ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ: সো ফার সো গুড
Published: 4th, August 2025 GMT
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা গত বৃহস্পতিবার শেষ হলো। ২৩ দিন ধরে এই আলোচনা চলে। প্রথম পর্বের আলোচনা ছিল এর চেয়েও দীর্ঘ। প্রায় দুই মাস ধরে চলা এই আলোচনা নিয়ে দুটি কথা বলতে চাই। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, এত দিনকার বৈঠকে ১৯টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৯টি বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে।
প্রায় ছয় মাস আগে ৫টি বিষয়ে মোট ১৬৬টি ইস্যুতে প্রথম পর্বের সংলাপ শুরু হয়। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত ঐকমত্য কমিশন ইস্যুগুলো তৈরি করে। পুলিশ বিভাগেও সংস্কারের প্রশ্ন ছিল। তবে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় স্থান পায়নি।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বিভাগীয়ভাবেই সংস্কারের এ প্রক্রিয়া চলবে। অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে মোট ১৫টি বিষয়ের ওপর আলোচনা শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে কেবল অর্থনীতির ওপর যে টাস্কফোর্স করা হয়েছিল, তাদের প্রস্তাবনা ও নীতিগুলো সাধারণের উদ্দেশে প্রকাশিত হয়।
আরও পড়ুনঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মান–অভিমান ও সহমত–দ্বিমত২১ জুন ২০২৫এ কথা সত্য, সংস্কার বলতে আমরা প্রধানত রাজনৈতিক সংস্কারকে বুঝেছিলাম বা বুঝিয়েছিলাম। ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে লড়াই করতে হয়েছিল গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য। পরপর তিনটি নির্বাচনকে পুরোপুরি গিলে খাওয়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে সমগ্র লড়াইয়ের দাবি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে।
কিন্তু কীভাবে সেই নির্বাচন সম্ভব? ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার তো ১৫ বছরে গণতন্ত্র ও নির্বাচনকে ‘বিবস্ত্র’ করে ফেলেছিল। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে যে প্রশাসন ও পুলিশ দরকার, তা তার জনমুখী চরিত্র সম্পূর্ণ হারিয়ে জনগণ ও গণতন্ত্রের শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। এখানেই এসেছিল সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা।
যেসব রাজনৈতিক দল এ লড়াই করেছিল, তারা মিলে সংস্কারের কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিল। আরেকটা কারণেও সংস্কারের কথা উঠেছিল। আন্দোলন করতে গিয়ে যখন নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল, রক্ত ঝরছিল, অকাতরে মানুষ রক্ত দিচ্ছিল, তখনো প্রশ্ন উঠেছিল, জনতার এই রক্তধারা তার সফল অভিধায় পৌঁছাতে পারবে তো? ’৫২ থেকে এযাবৎকাল এই ভূখণ্ডের মানুষ কম রক্ত তো দেয়নি। সেই আত্মত্যাগ–রক্তদান যথাযথ মর্যাদা পেয়েছিল?
১৫ বছরের ফ্যাসিবাদের রক্তাক্ত থাবা এখনো টিকে থাকা মানুষের বুকে তুষের আগুনের মতো জ্বলে। এ জন্যই সবাই এমন সংস্কার চেয়েছে, যাতে ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসতে না পারে। সে জন্য কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি বিশেষ কোনো অনুরাগ নয়, বরং গণতন্ত্র চালু রাখতে সংবিধানে বা দেশের প্রচলিত বিধানে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হয়ে থাকে, তবে তা বিলুপ্ত করে গণতান্ত্রিক বিধান চালুর দাবি উঠেছে।এ ধরনের প্রশ্নের সরাসরি জবাব হয় না। প্রশ্নের পেছনে আবেগ যতখানি থাকে, তা দিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং তা থেকে এ প্রশ্নের জবাবে যে নীতি ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করা উচিত, তা করা সম্ভব হয় না। তবে বর্তমান সময়ের জন্য আমি বলব, বিশেষ করে তরুণেরা শেষের দিকে এসে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিল বলে এই প্রশ্নগুলো জীবন্ত ছিল।
এ কারণে প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে পাওয়া তথা এই মহান আত্মত্যাগকে তার যথাযথ অভিধায় নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন সব সময় সামনে ছিল। তবে আন্দোলনের বিজয় মানে সব সময় কেবল শত্রুপক্ষের পরাজয় নয়, বরং আন্দোলন যে লক্ষ্যে পরিচালিত হয়, তার সফল বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করে। আর এ জন্যই বিজয়ের পর কারা নেতৃত্ব তথা ক্ষমতা দখল করল, তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি, সম্ভবত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউই পটপরিবর্তনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের আগমনকে বিবেচনায় নেননি। যাঁরা আন্দোলন করেছিলেন বা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরাও শুরুতে এই পরিণতি সম্পর্কে সম্যকভাবে বুঝতে পারছিলেন না। ফলে শেষতক তারুণ্যের বুকে স্পন্দিত বিপ্লব ইউনূসের পরিপক্ব মস্তিষ্কপ্রসূত পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে মিলল না। এ নিয়েই এই বিশাল গণ–অভ্যুত্থানের কাঠামো গড়ে উঠল।
অতি সম্প্রতি গণ–অভ্যুত্থানের তরুণ নেতা নাহিদ ইসলাম (যিনি বর্তমানে নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির আহ্বায়ক) ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, তিনি বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে যে জাতীয় সরকার গঠন করার কথা বলেছিলেন, সেটি বিএনপি গ্রহণ করেনি। কার কথা ঠিক, সেই বিতর্কের মধ্যে যাচ্ছি না। তবে নাহিদ ইসলামের বক্তব্য অনুযায়ী, তাঁরা মনে করতেন, একটি জাতীয় সরকার করা দরকার। আর প্রধান দল বিএনপি সেই ধারণা গ্রহণ করেনি।
আরও পড়ুনঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মান–অভিমান ও সহমত–দ্বিমত২১ জুন ২০২৫দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই মুহাম্মদ ইউনূস যে কাজের ওপর জোর দিয়েছেন, সেটি হলো সংস্কার। বিষয়টি মূল্যায়ন করার আগেই গোড়ার গলদটা বুঝতে হবে। নিশ্চিতভাবে সেই গলদ হয়েছে গত বছরের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহেই। যখন অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, তখন জাতীয় ঐক্য যে অবস্থায় বা যে অবস্থানেই থাকুক, অভ্যুত্থান প্রশ্নে আমরা সবাই একমত ছিলাম না এবং তা তো হতেই পারে।
যে রকম বলা হয়—বহুজন, বহুমত; সে রকম করেই প্রতিটি দলই চিন্তাচেতনায় একটা আরেকটা থেকে আলাদা। আর এমনিতে আমাদের সমাজ চিন্তাচেতনায়, রুচি–সংস্কৃতিতে বহুধা বিভাজিত। মুহাম্মদ ইউনূস বা তাঁর সরকারের কৃতিত্ব এই যে তিনি এ রকম একটি বিভাজিত সমাজে বিভিন্ন সামাজিক–রাজনৈতিক প্রশ্নে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার এক বিরাট যজ্ঞ শুরু করতে পেরেছিলেন। এ জন্য তাঁকে একক কৃতিত্ব দিচ্ছি না। সে রকম একটি পরিস্থিতিরই উদ্ভব হয়েছিল এবং অন্তর্বর্তী সরকার সেটাকে সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে।
আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা বলে, কোনো দল সংসদে দুই–তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে গেলে তার স্বৈরাচারী হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। আমাদের মতো এককেন্দ্রিক দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থার কথা এ জন্যই চালু হয়েছে, যাতে ওপরের কক্ষ নিম্নকক্ষকে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠায় বাধা দিতে পারে।প্রথম আলোয় ১ আগস্ট প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, গুরুত্বপূর্ণ চারটি প্রতিষ্ঠানে বাছাই কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া, সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়নি। তবে এ দুটিসহ সাতটি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গত বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে অন্তত পাঁচটি সিদ্ধান্তে একাধিক দল ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) দিয়েছে।
গত ৩১ জুলাই শেষ দিনের আলোচনায় যে সাতটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়, সেগুলো হলো চার প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, উচ্চকক্ষ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা ও সংবিধানের মূলনীতি। মৌলিক কিছু বিষয়ে যে ঐকমত্য হয়নি, এ নিয়ে দুটি কথা বলা দরকার। ৫৪ বছরের বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চিত হওয়ারই সুযোগ পায়নি। প্রায়ই সে জায়গা দখল করেছে এক ব্যক্তি বা একদলীয় শাসন।
আরও পড়ুনরাজনৈতিক ঐকমত্য থাকলে সংবিধান কোনো বাধা নয়২৩ অক্টোবর ২০২৪১৫ বছরের ফ্যাসিবাদের রক্তাক্ত থাবা এখনো টিকে থাকা মানুষের বুকে তুষের আগুনের মতো জ্বলে। এ জন্যই সবাই এমন সংস্কার চেয়েছে, যাতে ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসতে না পারে। সে জন্য কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি বিশেষ কোনো অনুরাগ নয়, বরং গণতন্ত্র চালু রাখতে সংবিধানে বা দেশের প্রচলিত বিধানে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হয়ে থাকে, তবে তা বিলুপ্ত করে গণতান্ত্রিক বিধান চালুর দাবি উঠেছে।
আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা বলে, কোনো দল সংসদে দুই–তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে গেলে তার স্বৈরাচারী হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। আমাদের মতো এককেন্দ্রিক দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থার কথা এ জন্যই চালু হয়েছে, যাতে ওপরের কক্ষ নিম্নকক্ষকে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠায় বাধা দিতে পারে।
সংখ্যানুপাতিক ভোট নিয়ে যে বিতর্ক, তাতে কমিশন এই সিদ্ধান্ত দিয়েছে, নিচের কক্ষের ভোট আগের মতোই হবে, কিন্তু ওপরের কক্ষে ১০০টি আসনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত অনুযায়ী দলগুলোর মধ্যে বণ্টন করা হবে। বিএনপির প্রস্তাব, নিচে যেভাবে ভোট হবে, যে অনুপাতে আসনে জিতবে, সেই অনুপাতে ওপরের কক্ষেও আসন বরাদ্দ করা হোক। কিন্তু তাহলে সেটা নিচের কক্ষের রেপ্লিকা হয়ে যায়। এ জন্যই ওপরের কক্ষে সংখ্যানুপাতিক আসন বরাদ্দ করা যুক্তিসংগত হবে বলে মনে করি।
এবার ঐকমত্য কমিশনের এই বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলো মতপার্থক্য করেছে। কিন্তু তারপরও ২৩ দিনের আলোচনা শেষ পর্যন্ত কোনো রকম বড় মন–কষাকষি ছাড়াই সমাপ্ত হয়েছে। কমিশন নোট অব ডিসেন্টের প্রভিশন রেখে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। কোনো মত চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। ভবিষ্যতে গণতন্ত্র বা সংসদীয় পদ্ধতিতে বিতর্কের মাধ্যমেও সেই মতপার্থক্যের নিষ্পত্তি হতে পারে।
এ জন্য ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ দিই। বিশেষ করে ধন্যবাদ দিই কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজকে। তিনি যেভাবে এত দিন ধরে সভা পরিচালনা করেছেন, যেভাবে ভিন্নমতের নির্যাস নিয়ে সেটাকে ঐকমত্যের দিকে নিয়ে গেছেন, সেটা অনন্য। হয়তো আরও ভালো কিছু করা যেতে পারত, কিন্তু বাস্তবতার কারণে তা পারা যায়নি। অতএব, সো ফার সো গুড।
মাহমুদুর রহমান মান্না সভাপতি, নাগরিক ঐক্য
*মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণতন ত র এ জন য আম দ র ত র জন ত হয় ছ হয় ছ ল কর ছ ল প রস ত অন য য় প রথম র ওপর বছর র ক ষমত সরক র ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কেন এমন দুর্বোধ্য পথ
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ রাজনীতিতে অনৈক্য ও বিভক্তি বাড়িয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের সুপারিশ নিয়ে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক সামনে এসেছে। সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে ইচ্ছাকৃতভাবে একটি জটিল পথ বেছে নেওয়া হয়েছে কি না, সে প্রশ্নও এসেছে।
৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর জুলাই সনদ প্রণয়ন এবং অধিকাংশ দলের স্বাক্ষর সত্ত্বেও কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নতুন বিতর্ক উসকে দিয়েছে। গত ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত সনদের সঙ্গে বাস্তবায়নের সুপারিশের অসামঞ্জস্য লক্ষণীয়।
ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য দুটি বিকল্প প্রস্তাব সুপারিশ করেছে। দুটোই গণভোট-নির্ভর। প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গণভোটে ভোটারদের জিজ্ঞাসা করা হবে, তাঁরা কি ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) আদেশ ২০২৫’ এবং এর প্রথম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত সংবিধান সংস্কারের খসড়া বিল অনুমোদন করেন? আর দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ভোটারদের জিজ্ঞাসা করা হবে, তাঁরা কি ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) আদেশ ২০২৫’ এবং এর প্রথম তফসিলে উল্লেখিত প্রস্তাবসমূহ অনুমোদন করেন?
একটিতে প্রস্তাব, অন্যটিতে বিল অনুমোদনের প্রশ্ন। প্রথম প্রস্তাব অনুযায়ী, সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সাংবিধানিক সংস্কারের কাজ শেষ করতে না পারলে প্রদত্ত বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে। তবে দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ করা হবে। না হলে কী হবে, তা উল্লেখ নেই।
জুলাই সনদে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) উল্লেখ থাকলেও ঐকমত্য কমিশন দুটি প্রস্তাবেই নোট অব ডিসেন্ট না রাখার সুপারিশ করেছে। জুলাই সনদে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব আছে। ৬১টিতে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাবের একাধিক ধাপ থাকায় বিভিন্ন ধাপসহ নোট অব ডিসেন্টের সংখ্যা শতাধিক।
দুর্বোধ্য, জটিল পথ
ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত দুটি বিকল্পই নানামুখী জটিলতার জন্ম দিতে সক্ষম। কমিশনের সুপারিশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যেমন নোট অব ডিসেন্ট পুনর্বিবেচনা করা যাবে কি না? উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিষয়টিও কি পুনর্বিবেচনার সুযোগ থাকবে? গণভোট যদি প্রত্যাখ্যাত হয়, তাহলে কী হবে? অস্পষ্টতা এবং জটিল প্রক্রিয়া রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দিতে পারে।
সুপারিশকৃত স্বয়ংক্রিয় সাংবিধানিক সংশোধনী ব্যবস্থাটি একটি মারাত্মক হুমকি। বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই সংবিধান সংশোধনের জন্য এমন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা নেই। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, কানাডা, জার্মানিসহ সব স্থিতিশীল গণতন্ত্রে সংবিধান সংশোধনে সংসদ বা কংগ্রেসের স্পষ্ট ভোট ও সমর্থন আবশ্যক। সুপারিশটি গৃহীত হলে বিপজ্জনক নজির স্থাপন করবে। এই বিধান সংসদীয় সার্বভৌমত্বের মৃত্যু ঘটাবে। এই প্রস্তাব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি অবহেলারও বহিঃপ্রকাশ। এটি একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া। গুণগত মানের চেয়ে সময়সীমা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। সংসদ সদস্যরা সময়ের চাপে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয়ে যথাযথ বিবেচনা না করেই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবেন। ধরা যাক, সংসদ সদস্যরা খসড়া বিলের কিছু ধারা নিয়ে গভীরভাবে দ্বিমত পোষণ করছেন এবং তা সমাধান না করেই ২৭০ দিন পার হয়ে গেল।
সে ক্ষেত্রে একটি অগ্রহণযোগ্য ও অসম্পূর্ণ খসড়া বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। এই বিধান গুরুতর সাংবিধানিক সংকট ও রাষ্ট্রযন্ত্রে অচলাবস্থাও সৃষ্টি করতে পারে। কোনো খসড়া বিল ‘স্বয়ংক্রিয়ভাবে’ সংবিধানে রূপ নিলে, প্রশ্ন উঠবে—এ প্রক্রিয়া নিজেই কি সংবিধানসম্মত? আদালতকে বলা হবে, সংবিধান পরিবর্তনের নিয়ম এভাবে পাশ কাটানো যায় কি না। ফলে একের পর এক রিট, স্থগিতাদেশ ও মামলার জট তৈরি হতে পারে। আদেশ সংবিধানের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে রাষ্ট্র পরিচালনাও স্থবির হয়ে পড়বে। স্বয়ংক্রিয় বিধান কার্যকর হলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এর জন্য দায়ী থাকবে না।
সংসদ বলবে, ‘সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হয়নি, বিল নিজে থেকেই কার্যকর হয়েছে।’ সরকার বলবে, ‘এটি আইন অনুযায়ী হয়েছে।’ সুশাসনের পরিপন্থী এই গলদ কাঠামোর জন্য কেউ জবাবদিহি করবে না।
১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালের গণভোটের জনসাধারণের বোধগম্য ও সরল প্রশ্নের তুলনায় প্রস্তাবিত প্রশ্ন দুটি অত্যন্ত জটিল। উভয় বিকল্পতেই গণভোটে ৪৮টি সাংবিধানিক ইস্যুর একটি প্যাকেজের অনুমোদন চাওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি পুনর্বিবেচনা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠন এবং বিরোধী দলকে শক্তিশালীকরণের মতো মৌলিক পরিবর্তন অন্তর্ভুক্ত। সব নাগরিককে বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয়, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছরে সীমাবদ্ধ এবং প্রধানমন্ত্রীকে দলীয় প্রধান পদে একই সঙ্গে রাখা নিষিদ্ধ করার মতো প্রস্তাবও এতে রয়েছে।
এই গুচ্ছকরণের ফলে ভোটারকে পুরো প্যাকেজটিকে সম্মতি দান বা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। যদি কেউ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাব সমর্থন করেন, কিন্তু অন্যগুলোর বিরোধিতা করেন, তাহলে তাঁর পক্ষে স্পষ্ট ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেওয়া দুরূহ।
১৯৯১ সালের গণভোট ঐকমত্যের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার সাংবিধানিক সংস্কার বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মাত্র ৩৫ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি ছিল। সুপারিশকৃত গণভোটের প্রশ্নের ভাষা ভোটারদের কম উপস্থিতির কিংবা বিভ্রান্তির বা ভুল সিদ্ধান্তের কারণ হতে পারে।
নোট অব ডিসেন্টের বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী হবে—এ প্রশ্ন আরও জটিলতা তৈরি করেছে। কমিশনের দুটি সুপারিশেই নোট অব ডিসেন্ট অন্তর্ভুক্ত করেনি। উভয় প্রস্তাবই আগামী সংসদকে সংবিধান পরিবর্তনের জন্য সরল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছে। সংবিধান সংশোধনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিধানে ছাড় দেওয়া হয়েছে। ফলে সরল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া দল নিজের ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করার সুযোগ পাবে।
গণভোট কবে হবে এবং আদেশ কে জারি করবে, এ সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে বলেছে কমিশন।
গণতান্ত্রিকতার মাধ্যমে সহজ সমাধান
কমিশনের সুপারিশকৃত দুর্বোধ্য গলিপথ থেকে বেরিয়ে সরল, স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করা যেতে পারে। সামনের দিকে অগ্রসর হতে হলে অন্তর্বর্তী সরকারের সাহস, সততা ও ক্ষমতা হস্তান্তরের সদিচ্ছা প্রদর্শন জরুরি।
এ ক্ষেত্রে সম্মতির বিষয়বস্তু নিয়ে সরল গণভোট ও আপত্তির বিষয়গুলো সংসদে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির সমন্বিত পদ্ধতি কার্যকর সমাধান হতে পারে। অর্থাৎ জনগণ গণভোটের মাধ্যমে গাঠনিক ক্ষমতা (কনস্টিটুয়েন্ট পাওয়ার) বা সংবিধান তৈরি বা পুনর্গঠন করার অধিকার প্রদান করবে। ‘বেসিক স্ট্রাকচার’ ডকট্রিনের প্রয়োজনীয়তা প্রতিপালিত হবে।
জটিলতা সৃষ্টি করে সময় নষ্ট করার অর্থ হলো অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকে আরও গভীরতর করা। সহজ, সরল ও গণতান্ত্রিক পন্থাই জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী জনমানুষের আকাঙ্ক্ষার ঐক্যের বাংলাদেশ নিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ।
টালবাহানা নয়, সাংবিধানিক সংস্কারের নিমিত্তে গাঠনিক ক্ষমতার প্রয়োগের জন্য গণভোট ও নির্বাচনই সহজ পথ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ ঘোষিত সময় অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারপারসন, উন্নয়ন অন্বেষণ।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)