দুই পাশে বসতবাড়ি। কোনোটি কাঁচা, আবার কোনোটি পাকা। মাঝ দিয়ে চলে গেছে পিচঢালাই রাস্তা। রাস্তাটি পেরিয়ে মানুষজনকে যেতে হয় অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজসহ নানা কাজে। কিন্তু ওই রাস্তার মাঝখানে ইটের দেয়াল তুলে দেওয়ায় মানুষজনের চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ১৫ দিন ধরে চলাচলে ভোগান্তিতে পড়েছে ৪০টি পরিবারের ১৭০ মানুষ।

ঘটনাটি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর এলাকার। রাস্তাটি দিয়ে দৌলতপুর হয়ে সাগুনীতে যাওয়া যায়।

এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের লোকজন বসতবাড়ির মাঝের ব্যক্তিমালিকানার একটি কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলাচল করে আসছিলেন। আর ওই রাস্তার ২০ থেকে ২৫ মিটার উত্তরে সিএস রেকর্ডের রাস্তার জায়গায় এলাকাবাসীর অনেকেই ঘর তুলে বসবাস করতেন। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ওই কাঁচা রাস্তার দুই কিলোমিটার পাকা করার উদ্যোগ নেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। সে সময় ওই গ্রামের বাসিন্দা আলী হোসেন ও তাঁর পরিবারের লোকজন রাস্তার কিছু অংশ নিজেদের জমি দাবি করে রাস্তা নির্মাণে বাধা দেয়। সে সময় আলী হোসেন ব্যক্তিমালিকানার জমির বদলে সিএস রেকর্ডের রাস্তাটি পাকা করার উদ্যোগ নিতে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন করেন।

দৌলতপুর গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, সে সময় তাঁরা গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তিমালিকানার রাস্তাটি পাকা করার পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু সে সময় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজওয়ানুল হকের ভিটায় যাতায়াতের জন্য ব্যক্তিমালিকানার রাস্তাটি পাকা করে নেন তিনি। রাস্তাটি পাকা করার প্রতিবাদ করায় স্থানীয় লোকজনকে ভয়ভীতিও দেখানো হয়। পুলিশ দিয়ে হয়রানিও করা হয়।

আলী হোসেনের ছেলে মো.

মুসলিম বলেন, ‘যখন রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন বলা হয়েছিল, সিএস রেকর্ডের রাস্তাটি পাকা হবে। কিন্তু কাজের সময় দেখা গেল, আমাদের ব্যক্তিমালিকানার রাস্তাটি পাকা হচ্ছে। যখন দেখলাম, আমাদের জায়গাটি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, তখন আমার বাবা আদালতের আশ্রয় নেন। ২০২০ সালে মামলায় আমাদের পক্ষে রায় পাই। এরপর আমরা আমাদের মালিকানার জমি হেফাজতে নিই।’ মামলার রায়ের পর আলী হোসেন ও তাঁর ছেলেরা রাস্তার ইট তুলে জায়গাটি বেড়া দিয়ে ঘিরে দেন। পরে রাস্তার ওপর কয়েকটি গর্ত করে রাখেন।

এ ঘটনার পর ২০২৩ সালের জুলাইয়ে সিএস রেকর্ডের রাস্তাটি উদ্ধারে উদ্যোগ নেয় উপজেলা প্রশাসন। সে সময় মনু মিয়া, আকতার হোসেন, মুক্তার হোসেন, মো. খোকাসহ কয়েকজনকে রেকর্ডের রাস্তার দখল ছেড়ে দিতে নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশ পেয়ে তাঁরা রাস্তার জায়গা থেকে তাঁদের স্থাপনা সরিয়ে নেন। মনু মিয়া বলেন, ‘রেকর্ডের রাস্তার দখল ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ পেয়ে আমরা ছয়টা ঘর ভেঙে ফেলি। কিন্তু আকতার ও মুক্তার দখল ছাড়েননি। এতে রেকর্ডের রাস্তটিও চালু হয়নি। এ কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।’

গত ৩০ ডিসেম্বর মনু মিয়া তাঁর ছেলেদের নিয়ে হঠাৎই এলজিইডির ওই পাকা রাস্তায় ইটের দেয়াল তুলে মানুষজনের চলাচলের পথ বন্ধ করে দেন। এতে দুর্ভোগে পড়ে যান এলাকাবাসী। তাঁদের এখন অন্য মানুষজনের জায়গা-জমি দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। ভুক্তভোগী লোকজন এ সমস্যার প্রতিকার চেয়ে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) শরণাপন্ন হন। পরে ইউএনও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) পাঠিয়ে উভয়পক্ষকে নিয়ে বসে একটি সমঝোতার উদ্যোগ নেন। কিন্তু এখনো বিষয়টির সুরাহা হয়নি।

গতকাল সোমবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, এলাকাবাসীর চলাচলের এলজিইডির পিচঢালাই রাস্তার মাঝখানে ঠায় দাঁড়িয়ে ইটের পাকা দেয়াল। এলাকার লোকজন অলিগলি দিয়ে ঘুরে বড় সড়কে উঠছেন। খুদে শিক্ষার্থীসহ কেউ কেউ দেয়াল টপকে পেরিয়ে যাচ্ছে। সে সময় ওই এলাকার বাসিন্দা সুমি আক্তার ও ললিতা রানী দুটি শিশুকে সঙ্গে নিয়ে দেয়ালটি টপকে যান।

সুমি আক্তার বলেন, ‘এভাবেই দোকানে সদাই করতে যাচ্ছি। এতে কষ্টের শেষ নাই। যাঁরা রাস্তাটা বন্ধ করে দিছেন, তাঁরা বলছেন, এই রাস্তার জায়গাটার মালিক নাকি তাঁরা! তাঁরা এখন বলছেন, আমরা যেন রেকর্ডের রাস্তা দিয়ে চলাচল করি। কিন্তু ওই রাস্তা তো চলাচলের অবস্থায় নাই।’

ইটের দেয়ালের পূর্ব দিকে এক–দুজন করে ভুক্তভোগী লোকজনের ভিড়। তাঁদের একজন জ্যোৎস্না বেগম রাস্তাটি দেখিয়ে দিয়ে বললেন, রাস্তটি দিয়ে সহজে বাঁশগাড়ায় গিয়ে ওঠা যায়। এখন রাস্তার ওপর দেয়াল দেওয়ায় তাঁদের চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেল। অন্য মানুষের বাড়ি ও বাগানের ভেতর দিয়ে চলফেরা করতে হচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত মানুষের চলাচলের রাস্তায় এ রকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা যায় কি না, এ প্রশ্নের জবাবে মনু মিয়ার ছেলে দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘পাকা রাস্তার জায়গাটা তো ব্যক্তিমালিকানাধীন, তাই দেয়াল তুলেছি। রেকর্ডের রাস্তার ওপর ঘর ভেঙে নিতে প্রশাসন নোটিশ দেওয়ার পর আমরা ঘর সরিয়ে নিলাম। কিন্তু প্রশাসন এত দিনেও রাস্তাটি চালু করতে পারেনি। আমাদের দুই দিক থেকে ক্ষতি হচ্ছিল। বিষয়টি ইউএনওকে জানালে তিনি রেকর্ডের রাস্তার জায়গা ছেড়ে দিয়ে নিজেদের জায়গায় যা ইচ্ছা তা করতে বলেন। এরপর আমরা সেখানে দেয়াল তুলে রাস্তাটি বন্ধ করে দিয়েছি। এতে আমরা কোনো অন্যায় করিনি।’

পীরগঞ্জের ইউএনও রমিজ আলম বলেন, ‘মানুষজন যে রাস্তা দিয়ে চলাচল করেন, সেটি সরকারি জায়গায় হোক অথবা কারও ব্যক্তিগত জায়গায় হোক, কেউ তা বন্ধ করতে পারবেন না। রাস্তা বন্ধের বিষয়টি সরেজমিনে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে এসি ল্যান্ডকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। তাঁর মাধ্যমে জানতে পেরেছি, অভিযুক্ত ব্যক্তি যিনি রাস্তাটি বন্ধ করেছেন, তিনি অন্যায় করেছেন। সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আরও পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নেব।’

ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় এলজিইডি পাকা রাস্তা নির্মাণ করতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে এলজিইডি ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন বিশ্বাস বলেন, ‘আপনারা হয়তো ভুল করছেন। এলজিইডি রাস্তা পাকা করলে রেকর্ডেরই রাস্তাতেই করছে। পাঁচ বছর আগের ইস্যু নিয়ে এখন আলোচনা না ওঠানোই ভালো।’

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ব্যালটে মামদানি, অদৃশ্য ‘প্রার্থী’ ট্রাম্প

নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচন আগামীকাল মঙ্গলবার। ‘বিশ্বের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত এই শহরে প্রথমবার এমন একজন মেয়র পদে নির্বাচিত হতে পারেন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির চলতি ধারার একদম বিপরীতমুখী। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর রিপাবলিকান পার্টি এক ‘শ্বেতকায়, খ্রিষ্টান ও রক্ষণশীল’ আমেরিকার কথা বলছেন।

জোহরান মামদানি শ্বেতকায় নন, তিনি বাদামি রঙের দক্ষিণ এশীয়। তিনি খ্রিষ্টান নন, একজন মুসলিম। তিনি অবশ্যই রক্ষণশীল নন, তিনি খোলামেলাভাবে একজন প্রগতিশীল, যিনি নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলতে দ্বিধা করেন না।

‘মামদানি একজন ভয়ানক মানুষ’, সাবধান করে বলেছেন অ্যান্ড্রু কুমো, মঙ্গলবারের নির্বাচনে যিনি মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী। সারা জীবন ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য থাকলেও বাছাইপর্বে পরাজিত হয়ে তিনি এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন।

ব্যালটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম না থাকলেও এই নির্বাচনে তিনি একজন অদৃশ্য প্রার্থী। কুমোর পক্ষ নিয়ে তিনিও এই নির্বাচনের একজন অংশগ্রহণকারী। বড় ব্যবধানে মামদানির বিজয় হলে অনেকেই তা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অনাস্থা হিসেবেই দেখবেন।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউইয়র্কের আদি বাসিন্দা। তিনি কোনোভাবেই চান না মামদানি এই শহরের মেয়র নির্বাচিত হোন। তাঁর বিবেচনায় মামদানি শুধু একজন পাক্কা কমিউনিস্টই নন, রীতিমতো উন্মাদ। এমন একজনকে নির্বাচিত করা হলে তিনি নিউইয়র্ক সিটির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল আটকে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, মামদানি একজন অবৈধ অভিবাসী। তা প্রমাণিত হলে তাঁকে বহিষ্কার করা হবে। মেয়র নির্বাচিত হয়ে মামদানি যদি অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের চলতি অভিযানে বাধা দেন, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে, এমন হুমকিও দিয়েছেন ট্রাম্প।

শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি।

ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়

শুধু নিউইয়র্কে নয়, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আরও অন্তত তিনটি রাজ্যে নির্বাচন হবে আগামীকাল, যার ফলাফল ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের ব্যাপারে একটি রেফারেন্ডাম বা জনরায় হবে ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নিউ জার্সি ও ভার্জিনিয়ায় গভর্নর পদে নির্বাচন। এই দুই রাজ্যে প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চ পরিষদেও ভোট গ্রহণ করা হবে। উভয় রাজ্যই ডেমোক্রেটিক রাজনীতির সমর্থক, বা ‘ব্লু স্টেট’। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দুই রাজ্যেই ট্রাম্পের হার হয়, কিন্তু ২০১৬ সালের তুলনায় তিনি অনেক ভালো ফল করেন। দেখার বিষয়, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে এই দুই রাজ্যে ট্রাম্পের জনসমর্থন এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে।

এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ায় গভর্নর গেভিন ন্যুসাম নির্বাচনী ম্যাপ পরিবর্তনের অনুমতি চেয়ে একটি গণভোটের আয়োজন করেছেন। আগামী বছরের নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে রিপাবলিকান পার্টি বড় রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তা ঠেকাতেই ট্রাম্পের নির্দেশে টেক্সাসের নির্বাচনী ম্যাপ ঢেলে সাজানো হয়েছে, যার ফলে রিপাবলিকান দল কংগ্রেসে আরও পাঁচটি আসন নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হবে ভাবা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ‘ব্লু স্টেট’ ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর ন্যুসামের নির্দেশে নির্বাচনী ম্যাপ বদলানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার ফলে সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য কংগ্রেসে পাঁচটি আসনে বিজয়ের সম্ভাবনা তৈরি হবে।

এই তিনটি নির্বাচনের প্রতিটিতেই ভোটারদের মনে থাকবেন ট্রাম্প, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আইনি বাধা উপেক্ষা করে বিভিন্ন ডেমোক্রেটিক শহরে অবৈধ অভিবাসনবিরোধী অভিযানের নামে সেনাসদস্যদের পাঠাচ্ছেন তিনি। যেসব ডেমোক্রেটিক নেতাকে শত্রু মনে করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছেন। কোনো যুক্তি বা কারণ ছাড়াই ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাঁর পক্ষে ভোট দেয়নি এমন ডেমোক্রেটিক রাজ্যের কেন্দ্রীয় অনুদান বাতিল করছেন। কংগ্রেসের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই একাধিক সরকারি দপ্তর আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করে মাদক পাচার বন্ধের নামে ভেনেজুয়েলার সমুদ্রসীমায় সামরিক হামলা চালাচ্ছেন। আমদানি শুল্কের নামে যে বাণিজ্যযুদ্ধ তিনি শুরু করেছেন, তার ফলে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের দাম বাড়া শুরু হয়েছে।

গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।

এসব কার্যকলাপের ফলে সারা দেশে ট্রাম্পের জনসমর্থন কমেছে। অধিকাংশ জনমত জরিপে তাঁর প্রতি সমর্থন ৪২ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি নয়। সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র ১০ মাসের মাথায় অন্য আর কোনো প্রেসিডেন্টের জনসমর্থনে এমন ধস নামেনি।

এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প কোনো রাজ্যেই ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি প্রচারে আসেননি। এমনকি রিপাবলিকান প্রার্থীদের পক্ষে সরব সমর্থনও জানাননি। এর একটা সম্ভাব্য কারণ, জয়ী হবেন এমন প্রার্থীর সমর্থন দিতেই ট্রাম্প ভালোবাসেন। আগামীকালের নির্বাচনে তেমন সম্ভাবনা কম।

এই নির্বাচন যে ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়, তার আরেক প্রমাণ নির্বাচনী প্রচারণায় সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অংশগ্রহণ। ডেমোক্রেটিক পার্টিতে জাতীয় নেতা বলতে তিনিই সবেধন নীলমণি। শনিবার নিউ জার্সির ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী মাইকি শেরিলকে পাশে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। একই দিন ভার্জিনিয়ায় ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী এবিগেইল স্প্যানবার্গারের পক্ষেও প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। উভয় রাজ্যেই ওবামা কঠোর ভাষায় ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেন, ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী নীতির কারণেই আমেরিকা আজ এক দুঃসময়ের মুখোমুখি।

জনমতে এগিয়ে মামদানি

ওবামা মামদানিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেননি। তবে তিনি যে মামদানির পাশে আছেন, সে কথাও গোপন রাখেননি। মামদানির ক্যাম্পেইন থেকে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি ওবামা নিজেই ফোন করে জানিয়েছেন, তাঁর (মামদানির) বিজয়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তিনি বলেছেন, মামদানির নির্বাচনী প্রচার ‘ইম্প্রেসিভ’ বা নজরে পড়ার মতো।

কুমো ক্যাম্প থেকে অহোরাত্রি তাঁকে ‘কমিউনিস্ট’ ও ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ হিসেবে প্রচার সত্ত্বেও মামদানি যেসব জনমত জরিপে এগিয়ে, তার একটি বড় কারণ মাঠপর্যায়ে তাঁর এই ‘ইম্প্রেসিভ’ প্রচারণা। শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি। এতে তিনি ফল পাচ্ছেন, গত দুই সপ্তাহে মামদানির সঙ্গে তাঁর ব্যবধান ১০ শতাংশের মতো কমে এসেছে। নিউইয়র্কের চলতি মেয়র নির্বাচন থেকে এরিক অ্যাডামস সরে দাঁড়ানোয় কুমোর লাভ হয়েছে সন্দেহ নেই, তবে এখনো মামদানির সঙ্গে যে ১৬-১৭ পয়েন্টের ব্যবধান রয়েছে, তা অতিক্রম করা কার্যত অসম্ভব, এই মত অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের।

ভূমিধস পরিবর্তন

একটা বিষয় স্পষ্ট। মেয়র নির্বাচনে মামদানি জয়ী হলে তা মার্কিন রাজনীতিতে প্রজন্মগত ও নীতিগত পরিবর্তনের সূচনা করবে। ভূমিধস পরিবর্তন আসবে ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিতে। মধ্যপন্থী ও ডানঘেঁষা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এই দল অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কম জনপ্রিয়। এই দলে যাঁরা নেতৃত্বে, তাঁদের অধিকাংশই বয়োবৃদ্ধ, করপোরেট আমেরিকার কাছে এদের হাত-পা বাঁধা। ইসরায়েল প্রশ্নে তাদের সমর্থন এখনো আগের মতো নতজানু।

পিউ রিসার্চের তথ্য অনুসারে, ইসরায়েল প্রশ্নে এখন নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে এমন আমেরিকানের সংখ্যা ৫৩ শতাংশ, যা তিন বছর আগের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। একইভাবে ধনতন্ত্রের প্রতিও আমেরিকানদের সমর্থন নিম্নগামী। গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।

অন্যদিকে ট্রাম্পের নেতৃত্বে রিপাবলিকান পার্টি খোলামেলাভাবে অভিবাসনবিরোধী, দক্ষিণপন্থী, খ্রিষ্টবাদী ও রক্ষণশীল। চলতি সপ্তাহের নতুন উদ্বাস্তু নীতিতে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন শ্বেতকায় ও ইউরোপীয় আশ্রয়প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেবে। এই অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতকায় নাগরিকবৃন্দ, ট্রাম্প প্রশাসনের চোখে যারা সে দেশের সরকারের বৈষম্যের শিকার।

এই প্রতিক্রিয়াশীল রিপাবলিকান পার্টির বিপরীতে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন গড়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও কংগ্রেস সদস্য ওকাসিও-কর্তেজ ইতিমধ্যে এই আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। সবাই মানেন, মামদানির মতো তরুণ ও বুদ্ধিমান নেতৃত্ব এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে।

এই সম্ভাবনার কথা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন বার্নি স্যান্ডার্স। তাঁর কথায়, এই দেশ করপোরেট আমেরিকার নির্দেশে চলবে, না তার রাজনীতির কেন্দ্রে থাকবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ—এ মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ‘যদি আমরা দ্বিতীয় পথটি বেছে নিতে চাই, করপোরেট আমেরিকার বদলে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিই, তাহলে আমাদের মামদানির পাশে দাঁড়াতে হবে।’

কোন পথ বেছে নেবে নিউইয়র্ক, মঙ্গলবারেই তা নিশ্চিত হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ