মান যা-ই হোক, উন্নতি কেবল প্রকাশকের
Published: 28th, February 2025 GMT
প্রতিবছর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা। প্রকাশনার মান যাই হোক, উন্নতি হয়েছে প্রকাশকদের। তাদের গাড়ি-বাড়ি বা বিদেশ সফরে ঘাটতি দেখা যায় না। ছোট প্রকাশকরা বড় হয়ে উঠেছেন। ১০ বছর আগে যারা মেলায় এক ইউনিটের স্টল পেতে অনেক কষ্ট করতেন, এখন তারা প্যাভিলিয়ন নেন। লেখক ও প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলা একাডেমির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এক দশকে মেলায় অংশ নেওয়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৫ সালে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছিল ৩৫১টি। এবারের মেলায় তা এসে দাঁড়িয়েছে ৭০৮টিতে, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২৪ সালে ৬৪২, ২০২৩ সালে ৬০১ এবং ২০২২ সালে ৫৩৪টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।
প্রকাশকরা নানা সংকটের কথা জানালেও প্রতি মেলায় বই বিক্রির পরিমাণ নেহাত কম নয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রায় ৬০ কোটি, ২০২৩ সালে ৪৭ কোটি, ২০২২ সালে ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। করোনাকালের মধ্যে ২০২১ সালে মেলায় বিক্রি হয়েছিল ৩ কোটি টাকার বই। এর আগে ২০২০ সালে ৮২ কোটি, ২০১৯ সালে ৮০ কোটি, ২০১৮ সালের ৭০ কোটি, ২০১৭ সালে ৬৫ কোটি ৪০ লাখ, ২০১৬ সালে ৪২ কোটি এবং ২০১৫ সালে প্রায় ২২ কোটি টাকার বই বিক্রির তথ্য পাওয়া যায়।
বইমেলায় কয়েকজন তরুণ কবি-লেখকের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, যেভাবে মেলা চলছে এতে সাহিত্যের বিকাশ ঘটবে না। নতুন পাঠক তৈরি হবে না। প্রকাশকরাও লাভবান হবেন না। একজন প্রকাশক ৩০০ কপি বই ছেপে ১০-২০ হাজার টাকা লাভ করছেন। এতে প্রকাশনা শিল্প দাঁড়াচ্ছে না, লেখকও লাভবান হচ্ছেন না। একজন প্রকাশককে কেন ১০০ তরুণ কবির বই ছাপতে হবে? ১০ জন তরুণের বই ১০টি প্রকাশনী যদি ছাপে, তখন প্রতিটি বই ৫০০ কপি বিক্রি হবে। কিছু প্রকাশক দায়িত্বশীল আছেন, বাকিরাও যদি দায়িত্বশীল হয়ে তরুণদের বই প্রকাশ করেন, তাহলে হয়। ১৮ কোটি মানুষের দেশে ১০০ জন পেশাদার প্রকাশক না থাকলে বলা যায় না প্রকাশনার সংকট কাটবে।
বিগত বছরগুলোয় ছাপা বইয়ের পাঠক বেড়েছে না কমেছে– এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হচ্ছে ডিজিটাল সংস্করণ বইয়ের (ই-বুক ও অডিও বুক) বাজার। বিশেষ করে তরুণ পাঠকরা কিন্ডল, মোবাইল ফোন বা অন্য ডিভাইসে বই পড়তে পছন্দ করেন। সেদিকে নজর রেখে দেশে ডিজিটাল সংস্করণের বই প্রকাশ ও বিক্রির কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে বইটই, বইঘর ও সেইবই– এর নাম বেশি শোনা যায়। এ ছাড়া রকমারি ডটকমেও ই-বুক বিক্রি হয়।
খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পেঙ্গুইন র্যানডম হাউসের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ১৫ হাজার ছাপা সংস্করণ এবং ৭০ হাজার ডিজিটাল সংস্করণের বই প্রকাশ করে।
বইঘরের মালিকানা প্রতিষ্ঠান ই বি সলিউশন্স লিমিটেডের সহকারী ব্যবস্থাপক সোমেশ্বর অলি সমকালকে বলেন, ই-বুক ও অডিও বুক এক বিশাল সম্ভাবনাময় খাত। প্রতিদিন এই নতুন ক্ষেত্রটি জনপ্রিয় হচ্ছে, বিক্রি বাড়ছে। বিনামূল্যের বইগুলোর ডাউনলোডের চিত্র এই বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে। অনেক প্রকাশনী এখন বইঘরসহ অন্য ই-বুক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের বইয়ের ডিজিটাল সংস্করণ বের করছে। এ বছর মেলায় প্রকাশের আগে ১০ লেখকের নতুন বইয়ের ডিজিটাল সংস্করণ এনেছে বইঘর। এই ই-বুকগুলোর দাম রাখা হয়েছে ছাপা সংস্করণের সমান। সেই সঙ্গে ছাপা সংস্করণে একটি কিউআর কোড দেওয়া থাকছে, যা দিয়ে একবার ই-বুক পড়া যাবে।
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বাতিঘরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাফর আহমদ রাশেদ সমকালকে বলেন, ১০ বছর আগে যেখানে ১০০ কপি বই বিক্রি হতো, সেখানে এখন ১২০ কপি বিক্রি হচ্ছে। তাহলে তো পাঠক বেড়েছে। তবে এই বৃদ্ধি আসলে যথেষ্ট নয়। এই পাঠকদের কেউ থ্রিলার, কেউ শিশুতোষ, কেউ উপন্যাস, কেউ গবেষণা, কেউ আবার রাজনীতির বই পড়েন। বই ভালো বিক্রি হয় এমন লেখক বাংলাদেশে খুবই কম। খুব হলে ১০ জন আছেন, যাদের বই বছরে ২ হাজার কপি বিক্রি হয়। ৫০০ কপি বই বিক্রি তো কোনো হিসাবের মধ্যে পড়ে না। একটি বইয়ের পেছনে আপনি কষ্ট করবেন, কিন্তু এক-দুই বছর পর তার আর বিক্রি নেই। পেঙ্গুইনের মতো প্রকাশনাগুলো একটি বই ৪০ বছর ধরে ছাপছে।
আরেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বললেন, বই যত কম ছাপবেন, তত খরচ বাড়বে। দিন দিন বই বিক্রি কমে আসছে, ফলে দামও বেড়ে যাচ্ছে। বিক্রি কম বলে দাম বেশি, না দাম বেশি বলে বিক্রি কম– তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু এটা ঠিক যে, পাঠক কমেছে। মোটা দাগে বই বিক্রির পরিমাণ বেশি দেখা যায়। কিন্তু আগে অল্পসংখ্যক বই বেশি বিক্রি হতো, এখন বেশিসংখ্যক বই অল্প বিক্রি হয়।
এ প্রসঙ্গে একজন জ্যেষ্ঠ লেখক বলেন, বই বিক্রি হয় না, অথচ প্রকাশনীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে– এটা তো একটা প্যারাডক্স।
কবি কামরুজ্জামান কামু বলেন, প্রকাশক বেড়ে থাকলে পাঠক অবশ্যই বেড়েছে। উৎপাদন বাড়ার অর্থ হচ্ছে, ভোক্তার সংখ্যাবৃদ্ধি। বইয়ের পাঠক মাঝে কমেছিল, সেটা আবার ঠিক হয়ে গেছে। অনলাইনের মাধ্যমেও মানুষ বই পড়ায় উৎসাহী হচ্ছে যে, ওই বইটি পড়তে হবে। বইয়ের স্বাদ তো আর অন্য কোনো মাধ্যমে পাওয়া যায় না। ফলে বইয়ের পাঠক আছে। আগে একমাত্র মাধ্যম ছিল বই, সেটা তো আর পাবেন না এখন। তবে অন্য মাধ্যমের পাশাপাশি বইও পড়ে মানুষ। আগেও সব মানুষ বই পড়ত তা নয়। বই সহজলভ্য হয়েছে। ঘরে বসে অর্ডার দিলে হাতে পাওয়া যায়।
দেশ পাবলিকেশন্সের কর্ণধার অচিন্ত্য চয়ন বলেন, পাঠকের কথা ভেবে মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করলে তা ধীরগতিতে হলেও ভালো বিক্রি হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোর পর্যবেক্ষণ বলছে, চটুল বইয়ের বদলে সিরিয়াস বইয়ের পাঠক বাড়ছে। আবার অনেক পাঠক ছাপা বইয়ের বদলে ই-বুক পড়ছেন। আসলে পাঠক নানাভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে এক প্রকাশক বলেন, সরকার পরিবর্তন হওয়ায় কিছু বই সরিয়ে ফেলতে হয়েছে। কিন্তু সরকার বদলের সঙ্গে বই সরানোর সম্পর্ক কী? এখানে কীভাবে বই বিকশিত হবে? রাষ্ট্র যদি সহনশীল না হয়, মতপ্রকাশ করতে না দেয়, কীভাবে বই করবেন?
এদিকে কোনো বই নকল হলে (অনুমতি ছাড়া ভিন্ন প্রকাশনী ছাপলে) সুষ্ঠু সমাধান পাওয়া কঠিন। জানা গেল, বাতিঘরের একটি বই নকল করায় প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা অভিযুক্ত প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলতে যান। কিন্তু সেই প্রকাশক এ নিয়ে মোটেও বিব্রত নন। বরং তিনি নকল বইগুলো কিনে নেওয়ার পরামর্শ দেন। এ নিয়ে মামলা করেও দীর্ঘসূত্রতার জটিলতায় পড়েন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বই ড জ ট ল স স করণ কর মকর ত বই ব ক র ষ ট কর র বই প
এছাড়াও পড়ুন:
বিএনপি ও জামায়াতের কাছে কেন আরপিওর ২১ ধারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল
নির্বাচনের আগেই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এ নিয়ে গত ছয় দিনে দল দুটির পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যেই নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন আরপিওর ২১ ধারার সংশোধনীর পরিবর্তন। জামায়াত মনে করে, সরকার বিএনপির চাপে নতি স্বীকার করে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত খসড়া সংশোধনী বাতিল করেছে। আর বিএনপি মনে করে, জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সরকার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশের খসড়ায় ২১ ধারার পরিবর্তন করে; যা গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদিত হয়। আরপিওর ২১ ধারা সংশোধনীর ওই পরিবর্তন বহাল থাকলে কোনো দল জোটগত নির্বাচন করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে বাধ্য ছিল। ৩০ অক্টোবর সেটি আবার পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত হয়। তাতে জোটগত নির্বাচন করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা থাকছে না। এতে জামায়াত বেশ ক্ষুব্ধ হয়।
যদিও সরকারের দিক থেকে এই নতুন সিদ্ধান্তের তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে সরকার-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সেটি শুধু বিএনপির দাবির কারণে নয়, ছোট বিভিন্ন দলেরও দাবি ছিল।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার নিশ্চিত করেছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবেই। আমরা সরকারের কথায় বিশ্বাস করি। সুতরাং এখন থেকে আমাদের সব কার্যক্রম নির্বাচনকেন্দ্রিক। এখন সরকার তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কীভাবে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে, সেটি তাদের বিষয়। তবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারকে যতটুকু সহযোগিতা দেওয়া দরকার, সেটা বিএনপি করবে।’
বাংলাদেশের শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যতই সময় যাচ্ছে...একটা পুরোপুরি নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চলছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপিএ দিকে আজ সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির নিয়মিত সভা হবে। তবে অন্য দিন রাতে সভা হলেও আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় সভা বসবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আজকের সভায় আলোচ্যসূচিতে প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করার বিষয় থাকবে। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন–সংক্রান্ত বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে।
হঠাৎ কেন সামনে এল আরপিওর সংশোধনী
আরপিওর ২১ ধারার সংশোধন বিএনপি ও জামায়াতের কাছে হঠাৎ করে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫–এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন হয়। আরপিওর ২১ ধারার এই সংশোধনীর ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো। এতে জামায়াত খুশি হলেও বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো অস্বস্তিতে পড়েছিল। এ কারণে এর পরিবর্তন চেয়ে বিএনপি নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও আইন উপদেষ্টাকে পৃথক চিঠি দেয়। এর পরেই সরকার আরপিওর ২১ ধারার পরিবর্তন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, নতুন সিদ্ধান্তে বিএনপি উপকৃত হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো, এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ভোটের হিসাব-নিকাশে ক্ষতিগ্রস্ত হতো বিএনপি। অন্য দিকে এতে লাভবান হয় জামায়াতসহ তার মিত্র দলগুলো। এর হিসাবটা হচ্ছে, ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আছে একসঙ্গে নির্বাচন করার জন্য এবং সংসদ সদস্য পদে জোটের প্রার্থী হওয়ার আশায়। সে ক্ষেত্রে বিএনপির ‘ধানের শীষ’ প্রতীককে ছোট দলগুলোর নেতারা জয়ের ক্ষেত্রে ‘ভরসা’ হিসেবে দেখেন।
...যে কারণে ফ্যাসিজমের যে রাস্তা, আমরা সংস্কারে বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, এগুলো ওনারা বন্ধ করতে দিচ্ছে না। সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের নায়েবে আমির, জামায়াতএখন জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হলে ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করতে খুব আগ্রহী হবে না। এর কারণ দুটি। প্রথমত, বিএনপির সমর্থন পেলেও ব্যক্তি জনপ্রিয়তা না থাকলে ছোট দলগুলোর নেতাদের নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে জেতা কঠিন হয়ে পড়বে। অন্য দিকে জোটের প্রার্থী হিসেবে বিএনপি আসন ছাড় দিলেও দলের কেউ বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলে ভোটে জেতা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে বিদ্রোহীকে সরাতে বিএনপির নেতৃত্ব কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সে প্রশ্নও আছে।
এ ছাড়া এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতে যে আটটি দল আছে, তারা আরপিওর ওই ধারা পরিবর্তনের পক্ষে। অর্থাৎ দলগুলো জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে—এর পক্ষে। এর জন্য দলগুলো যৌথ কর্মসূচিও করছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জামায়াত যে নির্বাচনী জোট বা নির্বাচনী সমঝোতা করতে চাইছে, সে দলগুলো পরস্পর আস্থাশীল। তাদের কাছে ‘দাঁড়িপাল্লা’ বা ‘হাতপাখা’ বা ‘রিকশা’ প্রতীক কোনো বিষয় নয়। সমঝোতা হলে সবাই ওই প্রতীকের পক্ষে এক হয়ে কাজ করবে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা নেই। অন্যদিকে বিএনপির জোটের ক্ষেত্রে ভাবনা হচ্ছে, ধানের শীর্ষ প্রতীক না দিলে ভোটের আগেই আসন হারানোর আশঙ্কা থাকবে।
গতকাল সকালে এক বিবৃতিতে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার দাবি করেন, একটি দলের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে সরকার আরপিওর সর্বশেষ সংশোধনী বাতিল করেছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) বাতিল করা হলে সেটি ন্যক্কারজনক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হবে।
আরপিওর ২১ ধারার এই সংশোধনীর ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো। এতে জামায়াত খুশি হলেও বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো অস্বস্তিতে পড়েছিল। এ কারণে এর পরিবর্তন চেয়ে বিএনপি নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও আইন উপদেষ্টাকে পৃথক চিঠি দেয়।ঐকমত্য কমিশন সুপারিশের পর থেকেই উত্তাপ
২৮ অক্টোবর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সুপারিশ জমা দেয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে—সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। এই সময়ের মধ্যে সংবিধান সংশোধন না করলে আপনা–আপনি সেটা সংবিধানে যুক্ত হবে। এ ছাড়া গণভোট কবে, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিন নাকি তার আগে—সেটা ঠিক করবে সরকার।
চরম অনৈক্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত ছিল, তারা কীভাবে হারানো ঐক্য ফিরে পেতে পারে, সেটি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা দরকার।অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহবিএনপি প্রথমত ক্ষুব্ধ হয় বাস্তবায়নের সুপারিশ থেকে ভিন্নমত বাদ দেওয়ায়। এ ছাড়া সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন, ২৭০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া, সেটা না হলে আপনা-আপনি সংবিধানে যুক্ত হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে দলটির আপত্তি আছে। দলটি গণভোট আগে নয়, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে চায়। জামায়াতের অবস্থান এর পুরো বিপরীত।
এসব নিয়ে পরস্পরকে লক্ষ্য করে দল দুটির রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতি ক্রমেই বাড়তে থাকে। জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে এটা আসছে যে জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এমন বক্তব্য অবশ্য বিএনপি আরও আগে থেকেই দিয়ে আসছে।
গতকাল দুপুরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা দেখছি যে বাংলাদেশের শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যতই সময় যাচ্ছে, ততই বাংলাদেশে একটা অ্যানার্কিক সিচুয়েশন, একটা পুরোপুরি নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চলছে।’
জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে এটা আসছে যে জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এমন বক্তব্য অবশ্য বিএনপি আরও আগে থেকেই দিয়ে আসছে।এর আগের দিন শনিবার বিএনপির মহাসচিব জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নির্বাচনকে যতটা বাধা সৃষ্টি করেছেন, সেটা আপনারা করেছেন।’
পাল্টা বক্তব্য এসেছে জামায়াতের দিক থেকেও। দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের গতকাল বিকেলে ঢাকায় এক সেমিনারে বলেছেন, ‘বিএনপি ভেতরে-ভেতরে আবার ফ্যাসিস্ট হওয়ার একটা খায়েশ আছে মনে হচ্ছে। যে কারণে ফ্যাসিজমের যে রাস্তা, আমরা সংস্কারে বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, এগুলো ওনারা বন্ধ করতে দিচ্ছেন না।’
অবশ্য সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে বিএনপিকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপি যতই উসকানি দিক, জামায়াত বিএনপির সঙ্গে বিরোধে জড়াতে চায় না। মানুষের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক আছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দূর করে স্পষ্ট করা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। সুতরাং আসুন আমরা সব ভুলে আলোচনায় বসি।’
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে এই মুখোমুখি অবস্থা চলতে থাকলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে। অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, একটা চরম অনৈক্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত ছিল, তারা কীভাবে হারানো ঐক্য ফিরে পেতে পারে, সেটি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা দরকার।