বঙ্গোপসাগরের আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের সেন্ট মার্টিন স্থানীয় লোকজনের কাছে পরিচিত ‘নারকেল জিঞ্জিরা’ নামে। দেশে-বিদেশের নানা ওয়েবসাইটে এই দ্বীপকে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ কারণে দেশের বেশির ভাগ মানুষ সেন্ট মার্টিনকে প্রবাল দ্বীপ হিসেবেই জানে। কক্সবাজার জেলা তথ্য বাতায়ন এবং মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ায় সেন্ট মার্টিনকে প্রবাল দ্বীপ বলা হয়েছে। কিন্তু সেন্ট মার্টিন কি আসলে প্রবাল দ্বীপ? সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করেন যাঁরা, তাঁরা কিন্তু এই প্রসঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন।

সেন্ট মার্টিনের প্রবালসহ জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ চৌধুরী। সর্বশেষ তিনি গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সেন্ট মার্টিন সফর করেন। টানা কয়েক দিন সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গবেষণা দলের নেতৃত্ব দেন তিনি।

সেন্ট মার্টিন ‘প্রবাল দ্বীপ’ কি না, জানতে চাইলে শাহনেওয়াজ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এটি মানুষের ভুল ধারণা। সেন্ট মার্টিন আসলে প্রবাল দ্বীপ নয়, প্রবালসমৃদ্ধ পাথুরে দ্বীপ। প্রবাল দ্বীপ প্রবালের কারণে তৈরি হয়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পাথুরে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই এখানে প্রবাল বা কোরাল ছিল। এখনো আছে। কক্সবাজারের পানি ঘোলাটে হলেও সেন্ট মার্টিনের পানি পরিষ্কার। কারণ, সেখানে পলি প্রবাহের প্রভাব কম। পানির লবণাক্ততা ও স্বচ্ছতা বেশি থাকার কারণেই সেখানে কোরাল তৈরি হয়। তবে প্রবাল তৈরি হলেও এটি প্রবাল দ্বীপ নয়।

২০২২ সালের ১ জুন সায়েন্স ডাইরেক্ট নামের আন্তর্জাতিক গবেষণা সাময়িকীর ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। কানাডীয় জীব বিজ্ঞানী টমাস টমাসিকের সঙ্গে যৌথভাবে ওই গবেষণা করেছিলেন গবেষক শাহনেওয়াজ চৌধুরী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক গবেষক মোহম্মদ নুরুন্নবী। গবেষণার শিরোনাম ছিল, ‘প্রবাল দ্বীপ হিসেবে সেন্ট মার্টিনকে ভুল চরিত্রায়ণের প্রভাব’।

গবেষণায় বলা হয়েছে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে কিছু প্রবালপ্রাচীর থাকলেও এটি মূলত পাললিক শিলা এবং বালির স্তর দ্বারা গঠিত। ভুল ‘চরিত্রায়ণের’ কারণে দ্বীপের প্রকৃত বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশগত গুরুত্ব উপেক্ষিত হতে পারে। সেই সঙ্গে দ্বীপের পর্যটন, মৎস্যসম্পদ এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মূল্যায়নেও ভুল হতে পারে।

তবে সেন্ট মার্টিন যে একটি প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ তাতে সন্দেহ নেই। এ নিয়ে শাহনেওয়াজ চৌধুরী বলেন, সেন্ট মার্টিনে যে পাথুরে প্রবাল পাওয়া যায়, সেটি আন্দামান দীপপুঞ্জের পরে শুধু শ্রীলঙ্কা, তামিলনাড়ুর ও মিয়ানমারের পশ্চিম উপকূলের দিকে দেখা মেলে। অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরের উত্তরে একমাত্র সেন্ট মার্টিনে পাথুরে প্রবালের দেখা মেলে, যা এ অঞ্চলের সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

এ কারণে পরিবেশবিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেন্ট মার্টিনকে সরাসরি প্রবাল দ্বীপ না বলে প্রবালসমৃদ্ধ পাথুরে দ্বীপ বলা যেতে পারে। কারণ, দ্বীপের চার দিকে ছড়িয়ে আছে পাথরের স্তূপ। অভ্যন্তরীণ ভূখণ্ডের দক্ষিণাংশের গলাচিপা, দক্ষিণপাড়া, দিয়ারমাথা, মাঝরপাড়া এলাকার ফসলি জমিতেও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য পাথরখণ্ড। সমুদ্রের ১-৩ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা এসব পাথরখণ্ডের মধ্যেই কিন্তু সাদা, লাল, নীল, সবুজসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রবাল জন্মে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের গঠন নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন গবেষক দল। ১৫ ফেব্রুয়ারি তোলা.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

স্তম্ভিত হারমানপ্রীত, আবেগ-রোমাঞ্চ-গর্ব-ভালোবাসায় মিলেমিশে একাকার

২০০৫ ও ২০১৭, ভারতের নারী ক্রিকেট দল ওয়ানডে বিশ্বকাপের খুব কাছে গিয়েও শিরোপা জিততে পারেননি। হারমানপ্রীত কৌররা লম্বা সেই অপেক্ষা দূর করলেন দুই হাজার পঁচিশে।

মুম্বাইয়ের নাভিতে প্রায় ষাট হাজার দর্শকের সামনে উচিুঁয়ে ধরলেন ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা। ২০১৭ সালের ফাইনালেও খেলেছিলেন হারমানপ্রীত। রানার্সআপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে। এবার আর ভুল করলেন না। অধিনায়ক হয়ে জিতলেন শিরোপা। গড়লেন ইতিহাস। যে ইতিহাস কখনো মুছবে না। কখনো জং ধরবে না।

ঝলমলে হাসিতে হারমানপ্রীত ট্রফি হাতে নিয়ে প্রেস কনফারেন্স রুমে প্রবেশ করেন। এবার তার আবেগের ধরণ ছিল ভিন্ন, যেন স্বপ্ন পূরণের মাখামাখি। লম্বা সংবাদ সম্মেলন জুড়ে বারবার তার কণ্ঠ ধরে আসে। আবেগ, রোমাঞ্চ, গর্ব, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তবে একটি শব্দের ওপর বারবার ফিরে আসছিলেন তিনি, তা হলো আত্মবিশ্বাস,
‘‘আমি কেবল আমার অনুভূতি প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। আমি স্তম্ভিত, আমি বুঝতে পারছি না। আসলে, এতে উত্থান-পতন ছিল, কিন্তু দলের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছিল। আমি প্রথম দিন থেকেই এটা বলে আসছি। আমরা বাম বা ডানে তাকাচ্ছিলাম না। আমরা কেবল আমাদের মূল লক্ষ্যের দিকে তাকিয়েছিলাম।’’ - বলেছেন হারমানপ্রীত।

স্বপ্ন পূরণের রাতে হারমানপ্রীত কাছে পেয়েছিলেন সাবেক তিন ক্রিকেটার মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামী এবং অঞ্জুম চোপড়াকে। প্রত‌্যেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন ভারতকে বিশ্বকাপ জেতানোর। তাদের অধরা সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন জেমিমা, দীপ্তি, শেফালি, স্মৃতিরা।

শিরোপা উৎসবে যোগ দেন মিতালি, ঝুলন, আঞ্জুমরা। তাদের হাতেও ট্রফি তুলে দেওয়া হয়। প্রাক্তন খেলোয়াড়দের সাথে সেই মুহূর্তটি ভাগ করে নেওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে হারমানপ্রীত বলেন, ‘‘ঝুলন দি আমার সবচেয়ে বড় আইডল ছিলেন। যখন আমি দলে যোগ দিই, তখন তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আমি যখন খুব কাঁচা ছিলাম এবং ক্রিকেট সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না, তখনও তিনি সবসময় আমাকে সমর্থন করতেন। অঞ্জুম দি-ও তাই। এই দুজন আমার জন্য দারুণ সমর্থন ছিলেন। আমি কৃতজ্ঞ যে আমি তাদের সাথে এই বিশেষ মুহূর্তটি ভাগ করে নিতে পেরেছি। এটি খুব আবেগপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। আমার মনে হয় আমরা সবাই এটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে, আমরা এই ট্রফি স্পর্শ করতে পেরেছি।’’

তার জন‌্য বিশ্বকাপের পুরো অভিযানটিই ছিল গভীরভাবে আবেগপূর্ণ। রাউন্ড রবিন লিগে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ম‌্যাচ হার। চোট, অফ ফর্ম, জড়তা। সব সামলে সেরা হয়েছেন। তাইতো নিজেদের নিয়ে গর্বটাও বেশি হারমানপ্রীতদের, ‘‘আমরা প্রথম বল থেকেই অনুভব করেছিলাম যে আমরা জিততে পারি, কারণ শেষ তিন ম্যাচে আমাদের দল যেভাবে খেলছিল, তাতে আমাদের জন্য অনেক কিছুর পরিবর্তন এসেছিল, বিশেষ করে আমাদের আত্মবিশ্বাস। আমরা অনেকদিন ধরেই ভালো ক্রিকেট খেলছি। আমরা জানতাম দল হিসেবে আমরা কী করতে পারি।”

"গত এক মাস খুব আকর্ষণীয় ছিল। সেই দিনটির (ইংল্যান্ডের কাছে হারের) পর আমাদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসে। সেই রাত আমাদের জন্য অনেক কিছু বদলে দিয়েছিল। এটি প্রত্যেকের উপর প্রভাব ফেলেছিল। আমরা বিশ্বকাপের জন্য আরও প্রস্তুত হলাম। আমরা ভিজ্যুয়ালাইজেশন এবং মেডিটেশন শুরু করেছিলাম। আমরা বারবার বলছিলাম, যে জন‌্য আমরা এখানে এসেছি এবং এবার আমাদের এটা করতেই হবে।" - যোগ করেন হারমানপ্রীত।

প্রথম যে কোনো কিছুই আনন্দের। রোমাঞ্চের। এই অভিজ্ঞতা শব্দে বয়ান করা যায় না। বয়ান করা সম্ভব হয় না। হারমানপ্রীতও পারেন না নিজের সবটা উজার করে বলতে। তবে এই শিরোপায় তাদের নাম লিখা হবে সেই আত্মবিশ্বাস তারও ছিল, ‘‘আমরা বহু বছর ধরে এটি নিয়ে কথা বলছি—আমরা ভালো ক্রিকেট খেলছি, কিন্তু আমাদের একটি বড় শিরোপা জিততেই হতো।"

ঢাকা/ইয়াসিন

সম্পর্কিত নিবন্ধ