মান যা-ই হোক, উন্নতি কেবল প্রকাশকের
Published: 28th, February 2025 GMT
প্রতিবছর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা। প্রকাশনার মান যাই হোক, উন্নতি হয়েছে প্রকাশকদের। তাদের গাড়ি-বাড়ি বা বিদেশ সফরে ঘাটতি দেখা যায় না। ছোট প্রকাশকরা বড় হয়ে উঠেছেন। ১০ বছর আগে যারা মেলায় এক ইউনিটের স্টল পেতে অনেক কষ্ট করতেন, এখন তারা প্যাভিলিয়ন নেন। লেখক ও প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলা একাডেমির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এক দশকে মেলায় অংশ নেওয়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৫ সালে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছিল ৩৫১টি। এবারের মেলায় তা এসে দাঁড়িয়েছে ৭০৮টিতে, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২৪ সালে ৬৪২, ২০২৩ সালে ৬০১ এবং ২০২২ সালে ৫৩৪টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।
প্রকাশকরা নানা সংকটের কথা জানালেও প্রতি মেলায় বই বিক্রির পরিমাণ নেহাত কম নয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রায় ৬০ কোটি, ২০২৩ সালে ৪৭ কোটি, ২০২২ সালে ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। করোনাকালের মধ্যে ২০২১ সালে মেলায় বিক্রি হয়েছিল ৩ কোটি টাকার বই। এর আগে ২০২০ সালে ৮২ কোটি, ২০১৯ সালে ৮০ কোটি, ২০১৮ সালের ৭০ কোটি, ২০১৭ সালে ৬৫ কোটি ৪০ লাখ, ২০১৬ সালে ৪২ কোটি এবং ২০১৫ সালে প্রায় ২২ কোটি টাকার বই বিক্রির তথ্য পাওয়া যায়।
বইমেলায় কয়েকজন তরুণ কবি-লেখকের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, যেভাবে মেলা চলছে এতে সাহিত্যের বিকাশ ঘটবে না। নতুন পাঠক তৈরি হবে না। প্রকাশকরাও লাভবান হবেন না। একজন প্রকাশক ৩০০ কপি বই ছেপে ১০-২০ হাজার টাকা লাভ করছেন। এতে প্রকাশনা শিল্প দাঁড়াচ্ছে না, লেখকও লাভবান হচ্ছেন না। একজন প্রকাশককে কেন ১০০ তরুণ কবির বই ছাপতে হবে? ১০ জন তরুণের বই ১০টি প্রকাশনী যদি ছাপে, তখন প্রতিটি বই ৫০০ কপি বিক্রি হবে। কিছু প্রকাশক দায়িত্বশীল আছেন, বাকিরাও যদি দায়িত্বশীল হয়ে তরুণদের বই প্রকাশ করেন, তাহলে হয়। ১৮ কোটি মানুষের দেশে ১০০ জন পেশাদার প্রকাশক না থাকলে বলা যায় না প্রকাশনার সংকট কাটবে।
বিগত বছরগুলোয় ছাপা বইয়ের পাঠক বেড়েছে না কমেছে– এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হচ্ছে ডিজিটাল সংস্করণ বইয়ের (ই-বুক ও অডিও বুক) বাজার। বিশেষ করে তরুণ পাঠকরা কিন্ডল, মোবাইল ফোন বা অন্য ডিভাইসে বই পড়তে পছন্দ করেন। সেদিকে নজর রেখে দেশে ডিজিটাল সংস্করণের বই প্রকাশ ও বিক্রির কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে বইটই, বইঘর ও সেইবই– এর নাম বেশি শোনা যায়। এ ছাড়া রকমারি ডটকমেও ই-বুক বিক্রি হয়।
খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পেঙ্গুইন র্যানডম হাউসের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ১৫ হাজার ছাপা সংস্করণ এবং ৭০ হাজার ডিজিটাল সংস্করণের বই প্রকাশ করে।
বইঘরের মালিকানা প্রতিষ্ঠান ই বি সলিউশন্স লিমিটেডের সহকারী ব্যবস্থাপক সোমেশ্বর অলি সমকালকে বলেন, ই-বুক ও অডিও বুক এক বিশাল সম্ভাবনাময় খাত। প্রতিদিন এই নতুন ক্ষেত্রটি জনপ্রিয় হচ্ছে, বিক্রি বাড়ছে। বিনামূল্যের বইগুলোর ডাউনলোডের চিত্র এই বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে। অনেক প্রকাশনী এখন বইঘরসহ অন্য ই-বুক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের বইয়ের ডিজিটাল সংস্করণ বের করছে। এ বছর মেলায় প্রকাশের আগে ১০ লেখকের নতুন বইয়ের ডিজিটাল সংস্করণ এনেছে বইঘর। এই ই-বুকগুলোর দাম রাখা হয়েছে ছাপা সংস্করণের সমান। সেই সঙ্গে ছাপা সংস্করণে একটি কিউআর কোড দেওয়া থাকছে, যা দিয়ে একবার ই-বুক পড়া যাবে।
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বাতিঘরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাফর আহমদ রাশেদ সমকালকে বলেন, ১০ বছর আগে যেখানে ১০০ কপি বই বিক্রি হতো, সেখানে এখন ১২০ কপি বিক্রি হচ্ছে। তাহলে তো পাঠক বেড়েছে। তবে এই বৃদ্ধি আসলে যথেষ্ট নয়। এই পাঠকদের কেউ থ্রিলার, কেউ শিশুতোষ, কেউ উপন্যাস, কেউ গবেষণা, কেউ আবার রাজনীতির বই পড়েন। বই ভালো বিক্রি হয় এমন লেখক বাংলাদেশে খুবই কম। খুব হলে ১০ জন আছেন, যাদের বই বছরে ২ হাজার কপি বিক্রি হয়। ৫০০ কপি বই বিক্রি তো কোনো হিসাবের মধ্যে পড়ে না। একটি বইয়ের পেছনে আপনি কষ্ট করবেন, কিন্তু এক-দুই বছর পর তার আর বিক্রি নেই। পেঙ্গুইনের মতো প্রকাশনাগুলো একটি বই ৪০ বছর ধরে ছাপছে।
আরেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বললেন, বই যত কম ছাপবেন, তত খরচ বাড়বে। দিন দিন বই বিক্রি কমে আসছে, ফলে দামও বেড়ে যাচ্ছে। বিক্রি কম বলে দাম বেশি, না দাম বেশি বলে বিক্রি কম– তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু এটা ঠিক যে, পাঠক কমেছে। মোটা দাগে বই বিক্রির পরিমাণ বেশি দেখা যায়। কিন্তু আগে অল্পসংখ্যক বই বেশি বিক্রি হতো, এখন বেশিসংখ্যক বই অল্প বিক্রি হয়।
এ প্রসঙ্গে একজন জ্যেষ্ঠ লেখক বলেন, বই বিক্রি হয় না, অথচ প্রকাশনীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে– এটা তো একটা প্যারাডক্স।
কবি কামরুজ্জামান কামু বলেন, প্রকাশক বেড়ে থাকলে পাঠক অবশ্যই বেড়েছে। উৎপাদন বাড়ার অর্থ হচ্ছে, ভোক্তার সংখ্যাবৃদ্ধি। বইয়ের পাঠক মাঝে কমেছিল, সেটা আবার ঠিক হয়ে গেছে। অনলাইনের মাধ্যমেও মানুষ বই পড়ায় উৎসাহী হচ্ছে যে, ওই বইটি পড়তে হবে। বইয়ের স্বাদ তো আর অন্য কোনো মাধ্যমে পাওয়া যায় না। ফলে বইয়ের পাঠক আছে। আগে একমাত্র মাধ্যম ছিল বই, সেটা তো আর পাবেন না এখন। তবে অন্য মাধ্যমের পাশাপাশি বইও পড়ে মানুষ। আগেও সব মানুষ বই পড়ত তা নয়। বই সহজলভ্য হয়েছে। ঘরে বসে অর্ডার দিলে হাতে পাওয়া যায়।
দেশ পাবলিকেশন্সের কর্ণধার অচিন্ত্য চয়ন বলেন, পাঠকের কথা ভেবে মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করলে তা ধীরগতিতে হলেও ভালো বিক্রি হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোর পর্যবেক্ষণ বলছে, চটুল বইয়ের বদলে সিরিয়াস বইয়ের পাঠক বাড়ছে। আবার অনেক পাঠক ছাপা বইয়ের বদলে ই-বুক পড়ছেন। আসলে পাঠক নানাভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে এক প্রকাশক বলেন, সরকার পরিবর্তন হওয়ায় কিছু বই সরিয়ে ফেলতে হয়েছে। কিন্তু সরকার বদলের সঙ্গে বই সরানোর সম্পর্ক কী? এখানে কীভাবে বই বিকশিত হবে? রাষ্ট্র যদি সহনশীল না হয়, মতপ্রকাশ করতে না দেয়, কীভাবে বই করবেন?
এদিকে কোনো বই নকল হলে (অনুমতি ছাড়া ভিন্ন প্রকাশনী ছাপলে) সুষ্ঠু সমাধান পাওয়া কঠিন। জানা গেল, বাতিঘরের একটি বই নকল করায় প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা অভিযুক্ত প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলতে যান। কিন্তু সেই প্রকাশক এ নিয়ে মোটেও বিব্রত নন। বরং তিনি নকল বইগুলো কিনে নেওয়ার পরামর্শ দেন। এ নিয়ে মামলা করেও দীর্ঘসূত্রতার জটিলতায় পড়েন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বই ড জ ট ল স স করণ কর মকর ত বই ব ক র ষ ট কর র বই প
এছাড়াও পড়ুন:
ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ
এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।
সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।
ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।
‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।
ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।
খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।
এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরীডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।
প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।
পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।
ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।
বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।
নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউবইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।
ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।
২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।