, ‘এই সামুদ্রিক ছত্রাক ২০২৩ সালে আমরা যেসব স্থলভিত্তিক ছত্রাক শনাক্ত করেছিলাম, তাদের চেয়েও বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।’
২০২৩ সালে গবেষকরা ৩০ দিনে পলিপ্রোপিলিনের ২১ শতাংশ ভাঙতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরে আরেকটি গবেষণায় ৯০ দিনে ২৭ শতাংশ পর্যন্ত ভাঙার নজির পাওয়া যায়। যেখানে অন্যান্য প্লাস্টিক-ভক্ষণকারী অণুজীবের কাজ করতে মাস বা বছর লেগে যায়, সেখানে ‘অ্যাসপারগিলাস টেরিয়াস’ মাত্র ১৪০ দিনের কম সময়ে সেই কাজ সম্পন্ন করতে পারে। আলো বা বাতাস ছাড়াই কাজ করার ফলে এটি বন্ধ জায়গা। যেমন ল্যান্ডফিল, ভূগর্ভস্থ বায়োরিঅ্যাক্টর বা সাবমেরিনের মতো পরিবেশে ব্যবহারযোগ্য হতে পারে।
প্লাস্টিক নিজ থেকেই ভাঙে না। গবেষণার শুরুতে তা প্রাক-প্রক্রিয়াজাত করা হয়–অতিবেগুনি রশ্মি বা তাপের মাধ্যমে; যা প্রাকৃতিক ক্ষয়ের মতো পরিবেশ তৈরি করে। এরপর সেই প্লাস্টিক ছত্রাকসমৃদ্ধ তরল দ্রবণে ডুবিয়ে রাখা হয়। সেখানে ছত্রাকের তৈরি প্রাকৃতিক এনজাইম পলিপ্রোপিলিনের জটিল অণু ভাঙতে শুরু করে।
অধ্যাপক আব্বাস বলেন, ‘ছত্রাক এমন প্রাকৃতিক এনজাইম তৈরি করে, যা জটিল উপাদান যেমন প্লাস্টিক ভাঙতে পারে। আমাদের শুধু তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিতে হয়।’ এই পদ্ধতিতে অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রায় কাজ হয়, ফলে শক্তি সাশ্রয় হয় এবং এটি বড় পরিসরে শিল্প প্রয়োগের জন্য উপযোগী।
কেন পলিপ্রোপিলিন নিয়ে এত উদ্বেগ
অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবহৃত প্লাস্টিক মোড়কের প্রায় ২০ শতাংশ পলিপ্রোপিলিন। এর মাত্র ৮ শতাংশ পুনর্ব্যবহৃত হয়। পেছনের মূল কারণ এর জটিল রাসায়নিক গঠন এবং ব্যবহারের পর সৃষ্ট দূষণ।
এই আবিষ্কার ভবিষ্যতের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। কল্পনা করুন–প্লাস্টিকের বর্জ্য থেকে সাবমেরিন, স্পেস স্টেশন কিংবা দুর্গম সামরিক ঘাঁটিতে খাবারের উপাদান তৈরি হচ্ছে; বা স্রেফ সমুদ্র আর মাটির নিচে জমা প্লাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কার হওয়ার পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ জৈব বায়োমাস।
তবে এই গবেষণা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বড় পরিসরে এটি প্রয়োগ করার আগে বিভিন্ন নিরাপত্তা মানদণ্ড পেরিয়ে যেতে হবে। প্রথমবারের মতো আমরা প্লাস্টিককে কেবল বর্জ্য হিসেবে নয়; বরং একটি উপযোগী কাঁচামাল হিসেবে ভাবতে পারি। একটি গৃহস্থালির আবর্জনার স্তূপ থেকে জন্ম নেওয়া ছত্রাক হয়তো এবার পৃথিবীর প্লাস্টিক সংকটের সমাধান দিতে পারে।
এই আবিষ্কারকে ঘিরে যতই আশাবাদ থাকুক, অধ্যাপক আব্বাস মনে করিয়ে দেন, এটি সার্বিক সমাধান নয়; বরং বড় একটি কৌশলের অংশমাত্র। তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন কমানো এবং চক্রাকার অর্থনীতি চালু করাই প্রধান লক্ষ্য থাকা উচিত।
সব কিছু ঠিকঠাক চললে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এটি প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক কার্যকর সমাধানে পরিণত হতে পারে। এই আবিষ্কার পরিবেশগত জৈবপ্রযুক্তির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যেখানে সামুদ্রিক ছত্রাক হতে পারে বিশ্বব্যাপী দূষণবিরোধী লড়াইয়ের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পল প র প ল ন ব যবহ র পর ব শ বর জ য
এছাড়াও পড়ুন:
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ ৪ কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি খারাপ
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ চার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো খারাপ অবস্থায় আছে বলে মনে করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। অন্য তিনটি কারণ হলো কঠোর আর্থিক ও রাজস্ব নীতির প্রভাব, বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা বৃদ্ধি এবং ব্যাংক খাতে অব্যাহত চাপ। আইএমএফের ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়েছে।
আইএমএফের সঙ্গে চলমান ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কর্মসূচি থেকে দুই কিস্তির ১৩৭ কোটি মার্কিন ডলার একসঙ্গে পাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামীকাল ২৬ জুন বাংলাদেশের হিসাবে এ অর্থ জমা হবে। গত সোমবার রাতে আইএমএফের বোর্ড সভায় দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়টি অনুমোদন করা হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আইএমএফ আরও বলেছে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে আগের সরকারের পতন হয়।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আছে, এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। বিনিয়োগ স্থবিরতাও কাটেনি। আইএমএফ অর্থনীতির কিছু বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা ঠিকই আছে। জাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক, ঢাকা কার্যালয়তখন সামষ্টিক অর্থনীতি আরও চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে। পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নানা উদ্যোগে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হয়; যা অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার পথে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জটিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও আইএমএফ কর্মসূচির অধীন তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের পর্যালোচনায় বাংলাদেশের পারফরম্যান্স মোটামুটি সন্তোষজনক ছিল। সরকার প্রয়োজনীয় নীতিগুলো বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সম্প্রতি বিনিময় হার আরও নমনীয় করার পাশাপাশি কর রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আছে, এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। বিনিয়োগ স্থবিরতাও কাটেনি। আইএমএফ অর্থনীতির কিছু বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা ঠিকই আছে।
জাহিদ হোসেনের মতে, আইএমএফ মূলত তিন ধরনের সুপারিশ করেছে। কঠোর আর্থিক নীতি অব্যাহত রাখার কথা বলেছে। এ ছাড়া যে বিনিময় হার ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়েছে, তা যেন বজায় রাখা হয়। আর রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজেট–ঘাটতি কমাতে হবে।
অর্থনীতি নিয়ে আইএমএফের মূল্যায়নআইএমএফ বলছে, চলতি অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। আগামী অর্থবছরে তা বেড়ে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হবে।
এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিও আগামী অর্থবছরে কিছুটা সহনীয় হবে। আইএমএফের মতে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি গড়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসতে পারে। চলতি অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি গড়ে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ হওয়ার কথা বলেছে আইএমএফ।
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি নানা ধরনের সামষ্টিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে। কঠিন পরিবেশ সত্ত্বেও আইএমএফের কর্মসূচির অধীনে প্রতিশ্রুত খাতগুলোর অগ্রগতি সন্তোষজনক রয়েছে এবং সরকার প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও সংস্কার বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এখন বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ পুনর্গঠন এবং মূল্যস্ফীতি কমানোর ওপর জোর দেওয়া উচিত।
সম্প্রতি সরকার নতুন বিনিময় হার ব্যবস্থা চালু করেছে এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিয়েছে, যা ইতিবাচক। কঠোর মুদ্রানীতির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন নীতিমালার সমন্বয়, নমনীয় বিনিময় হার এবং রাজস্ব ঘাটতি হ্রাস—এই তিনটি মিলেই অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক খাতে ভারসাম্য স্থাপনে সহায়ক হবে বলে মনে করে আইএমএফ।
সরকারি ভর্তুকি ধাপে ধাপে কমিয়ে একটি টেকসই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া উচিত বলেও মত দিয়েছে আইএমএফ। এ ছাড়া সরকারি অর্থের দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে ব্যয়ের দক্ষতা বাড়াতে হবে। আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ খাতে সংস্কারের জন্য ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য কৌশল প্রণয়ন জরুরি। পাশাপাশি ক্ষুদ্র আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে ব্যাংক খাত পুনর্গঠনের জন্য নতুন আইন দ্রুত কার্যকর করা দরকার।
আইএমএফের মতে, বাংলাদেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে টেকসই কাঠামোগত সংস্কার অপরিহার্য। এর মধ্যে রয়েছে রপ্তানি বৈচিত্র্য, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করা, সুশাসন জোরদার এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্তের গুণগত মান উন্নয়ন।
২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য সাড়ে তিন বছর মেয়াদি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন করে। ঋণ কর্মসূচি অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, ঝুঁকিতে থাকা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে এ ঋণ কর্মসূচি। চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, টাকার দরপতন হওয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া—মূলত এ তিন কারণে তখন আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার বাংলাদেশ পেয়েছে। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৩১ কোটি ডলার।