পাঁচ সংস্কার কমিশনের মেয়াদ বাড়ল
Published: 18th, February 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা পাঁচটি সংস্কার কমিশনের মেয়াদ আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে আজ মঙ্গলবার পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
পাঁচটি কমিশন হলো গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, নারীবিষয়ক, শ্রম ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। এসব কমিশনের কাজ সুসম্পন্ন করার স্বার্থে সময় বাড়ানো হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত নভেম্বরে এই পাঁচ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল। এর আগে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন।
এই ছয় কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর তা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দল ও অন্য অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ২৭টি রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রথম বৈঠক করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ সব সুপারিশে একমত নয় ইসি
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং ফেরারি আসামিদের নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করার সুপারিশকে ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ বলে মনে করছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সাংবিধানিক এই সংস্থা মনে করে, নতুন করে নির্বাচনের যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করার বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে এ সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য হবে। তারা বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিচ্ছে বলে ইসি সূত্র থেকে জানা গেছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের ৯টি প্রস্তাবের বেশ কিছু সুপারিশ আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করে গত ১৯ মার্চ ইসিকে পাঠিয়েছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এগুলো বাস্তবায়নে কত সময় প্রয়োজন এবং এতে আর্থিক সংশ্লেষ আছে কি না, তা ইসিকে জানাতে বলা হয়েছিল। গতকাল বুধবার সংস্কার কমিশনের আশু বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে মতামত পাঠিয়েছে ইসি। তাতে ১০-১২টি সুপারিশের ক্ষেত্রে আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে একমত হয়েছে।
সেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে এবং ফেরারি আসামিদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করার সুপারিশ আছে।সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠিতে যেসব সুপারিশকে আশু বাস্তবায়নযোগ্য বলা হয়েছে, তার সব কটি আশু বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে করছে না ইসি। যেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আর্থিক ব্যয় এবং রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিষয় আছে বলে ইসি মনে করে, সেগুলোকে এখনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করে না তারা। আর যেসব সুপারিশে আইনে কিছুটা সংশোধন আনা হলে বাস্তবায়ন সম্ভব এবং রাজনৈতিক বিতর্ক নেই, আর্থিক সংশ্লিষ্টতা নেই, সেগুলো এখনই বাস্তবায়নযোগ্য মনে করে ইসি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠিতে যে ৯টি প্রস্তাবকে আশু বাস্তবায়নযোগ্য বলা হয়েছে, তার একটি হলো জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন’। এই আইনের ৪০টি ধারায় অনেকগুলো সংশোধন/সংযোজনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। সেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে এবং ফেরারি আসামিদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করার সুপারিশ আছে।
পুলিশ সংস্কার কমিশন ছাড়া বাকি পাঁচটি কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।এর আগে গত ১৮ মার্চ সংস্কার কমিশনের অন্তত ২৮টি সুপারিশের বিষয়ে ইসি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে ভিন্নমত জানিয়েছিল। সেখানেও ‘আদালত কর্তৃক ফেরারি আসামি হিসেবে ঘোষিত ব্যক্তিদের প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখার’ সুপারিশের সঙ্গে ভিন্নমত জানিয়েছিল ইসি। তারা বলেছিল, এই বিধান করা হলে তা অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশে আরপিওতে সংশোধনী এনে ব্যালট পেপারে জলছাপ রাখার কথা বলা হয়েছিল। ইসি মনে করছে, এটি বাস্তবায়নের সঙ্গে আর্থিক সংশ্লিষ্টতা আছে। আবার কিসের জলছাপ থাকবে, তা নিয়েও আলোচনার বিষয় আছে। এই সুপারিশকেও ইসি আশু বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে করছে না।
অন্যদিকে আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশের সঙ্গে ইসি একমত। এটি বাস্তবায়িত হলে সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীকে নির্বাচনী দায়িত্ব দিতে আলাদা কোনো আদেশের প্রয়োজন হবে না। এখন ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’–এর আওতায় নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা হয়।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির লক্ষ্যে গত বছরের অক্টোবরে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, দুর্নীতি দমন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গত ৮ ফেব্রুয়ারি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেয়। এর মধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশন ছাড়া বাকি পাঁচটি কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
এই ১৬৬টি সুপারিশের বাইরে বেশ কিছু সুপারিশকে আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৩ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বাছাই করা আশু বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। ১৯ মার্চ পাঁচটি কমিশনের (সংবিধান সংস্কার কমিশন বাদে) এ ধরনের অন্তত ১২১টি প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট ১৪টি মন্ত্রণালয়/বিভাগে পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এগুলো বাস্তবায়নে কত সময় প্রয়োজন এবং এসব বাস্তবায়নে টাকা খরচ হবে কি না, হলে তা কত, সেই তথ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তরগুলোকে জানাতে বলা হয়েছিল।
সুপারিশগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে দেখেছি। যেগুলোতে রাজনৈতিক বিতর্ক নেই, সেগুলো আমরা দিয়ে দিয়েছিআবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ, নির্বাচন কমিশনারএর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানো হয়েছে আইন-বিধিসংশ্লিষ্ট ৯টি প্রস্তাব। অবশ্য একটি প্রস্তাবে একাধিক সুপারিশ আছে। এগুলো মূলত আইন-বিধি ও প্রশাসনিক সংস্কার-সংক্রান্ত। সেগুলো হলো গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন সংশোধন, নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন সংশোধন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও গণমাধ্যম নীতিমালা, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা সংশোধন, হলফনামার খসড়া, ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ, পোস্টাল ব্যালটের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং রাজনৈতিক ও নির্বাচনী অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার চর্চা নিশ্চিত করা।
আশু বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর বিষয়ে মতামত জানাতে নির্বাচন কমিশন ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় নিয়েছিল। গতকাল সে সময় শেষ হয়।
ইসি সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ইসির মতামত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মোটাদাগে আর্থিক সংশ্লেষ নেই এবং আইনে সামান্য সংশোধন করে বাস্তবায়ন সম্ভব—এমন ১০-১২টি সুপারিশের বিষয়ে ইসি একমত। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞাভুক্ত করা, রিটার্নিং কর্মকর্তা ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তা–সংক্রান্ত সুপারিশ আছে। এ ছাড়া বেশ কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। আর কিছু সুপারিশের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, এগুলো এখন যেভাবে আছে, সেভাবে থাকলেই চলে, পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই।
এর আগে গতকাল দুপুরে সংবাদ ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, সুপারিশগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে দেখা হয়েছে। সুপারিশে তিনটি ক্যাটাগরি আছে, যেটা আশু বাস্তবায়নযোগ্য কিন্তু রাজনৈতিক কোনো বিতর্ক নেই, সেগুলো ইসি দিয়ে দিয়েছে। যেগুলোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিষয় আছে, সেগুলো নিয়ে ইসি কোনো মন্তব্য করেনি। কিছু আছে বিধিসংশ্লিষ্ট, সেগুলো ইসি নিজে করতে পারবে।
ইসি সূত্র জানায়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন সংশোধনের সুপারিশের বিষয়ে ইসি বলেছে, এর সঙ্গে আর্থিক সংশ্লেষ আছে। এ দুটি আইনের ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে ইসির মতামতও সংযুক্ত করা হয়েছে। নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন সংশোধনের সুপারিশের বিষয়ে ইসি বলেছে, এর সঙ্গে আর্থিক সংশ্লেষ নেই। তবে তারা এ ক্ষেত্রেও সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে নিজেদের লিখিত মতামত তুলে ধরেছে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যম নীতিমালার বিষয়ে ইসি বলেছে, এর সঙ্গে আর্থিক সংশ্লেষ নেই। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা করে পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়নের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।
রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা সংশোধন এবং হলফনামার খসড়ার সুপারিশের বিষয়ে ইসি বলেছে, এগুলো সংশোধনের জন্য পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভোটার তালিকা হালনাগাদের বিষয়ে ইসি বলেছে, এর সঙ্গে আর্থিক সংশ্লেষ আছে। দেশের অভ্যন্তরে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। প্রবাসী ভোটারদের হালনাগাদের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পোস্টাল ব্যালট পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুপারিশের বিষয়ে ইসি বলেছে, এর সঙ্গে আর্থিক সংশ্লেষ আছে। এ বিষয়ে কার্যক্রম চলমান। নির্বাচনী আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার চর্চা নিশ্চিত করার সুপারিশের বিষয়ে ইসি বলেছে, এর সঙ্গেও আর্থিক সংশ্লেষ আছে। এ বিষয়ে কার্যক্রম চলমান।
এর আগে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ নিয়ে আপত্তি তুলেছিল ইসি। ১৮ মার্চ ১০টি ক্ষেত্রে অন্তত ২৮টি সুপারিশের বিষয়ে নিজেদের ভিন্নমত লিখিতভাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে তুলে ধরে ইসি। তাতে বলা হয়, সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে সাংবিধানিক এই সংস্থার স্বাধীনতা খর্ব হবে।