ইউরোপীয় ফুটবলের দুই মহাশক্তি, ম্যানচেস্টার সিটি ও রিয়াল মাদ্রিদ—আবারও চ্যাম্পিয়নস লিগের মঞ্চে মুখোমুখি। ভাগ্য যেন প্রতি মৌসুমেই তাদের এক সুতোয় গেঁথে দিচ্ছে। সেটাও নক আউট পর্বে।২০২৪-২৫ মৌসুমের নক আউটে আজ (১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫) রাতে তারা একে অপরের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। প্লে-অফের প্রথম লেগে সিটির মাঠ ইতিহাদ স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় রাত ২টায় সিটির পরীক্ষা নিবে আসরের সবচেয়ে সফল দল রিয়াল। 

এ নিয়ে টানা চতুর্থ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ নকআউটে মুখোমুখি হচ্ছে দল দুটি। সর্বশেষ মৌসুমে কোয়ার্টার ফাইনালে সিটিকে হারিয়েছিল রিয়াল। দুই লেগ মিলিয়ে ৪-৪ সমতার পর টাইব্রেকারে জিতে সেমিফাইনালে ওঠে লস ব্ল্যাঙ্কসরা। পরবর্তীতে ফাইনাল জিতে অর্জন করে রেকর্ড ১৫তম শিরোপা।

গত কয়েক বছরে সিটি ও রিয়ালের দ্বৈরথ পৌঁছেছে অন্য উচ্চতায়। মাঠের ফুটবলের সৌন্দর্যের সঙ্গে শক্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন, চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় ম্যাচ না হারার তীব্র লড়াই আলাদা ঝাঁজ নিয়ে এসেছে। দুই দলের সমর্থকরা আজও আশায় বুক বেঁধে আছে আরেকটি হাইভোল্টেজ লড়াইয়ের।

আরো পড়ুন:

বিতর্কিত পেনাল্টিতে পয়েন্ট ভাগাভাগি দুই মাদ্রিদের: আড়ালে বার্সার হাসি

বুটজোড়া তুলে রাখলেন মার্সেলো, রোনালদোর আবেগী বার্তা

রিয়াদের বিপক্ষে মুখোমুখি হওয়ার আগে খুব ভালো অবস্থানে নেই সিটি। গত চার মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন সিটির এবার শিরোপা ধরে রাখার সম্ভাবনা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। শীর্ষে থাকা লিভারপুলের চেয়ে ১৫ পয়েন্টে পিছিয়ে পঞ্চম স্থানে আছে পেপ গার্দিওলার দলটি। আত্মবিশ্বাস তলানিতে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরও নিজের দল নিয়ে গার্দিওয়ালা আশার কথাই শোনালেন, “আমরা অনেকবার তাদের মুখোমুখি হয়েছি। কঠিন মুহূর্তে তারা কীভাবে তাদের সেরাটা দেয়, আমরা জানি। অবশ্যই আমাদের দুটি ভালো ম্যাচ খেলতে হবে।” 

স্প্যানিশ ম্যানেজার অবশ্য চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসের সেরা দলটির আক্রমণের প্রশ্নগসা করতে ভুললেন না, ‘‘তাদের আক্রমণভাগকে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। সবাই জানে তারা অসাধারণ। আমাদের যতটা সম্ভব লড়াইয়ে তাদের সম্পৃক্ততা কমাতে হবে, এরপরও তাদেরও মুহূর্ত আসবে এবং আমাদের তা মেনে নিতে হবে। বার্নাব্যু ম্যাচের জন্য ভালো ফলাফল পেতে প্রথম লেগে আমাদের স্মার্ট হতে হবে এবং ছন্দ বুঝতে হবে।”

রিয়ালের লড়াইটা অবশ্য চোটের সঙ্গে। পুরো মৌসুমে তারা চোটের সঙ্গে সংগ্রাম করছে। আগেই জানা ছিল মাদ্রিদের দলটির মূল চার ডিফেন্ডার দানি কারভাহাল, মিলিতাও, রুডিগার, আলাবা আজ রাতে চোটের কারণে স্কোয়াডের বাইরে থাকবেন। সেই তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছেন লুকাস ভাসকেজ। তাই কার্লো আনচেলত্তির দলের ভয় আজ রক্ষণভাগ নিয়ে। তবে আক্রমণভাগ নিয়ে সুসংবাদ আছে। স্বস্তির খবর, ইনজুরি কাটিয়ে স্কোয়াডে ফিরেছেন জুড বেলিংহ্যাম ও কিলিয়ান এমবাপে। 

ম্যাচ পূর্ববর্তী সংফবাদ সম্মেলনে রিয়াল বস আনচেলত্তি জানিয়েছেন, এই ম্যাচে তারা ফেভারিট হিসেবেই মাঠে নামতে যাচ্ছে। তবে প্রতিপক্ষ ম্যানচেস্টার সিটিকে ইউরোপের অন্যতম সেরা হিসেবেই মানছেন তিনি, “হ্যাঁ তারা কঠিন প্রতিপক্ষ। আবার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপক্ষ। তবে তাদের খেলতে হবে সেরা ম্যানেজারের বিপক্ষে। আমি বুঝতে পারছি তারা কঠিন সময়ের ভেতরে যাচ্ছে। কিন্তু তারা আমার কাছে ইউরোপের অন্যতম সেরা প্রতিপক্ষ। আমি বিশ্বাস করি ম্যাচটা প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণই হতে যাচ্ছে। তাদের ভালোমানের কোচ এবং দুর্দান্ত কিছু খেলোয়াড় আছে।’’

ঢাকা/ইয়াসিন/নাভিদ

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর চ য ম প য়নস ল গ আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

আরও বিস্তৃত হয়েছে শ্রমিকের সংগ্রামের জমিন 

মে দিবস। পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষের দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে আট ঘণ্টা শ্রমদিবসের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন শ্রমিকেরা। পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ প্রাণ হারান। কিন্তু সেই রক্তের বিনিময়েই কাগজে–কলমে হলেও প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমের মর্যাদা, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, ন্যায্য মজুরি ও সংগঠনের অধিকার। একসময় এসব দাবিই রূপ নেয় আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের ভিত্তিতে।

কিন্তু ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা যখন এই দিনে ফিরে তাকাই, তখন প্রশ্ন আসে, এখনো কি সেই সব দাবি প্রাসঙ্গিক? নাকি সময় পাল্টে দিয়েছে সব? এখন তো কাজের ধরনই বদলে গেছে—একদিকে অটোমেশন, অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়যাত্রা। উৎপাদনের পদ্ধতি যেভাবে বদলেছে, তাতে পুরোনো ধরনের শ্রমিক যেন ক্রমে অদৃশ্য হয়ে পড়ছেন।

আজকের দুনিয়ায় পুঁজি এক ক্লিকে দেশান্তরিত হয়, কারখানা গড়ে ওঠে যেখানে মজুরি কম এবং আইনের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল। মানুষ এখন আর কেবল শ্রমিক নয়; তাঁদের বলা হচ্ছে ‘ফ্রিল্যান্সার’, ‘কন্ট্রিবিউটর’, ‘পার্টনার’, ‘ডেলিভারি ম্যান’। কিন্তু আসলে, এদের অনেকেই এক নতুন ধরনের দিনমজুর; যাঁদের নেই নিরাপত্তা, নেই সুনির্দিষ্ট অধিকার। কাজ করছেন তাঁরা—কখনো রাস্তায় খাবার পৌঁছে দিয়ে, কখনো কম্পিউটারে চ্যাটবট প্রশিক্ষণ দিয়ে, আবার কখনো অ্যালগরিদম পরিশোধনে; কিন্তু কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন। তাঁরা জানেন না যে তাঁদের কাজের ফল কোথায় যাবে, কীভাবে ব্যবহৃত হবে।

এই ব্যবস্থার একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে অ্যামাজন। তাদের গুদাম ও সরবরাহ চেইনে রোবট, ড্রোন ও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। শ্রমিকেরা সেখানে নির্ধারিত সময়ের বেশি কাজ করতে বাধ্য হন, মেশিনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অথচ যখন তাঁরা সংগঠিত হতে চান, তখন কোম্পানির বিরুদ্ধে ওঠে লবিং, বিরোধিতা, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ। ২০২৩ সালে অ্যামাজনের একাধিক গুদামে ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টাকে রুখে দিতে কোম্পানিটি কোটি কোটি ডলার খরচ করে আইনি দল গঠন করে।

মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়; সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে না

শুধু অ্যামাজন নয়, গোটা দুনিয়াতেই শ্রমের এক নতুন রূপ তৈরি হচ্ছে—ডিজিটাল ও প্ল্যাটফর্মভিত্তিক শ্রম। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকেরা কাজ করেন উবার, ফুডপান্ডা, আপওয়ার্ক বা ফাইভারের মতো অ্যাপে যুক্ত হয়ে। অথচ তাঁদের নেই কোনো কর্মস্থল, নেই কর্মঘণ্টার নিশ্চয়তা, নেই অসুস্থতার ছুটি বা পেনশনের মতো সামাজিক সুরক্ষা। বাস্তবে তাঁরা একা, বিচ্ছিন্ন। প্রতিযোগিতার চাপে তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয় অনিরাপত্তার ভেতর।

২০২৩ সালের একটি আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশের অন্তত ৮০% গিগ-ওয়ার্কার দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। অথচ তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ মাস শেষে কোনো নির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি পান না। গ্লোবাল গিগ ইকোনমির এই বাস্তবতা বাংলাদেশেও দৃশ্যমান। আমাদের শহরগুলোয় এখন হাজারো বাইক বা সাইকেলচালক কাজ করছেন খাবার কিংবা পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য, কিন্তু তাঁরা কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন।

এর পাশাপাশি আরও একটি বড় পরিবর্তন এনেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান। প্রশ্ন উঠেছে, এআই কি শ্রমিকের বন্ধু, না প্রতিদ্বন্দ্বী? যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার এক গবেষণা অনুযায়ী, আগামী ৫ বছরে এআই কমপক্ষে ৮০ কোটি মানুষের কাজের ধরন পাল্টে দেবে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ সম্পূর্ণভাবে কাজ হারাতে পারেন। হোয়াইট-কলার পেশাগুলো যেমন হিসাবরক্ষণ, গ্রাহকসেবা, এমনকি সাংবাদিকতার কাজও এই প্রযুক্তির কারণে সংকটে পড়ছে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২৩ সালের ‘দ্য ফিউচার অব জবস’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৮ কোটি ৫০ লাখ কাজ হারিয়ে যাবে প্রযুক্তি ও অটোমেশনের কারণে। তবে একটা মৌলিক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। যদি উৎপাদিত পণ্যের খরিদ্দার না থাকে, তাহলে উৎপাদন করে কীভাবে মুনাফা আসবে? আর শ্রমিক না থাকলে কিনবে কে? তবে একই সময়ে ৯ কোটি ৭০ লাখ নতুন ধরনের কাজের সৃষ্টি হতে পারে। কাজগুলো হবে ডেটা অ্যানালিটিকস, প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালনা এবং সৃজনশীল ও মানবিক দক্ষতানির্ভর কাজ। এই নতুন শ্রমিকদের অবস্থার কথা ওপরে বলা হয়েছে।

কিন্তু এই নতুন কাজের মালিকানা কার হাতে? শ্রমিকদের নয়, রাষ্ট্রেরও নয়—এই ক্ষমতা এখন করপোরেট অলিগার্কদের হাতে কেন্দ্রীভূত। যুক্তরাষ্ট্রে ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, মার্ক জাকারবার্গদের মতো প্রযুক্তি ধনকুবেররা শুধু প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রকই নন, তাঁরা রাজনীতিতেও সরাসরি প্রভাব ফেলছেন। করপোরেট লবিংয়ের মাধ্যমে আইন তৈরির পেছনে তাঁদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে; যেমন ট্যাক্স ছাড়, শ্রম আইন শিথিলকরণ বা প্রতিযোগিতা নীতির ধ্বংস।

বাংলাদেশেও দৃশ্যপট খুব আলাদা নয়। তৈরি পোশাকশিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাঁরা দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের ভিত্তি। কিন্তু তাঁরা এখনো ন্যূনতম মানবিক মজুরি পান না। গত বছর শ্রমিকেরা ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা মজুরি চাইলেও সরকার তা নামিয়ে ১২ হাজারে নিয়ে আসে। আন্দোলনের জবাবে আসে পুলিশি দমন, ধরপাকড়, ভয়ের পরিবেশ। মালিকেরা নতুন প্রযুক্তি বসিয়ে আরও কম শ্রমিক দিয়ে আরও বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করবেন। আগে–পরে এটা অবধারিত।

এই প্রেক্ষাপটে মে দিবস আজ আমাদের সামনে এক নতুন প্রশ্ন তোলে—শ্রমিক আসলে কে? তাঁর অধিকার কী? আর লড়াইটা কিসের জন্য?

যদি শ্রমিকের সংজ্ঞাই বদলে যায়, তাহলে লড়াইয়ের রূপও কি পাল্টাতে হবে না? একসময়ের আট ঘণ্টার কাজের দাবি এখন হয়তো পুরোনো মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে বহু মানুষ এখনো দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। কেউ কাজ পাচ্ছেন না, কেউ কাজ করেও মাস শেষে ঠিকমতো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। কেউ এমন এক ধরনের ডিজিটাল শ্রম করছেন, যার নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা তাঁর নয়, তিনি জানেনই না যে কার জন্য কাজ করছেন।

তাই আজ মে দিবস শুধু অতীত স্মরণের দিন নয়—এটি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনারও দিন। এটি নতুন ধরনের দাবির জায়গা—ডিজিটাল শ্রমের স্বীকৃতি, গিগ-ওয়ার্কারদের অধিকার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি। আর অবশ্যই আমাদের মতো দেশে গায়ে খাটা শ্রমের ন্যায্য মজুরির দাবি।

মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়, সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক, শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে না।

এই সত্য যত দিন থাকবে, মে দিবস তত দিন থাকবে; নতুন প্রশ্ন নিয়ে, নতুন লড়াই নিয়ে।

জাভেদ হুসেন প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী

সম্পর্কিত নিবন্ধ