‘এদেশে কেউ বিয়ে করতিও চায় না, দিতিও চায় না’
Published: 7th, July 2025 GMT
‘১০ চাহার (চাকা) গাড়ি চলে। রাস্তাঘাট ভাঙা। সরকার কোনো কাম করে না। ধরেন, আজ ১২-১৪ বছর কেউ মিয়া ছোয়ালপাল বিয়া দিবার পারে না। এদেশে কেউ বিয়ে করতিও চায় না, দিতিও চায় না। আসা-যাওয়ার খুব কষ্ট। ১৫ বছর ধরে মানুষ খুব দুর্ভোগে পড়ে রইছে। কাদার ছয় মাস মানুষ বাড়িরতে বের হবার পায় না।’
আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব সাদেক আলী। তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার সদকী ইউনিয়নের উত্তর মূলগ্রামের বাসিন্দা।
একই ইউনিয়নের হিজলাকর গ্রামের তরিকুল ইসলামের স্ত্রী শিলা খাতুন বলেন, ছেলেপক্ষ মেয়ে দেখতে এসে বলে, গ্রামের রাস্তা ভালো না। পরিবেশ ভালো না। এইটা বলে বিয়ে ভেঙে দেয়। তাঁর ভাষ্য, দেড় মাস আগে সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে তাঁর ননদের বিয়ে ভেঙে গেছে।
২০০৬ সালে সদকী ইউনিয়নের জিলাপীতলা বাজার থেকে গড়াই নদীর বালুরঘাট পর্যন্ত প্রায় ৭০০ মিটার গ্রামীণ সড়ক পাকা করা হয়। প্রতিবছর প্রায় দুই কোটি টাকার বালুর ঘাট ইজারা দেয় স্থানীয় প্রশাসন। প্রতিদিনই ২০০ থেকে ৩০০টি বালুভর্তি ছয় চাকা ও ১০ চাকার ডাম্প ট্রাক চলে এই সড়ক দিয়ে। এতে সড়কের কার্পেটিং উঠে অসংখ্য খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে ধুলাবালু আর বর্ষায় জমে থাকে কাদাপানি। এতে সারাবছরই চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় জিলাপীতলা, হিজলাকর, উত্তর মূলগ্রামসহ আশপাশ এলাকার অন্তত ১০ হাজার বাসিন্দাকে। এখন নদীতে পানি বাড়ায় বালু তোলা বন্ধ রয়েছে। বালু তোলার ড্রেজিং মেশিন রাখা আছে ঘাটে।
সড়কটি সংস্কারের দাবিতে সোমবার কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী আঞ্চলিক সড়কের জিলাপীতলায় মানববন্ধন করেন এলাকাবাসী। পরে ভাঙা ও জরাজীর্ণ সড়কে ধানের চারা রোপণ করে প্রতিবাদ জানান তারা। সরেজমিন দেখা যায়, সড়কের কার্পেটিং উঠে গেছে অনেক আগেই। অসংখ্য খানাখন্দে ভরে আছে গোটা সড়ক। ভারী যানবাহন চলায় সড়কের দুই পাশে নালার মতো গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। তাতে জমে আছে কাদাপানি। সড়ক সংস্কারের দাবিতে স্থানীয়রা বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে তাতে ধানের চারা রোপণ করেন।
মানববন্ধন চলাকালে কৃষক নাজমুল হোসেন বলেন, দিন-রাত শত শত বালুর গাড়ি চলে। দেখে বোঝার উপায় নেই, এটি কাঁচা নাকি পাকা সড়ক। কাদাপানির কারণে এই সড়ক দিয়ে অটোভ্যান, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ কোনো গাড়ি আসতে চায় না। মাথায় করে কৃষি পণ্য আনা-নেওয়া করা লাগে। এতে খরচ ও ভোগান্তি উভয়ই বেশি হয়। তিনি দ্রুত সড়কটি সংস্কারের দাবি জানান। গৃহিণী নাজমা খাতুন বলেন, শুষ্ক মৌসুমে ধুলাবালুতে বাড়িঘরে টেকা যায় না। নোংরা খাবার খেয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবার হাসপাতালে যাওয়ার জন্য কোনো গাড়িও পাওয়া যায় না।
সদকী ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য আব্দুল হামিদ ও পল্লি চিকিৎসক আসাদুল ইসলাম বলেন, বালুর গাড়ি চলায় কার্পেটিং উঠে রাস্তার করুণ দশা। সরকার প্রতিবছর দুই কোটি টাকার বেশি রাজস্ব নিয়ে যায়। কিন্তু রাস্তার কোনো কাজ করে না।
হিজলাকর উত্তর মূলগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহিম বলেন, রাস্তার কারণে বর্ষা মৌসুমে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে কম আসে। একাধিকবার স্থানীয় এমপি, চেয়ারম্যান ও প্রশাসনকে জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি বলে জানিয়েছেন সদকীর ইউপির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৭০০ মিটার সড়কের কাছে অসহায় এলাকার মানুষ।
ভ্যাটসহ প্রায় আড়াই কোটি টাকা দিয়ে জিলাপীতলা বালুর ঘাট ইজারা নিয়েছেন কুমারখালী পৌর বিএনপির সভাপতি মনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, নদীতে পানি বাড়ায় বালু তোলা বন্ধ আছে। যেহেতু সরকার রাজস্ব আয় করছে, সেহেতু সরকারকেই রাস্তা মেরামত করতে হবে।
গ্রামীণ সড়কে ভারী যানবাহন চলা নিষিদ্ধ হলেও ঘাটের কারণে বালুর গাড়ি চলাচল করে জানিয়ে উপজেলা প্রকৌশলী মো.
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ঘুঘুডাঙ্গার মনোরম তালসড়ক
অক্টোবরের প্রথম দিকে লম্বা এক ছুটিতে বেড়াতে গেলাম বগুড়া। দেশের উত্তরের জনপদ বরাবরই আমার পছন্দ। মানুষ কম, হালকা বসতি। পথে বা হাটবাজারে ততটা ভিড়ভাট্টা নেই। বাজারে কম দামে টাটকা শাকসবজি মেলে। এসব কেনার চেয়ে দেখেই তুমুল আনন্দ পাই। নিঝুম গ্রামের ভেতর ফসলের মাঠে ছড়িয়ে থাকা বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি বেশ উপভোগ করি। যত দূর চোখ যায়Ñ গ্রামের পর গ্রাম। মুঠো মুঠো সবুজের ভেতর এঁকেবেঁকে ছুটে চলা মেঠো পথ মাড়িয়ে আমরা প্রতিদিন দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। দিনের মুহূর্তগুলো মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কতটা নিপুণভাবে ক্ষণে ক্ষণে বদলে যেতে পারে,Ñ এসব গ্রামে না এলে তা বোঝার উপায় নেই। কৃষিনির্ভর এই জনপদে প্রতিমুহূর্তের ব্যস্ততা যেন অনিবার্য নিয়তি।
বগুড়ার গ্রামীণ জনপদ ঘুরে, দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে মনে হলো যথেষ্ট নয়! চোখের তৃষ্ণা মেটেনি। মনের ক্ষুধাও যায়নি! তখনই মনে পড়ল নওগাঁর ঘুঘুডাঙ্গার বিখ্যাত তালসড়কটির কথা। এত কাছে এসে তালসড়কটি দেখতে যাব না, তা কি হয়? স্থানীয় সাংবাদিক আনোয়ার পারভেজ বললেন, ‘বগুড়া থেকে মাত্র ৩ ঘণ্টারই তো জার্নি। ঘুরে আসুন।’ আমারও মনে হলো, এমন একটি অসাধারণ দৃশ্যের জন্য এই দূরত্ব কিছুই না।
সকালে তুমুল বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার থেমেও গেল। গাড়িতে ওঠার সময় স্থলপদ্মের গাছটি চোখে পড়ল। গাছভর্তি ফুলগুলো বৃষ্টির দাপটে একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। অথচ বিকেলে ভেবে রেখেছিলাম, সকালে শরতের মধুর আলোয় স্থলপদ্মের ছবি তুলব। তা আর হলো না। দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে গেলাম নওগাঁর সাপাহারের কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানার বাগানে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যখন স্বপ্নমণ্ডিত সেই তালসড়কে পৌঁছাই, তখন ঠিক দুপুরবেলা।
কিন্তু দুপুর হলেও দর্শনার্থীদের পদচারণে মুখর তালসড়ক। শুধু বৃহত্তর রাজশাহী নয়, দূরদূরান্ত থেকেও পর্যটকেরা এখানে আসেন। নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নে এই তালসড়কের অবস্থান। মূলত ঘুঘুডাঙ্গা-শিবপুর সড়কের দুপাশজুড়ে থাকা বীথিবদ্ধ তালগাছের জন্যই সড়কটি ‘তালসড়ক’ বা ‘তালতলী’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। হাজীনগর গ্রামের মজুমদার মোড় থেকে ঘুঘুডাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার সড়কজুড়ে এই তালসড়কের অবস্থান।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন রাস্তা ও খালপাড়ে ৭২০ কিলোমিটারের বেশি জায়গাজুড়ে লাগানো হয়েছে কয়েক লাখ তালগাছ। তখন বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত নওগাঁর নিয়ামতপুর, পোরশা, পত্নীতলা ও ধামইরহাট, রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, রহনপুর উপজেলার রাস্তার দুপাশে রোপণ করা হয়েছে অনেক তালগাছ। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে অনেক গাছই হারিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে বেঁচে আছে কিছু। তবে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ঘুঘুডাঙ্গার এই গাছগুলো এখনো কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। বর্তমানে গাছগুলো ৫০ থেকে ৬০ ফুট উঁচু হওয়ায় রাস্তার দুপাশে শোভাবর্ধন করছে।
একসময় নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নের ঘুঘুডাঙা-শিবপুর সড়কটি ছিল একটি মেঠো পথ। ২০১২ সালের দিকে সড়কটি পাকা করা হয়। বর্তমানে তালসড়কের দুপাশে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ থাকায় সড়কটি বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
ভাদ্র মাসে তাল পাকার মৌসুমে তালসড়ক ঘিরে উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। নানা স্বাদের তালের পিঠা এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। তবে বেড়াতে আসা পর্যটকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য এখানে মানসম্পন্ন পর্যটনসেবা থাকা প্রয়োজন।
শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলই নয়, বৃহত্তর ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানেও প্রচুর পরিমাণে তালগাছ চোখে পড়ে। খেতের আলপথ, বাড়ির সীমানা, খালপাড়, পুকুরপাড় বা পথের ধারে এসব সুদৃশ্য তালগাছ প্রকৃতিতে ভিন্ন এক ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। দেশের বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে থাকা এসব তালগাছের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও আছে। দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দৃশ্যমান তালগাছের রস থেকে ভালো মানের সুস্বাদু গুড় ও মিছরি তৈরি করা হয়। বাজারে এসব গুড়-মিছরির চাহিদাও ব্যাপক। আমাদের দেশেও এসব গাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে তালের গুড় তৈরি করা সম্ভব। প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক