একটা সময় ছিল, যখন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন ছাপা হতো ‘উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশযাত্রা’। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই মাস দেখাল এক নতুন বিজ্ঞাপন—‘উচ্চগতির ইন্টারনেট পেতে বিদেশযাত্রা’। এটি কোনো রসিকতা নয়, এটি ছিল বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতির হৃৎপিণ্ডে আঘাত হানা এক কঠিন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে দেশব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে যে গভীর সংকট তৈরি হয়েছিল, এটি তারই একটি খণ্ডচিত্র।
থেমে গেল অর্থনীতির নতুন চাকাঘটনার শুরুটা হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে। ১৭ জুলাই মধ্যরাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট এবং পরদিন রাত থেকে ব্রডব্যান্ড সংযোগও বন্ধ করে দেওয়া হলে কার্যত পুরো দেশ এক ডিজিটাল বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়। এর সবচেয়ে বড় এবং তাৎক্ষণিক আঘাতটি এসে পড়ে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ওপর, বিশেষ করে সেই মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সারদের ওপর, যাঁদের পুরো পৃথিবীই বাঁধা ইন্টারনেট তারে।
২৪ জুলাইয়ের মধ্যেই সংকটটি ভয়াবহ রূপ নেয়। দেশজুড়ে হাজার হাজার ফ্রিল্যান্সার তাঁদের বিদেশি গ্রাহক বা ক্রেতাদের বার্তা পাচ্ছেন না, উত্তরও দিতে পারছেন না। বছরের পর বছর ধরে গড়ে তোলা পেশাদারত্ব আর আস্থার সম্পর্কগুলো চোখের সামনে ভেঙে পড়তে দেখছিলেন তাঁরা। কারও কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল, আবার কেউ নতুন কাজের সুযোগ হারাচ্ছিলেন। ২৭ জুলাই নাগাদ পরীক্ষামূলকভাবে ব্রডব্যান্ড চালু হলেও ধীরগতি কারণে তা কোনো কাজেই আসছিল না। ফাইল ডাউনলোড, অনলাইন মিটিং বা গ্রাহকের সঙ্গে সামান্য যোগাযোগটুকুও হয়ে উঠেছিল এক দুঃসাধ্য কাজ।
নকরেক আইটি ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী সুবীর নকরেক আজ মঙ্গলবার সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের দিনে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট—এটি ছিল এক নির্মম বাস্তবতা। লাখ লাখ ফ্রিল্যান্সার সেই মুহূর্তে হারিয়ে ফেলেন তাঁদের জীবন ও স্বপ্নের একমাত্র সেতু। ডেলিভারি না দিয়ে অনেকে হারান বিদেশি ক্লায়েন্ট, কেউ কেউ হারান স্থায়ী প্রকল্প কিংবা মাসের উপার্জন। দেশজুড়ে হাজারো তরুণের ঘরে নেমে আসে হতাশা, কান্না আর নীরব ক্ষয়। এ ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয়—ইন্টারনেট শুধু প্রযুক্তি নয়, এটা এখন জীবনের অংশ, স্বপ্ন বাঁচানোর অবলম্বন। বহির্বিশ্বের মতো ইন্টারনেট এখন মৌলিক চাহিদার পর্যায়ে, এটির অধিকার হোক সবার। দেশের যেখানে ইন্টারনেট–সুবিধা নেই, সেখানেও পৌঁছে যাক ইন্টারনেট এবং কখনোই যেন বন্ধ না হয়।
ফ্লিট বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) খায়রুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পুরো কার্যক্রমই ইন্টারনেটনির্ভর। ইন্টারনেট বন্ধ হওয়া মানে যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া। আমরা অ্যামাজন, ওয়ালমার্টসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসে স্টোর ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস দিয়ে থাকি। প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারের মতো অর্ডার প্রক্রিয়াকরণ করি আমরা। কিন্তু হঠাৎ করেই যখন দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়, আমাদের সবকিছু যেন থমকে যায়। সেই সময় আমি ছিলাম ব্যাংককে, সঙ্গে ছিলেন আরও তিনজন সহকর্মী। আমরা চারজন মিলে যতটা সম্ভব পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করি। গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বুঝিয়ে বলি—কাজ কিছুটা ধীরগতিতে হবে। কারণ, বাংলাদেশে আমার ২৫০ জন দক্ষ কর্মী থাকলেও ইন্টারনেট না থাকায় কেউই কাজ করতে পারছিলেন না। এই সংকটের মধ্যে দুজন গ্রাহক সরে যান। আরও অনেক ক্লায়েন্ট উদ্বিগ্ন হয়ে বারবার জানতে চাইছিলেন, আমরা আদৌ সময়মতো কাজগুলো শেষ করতে পারব কি না। সত্যি বলতে, সেই সময়টা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। এত দিন ধরে গড়ে তোলা সম্পর্ক আর অর্জিত আস্থা যেন একমুহূর্তেই হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ছিলাম। এই কঠিন অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা এখন স্টারলিংক সেবা গ্রহণ করেছি; যাতে ভবিষ্যতে কোনো ইন্টারনেট–বিভ্রাট আমাদের থামিয়ে না দিতে পারে।’
আরও পড়ুনইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিপদে দেশের ফ্রিল্যান্সাররা২৪ জুলাই ২০২৪অন্ধকারে ফেসবুকভিত্তিক উদ্যোক্তারাএকইভাবে অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিলেন দেশের কয়েক লাখ ই-কমার্স ও ফেসবুকভিত্তিক (এফ-কমার্স) উদ্যোক্তা। তাঁদের ব্যবসার প্রচার, গ্রাহক সংগ্রহ ও বেচাকেনার পুরোটাই ছিল ফেসবুকনির্ভর। জেবিন সুলতানার কথাই ধরা যাক। ‘জারা ফ্যাশন’ নামের পেজ থেকে তিনি নিজের ডিজাইন করা পোশাক বিক্রি করতেন, ফেসবুক লাইভে প্রচার চালাতেন। যেখানে তাঁর প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হতো, ইন্টারনেট বন্ধের সেই দিনগুলোয় তাঁর বেচাকেনা নেমে এসেছিল শূন্যের কোঠায়। ২৯ জুলাই সীমিত আকারে ইন্টারনেট ফিরলেও ফেসবুক বন্ধ থাকায় তাঁদের ব্যবসার চাকা ঘোরেনি। সে সময় জেবিন সুলতানা হতাশ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘ইন্টারনেটের গতি এত ধীর যে ফেসবুকে লাইভ করা যায় না। এমন বিক্রিশূন্য অবস্থা আরও কত দিন যাবে বুঝতে পারছি না।’ এই হাহাকার জেবিনের একার ছিল না, অগণিত অনলাইন উদ্যোক্তার, যাঁদের স্বপ্ন আর জীবিকা একসঙ্গে থমকে গিয়েছিল।
কুমিল্লার জায়ান্ট মার্কেটার্সের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো.
৩০ জুলাইয়ের মধ্যে পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে দেশের সফটওয়্যার উদ্যোক্তা ও ফ্রিল্যান্সাররা তাঁদের ৮ থেকে ১০ বছরের পুরোনো বিদেশি গ্রাহক ও কাজ টিকিয়ে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়ার জন্য অনেকে দল বেঁধে বা নিজে দেশের বাইরে পাড়ি জমান, যা ছিল এক অভাবনীয় এবং করুণ দৃশ্য। আগস্টের ৩ তারিখ পর্যন্ত এই অচলাবস্থার রেশ কাটেনি। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা এই ডিজিটাল অচলাবস্থা কেবল আর্থিক ক্ষতিই করেনি, বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ভাবমূর্তি এবং নির্ভরযোগ্যতাকে এক বড় প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। যে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে লাখ লাখ তরুণ-তরুণী নিজেদের পথ তৈরি করছিল, এই একটি সিদ্ধান্ত সেই পথের ওপর এক গভীর ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়ে গেছে, যা শুকাতে হয়তো আরও অনেক সময় লাগবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব রডব য ন ড পর স থ ত ফ সব ক গ র হক
এছাড়াও পড়ুন:
রাবিতে নবমবারের মতো আয়োজিত হবে চাকরি মেলা
রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ক্যারিয়ার ক্লাব (আরইউসিসি) নবমবারের মতো আয়োজন করতে যাচ্ছে ‘জব ফেয়ার ২০২৫’।
আগামী ১৯ ও ২০ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যারিয়ার কাউন্সিলিং ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের (সিসিডিসি) সংযুক্তিতে ও রাকসুর সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী চত্বরে এ আয়োজন করা হবে।
আরো পড়ুন:
রাবিতে ছাত্রীদের পরিচয় নিশ্চিতে সর্বোচ্চ সংবেদনশীলতা বজায় রাখার নির্দেশ
ছয় শতাধিক উদ্যোক্তা, গাছী ও গবেষক নিয়ে রাবিতে গুড় সম্মেলন
বুধবার (১০ নভেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টায় সিসিডিসি ভবনে একটি সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান আরইউসিসির সভাপতি প্রান্ত বড়ুয়া।
তিনি জানান, মেলায় অংশ নেবে বিকাশ, আপন গ্রুপ, আনোয়ার গ্রুপ, প্রাইম ব্যংক, প্রাণ-আরএফএল, ইস্পাহানি লিমিটেডে, ব্র্যাক, আড়ং, ম্যারিকো বাংলাদেশসহ দেশের বিভিন্ন কর্পোরেট ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান।
সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে প্রান্ত বড়ুয়া বলেন, “চাকরি মেলা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বাস্তবমুখী প্ল্যাটফর্ম। এখানে তারা সরাসরি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এইচআর ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলতে পারবে, সিভি জমা দিতে পারবে, ক্যারিয়ার বিষয়ে দিকনির্দেশনা নিতে পারবে এবং অনেকে অন-স্পট ভাইভায়ও অংশ নিতে পারবেন।”
তিনি বলেন, “অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি বাস্তব জব মার্কেট, রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়া এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতার চাহিদা বোঝার সবচেয়ে কার্যকর সুযোগগুলোর একটি।”
তিনি আরো বলেন, “জব ফেয়ার উপলক্ষে এবার আমরা আয়োজন করেছি দুইটি ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেশন। যেখানে কোম্পানির উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ বর্তমান জব মার্কেট এবং চাকরির পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করবেন। এছাড়াও থাকবে সিভি সাবমিশন বুথ, সিভি রিভিউ, স্কিল মূল্যায়ন, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং, ইন্টার্নশিপ ও ফুলটাইম চাকরির সুযোগ।”
তিনি জানান, গত বছর আয়োজিত অষ্টম আরইউসিসি জব ফেয়ার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য সাড়া পেয়েছিল। প্রান-আরএফএল, এসিআই, মেঘনা গ্রুপ, নাবিল, ব্রিটিশ কাউন্সিলসহ অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়ে দুইদিনে ৩ হাজারের বেশি সিভি সংগ্রহ করে এবং বেশকিছু শিক্ষার্থী অন-স্পট ভাইভাতে চাকরি সুযোগ পেয়েছিল।
সিসিডিসির পরিচালক অধ্যাপক নুরুল মোমেন বলেন, “১৯ ও ২০ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে নবমবারের মতো জব ফেয়ার অনুষ্ঠিত হবে। ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের সহযোগিতায় আয়োজিত এ ফেয়ারের লক্ষ্য, শিক্ষার্থীদের চাকরি বাজারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করা ও স্কিল ডেভেলপমেন্টে সহায়তা করা।”
তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীরা যেন তাদের অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিন ও দক্ষতার সঙ্গে মিল থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্টল ভিজিট করে সিভি জমা দিতে পারে, সেটাই মূল উদ্দেশ্য। গত বছর তিন হাজারের বেশি সিভি জমা পড়েছিল; এবার আরও বেশি অংশগ্রহণ ও সরাসরি জব প্লেসমেন্টের হবে বলে আশা করছি।”
এ বিষয়ে রাকসুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক তোফায়েল আহমেদ তোফা বলেন, “আরইউসিসির আয়োজনে রাবিতে প্রতি বছরই জব ফেয়ার হয়ে থাকে। এবার যেহেতু রাকসু হয়েছে, তাই আশা করছি এবারের আয়োজন আরো বড় পরিসরে ও সফলভাবে অনুষ্ঠিত হবে। আমরা আশা করছি, অনেক নামী প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেবে।”
তিনি বলেন, “আমাদের ক্যাম্পাসে বহু মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছেন। আমরা চাই, এই মেধাবী শিক্ষার্থীরা যেন জব ফেয়ারের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারেন এবং তাদের মেধার যথাযথ মূল্যায়ন হয়। কোনো সন্দেহ ছাড়াই বলা যায়, রাকসু সব সময় এমন কার্যক্রমে সহযোগিতা করবে।”
ঢাকা/ফাহিম/মেহেদী