ফিলিস্তিনিদের হাতের মুঠোয় আনতেই কি স্বীকৃতির কথা সামনে আনা হচ্ছে
Published: 4th, August 2025 GMT
গত সপ্তাহে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ফিলিস্তিন প্রশ্নে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গাজায় অব্যাহত যুদ্ধ বন্ধ করার স্বার্থে হামাসকে সরে যেতে হবে। শুধু নিরস্ত্র করাই যথেষ্ট নয়, তাদের গাজার শাসনভার থেকেও পুরোপুরি বিযুক্ত করতে হবে।
হামাসের জায়গায় অঞ্চলটির শাসনভার গ্রহণ করবে মাহমুদ আব্বাসের ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটি, সংক্ষেপে পিএ)। তবে তিনি একা নন, তাঁকে এই কাজে সাহায্য করবে একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনী। প্রশাসনিক কাজে সাহায্য করতেও বিদেশি, মুখ্যত আরব, বিশেষজ্ঞেরা যোগ দেবেন।
প্রস্তাবটি খুব নতুন, তা নয়। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রধান মাহমুদ আব্বাস নিজেও মাত্র দুই সপ্তাহ আগে গাজা থেকে হামাসের সশস্ত্র সদস্যদের সরে যাওয়ার দাবি করেছেন। তবে প্রথমবারের মতো সৌদি আরব ও কাতারের মতো আরব দেশ, যাদের অর্থে হামাস টিকে আছে, তারা নিরস্ত্র করার পাশাপাশি গাজার শাসনব্যবস্থা থেকে হামাসকে সরে যাওয়ার দাবি তুলল। আর কিছু না হোক, এই দুই দেশের সমর্থনের কারণে প্রস্তাবটি এখন নানা মহলে আলোচিত হচ্ছে।
প্রায় দুই বছর হতে চলল গাজায় নির্বিচার গণহত্যা চলছে। সেখানে মৃতের সংখ্যা ৬০ হাজার ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে শিশুদের সংখ্যাই ১৮ হাজার ৫০০। এত দিন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র এই সংখ্যা সঠিক নয় বলে নানা সাফাই গেয়ে এসেছে।
জাতিসংঘ সম্মেলনের সঙ্গে মিল রেখে চলতি সপ্তাহেই ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা গাজায় নিহত সব শিশুর নাম প্রকাশ করেছে। অনেকের ছবি ও মৃত্যুর কাহিনিও তুলে ধরেছে। ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ। ফিলিস্তিন প্রশ্নে অধিকাংশ মার্কিন তথ্যমাধ্যমে ইসরায়েল নাখোশ হয়, এমন কথা বলা হয় না। গাজায় কোনো গণহত্যা চলছে না, এ কথাও তারা নানাভাবে জানান দিয়েছে। সেখানে এমন খোলামেলাভাবে গণহত্যার সবচেয়ে নির্মম দিকটির এই সচিত্র পরিবেশনা বিস্ময়কর, তবে এর পেছনে যে গাজায় ইসরায়েলি হামলা প্রশ্নে মার্কিন নাগরিকদের পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব রয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুনগাজা যে কারণে একুশ শতকের প্রাণঘাতী যুদ্ধ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪গ্যালপের গৃহীত সর্বশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ৩২ শতাংশ মানুষ গাজায় ইসরায়েলি ভূমিকা সমর্থন করে, যা গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৪২ শতাংশ কম। একই জরিপ অনুসারে, ৬০ শতাংশ মার্কিন ফিলিস্তিনের ব্যাপারে ইসরায়েলের চলতি নীতি সমর্থন করে না। এই মনোভাব পশ্চিম ইউরোপসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সঙ্গে তুলনীয়। পিউ রিসার্চ জানিয়েছে, বর্তমানে ইসরায়েলের ভূমিকা সমর্থন করে না, এমন পশ্চিম ইউরোপীয়দের সংখ্যা ৬২ শতাংশ।
গাজায় গণহত্যা বন্ধের পক্ষে সারা বিশ্বে জোরদার সমর্থন থাকলেও অবস্থার আদৌ কোনো পরিবর্তন হয়নি, তার একটি প্রধান কারণ ইসরায়েলের সমর্থনে মার্কিন প্রশাসনের অনড় অবস্থান। ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজায় সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর প্রতি অসন্তুষ্ট, এমন একটি গল্প এ দেশের গণমাধ্যমে আজকাল শোনা যাচ্ছে। কিন্তু মুখে যতই সমালোচনা হোক, ইসরায়েলের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়, এমন কাজ কোনো মার্কিন প্রশাসন কখনোই করবে না, এটা স্বতঃসিদ্ধ।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের আশায় ডোনাল্ড ট্রাম্প মনগড়া শান্তি প্রস্তাব করতে পারেন বটে, কিন্তু ইসরায়েলে আমেরিকার অর্থ বা অস্ত্র প্রেরণ কোনোটাই বন্ধ হবে না। গত মাসে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন বোমাবর্ষণ থেকেও স্পষ্ট—এই দুই দেশ একে অপরের কোমর কত শক্তভাবে জড়িয়ে আছে।
প্রস্তাবটিতে হামাসকে নিরস্ত্র করার কথা বলা হলেও ইসরায়েলকে একই ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো শর্ত রাখা হয়নি। মিসরীয় ভাষ্যকার আমর আবদেলরাহমান সে কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে প্রশ্ন করেছেন, গাজায় ইসরায়েলি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার কথা কেউ বলছে না। তাহলে গাজাকে আত্মরক্ষার ও প্রতিরোধের সব সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হবে কেন?ঠিক এই বাস্তবতার মুখে আরব দেশগুলোর সমর্থনে হামাসকে গাজা থেকে সরে যাওয়ার প্রস্তাবটি এসেছে। হামাস নিরস্ত্র হলে ও অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণভার তাদের হাতে না থাকলে গাজায় অব্যাহত হামলা বা অধিগ্রহণের পক্ষে ইসরায়েলের কোনো যুক্তি ধোপে টিকবে না। অন্যদিকে, এই যুদ্ধের কঠোর বাস্তবতা হামাসের প্রতিকূলে। প্রায় দুই বছরের টানা ইসরায়েলি আক্রমণের মুখে অধিকাংশ হামাস যোদ্ধা হয় নিহত হয়েছে, অথবা সামরিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। বাকি যে হাজার বারো যোদ্ধা এখনো অবশিষ্ট, তারা ইসরায়েলকে পরাজিত করবে, সে প্রশ্ন ওঠে না।
গাজার অনেক মানুষ তাদের দুর্ভোগের জন্য ইসরায়েলের পাশাপাশি হামাসকেও দায়ী করে। তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিক্ষোভও বাড়ছে। এ অবস্থায় বৃহত্তর শান্তি ও নিরাপত্তার খাতিরে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ একটি বাস্তবসম্মত সমাধান বলে সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব দেশ মনে করছে। উল্লেখযোগ্য, আরব লীগের সদস্য ২২টি দেশই নিউইয়র্ক প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।
গত পাঁচ বছরে মার্কিন প্রশাসনের সমর্থনে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক সামাজিকীকরণের যে প্রক্রিয়া চলছে, তার ফলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নটি কার্যত চাপা পড়ে গেছে। নিউইয়র্ক সম্মেলনে সেই দাবি নতুন করে উত্থাপিত হলো।
আরও পড়ুনগাজা যুদ্ধ ইসরায়েলি সমাজে ভাঙন ধরিয়ে দিয়েছে২৯ মে ২০২৪ইতিমধ্যে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ও গাজার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ডজনখানেক প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে গাজা থেকে প্রায় ২২ লাখ ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে সেখানে বিদেশি পর্যটকদের জন্য একটি অতি আধুনিক প্রমোদকানন বানানোর প্রস্তাবও রয়েছে। এই প্রস্তাব করেছেন (হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি চান মিসর ও জর্ডান বাস্তুচ্যুত গাজাবাসীকে জায়গা দিকে। এই দুই দেশ ‘না’ করায় গাজাবাসীকে স্থায়ীভাবে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ইসরায়েল একাধিক আফ্রিকান দেশের সঙ্গে কথা বলেছে।
অবাস্তব বিবেচনা করে মিসর ও অন্যান্য আরব দেশ মিলে একটি পাল্টা প্রস্তাব দিয়েছে, যার মোদ্দাকথা, ফিলিস্তিনিদের না তাড়িয়েই গাজায় এক অত্যাধুনিক নগর নির্মাণ সম্ভব। টাকাপয়সা সব আরব দেশগুলোই দেবে। মিসরের একটি কোম্পানি ইতিমধ্যেই নির্মাণ নকশা চূড়ান্ত করে ফেলেছে। মিসর বলেছে, ট্রাম্প সাহেব, যিনি নিজে একজন সুপরিচিত ‘ডেভেলপার’, তিনিও এই উদ্যোগে শামিল হতে পারেন।
গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলে বিভাজন বাড়ছে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র য় ইসর য় ল প রস ত ব আরব দ শ গণহত য
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ