ঘুরে দাঁড়াতে এখনও লড়ছেন ফেনীর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা
Published: 17th, January 2025 GMT
মুহুরী ও কহুয়া নদীর পার ঘেঁষে উত্তর দৌলতপুর গ্রাম। প্রায় প্রতিবছর বর্ষায় এ দুই নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় উত্তর দৌলতপুরসহ অন্তত ১৪টি গ্রাম। দুই নদীর মোহনার খুব কাছেই মাত্র দেড় হাজার গজ দূরত্বে শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. কামালের ঘর। প্রতিবছর পানি ওঠে, কয়েক দিন পর তা কমেও যায়। তিন মেয়ে, মা ও স্ত্রীকে নিয়ে বন্যার পানিতে থাকার অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। তবে গত বছরের ২০ আগস্ট তুমুল বৃষ্টিপাতের সঙ্গে আকস্মিক বন্যা হানা দেয় কামালদের গ্রামে। প্রথম ধাক্কাতেই বন্যার স্রোত ভাসিয়ে নেয় তাঁর ঘরের জিনিসপত্রসহ গৃহপালিত পশুপাখি। বাধ্য হয়ে কামাল পরিবার নিয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় গ্রামের উঁচু এক ভবনে আশ্রয় নেন। সেখানেই প্রায় তিন দিন তারা না খেয়ে পড়ে ছিলেন।
উত্তর দৌলতপুরের কামালই শুধু নন, পাঁচ শতাধিক পরিবার ফেনীর ওই বন্যায় জীবন বাঁচাতে লড়াই করেছিলেন। মুহুরী ও কহুয়ার এমন স্রোত আগে কখনও দেখেননি বলে জানান কামালের স্ত্রী জোৎস্না।
পানি নেমে গেলে বাড়ে দুর্ভোগ
সরেজমিন ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরামের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, প্রায় পাঁচ মাস পার হলেও এখনও রয়ে গেছে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। কারও ঘরের চাল এখনও ঠিক করা হয়নি। দেয়ালে মাটি লেপে ক্ষতচিহ্ন মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন অনেকে। কেউ বাড়ি মোটামুটি ঠিক করলেও ল্যাট্রিন ছালা মোড়ানো; ব্যবহারের অনুপযোগী। সবকিছু হারানোর ধাক্কা কাটাতে নতুন করে হাঁস-মুরগি পালন শুরু করেছেন অনেকে।
ফুলগাজী উপজেলার উত্তর বরইয়া ইউনিয়নের মৌলভীবাড়ির ফাতেমা খাতুন বলেন, ‘বানের পানি কমলেও ঘরে একটুও চাল ছিল না যে পাকাব। এমনকি হাঁড়ি, চুলা তাও ছিল না। ল্যাট্রিন ভেসে গেছে। ভিজা কাপড় নিয়ে ছিলাম সাত দিন।’
একই গ্রামের হাসিনা আক্তার বলেন, ‘বন্যার পানিতে আংগো (আমাদের) ঘর, ল্যাট্রিন কিছুই আছিলো না। ঘর দিমু নাকি ল্যাট্রিন? মাইয়া বিয়াও এই জন্য ভাঙানি পড়ছে।’ বিয়ে ভাঙার কারণ সম্পর্কে তিনি জানান, পাত্রপক্ষ বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি ও চট দিয়ে ঘেরা ল্যাট্রিন দেখে আত্মীয়তা করতে অস্বীকৃতি জানায়।
গত বছর ওই বন্যার সময় ২১ থেকে ২৩ আগস্ট আটকে পড়া কামাল, হাসিনাদের মতো অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ফেনী ইউনিটের স্বেচ্ছাসেবকরা। তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেন তারা। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্তদের ঘুরে দাঁড়াতেও এখন কার্যক্রম চালাচ্ছে রেড ক্রিসেন্ট।
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ফেনী জেলা ইউনিটের যুবপ্রধান শামসুল আরেফিন বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রাথমিকভাবে ফুলগাজীতে ৭৫টি শৌচাগার নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। ফেনী জেলার ইউনিট সভাপতি মো.
ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নানামুখী উদ্যোগ
রেড ক্রিসেন্টের ফেনী ইউনিট লেভেল অফিসার (ইউএলও) আবদুল মান্নান বলেন, বন্যার সময় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জাতীয় সদরদপ্তর ও ফেনী জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়। ২৩ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চারটি ম্যানপ্যাক মেশিনের মাধ্যমে ২ লাখ লিটারের বেশি নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করা হয়। ৩১ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০ জন স্বেচ্ছাসেবক ২১৫টি টিউবওয়েল মেরামত বা পানি বিশুদ্ধকরণ কার্যক্রমে অংশ নেন। ২৭ আগস্ট থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনটি মেডিকেল টিমের মাধ্যমে ২২টি জায়গায় বিনামূল্যে মেডিকেল ক্যাম্প করে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দেওয়া হয়। এ ছাড়া চারজন দক্ষ স্বেচ্ছাসেবকের সমন্বয়ে তিনটি দল মানসিকভাবে ট্রমাগ্রস্তদের মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সহায়তা দেন। ২৩ থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত ৭৭ স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে ৪ হাজার প্যাকেট জরুরি শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়। ৯৫ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি বিতরণ করা হয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত গোটা জেলায় ১২ হাজার প্যাকেট সাত দিনের ফুড প্যাকেজ বিতরণ করা হয়। এর আওতায় প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত ও অসহায় পরিবারকে সাড়ে সাত কেজি চাল, দুই কেজি ডাল, এক কেজি লবণ, এক কেজি চিনি, আধা কেজি সুজি, এক লিটার তেলসহ ১২ কেজি করে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়। জরুরি সহায়তার আওতায় বিতরণ করা হয় ১ হাজার ৯৮৫ প্যাকেট স্যানিটারি প্যাড। ত্রাণের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে জরুরিভাবে ৫৫০ পিস তারপলিনও বিতরণ করা হয়।
তিনি আরও জানান, পরবর্তী সময় প্রথম ধাপে ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ফুলগাজী, পরশুরাম উপজেলায় ২ হাজার পরিবারের মধ্যে ৬ হাজার টাকা করে নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। দ্বিতীয় ধাপে ছাগলনাইয়া, সোনাগাজী, ফেনী সদর উপজেলায় ৩ হাজার ৫০০ পরিবারে ৬ হাজার টাকা করে নগদ অর্থ সহায়তার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশাপাশি সোনাগাজীর নবাবপুর ইউনিয়নে ৩৫টি পরিবারের মধ্যে ঘর মেরামতে ঢেউটিন ও নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়ার কাজ চলমান। এসব কার্যক্রম পরিচালনায় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স টিমের সদস্য তানজিম হাসানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি দল ‘ফেনী ফ্লাড অপারেশন-২০২৪’ কার্যক্রমে কারিগরি সহায়তা দিতে নজরদারি করছে।
ফুলগাজীর ইউএনও তানিয়া ভূঁইয়া বলেন, ২০২৪ সালের বন্যা পরিস্থিতি এতটাই কঠিন ছিল, বলে বোঝানো সম্ভব নয়। তার পরও উদ্ধার কার্যক্রমে স্থানীয় যুবসমাজ, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে আসায় প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতির যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তা প্রশমিত করা সম্ভব হয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বন য পর ব র ইউন ট আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
গংগাচড়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ, আতঙ্ক কাটেনি এখনও
রংপুরের গংগাচড়ায় ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ঘিরে সহিংসতার শিকার হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। তবে ঘটনার তিন দিন পরেও এলাকায় ফেরেনি অনেক পরিবার। আতঙ্কে এখনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে।
গত ২৭ জুলাই রাতে ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার আগে এলাকায় মাইকিং করে লোকজন জড়ো করা হয়।
পুলিশ, প্রশাসন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, যারা হামলা করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন ‘বহিরাগত’। পাশের নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা থেকে লোকজন এসে হামলা চালিয়ে চলে যায়। হামলার সময় ২২টি ঘরবাড়ি তছনছ ও লুটপাট করা হয়।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এলাকায় অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প বসানো হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে পুলিশ টহল। প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঢেউটিন, কাঠ, চাল-ডাল ও শুকনো খাবার বিতরণ করেছে এবং ঘরবাড়ি মেরামতের কাজও শুরু হয়েছে। তবু আতঙ্কিত পরিবারগুলো।
ক্ষতিগ্রস্তদের একজন অশ্বিনী চন্দ্র মোহান্ত বলেন, “সেদিনের ঘটনা ছিল এক ভয়াবহ। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে ধর্ম অবমাননাকারী কিশোরকে থানা হেফাজতে দিয়েছি। কিন্তু তারপরও ঘরবাড়ি রক্ষা হয়নি। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি এবং কিছু মুরুব্বি আমাদেরকে অভয় দিয়েছিলেন, কিন্তু রক্ষা হয়নি।”
তিনি আরো বলেন, “আমরা নিজেরাই অভিযুক্ত কিশোরকে থানায় সোপর্দ করেছি। তারপরও মিছিল নিয়ে এসে দুই দফায় আমাদের ২০ থেকে ২৫টি ঘরবাড়ি তছনছ করে দিয়ে লুটপাট করেছে তারা। এদের মধ্যে অধিকাংশ লোকেই অপরিচিত।”
আরেক ভুক্তভোগী দেবেন্দ্র চন্দ্র বর্মন জানান, “প্রথমে অল্পসংখ্যক কম বয়সী কিছু ছেলে আসে। পরে হাজারো লোকজন এসে আমাদের বাড়িঘরে তাণ্ডব চালায়। অনেকেই এখনো আত্মীয়দের বাড়িতে। আমরা চরম আতঙ্কে আছি।”
রবীন্দ্র চন্দ্রের স্ত্রী রুহিলা রানী বলেন, “ছোট ছেলেটা যদি ভুল করে থাকে, আমরা তাকে থানায় দিয়েছি। কিন্তু তারপরও এমন ধ্বংসযজ্ঞ কেন? আমাদের গরু, সোনা-টাকা সব লুটে নিয়েছে। শুধু চাল-ডাল আর টিনে কি জীবন চলে?”
গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রংপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম ও সদস্য সচিব আনিসুর রহমান লাকুসহ একটি প্রতিনিধি দল। তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরণ করেন এবং পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
গংগাচড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আল এমরান বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে কিশোরটিকে গ্রেপ্তার করে থানায় আনা হয় এবং পরে আদালতের মাধ্যমে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এখন পর্যন্ত কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তারপরও পুলিশ প্রশাসন সর্বাত্মক নিরাপত্তায় নিয়োজিত।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহামুদ হাসান মৃধা বলেন, “অপরাধীদের ধরতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হচ্ছে সহায়তা। পুলিশ ও সেনাবাহিনী পুরো এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে।”
উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্যমতে, হামলায় ১৫টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাতে ২২টি পরিবার বসবাস করতেন। ঘর মেরামতের পর কিছু পরিবার ফিরলেও অভিযুক্ত কিশোর ও তার চাচার পরিবারের কেউ এখনো ফিরে আসেনি।
ঢাকা/আমিরুল/ইভা