১৮২৪ সালে আজকের এই দিনে জন্ম নেওয়া কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর কবি-প্রতিভার বাইরেও একজন নাট্যকার হিসেবে সুপরিচিত। মাত্র তিন বছর ১৮৫৯ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত রচনা করেছেন নাটক। এই অল্প সময়ে জুলিয়াস সিজারের ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ বাণীটি যেন মধুসূদনের নাটক রচনার ক্ষেত্রে যথোপযুক্তভাবেই প্রযোজ্য।
শেকসপিয়রীয় রীতিতে মহাভারতের শর্মিষ্ঠা, যযাতি ও দেবযানী আখ্যান অবলম্বনে তিনি প্রথম নাটক রচনা করেন ১৮৫৯ সালে ‘শমির্ষ্ঠা’; যা সে বছরেই সেপ্টেম্বরে বেলগাছিয়া থিয়েটারে মঞ্চায়িত হয়। এটিই ছিল শুরু। এরপর প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ চরিত্রের সংলাপ শোনা যায় ‘পদ্মাবতী’ নাটকে; যা গ্রিক পুরাণের ‘অ্যাপল অব ডিসকোর্ড’ অবলম্বনে রচিত। প্রতিটি নাটকের মাধ্যমে নিজেকে ভাঙতে পছন্দ করতেন মধুসূদন; যা তাঁর প্রতিটি নাটকেই লক্ষণীয়।
নাটকের পাশাপাশি প্রহসনও রচনা করেছেন তিনি। ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এবং ‘একেই কি বলে সভ্যতা’– দুটি প্রহসনের মাধ্যমে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থাকে আঙুল তুলে দেখিয়েছেন তিনি। ১৮৬১ সালে বাংলা নাট্যসাহিত্যে রচিত হয় প্রথম ট্র্যাজেডি নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’। কৃষ্ণকুমারীর আত্মবিসর্জন নিয়ে পুরো নাটক রচিত; যা প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৮৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শোভাবাজার প্রাইভেট থিয়েট্রিক্যাল সোসাইটিতে। এ নাটকের মাধ্যমে বাংলা নাট্যজগতের নতুন এক দুয়ার উন্মোচন করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত নাটক ‘মায়াকানন’। পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত এই নাটক ১৮৭৪ সালে বেঙ্গল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় প্রথম।
মধুসূদন প্রতিটি নাটকের মূল চরিত্রগুলো এমনভাবে সংলাপসহ উপস্থাপন করেছেন, যা ছিল গভীর সামাজিক ও নৈতিক বার্তার বাহক। নাটকের ঘটনা ও চরিত্রের একরৈখিক গতি নাটক ও প্রহসনের উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে। সমকালীন সমাজের ভণ্ডামি, ধর্মীয় কুসংস্কার এবং শোষণমূলক অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রতি তিনি প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছেন। মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করলে তাঁর রচিত নাটকগুলোর শৈল্পিক ও আদর্শিক প্রভাব স্পষ্ট। ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের উক্তি, ‘সমাজতান্ত্রিক উদ্দেশ্যমূলক না হয়েও সাহিত্য সমাজের সংকট চিহ্নিত করতে পারে’– যথাযথভাবে বোঝা যায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাটকগুলোর মূল ভাবনা বোঝার মাধ্যমে।
মধুসূদনের সমাজভাবনা কেবল তাঁর সমকালীন সমাজ নয়, বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক। তিনি এমন একটি সমাজের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন, যেখানে পুঁজিবাদী শোষণ ও কপটতা সমাজের ক্ষত সৃষ্টি করে। তাঁর রচনার আধুনিক চিন্তা বর্তমান সমাজের সংকটকে বুঝতে এবং সমাধান খুঁজতে সাহায্য করে। মধুসূদন রচিত নাটক ও প্রহসন শুধু অতীত নয়, এটি একটি চলমান সংকটময় সমাজে পরিবর্তনের আহ্বান জানায় আমাদের। আজন্ম পাশ্চাত্যের প্রতি দুর্বল থাকা মাইকেল মধুসূদন দত্ত আত্মোপলব্ধি এবং মাত্র চারটি নাটক ও দুটি প্রহসন রচনা করে বাংলা নাটকের জগতে শক্ত ভিত তৈরি করেন। বাংলা নাট্যসাহিত্যে মোহময়তা এবং প্রতিবাদী লেখনী তুলে ধরা মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনের শেষ দিনগুলোও ছিল তাঁর রচিত নাটকের মতো ট্র্যাজেডিপূর্ণ। নিঃসঙ্গ, পরিবারহীন এক দাতব্য চিকিৎসালয়ে তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
স্তম্ভিত হারমানপ্রীত, আবেগ-রোমাঞ্চ-গর্ব-ভালোবাসায় মিলেমিশে একাকার
২০০৫ ও ২০১৭, ভারতের নারী ক্রিকেট দল ওয়ানডে বিশ্বকাপের খুব কাছে গিয়েও শিরোপা জিততে পারেননি। হারমানপ্রীত কৌররা লম্বা সেই অপেক্ষা দূর করলেন দুই হাজার পঁচিশে।
মুম্বাইয়ের নাভিতে প্রায় ষাট হাজার দর্শকের সামনে উচিুঁয়ে ধরলেন ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা। ২০১৭ সালের ফাইনালেও খেলেছিলেন হারমানপ্রীত। রানার্সআপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে। এবার আর ভুল করলেন না। অধিনায়ক হয়ে জিতলেন শিরোপা। গড়লেন ইতিহাস। যে ইতিহাস কখনো মুছবে না। কখনো জং ধরবে না।
ঝলমলে হাসিতে হারমানপ্রীত ট্রফি হাতে নিয়ে প্রেস কনফারেন্স রুমে প্রবেশ করেন। এবার তার আবেগের ধরণ ছিল ভিন্ন, যেন স্বপ্ন পূরণের মাখামাখি। লম্বা সংবাদ সম্মেলন জুড়ে বারবার তার কণ্ঠ ধরে আসে। আবেগ, রোমাঞ্চ, গর্ব, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তবে একটি শব্দের ওপর বারবার ফিরে আসছিলেন তিনি, তা হলো আত্মবিশ্বাস,
‘‘আমি কেবল আমার অনুভূতি প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। আমি স্তম্ভিত, আমি বুঝতে পারছি না। আসলে, এতে উত্থান-পতন ছিল, কিন্তু দলের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছিল। আমি প্রথম দিন থেকেই এটা বলে আসছি। আমরা বাম বা ডানে তাকাচ্ছিলাম না। আমরা কেবল আমাদের মূল লক্ষ্যের দিকে তাকিয়েছিলাম।’’ - বলেছেন হারমানপ্রীত।
স্বপ্ন পূরণের রাতে হারমানপ্রীত কাছে পেয়েছিলেন সাবেক তিন ক্রিকেটার মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামী এবং অঞ্জুম চোপড়াকে। প্রত্যেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন ভারতকে বিশ্বকাপ জেতানোর। তাদের অধরা সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন জেমিমা, দীপ্তি, শেফালি, স্মৃতিরা।
শিরোপা উৎসবে যোগ দেন মিতালি, ঝুলন, আঞ্জুমরা। তাদের হাতেও ট্রফি তুলে দেওয়া হয়। প্রাক্তন খেলোয়াড়দের সাথে সেই মুহূর্তটি ভাগ করে নেওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে হারমানপ্রীত বলেন, ‘‘ঝুলন দি আমার সবচেয়ে বড় আইডল ছিলেন। যখন আমি দলে যোগ দিই, তখন তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আমি যখন খুব কাঁচা ছিলাম এবং ক্রিকেট সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না, তখনও তিনি সবসময় আমাকে সমর্থন করতেন। অঞ্জুম দি-ও তাই। এই দুজন আমার জন্য দারুণ সমর্থন ছিলেন। আমি কৃতজ্ঞ যে আমি তাদের সাথে এই বিশেষ মুহূর্তটি ভাগ করে নিতে পেরেছি। এটি খুব আবেগপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। আমার মনে হয় আমরা সবাই এটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে, আমরা এই ট্রফি স্পর্শ করতে পেরেছি।’’
তার জন্য বিশ্বকাপের পুরো অভিযানটিই ছিল গভীরভাবে আবেগপূর্ণ। রাউন্ড রবিন লিগে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ হার। চোট, অফ ফর্ম, জড়তা। সব সামলে সেরা হয়েছেন। তাইতো নিজেদের নিয়ে গর্বটাও বেশি হারমানপ্রীতদের, ‘‘আমরা প্রথম বল থেকেই অনুভব করেছিলাম যে আমরা জিততে পারি, কারণ শেষ তিন ম্যাচে আমাদের দল যেভাবে খেলছিল, তাতে আমাদের জন্য অনেক কিছুর পরিবর্তন এসেছিল, বিশেষ করে আমাদের আত্মবিশ্বাস। আমরা অনেকদিন ধরেই ভালো ক্রিকেট খেলছি। আমরা জানতাম দল হিসেবে আমরা কী করতে পারি।”
"গত এক মাস খুব আকর্ষণীয় ছিল। সেই দিনটির (ইংল্যান্ডের কাছে হারের) পর আমাদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসে। সেই রাত আমাদের জন্য অনেক কিছু বদলে দিয়েছিল। এটি প্রত্যেকের উপর প্রভাব ফেলেছিল। আমরা বিশ্বকাপের জন্য আরও প্রস্তুত হলাম। আমরা ভিজ্যুয়ালাইজেশন এবং মেডিটেশন শুরু করেছিলাম। আমরা বারবার বলছিলাম, যে জন্য আমরা এখানে এসেছি এবং এবার আমাদের এটা করতেই হবে।" - যোগ করেন হারমানপ্রীত।
প্রথম যে কোনো কিছুই আনন্দের। রোমাঞ্চের। এই অভিজ্ঞতা শব্দে বয়ান করা যায় না। বয়ান করা সম্ভব হয় না। হারমানপ্রীতও পারেন না নিজের সবটা উজার করে বলতে। তবে এই শিরোপায় তাদের নাম লিখা হবে সেই আত্মবিশ্বাস তারও ছিল, ‘‘আমরা বহু বছর ধরে এটি নিয়ে কথা বলছি—আমরা ভালো ক্রিকেট খেলছি, কিন্তু আমাদের একটি বড় শিরোপা জিততেই হতো।"
ঢাকা/ইয়াসিন