জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা গত বৃহস্পতিবার শেষ হলো। ২৩ দিন ধরে এই আলোচনা চলে। প্রথম পর্বের আলোচনা ছিল এর চেয়েও দীর্ঘ। প্রায় দুই মাস ধরে চলা এই আলোচনা নিয়ে দুটি কথা বলতে চাই। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, এত দিনকার বৈঠকে ১৯টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৯টি বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে।

প্রায় ছয় মাস আগে ৫টি বিষয়ে মোট ১৬৬টি ইস্যুতে প্রথম পর্বের সংলাপ শুরু হয়। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত ঐকমত্য কমিশন ইস্যুগুলো তৈরি করে। পুলিশ বিভাগেও সংস্কারের প্রশ্ন ছিল। তবে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় স্থান পায়নি।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বিভাগীয়ভাবেই সংস্কারের এ প্রক্রিয়া চলবে। অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে মোট ১৫টি বিষয়ের ওপর আলোচনা শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে কেবল অর্থনীতির ওপর যে টাস্কফোর্স করা হয়েছিল, তাদের প্রস্তাবনা ও নীতিগুলো সাধারণের উদ্দেশে প্রকাশিত হয়।

আরও পড়ুনঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মান–অভিমান ও সহমত–দ্বিমত২১ জুন ২০২৫

এ কথা সত্য, সংস্কার বলতে আমরা প্রধানত রাজনৈতিক সংস্কারকে বুঝেছিলাম বা বুঝিয়েছিলাম। ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে লড়াই করতে হয়েছিল গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য। পরপর তিনটি নির্বাচনকে পুরোপুরি গিলে খাওয়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে সমগ্র লড়াইয়ের দাবি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে।

কিন্তু কীভাবে সেই নির্বাচন সম্ভব? ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার তো ১৫ বছরে গণতন্ত্র ও নির্বাচনকে ‘বিবস্ত্র’ করে ফেলেছিল। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে যে প্রশাসন ও পুলিশ দরকার, তা তার জনমুখী চরিত্র সম্পূর্ণ হারিয়ে জনগণ ও গণতন্ত্রের শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। এখানেই এসেছিল সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা।

যেসব রাজনৈতিক দল এ লড়াই করেছিল, তারা মিলে সংস্কারের কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিল। আরেকটা কারণেও সংস্কারের কথা উঠেছিল। আন্দোলন করতে গিয়ে যখন নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল, রক্ত ঝরছিল, অকাতরে মানুষ রক্ত দিচ্ছিল, তখনো প্রশ্ন উঠেছিল, জনতার এই রক্তধারা তার সফল অভিধায় পৌঁছাতে পারবে তো? ’৫২ থেকে এযাবৎকাল এই ভূখণ্ডের মানুষ কম রক্ত তো দেয়নি। সেই আত্মত্যাগ–রক্তদান যথাযথ মর্যাদা পেয়েছিল?

১৫ বছরের ফ্যাসিবাদের রক্তাক্ত থাবা এখনো টিকে থাকা মানুষের বুকে তুষের আগুনের মতো জ্বলে। এ জন্যই সবাই এমন সংস্কার চেয়েছে, যাতে ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসতে না পারে। সে জন্য কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি বিশেষ কোনো অনুরাগ নয়, বরং গণতন্ত্র চালু রাখতে সংবিধানে বা দেশের প্রচলিত বিধানে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হয়ে থাকে, তবে তা বিলুপ্ত করে গণতান্ত্রিক বিধান চালুর দাবি উঠেছে।

এ ধরনের প্রশ্নের সরাসরি জবাব হয় না। প্রশ্নের পেছনে আবেগ যতখানি থাকে, তা দিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং তা থেকে এ প্রশ্নের জবাবে যে নীতি ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করা উচিত, তা করা সম্ভব হয় না। তবে বর্তমান সময়ের জন্য আমি বলব, বিশেষ করে তরুণেরা শেষের দিকে এসে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিল বলে এই প্রশ্নগুলো জীবন্ত ছিল।

এ কারণে প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে পাওয়া তথা এই মহান আত্মত্যাগকে তার যথাযথ অভিধায় নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন সব সময় সামনে ছিল। তবে আন্দোলনের বিজয় মানে সব সময় কেবল শত্রুপক্ষের পরাজয় নয়, বরং আন্দোলন যে লক্ষ্যে পরিচালিত হয়, তার সফল বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করে। আর এ জন্যই বিজয়ের পর কারা নেতৃত্ব তথা ক্ষমতা দখল করল, তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি, সম্ভবত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউই পটপরিবর্তনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের আগমনকে বিবেচনায় নেননি। যাঁরা আন্দোলন করেছিলেন বা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরাও শুরুতে এই পরিণতি সম্পর্কে সম্যকভাবে বুঝতে পারছিলেন না। ফলে শেষতক তারুণ্যের বুকে স্পন্দিত বিপ্লব ইউনূসের পরিপক্ব মস্তিষ্কপ্রসূত পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে মিলল না। এ নিয়েই এই বিশাল গণ–অভ্যুত্থানের কাঠামো গড়ে উঠল।

অতি সম্প্রতি গণ–অভ্যুত্থানের তরুণ নেতা নাহিদ ইসলাম (যিনি বর্তমানে নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির আহ্বায়ক) ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, তিনি বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে যে জাতীয় সরকার গঠন করার কথা বলেছিলেন, সেটি বিএনপি গ্রহণ করেনি। কার কথা ঠিক, সেই বিতর্কের মধ্যে যাচ্ছি না। তবে নাহিদ ইসলামের বক্তব্য অনুযায়ী, তাঁরা মনে করতেন, একটি জাতীয় সরকার করা দরকার। আর প্রধান দল বিএনপি সেই ধারণা গ্রহণ করেনি।

আরও পড়ুনঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মান–অভিমান ও সহমত–দ্বিমত২১ জুন ২০২৫

দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই মুহাম্মদ ইউনূস যে কাজের ওপর জোর দিয়েছেন, সেটি হলো সংস্কার। বিষয়টি মূল্যায়ন করার আগেই গোড়ার গলদটা বুঝতে হবে। নিশ্চিতভাবে সেই গলদ হয়েছে গত বছরের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহেই। যখন অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, তখন জাতীয় ঐক্য যে অবস্থায় বা যে অবস্থানেই থাকুক, অভ্যুত্থান প্রশ্নে আমরা সবাই একমত ছিলাম না এবং তা তো হতেই পারে।

যে রকম বলা হয়—বহুজন, বহুমত; সে রকম করেই প্রতিটি দলই চিন্তাচেতনায় একটা আরেকটা থেকে আলাদা। আর এমনিতে আমাদের সমাজ চিন্তাচেতনায়, রুচি–সংস্কৃতিতে বহুধা বিভাজিত। মুহাম্মদ ইউনূস বা তাঁর সরকারের কৃতিত্ব এই যে তিনি এ রকম একটি বিভাজিত সমাজে বিভিন্ন সামাজিক–রাজনৈতিক প্রশ্নে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার এক বিরাট যজ্ঞ শুরু করতে পেরেছিলেন। এ জন্য তাঁকে একক কৃতিত্ব দিচ্ছি না। সে রকম একটি পরিস্থিতিরই উদ্ভব হয়েছিল এবং অন্তর্বর্তী সরকার সেটাকে সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে।

আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা বলে, কোনো দল সংসদে দুই–তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে গেলে তার স্বৈরাচারী হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। আমাদের মতো এককেন্দ্রিক দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থার কথা এ জন্যই চালু হয়েছে, যাতে ওপরের কক্ষ নিম্নকক্ষকে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠায় বাধা দিতে পারে।

প্রথম আলোয় ১ আগস্ট প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, গুরুত্বপূর্ণ চারটি প্রতিষ্ঠানে বাছাই কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া, সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়নি। তবে এ দুটিসহ সাতটি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গত বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে অন্তত পাঁচটি সিদ্ধান্তে একাধিক দল ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) দিয়েছে।

গত ৩১ জুলাই শেষ দিনের আলোচনায় যে সাতটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়, সেগুলো হলো চার প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, উচ্চকক্ষ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা ও সংবিধানের মূলনীতি। মৌলিক কিছু বিষয়ে যে ঐকমত্য হয়নি, এ নিয়ে দুটি কথা বলা দরকার। ৫৪ বছরের বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চিত হওয়ারই সুযোগ পায়নি। প্রায়ই সে জায়গা দখল করেছে এক ব্যক্তি বা একদলীয় শাসন।

আরও পড়ুনরাজনৈতিক ঐকমত্য থাকলে সংবিধান কোনো বাধা নয়২৩ অক্টোবর ২০২৪

১৫ বছরের ফ্যাসিবাদের রক্তাক্ত থাবা এখনো টিকে থাকা মানুষের বুকে তুষের আগুনের মতো জ্বলে। এ জন্যই সবাই এমন সংস্কার চেয়েছে, যাতে ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসতে না পারে। সে জন্য কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি বিশেষ কোনো অনুরাগ নয়, বরং গণতন্ত্র চালু রাখতে সংবিধানে বা দেশের প্রচলিত বিধানে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হয়ে থাকে, তবে তা বিলুপ্ত করে গণতান্ত্রিক বিধান চালুর দাবি উঠেছে।

আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা বলে, কোনো দল সংসদে দুই–তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে গেলে তার স্বৈরাচারী হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। আমাদের মতো এককেন্দ্রিক দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থার কথা এ জন্যই চালু হয়েছে, যাতে ওপরের কক্ষ নিম্নকক্ষকে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠায় বাধা দিতে পারে।

সংখ্যানুপাতিক ভোট নিয়ে যে বিতর্ক, তাতে কমিশন এই সিদ্ধান্ত দিয়েছে, নিচের কক্ষের ভোট আগের মতোই হবে, কিন্তু ওপরের কক্ষে ১০০টি আসনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত অনুযায়ী দলগুলোর মধ্যে বণ্টন করা হবে। বিএনপির প্রস্তাব, নিচে যেভাবে ভোট হবে, যে অনুপাতে আসনে জিতবে, সেই অনুপাতে ওপরের কক্ষেও আসন বরাদ্দ করা হোক। কিন্তু তাহলে সেটা নিচের কক্ষের রেপ্লিকা হয়ে যায়। এ জন্যই ওপরের কক্ষে সংখ্যানুপাতিক আসন বরাদ্দ করা যুক্তিসংগত হবে বলে মনে করি।

এবার ঐকমত্য কমিশনের এই বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলো মতপার্থক্য করেছে। কিন্তু তারপরও ২৩ দিনের আলোচনা শেষ পর্যন্ত কোনো রকম বড় মন–কষাকষি ছাড়াই সমাপ্ত হয়েছে। কমিশন নোট অব ডিসেন্টের প্রভিশন রেখে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। কোনো মত চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। ভবিষ্যতে গণতন্ত্র বা সংসদীয় পদ্ধতিতে বিতর্কের মাধ্যমেও সেই মতপার্থক্যের নিষ্পত্তি হতে পারে।

এ জন্য ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ দিই। বিশেষ করে ধন্যবাদ দিই কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজকে। তিনি যেভাবে এত দিন ধরে সভা পরিচালনা করেছেন, যেভাবে ভিন্নমতের নির্যাস নিয়ে সেটাকে ঐকমত্যের দিকে নিয়ে গেছেন, সেটা অনন্য। হয়তো আরও ভালো কিছু করা যেতে পারত, কিন্তু বাস্তবতার কারণে তা পারা যায়নি। অতএব, সো ফার সো গুড।

মাহমুদুর রহমান মান্না সভাপতি, নাগরিক ঐক্য

*মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণতন ত র এ জন য আম দ র ত র জন ত হয় ছ হয় ছ ল কর ছ ল প রস ত অন য য় প রথম র ওপর বছর র ক ষমত সরক র ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

নারী আসন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ

জাতীয় সংসদে নারী আসন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নারী অধিকারকর্মীরা। কমিশনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে তাঁরা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের কোনো সুপারিশ জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গ্রহণ করেনি। নারী অধিকারকর্মীদের দেওয়া প্রস্তাবও উপেক্ষা করা হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় নারী অধিকারের বিষয়টি সবচেয়ে কম গুরুত্ব পেয়েছে।

‘নারীকে বাদ দিয়ে নারীর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় নারী অধিকারকর্মীরা এ কথাগুলো বলেন। আজ শনিবার রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে ‘গণসাক্ষরতা অভিযান ও সকল সহযোগী সংগঠন’–এর ব্যানারে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।

সভায় বক্তারা বলেন, নারী অধিকারকর্মী ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা বাড়িয়ে সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচন করার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন এই সুপারিশ গ্রহণ করেনি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী নারী হলেও ঐকমত্য কমিশনে নারীর কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। কমিশন নারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। তারা শুধু রাজনৈতিক দলের কথায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

প্রসঙ্গত, সংসদে নারীদের জন্য আসন বাড়িয়ে ১০০ করে সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছিল নারীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন সংসদের আসন বাড়িয়ে ৬০০ করে ৩০০টি আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রেখে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছিল। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার পর গত বৃহস্পতিবার ঐকমত্য কমিশন জানায়, বেশির ভাগ দল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (আপত্তি) জানিয়েছে। তাই সংরক্ষিত নারী আসন সংখ্যা ৫০ রাখা এবং তাতে নারী সদস্যদের মনোনীত করার আগের পদ্ধতি বহাল রাখে কমিশন।

সভায় সূচনা বক্তব্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনে নারী প্রতিনিধি কোথায়? ঐকমত্য কমিশনে যাঁরা আছেন, তাঁরা কি নারীবিদ্বেষী ধরে নেব? তাঁরা নারীর পক্ষে কাজ করবেন, বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করবেন, সেটা ভেবে সহ্য করেছি। ধৈর্য ধরে দেখতে চেয়েছি কী সিদ্ধান্ত আসে। তাঁরা আমাদের শুধু হতাশই করেননি, আমরা একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৫১ শতাংশ নারী। আমরা কথা বলব। আমাদের, নারীদের কথা শুনতে হবে।’

সভায় সম্মানিত অতিথি ছিলেন নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক। কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশ জমা দেওয়ার পর এ নিয়ে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ও কমিশনের সদস্যদের নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্যের প্রসঙ্গ টানেন তিনি। বলেন, তাঁরা আলোচনা–সমালোচনা, তর্ক–বিতর্ককে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কারণ, বাক্স্বাধীনতা সবার আছে। তাই বলে গালিগালাজ করার স্বাধীনতা কারও নেই।

শিরীন পারভিন হক বলেন, জাতীয় সংসদে এখন সমান হিস্যা চাওয়ার সময় এসেছে। এক–তৃতীয়াংশ আসন দিয়ে আর হবে না। আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৬০০ করে অন্তত পরবর্তী দুই মেয়াদে নারীদের জন্য ৩০০ সংরক্ষিত আসন রেখে সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।

গত এপ্রিলে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় উল্লেখ করে সংস্কার কমিশনের সদস্য মাহীন সুলতান বলেন, তখন তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছিলেন, সুপারিশগুলো আমলে নেওয়ার জন্য ঐকমত্য কমিশনকে পাঠাবেন। পরে শোনা গেল, ঐকমত্য কমিশনের টার্মস অব রেফারেন্স (কাজের পরিধি বা টর) নির্ধারিত। ওই টরের মধ্যে তাঁরা নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন না। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় নারী অধিকার বিষয়টি সবচেয়ে কম গুরুত্ব পেয়েছে। ভোটার হিসেবে নারীদের মূল্যায়ন করা হয়নি।

ঐকমত্য কমিশন যেসব দলের সঙ্গে আলোচনা করেছে, সেসব দল নারীর প্রতিনিধিত্ব করে কি না, সে প্রশ্ন তোলেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন–এর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। তিনি বলেন, ‘অনেক দলকে আমরা চিনি না। তারা কাদের প্রতিনিধিত্ব করে, তা আমরা জানি না। তবে এটা জানি যে তারা অন্তত নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে না। এত ভালো ভালো সুপারিশ করেছিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন, কিন্তু সেসব সুপারিশ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে। তাহলে কি তাঁর কথার মূল্য নেই?’

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, দেশে এখন নারীবিরোধী ‘জাগরণ’ দেখা যাচ্ছে। নারীর পোশাক নিয়ে কথা হয়। ‘মব সন্ত্রাসে’র (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ আক্রমণ) মাধ্যমে নারীকে অপদস্থ করা হয়। নারী আসন নিয়ে নারীদের সুপারিশই মানা হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই অবস্থায় নারীরা ঐকমত্য কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করছে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পরে নারীবিরোধী যে অবস্থানকে লালন করা হচ্ছে, সেটা বন্ধ করতে হবে।’

সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের দাবি জানান বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। তিনি বলেন, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানপরবর্তী নতুন বন্দোবস্তের দায়িত্ব যাঁরা নিয়েছিলেন, তাঁদের চিন্তাচেতনা ও মানসপটে নারী অনুপস্থিত।

নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশি কবীর বলেন, সরকার কমিশনগুলো গঠন করেছে অলংকার হিসেবে। ঐকমত্য কমিশন যেসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেছে, তাদের কারা নির্বাচিত করেছে ও তাদের আদর্শ কী, সে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, পরিবর্তনের জন্য সবাই জুলাইয়ে পথে নেমেছিল। মুষ্টিমেয় চলে এসেছে সামনে। বাকিরা সংগঠিত হয়নি। তাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি মঞ্চের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে যেতে হবে।

নারীপক্ষ-এর সভানেত্রী গীতা দাস বলেন, যেটুকু সামনে এগিয়েছিল নারী, তা থেকে শতভাগ পেছনে নিয়ে যাচ্ছে ঐকমত্য কমিশন। নারীদের বাদ দিয়ে সংস্কার হলে আগামী নির্বাচনে নারীরা ভোট দেবেন না।

ঐকমত্য কমিশনের কাছে কিছু দাবি সভায় তুলে ধরেন গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। দাবিগুলো দু-এক দিনের মধ্যে ঐকমত্য কমিশনে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সভায় আরও বক্তব্য দেন নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ফেরদৌসী সুলতানা, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শরমিন্দ নিলোর্মি, সিএসও অ্যালায়েন্সের প্রতিনিধি সাঈদ আহমেদ, ক্যাথলিক এডুকেশন বোর্ডের সেক্রেটারি জ্যোতি এফ গমেজ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপপরিচালক নাসরিন বেগম, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ‘জুলাই কন্যা’ শাহ্‌জাদী ফানান্না, ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্সের শিক্ষার্থী ‘জুলাই কন্যা’ সামান্তা করিম ও গৃহশ্রমিক কোহিনূর আক্তার। স্বাগত বক্তব্য দেন গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক তপন কুমার দাশ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে আবার আলোচনা
  • কথিত গণতন্ত্র থাকলেও আমরা বাকস্বাধীনতা হারিয়েছিলাম: তথ‌্য স‌চিব
  • সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলবে ঐকমত্য কমিশন
  • ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ ঠেকাতে অবশ্য সচেতন থাকতে হবে
  • ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নে গতি আনতে চায় কমিশন
  • রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র আর বেশিদিন টিকবে না
  • ঐকমত্য হয়েছে বেশ কিছু মৌলিক সংস্কারে
  • নারী আসন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ
  • হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অধ্যাপক ইউনূস একটি কথাও বলেননি: মেজর (অব.) হাফিজ