নির্বাচনের দিনক্ষণ জানাতে বাধাটা কোথায়?
Published: 26th, February 2025 GMT
রাজনৈতিক আলোচনা এলেই সবাই জানতে চান, দেশে কী হচ্ছে? সংস্কার কতটা এগোল? নির্বাচন কবে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের মতো আমজনতার জানার কথা নয়। তারপরও অনেকের ধারণা, সাংবাদিকেরা সব জানেন। কিন্তু আদার ব্যাপারী যেমন জাহাজের খবর জানেন না, তেমনি সাংবাদিকেরাও হাঁড়ির খবর বের করতে পারেন না, যদি খবরের মালিকেরা সেটা প্রকাশ করতে না চান।
গত বছরের ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর নির্বাচন নিয়ে যত কথা হয়েছে, আর কোনো বিষয়ে এত কথা হয়নি। আর আগস্টই বা বলি কেন?
বাংলাদেশে আমরা এমন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি, যেখানে নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করতে হয়, মানুষকে জীবন দিতে হয়। অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, যার লক্ষ্য ছিল স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে দেশের গণতন্ত্রে উত্তরণ। নির্বাচন ছাড়া সেটি কীভাবে সম্ভব। এমনকি সংস্কারের জন্যও নির্বাচন প্রয়োজন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে চলছে জনগণের অধিকার হরণের পালা। যারা জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার কথা বলে ক্ষমতায় আসেন, তারাই বেশি ভোটাধিকার করেছেন। যার ফল তারা কমবেশি ভোগও করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সূচনা বৈঠকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে সংস্কার করে নির্বাচন হবে, না চাইলে সংস্কার ছাড়াই নির্বাচন হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো অ্যাজেন্ডা নেই। এর আগে তিনি জানিয়েছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার চাইলে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে, আর রাজনৈতিক দলগুলো অল্প সংস্কার চাইলে সেটি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে।
মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি, ২০২৫) প্রথম আলোর চারের পাতায় দুটি পাশাপাশি খবর। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, ‘আমাদের টার্গেট ডিসেম্বর এবং জাতীয় নির্বাচন।’ এর আগে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন প্রস্তাব দিয়েছিল, আগামী জুনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার। কিন্তু সিইসি বলেছেন, সেটা সম্ভব নয়। যারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাইছেন, তাদের আশার বেলুন ফুটো করে দিয়েছেন সিইসি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন ছিল। বিশেষ করে যেসব রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন ও পেশাজীবী মানুষ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল, তারা নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু সাড়ে ছয় মাস পর পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে। যেকোনো সরকারের জনসমর্থনের দুটি প্রধান উপাদান থাকে।অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বরে অথবা সর্বোচ্চ পরের বছরের মার্চের মধ্যে হতে পারে। এর আগেও নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে।
বিএনপি প্রথমে বলেছিল, স্বল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। এরপর দলের এক নেতা বললেন, ২০২৫ সালের জুনের মধ্যেই নির্বাচন করা সম্ভব। আরেক নেতা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য চলতি বছরের ৫ আগস্টই নির্বাচন হোক।
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে প্রথম কথা বলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যাতে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে, সে জন্য তিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দেবেন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি প্রথম আলোর সঙ্গে আরেক সাক্ষাৎকারে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন যে দেশবাসী অবশ্যই একটা ভালো নির্বাচন চায়। সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর নির্বাচন চায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্যও সেটা। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময়সীমা দিয়েছেন। সেটা ঠিক সময়। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনের রূপরেখা বাস্তবায়নে সব সহযোগিতা করব।’ (প্রথম আলো, ১ জানুয়ারি, ২০২৫)
এরপরও নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে বলে মনে হয় না। প্রায় প্রতিদিনই রাজনীতিকেরা নির্বাচন নিয়ে নানা রকম কথা বলছেন। উপদেষ্টারা বলছেন। কোনো দল বলছে, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক। কোনো দলের দাবি, সবার আগে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। আবার কারও কারও সাফ কথা হলো ফ্যাসিবাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না। এখন প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগের আমলে যারা হত্যা, নির্যাতনসহ ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের বিচার হতে কত দিন সময় লাগবে, এ বিষয়ে দিনক্ষণ কি কেউ বেঁধে দিয়েছেন। দেননি। দিতেও পারেন না। এটা আদালতের বিষয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন ছিল। বিশেষ করে যেসব রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন ও পেশাজীবী মানুষ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল, তারা নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু সাড়ে ছয় মাস পর পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে। যেকোনো সরকারের জনসমর্থনের দুটি প্রধান উপাদান থাকে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখা—যাতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে পড়ে। সরকার দুটো ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ হিসেবে উপদেষ্টারা যে দোহাই দিন না কেন, মানুষ শুনতে চাইবে না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পেয়েছিল। ঘরে ঘরে অভাব ছিল, যোগাযোগব্যবস্থা বেহাল ছিল। মানুষ কিছুদিন সেটাও মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু এরপর আর সরকারকে সময় দিতে চায়নি, দেয়ও নি।
একই ঘটনা ঘটেছে অন্তর্বর্তী সরকারের বেলাতেও। গত বছর আগস্ট সেপ্টেম্বরে তাদের প্রতি জনগণের যে সমর্থন ছিল, সেটি আর এখন নেই। সাম্প্রতিককালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়েছে যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগের দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভও হয়েছে।
সরকার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক যাত্রার পর আর কমিশনের আর কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো নাকি এখন তাদের কাছে সুপারিশ বা প্রস্তাব পাঠাবে। কিন্তু জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠকে এ রকম ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা বসবে, আলোচনা করবে। সেই আলোচনার ভিত্তিতে সরকার ‘জুলাই সনদ’ চূড়ান্ত করবে এবং নির্বাচনের রূপরেখা ঘোষণা করবে।
ফেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখেও ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসার দিন-তারিখ ঘোষণা করেনি। সরকারি সূত্রে আরও জানা গেছে, একজন সাংবাদিককে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডেকে এনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে শুধু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। এর আগে এসএমএস-এ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ নিয়ে অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। কেউ কেউ সময়মতো আমন্ত্রণ না জানানোয় সংলাপ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সরকারের পক্ষ থেকে যতই আশ্বস্ত করা হোক না কেন, নির্বাচন নিয়ে জনমনে বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনিশ্চয়তা থেকেই গেছে। এটা কাটানোর উপায় হলো, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা। অমুক মাসের মধ্যে অমুক তারিখের মধ্যে অনির্দিষ্ট কথা না বলে নির্বাচনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করুন। নির্বাচনের দিন তারিখ ঘোষণা করলে এ নিয়ে জনমনে যে অনিশ্চয়তা ও সংশয় আছে, সেটা কেটে যাবে আশা করি। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোও বিবৃতি যুদ্ধে সময়ক্ষেপণ না করে নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়বে।
সংস্কারের কথা বলে নির্বাচনকে বিলম্বিত করা কতটা সমীচীন হচ্ছে, সেই বিচারের ভার বিজ্ঞ উপদেষ্টাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স থ ন য় সরক র উপদ ষ ট র সরক র র প প রথম আল পর স থ ত র র জন র জন য বল ছ ন আগস ট বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
ঐকমত্য কমিশনে যারা আছেন, তারা নিজেদের কাজে ফিরে যান: খসরু
ঐকমত্য কমিশনে যারা আছেন, তারা আগে যে কাজ করতেন, তাদেরকে সে কাজে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
শনিবার (১ নভেম্বর) দুপুরে রাজশাহী বিভাগের ব্যবসায়ীদের এক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ অনুরোধ জানান।
ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ তুলে আমীর খসরু বলেন, “জোর করে আরেকটি দলের অথবা দুটি দলের বা তিনটি দলের মতামত বাকি দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আমরা একটা রাজনৈতিক দল, তারাও একটি রাজনৈতিক দল। এখানে ঐকমত্যের বাইরে গিয়ে তাদের দাবি আমাদের ওপর চাপাতে চাচ্ছে, জনগণের ওপর চাপাতে চাচ্ছে। অথচ, ঐকমত্য কমিশন করার উদ্দেশ্য ছিল, ঐকমত্য যতটুকু হবে, সেটা নিয়ে আমরা জনগণের কাছে যাব।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, “ঐকমত্য হয়েছে, সই হয়েছে, তার বাইরে গিয়ে এখন নতুন নতুন দাবি নিয়ে আসছে। তাদের দাবি মানতে হবে, না মানলে এটা হবে, সেটা হবে...। আবার তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে ঐকমত্যের কিছু লোকজন। তাদেরও আবার মতামত আছে। রাজনীতিবিদদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে তারা তাদেরটা চাপাতে চাচ্ছে। আবার ঐকমত্য কমিশনেরও একটা নিজস্ব মতামত আছে। ঐকমত্য কমিশনের মতামতের জন্য তো তাদেরকে সেখানে রাখা হয়নি। এখন তাদেরও মতামত আছে এবং ওটা আমাদেরকে মানতে হবে।”
দেশের মানুষকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, “ঐকমত্য কমিশনে যারা আছেন, যাদের দাবি রাজনীতিবিদদের ওপর চাপাতে চান, জনগণের ওপর চাপাতে চান; তাদের প্রতি আমার অনুরোধ- আপনারা যে যেই কাজ করতেন আগে, ওই জায়গায় ফিরে যান। বাংলাদেশের মানুষকে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে দেন। আমি অনুরোধ করছি, আপনারা স্ব স্ব কাজে ফিরে যান। বাংলাদেশের মানুষকে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দয়া করে তাদের ওপরেই ছেড়ে দেন। আপনাদেরকে এই দায়িত্ব কেউ দেয় নাই।”
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ আগামী নির্বাচনে তাদের সিদ্ধান্ত দেবে। যেসব দল তাদের দাবি-দাওয়া চায়, তাদেরকে জনগণের কাছে যেতে হবে তো। জনগণের মতামত নিতে হবে তো। জনগণের ম্যান্ডেট নিতে হবে তো। মতামত জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া চলবে না।”
নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা চলছে, অভিযোগ করে আমীর খসরু বলেন, “ব্যবসায়ীরা আমাকে প্রতিনিয়ত বলছেন, ফেব্রুয়ারি নয়; পারলে এখনই নির্বাচন করে আমাদেরকে একটু মুক্ত করেন। আমাদের ব্যবসা ধ্বংস হওয়ার উপক্রম। আমরা কোনো বিনিয়োগ করতে পারছি না। বিদেশিরা কোনো বিনিয়োগ করছে না। সুতরাং, এই নির্বাচনকে যারা বিলম্বিত করতে চায় তাদের স্বার্থের জন্য, এখানে ব্যবসায়ীদেরকে সোচ্চার হতে হবে। দ্রুতই নির্বাচনের দিকে যেতে হবে।”
রাজশাহী জেলা পরিষদ মিলনায়তনে এই বিভাগীয় ব্যবসায়ী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। রাজশাহী বিভাগীয় ব্যবসায়ী ফোরাম এর আয়োজন করে। এতে বিএনপি চেয়ারপারসনের অন্যতম উপদেষ্টা ও সাবেক সিটি মেয়র মিজানুর রহমান মিনুসহ রাজশাহী বিভাগের আট জেলার ব্যবসায়ীরা অংশ নেন। সভাপতিত্ব করেন রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি লুৎফর রহমান।
ঢাকা/কেয়া/রফিক