ভাষাবৈচিত্র্য ও বাংলা ভাষার চ্যালেঞ্জ
Published: 25th, February 2025 GMT
ডিজিটাল দুনিয়ায় আমরা নিরন্তর যোগাযোগের মধ্যে আছি। এ বিচরণের প্রধান বাহন ইংরেজি ভাষা। ইংরেজি বিশ্বায়ন, ক্ষমতা ও কেন্দ্রের ভাষা। ইংরেজির ঔপনিবেশিক ঘোর থেকে আমরা কখনোই মুক্ত হইনি। একই সঙ্গে স্থানীয় ও বৈশ্বিক হয়ে উঠেছি; যুগপৎ বাস্তব ও ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা। ডিজিটাল যুগে বাংলা ভাষার সামনে বিপদ ও সুযোগ উভয়ই তৈরি হয়েছে। আমাদের সীমিত ডিজিটাল সক্ষমতা এখনও বাংলা ভাষার জন্য প্রতিকূল। বাংলায় সফটওয়্যার ও অ্যাপ্লিকেশন কম। ওয়েবসাইটও সে অর্থে অপ্রতুল। ডিজিটাল গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মে বাংলার সঙ্গে ইন্টারফেস অপ্রতুল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও ভাষা প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে বাংলা অনেক পিছিয়ে।
যোগাযোগ ও অনলাইনে ইংরেজি কনটেন্টের আধিপত্যের ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলা দক্ষতা ও আগ্রহ হ্রাস পেতে পারে। অন্যদিকে এখন সামাজিক মাধ্যমে প্রতিদিন অনেক বাংলা লেখা হয়, যা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুভূতির বিরাট অংশ ইংরেজি অথবা আরবিতে বলতে দেখা যায়। বাংলায় ধন্যবাদ বা অভিনন্দন না লিখে আমরা এখন ইংরেজি অথবা আরবিতে বলি। আমরা বাংলা, ইংরেজি ও আরবির মিশ্রণে একটি হাইব্রিড বা সংকর ভাষা তৈরি করছি, যা বাংলা ভাষার চরিত্রকে বদলে বিকৃত ভাষা তৈরি করছে।
আমরা আঞ্চলিকতা দিয়ে প্রমিত বাংলাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছি। জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভবের সঙ্গে মানভাষা গড়ে ওঠা সম্পর্কিত। মানভাষা গঠন প্রক্রিয়ায় আমরা অনেক আঞ্চলিক শব্দ ও রীতি বর্জন করেছি। ডিজিটাল যুগে যোগাযোগে ও প্রযুক্তিগত কথোপকথনের জন্য মানভাষা গুরুত্বপূর্ণ। মানভাষা আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে একটা টানাপোড়েন এবং গ্রাম ও শহরের মধ্যে ভাষাগত পার্থক্য তৈরি করেছে। মানভাষা ভাষাগত সমরূপতা তৈরি করলেও আমাদের ভাষাবৈচিত্র্য হ্রাস করেছে। এই প্রমিত বাংলাকে ভাঙার চেষ্টায় অনেকেই এক ধরনের উদ্ভট ভাষারীতি চালু করছেন।
সম্প্রতি বাংলা ভাষার মধ্যে কৃত্রিমভাবে আরবি-ফার্সি শব্দ ঢোকানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বাংলা ভাষা অনেক আরবি, ফার্সি, পর্তুগিজ ও ইংরেজি শব্দ আত্তীকরণ করেছে। ধর্মের কারণে অনেক আরবি শব্দ স্বাভাবিকভাবেই বাংলায় প্রবেশ করেছে। ফার্সি ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত এখানকার রাষ্ট্রভাষা ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেককে অনুভূতি আরবি ও ইংরেজিতে লিখতে দেখি। আমরা কি আমাদের আবেগ-অনুভূতি বাংলায় প্রকাশ করতে পারি না? ইংরেজির বদলে বাংলায় প্রকাশ করলে কি আমাদের মর্যাদা কমে যাবে? আরবিতে না বললে আমরা কি ধর্মভ্রষ্ট হবো? ধর্মে কি এমন কোনো নির্দেশ আছে যে, অনুভূতি মাতৃভাষায় প্রকাশ করা যাবে না? অথচ বাংলার সঙ্গে বৈরিতা না করেও ধর্মনিষ্ঠ হতে কোনো অসুবিধা নেই।
উনিশ শতকের শুরুতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে কেন্দ্র করে যে বাংলা গদ্য গড়ে ওঠে, তাতে বাংলার সংস্কৃতায়ন ঘটে। তারা সংস্কৃতকে বাংলার ভিত্তি হিসেবে নিয়ে বাংলা ভাষাকে তৎসম শব্দে ভারাক্রান্ত করেন এবং আরবি-ফার্সি, দেশি শব্দ এবং অনেক বাংলা ক্রিয়াপদ বর্জন করেন। অনেকেই একে মুসলমানবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন। ভাষার এই বিভক্তিকে কেন্দ্র করে পরে হিন্দু-মুসলিম ভাষা সাম্প্রদায়িকতা দেখা যায়। ন্যাথানিয়েল হ্যালহেড বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়নের পথিকৃৎ। তিনি মনে করতেন, আরবি-ফার্সি শব্দের ব্যবহার বাংলার বিশুদ্ধতা নষ্ট করবে। এই দলের হেনরি ফরস্টার ও উইলিয়াম কেরি কেউই হিন্দু ছিলেন না। হ্যালহেড তাঁর ব্যাকরণে আরবি-ফার্সি শব্দ বাদ দেন। ফস্টার তাঁর অভিধানে আরবি-ফার্সি শব্দ বর্জন করেন। কারও কারও মতে, হ্যালহেড সংস্কৃতের সঙ্গে গ্রিক ও লাতিনের সাদৃশ্য আছে বলে মনে করতেন এবং বাংলা ভাষা সংস্কৃত উৎসজাত ভেবে বাংলার সংস্কৃতায়নের পক্ষে ছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে এক দল বাংলার মধ্যে কৃত্রিমভাবে আবারও আরবি-ফার্সি শব্দ প্রবেশ করানোয় সচেষ্ট।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আরবি হরফে বাংলা লেখারও চেষ্টা হয়েছিল। এর বিপরীতে ষাটের দশকে পাকিস্তানবিরোধী ভাষাভিত্তিক সেক্যুলার ভাবধারারও প্রসার ঘটে। বাংলা ভাষা তার শৈশব অতিক্রম করে সংস্কৃতের প্রভাব কাটিয়ে নিজস্ব ভিত্তি তৈরি করে নিয়েছে। এ কথাও মানতে হবে, সংস্কৃত ভাষার বিপুল শব্দভান্ডার থেকে বাংলা নিয়েছে অনেক। আনিসুজ্জামানের মতে, এ যাত্রায় অনেক বিত্ত সংগৃহীত হয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু ঘরের অনেক দিনের সঞ্চয়ও হারিয়ে গিয়েছিল।
ভাষা সাম্প্রদায়িকরা বাংলা ভাষার শরীরকে হিন্দু ও মুসলিম বাংলায় ভাগ করতে চায়। এই দ্বিখণ্ডীকরণের পথে রবীন্দ্রনাথকে বিদ্বেষভাজন করে তোলা হচ্ছে, যিনি কিনা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে প্রমিত বাংলায় তুলে এনে বাংলাকে সংস্কৃতমুক্ত করেছেন; ভাষার চলিত রূপের ব্যবহার সম্ভব করেছেন। ষাটের দশকে মওলানা আকরম খাঁ, ফজলুর রহমান, আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, গোলাম মোস্তফা ও আজাদ পত্রিকা ইসলামী বাংলা ভাষার পক্ষে বলেছেন। এদের সম্পর্কে ১৯৫৪ সালে সাহিত্য সম্মেলনে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেন, ‘আরবি হরফে বাংলা লেখা, বাংলা ভাষায় অপ্রচলিত আরবি-ফার্সি শব্দের আমদানি, প্রচলিত বাংলা ভাষাকে গঙ্গাতীরের ভাষা বলে তার পরিবর্তে পদ্মাতীরের ভাষা প্রচলনের খেয়াল প্রভৃতি বাতুলতা আমাদের একদল সাহিত্যিককে পেয়ে বসল।’
বাংলা ভাষা চিরকালই আক্রান্ত হয়েছে তার শত্রুদের দ্বারা। প্রতাপের ভাষা ফার্সি, ইংরেজি ও উর্দু বাংলাকে পরাস্ত করতে চেয়েছে বারবার। কেবল বিজেতাই নয়, স্থানীয় শাসক শ্রেণি বাংলার সঙ্গে শত্রুতায় লিপ্ত ছিল, আজও আছে। বাংলা গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা। আশরাফ ও ভদ্দরলোক শ্রেণির কাছে বাংলা কখনোই স্বীকৃতি পায়নি। তারা বাংলাকে ইতর ভাষা বলে মনে করত। উনিশ শতকে বাংলার শহরবাসী অভিজাত মুসলমানদের ভাষা ছিল উর্দু। নবাব আব্দুল লতিফ বাংলাকে হিন্দু ও গ্রামের নীচু জাতের মানুষের ভাষা বলে মনে করতেন। এদের প্রসঙ্গে ড.
বাংলাদেশের শাসক শ্রেণি বাংলা ভাষাকে কখনোই পেশার ভাষা, কাজের ভাষা, জ্ঞানের ভাষা হয়ে উঠতে দেয়নি। শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলাকে প্রান্তিক এবং অদ্ভুতভাবে প্রাথমিক শিক্ষায় ইংরেজি ভার্সন চালু করা হয়েছে। বাংলায় জ্ঞানচর্চায় ক্লীব আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বাংলাকে দমন করে রেখেছে ধণিক শ্রেণি। বাংলা এখন ইংরেজি, আরবি ও হিন্দি দিয়ে বিপদগ্রস্ত; ঘরের শত্রু বিভীষণেও আক্রান্ত। ইংরেজি আমাদের জানতে হবে; ধর্মের প্রয়োজনে আরবিও, কিন্তু মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। অতীতে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রেখেছিল, আজও তেমনি বাংলাভাষী মানুষ তার মাতৃভাষা বাংলাকে টিকিয়ে রাখবে। আমাদের ভাষাজ ফ্যাসিবাদ বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশে আধিপত্যশীল বাংলা ভাষা দিয়ে আমরা যেন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভাষাকে অবদমিত না করি। ভাষাজ বৈচিত্র্য ও বহুত্ব আমাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মননকে প্রসারিত করবে। ফেব্রুয়ারি মাসকে আমরা যেন কপট ভাষাপ্রেমের ‘স্নিগ্ধ ছলনার মাসে’ পরিণত
না করি।
ড. আখতার সোবহান মাসরুর: লেখক ও নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম ছাত্রনেতা
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
বিএনপি ও জামায়াতের কাছে কেন আরপিওর ২১ ধারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল
নির্বাচনের আগেই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এ নিয়ে গত ছয় দিনে দল দুটির পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যেই নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন আরপিওর ২১ ধারার সংশোধনীর পরিবর্তন। জামায়াত মনে করে, সরকার বিএনপির চাপে নতি স্বীকার করে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত খসড়া সংশোধনী বাতিল করেছে। আর বিএনপি মনে করে, জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সরকার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশের খসড়ায় ২১ ধারার পরিবর্তন করে; যা গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদিত হয়। আরপিওর ২১ ধারা সংশোধনীর ওই পরিবর্তন বহাল থাকলে কোনো দল জোটগত নির্বাচন করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে বাধ্য ছিল। ৩০ অক্টোবর সেটি আবার পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত হয়। তাতে জোটগত নির্বাচন করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা থাকছে না। এতে জামায়াত বেশ ক্ষুব্ধ হয়।
যদিও সরকারের দিক থেকে এই নতুন সিদ্ধান্তের তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে সরকার-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সেটি শুধু বিএনপির দাবির কারণে নয়, ছোট বিভিন্ন দলেরও দাবি ছিল।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার নিশ্চিত করেছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবেই। আমরা সরকারের কথায় বিশ্বাস করি। সুতরাং এখন থেকে আমাদের সব কার্যক্রম নির্বাচনকেন্দ্রিক। এখন সরকার তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কীভাবে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে, সেটি তাদের বিষয়। তবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারকে যতটুকু সহযোগিতা দেওয়া দরকার, সেটা বিএনপি করবে।’
বাংলাদেশের শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যতই সময় যাচ্ছে...একটা পুরোপুরি নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চলছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপিএ দিকে আজ সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির নিয়মিত সভা হবে। তবে অন্য দিন রাতে সভা হলেও আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় সভা বসবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আজকের সভায় আলোচ্যসূচিতে প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করার বিষয় থাকবে। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন–সংক্রান্ত বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে।
হঠাৎ কেন সামনে এল আরপিওর সংশোধনী
আরপিওর ২১ ধারার সংশোধন বিএনপি ও জামায়াতের কাছে হঠাৎ করে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫–এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন হয়। আরপিওর ২১ ধারার এই সংশোধনীর ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো। এতে জামায়াত খুশি হলেও বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো অস্বস্তিতে পড়েছিল। এ কারণে এর পরিবর্তন চেয়ে বিএনপি নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও আইন উপদেষ্টাকে পৃথক চিঠি দেয়। এর পরেই সরকার আরপিওর ২১ ধারার পরিবর্তন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, নতুন সিদ্ধান্তে বিএনপি উপকৃত হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো, এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ভোটের হিসাব-নিকাশে ক্ষতিগ্রস্ত হতো বিএনপি। অন্য দিকে এতে লাভবান হয় জামায়াতসহ তার মিত্র দলগুলো। এর হিসাবটা হচ্ছে, ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আছে একসঙ্গে নির্বাচন করার জন্য এবং সংসদ সদস্য পদে জোটের প্রার্থী হওয়ার আশায়। সে ক্ষেত্রে বিএনপির ‘ধানের শীষ’ প্রতীককে ছোট দলগুলোর নেতারা জয়ের ক্ষেত্রে ‘ভরসা’ হিসেবে দেখেন।
...যে কারণে ফ্যাসিজমের যে রাস্তা, আমরা সংস্কারে বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, এগুলো ওনারা বন্ধ করতে দিচ্ছে না। সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের নায়েবে আমির, জামায়াতএখন জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হলে ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করতে খুব আগ্রহী হবে না। এর কারণ দুটি। প্রথমত, বিএনপির সমর্থন পেলেও ব্যক্তি জনপ্রিয়তা না থাকলে ছোট দলগুলোর নেতাদের নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে জেতা কঠিন হয়ে পড়বে। অন্য দিকে জোটের প্রার্থী হিসেবে বিএনপি আসন ছাড় দিলেও দলের কেউ বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলে ভোটে জেতা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে বিদ্রোহীকে সরাতে বিএনপির নেতৃত্ব কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সে প্রশ্নও আছে।
এ ছাড়া এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতে যে আটটি দল আছে, তারা আরপিওর ওই ধারা পরিবর্তনের পক্ষে। অর্থাৎ দলগুলো জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে—এর পক্ষে। এর জন্য দলগুলো যৌথ কর্মসূচিও করছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জামায়াত যে নির্বাচনী জোট বা নির্বাচনী সমঝোতা করতে চাইছে, সে দলগুলো পরস্পর আস্থাশীল। তাদের কাছে ‘দাঁড়িপাল্লা’ বা ‘হাতপাখা’ বা ‘রিকশা’ প্রতীক কোনো বিষয় নয়। সমঝোতা হলে সবাই ওই প্রতীকের পক্ষে এক হয়ে কাজ করবে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা নেই। অন্যদিকে বিএনপির জোটের ক্ষেত্রে ভাবনা হচ্ছে, ধানের শীর্ষ প্রতীক না দিলে ভোটের আগেই আসন হারানোর আশঙ্কা থাকবে।
গতকাল সকালে এক বিবৃতিতে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার দাবি করেন, একটি দলের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে সরকার আরপিওর সর্বশেষ সংশোধনী বাতিল করেছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) বাতিল করা হলে সেটি ন্যক্কারজনক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হবে।
আরপিওর ২১ ধারার এই সংশোধনীর ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো। এতে জামায়াত খুশি হলেও বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো অস্বস্তিতে পড়েছিল। এ কারণে এর পরিবর্তন চেয়ে বিএনপি নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও আইন উপদেষ্টাকে পৃথক চিঠি দেয়।ঐকমত্য কমিশন সুপারিশের পর থেকেই উত্তাপ
২৮ অক্টোবর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সুপারিশ জমা দেয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে—সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। এই সময়ের মধ্যে সংবিধান সংশোধন না করলে আপনা–আপনি সেটা সংবিধানে যুক্ত হবে। এ ছাড়া গণভোট কবে, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিন নাকি তার আগে—সেটা ঠিক করবে সরকার।
চরম অনৈক্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত ছিল, তারা কীভাবে হারানো ঐক্য ফিরে পেতে পারে, সেটি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা দরকার।অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহবিএনপি প্রথমত ক্ষুব্ধ হয় বাস্তবায়নের সুপারিশ থেকে ভিন্নমত বাদ দেওয়ায়। এ ছাড়া সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন, ২৭০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া, সেটা না হলে আপনা-আপনি সংবিধানে যুক্ত হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে দলটির আপত্তি আছে। দলটি গণভোট আগে নয়, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে চায়। জামায়াতের অবস্থান এর পুরো বিপরীত।
এসব নিয়ে পরস্পরকে লক্ষ্য করে দল দুটির রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতি ক্রমেই বাড়তে থাকে। জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে এটা আসছে যে জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এমন বক্তব্য অবশ্য বিএনপি আরও আগে থেকেই দিয়ে আসছে।
গতকাল দুপুরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা দেখছি যে বাংলাদেশের শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যতই সময় যাচ্ছে, ততই বাংলাদেশে একটা অ্যানার্কিক সিচুয়েশন, একটা পুরোপুরি নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চলছে।’
জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে এটা আসছে যে জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এমন বক্তব্য অবশ্য বিএনপি আরও আগে থেকেই দিয়ে আসছে।এর আগের দিন শনিবার বিএনপির মহাসচিব জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নির্বাচনকে যতটা বাধা সৃষ্টি করেছেন, সেটা আপনারা করেছেন।’
পাল্টা বক্তব্য এসেছে জামায়াতের দিক থেকেও। দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের গতকাল বিকেলে ঢাকায় এক সেমিনারে বলেছেন, ‘বিএনপি ভেতরে-ভেতরে আবার ফ্যাসিস্ট হওয়ার একটা খায়েশ আছে মনে হচ্ছে। যে কারণে ফ্যাসিজমের যে রাস্তা, আমরা সংস্কারে বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, এগুলো ওনারা বন্ধ করতে দিচ্ছেন না।’
অবশ্য সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে বিএনপিকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপি যতই উসকানি দিক, জামায়াত বিএনপির সঙ্গে বিরোধে জড়াতে চায় না। মানুষের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক আছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দূর করে স্পষ্ট করা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। সুতরাং আসুন আমরা সব ভুলে আলোচনায় বসি।’
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে এই মুখোমুখি অবস্থা চলতে থাকলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে। অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, একটা চরম অনৈক্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত ছিল, তারা কীভাবে হারানো ঐক্য ফিরে পেতে পারে, সেটি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা দরকার।