নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কি কেবল বলেই যাব, কিছুই করব না আমরা
Published: 10th, March 2025 GMT
নারীর সম–অধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় ১৯০৯ সাল থেকে। প্রথমে নিউজিল্যান্ড, পরে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপজুড়ে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ ১৯৭৭ সালে বিশ্ব নারী দিবসের স্বীকৃতি দেয় এবং দিবসটি পালিত হতে থাকে বিশ্বজুড়ে। নারী দিবসের মূলমন্ত্রই হলো নারীর অধিকার ও সচেতনতা। কিন্তু এত বছর পরও আমরা দেখছি দেশে নারীর শরীর, স্বাস্থ্য ও প্রজননবিষয়ক অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। নারীকে সন্তান ধারণ ও জন্ম দেওয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়। মানবজাতির টিকে থাকা ও বংশবৃদ্ধিতে যা সবচেয়ে জরুরি। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় নারীর অধিকার কতটুকু?
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধপ্রজননসংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত স্বামী ও স্ত্রী মিলে একত্রে নিতে হবে। সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ কখন নেবেন, কয়টি নেবেন, কত বিরতিতে নেবেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কী হবে—এর কোনোটাই নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। এসব বিষয়ে নারীর সঠিক জ্ঞান, সচেতনতা ও অংশীদারত্ব দরকার। এখনো বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক মেয়ের ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায় এবং সন্তান জন্ম দেয়। এই বালিকাদের নিজের শরীর ও স্বাস্থ্য নিয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বা বয়স কোনোটাই হয়নি। তাই প্রজননস্বাস্থ্যে নারীর অধিকার পেতে চাইলে অবশ্যই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে হবে।
আরও পড়ুনমিতা তঞ্চঙ্গ্যা যেভাবে দেশের প্রথম নারী ফরেস্টার০৮ মার্চ ২০২৫গর্ভধারণ–পূর্ববর্তী পরামর্শসন্তান ধারণের আগে প্রি–কনসেপশনাল পরামর্শ আমাদের দেশে খুব একটা প্রচলিত নেই। কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই যেকোনো সময় অপরিকল্পিতভাবে বেশির ভাগ দম্পতি সন্তান নেন। এতে যেসব জটিলতার সৃষ্টি হয়, তার মূল ভুক্তভোগী নারী। প্রি–কনসেপশন বা গর্ভধারণ–পূর্ববর্তী পরামর্শ ও রুটিন চেকআপ সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা দরকার। সন্তান নেওয়ার আগে একজন নারী যথেষ্ট ফিট ও সম্পূর্ণ সুস্থ কি না, তাঁর পুষ্টিমান, জীবনযাত্রার মান কেমন, তা নির্ণয় করতে হবে।
রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের সমস্যা, রক্তশূন্যতা ইত্যাদি নারীর গর্ভাবস্থা ও প্রসবের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে মা–শিশু উভয়েরই জীবন বিপন্ন হতে পারে। তাই আগেভাগেই এসব স্ক্রিনিং করে যথাযথ পরামর্শ নেওয়া জরুরি। প্রতিটি সন্তানকামী নারীকে অন্তত তিন মাস আগে থেকে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট দিতে পারলে অনাগত শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যায়। এসব প্রোগ্রাম জাতীয় ও সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসা উচিত।
গর্ভকালীন যত্ন ও পরিচর্যাগর্ভাবস্থায় একজন নারীর সঠিক পরিচর্যার জন্য যথাসময়ে প্রসবপূর্ব চেকআপ, টিকা, প্রয়োজনীয় সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রসব বা ডেলিভারি যেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা হাসপাতালে হয়, তা নিশ্চিত করা এবং বাড়িতে প্রসবের হার কমানোও গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয় কেবল নারীস্বাস্থ্যের জন্যই যে জরুরি, তা নয়; এসব নারীর মৌলিক অধিকার।
মাতৃমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও দুঃখজনকভাবে এখনো বাংলাদেশে প্রসবকালীন জটিলতায় হাজার হাজার নারী মারা যাচ্ছেন এবং আরও অনেক নারী শিকার হচ্ছেন স্থায়ী জটিলতার। প্রসব–পরবর্তী রক্তক্ষরণ, ফিস্টুলা, প্রোল্যাপস ইত্যাদি সমস্যায় হাজারো নারীর জীবন চিরকালের জন্য অভিশপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই প্রসবকালীন যত্ন ও পরিচর্যা নারীর অধিকার হিসেবে বিবেচ্য হতে হবে, আর এতে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকার সবারই কর্তব্য এবং দায় আছে।
নারী ও শিশুবান্ধব পরিবেশপ্রসবের পর স্তন্যদানে সহায়তা, প্রসব–পরবর্তী চেকআপ, পরবর্তী সন্তান নেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বিষয়ে নারীকে জ্ঞান দিতে হবে। সন্তান ধারণ ও জন্মদানের বিষয়ে জনকল্যাণমুখী সরকারের দায়িত্ব থাকতে হবে। একজন মা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক যত্ন পেলেই কেবল একটি সুস্থ–সবল সন্তান জন্ম দিতে পারবেন।
কর্মজীবী নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ও কর্মক্ষেত্রে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র ইত্যাদি বিষয়ে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। এখানে সন্তান জন্ম দেওয়া ও তাকে বড় করার দায়িত্ব মায়ের ওপরই চাপিয়ে দেওয়া হয়। পরিবার, অফিস, সমাজ বা রাষ্ট্র কোনো সহযোগিতা করতে নারাজ। যেহেতু এখন বিপুলসংখ্যক নারী বাইরে কাজ করেন, তাই নারী ও শিশুবান্ধব কর্মক্ষেত্র এখন সময়ের দাবি।
পরিবেশদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবআমাদের দেশে ৩০ শতাংশ কৃষিখাদ্য উৎপাদন করেন নারীরা। কিন্তু তাঁদের ২০ শতাংশের বেশি উদ্যোক্তারই নিজস্ব জমি নেই। আমাদের মাঠেঘাটে খেটে খাওয়া নারীদের মধ্যে ৬০ শতাংশই বিধবা অথবা তাঁদের স্বামী নেই। অনেকেই গার্মেন্টস, অন্যান্য কারখানা ও বাইরে কাজ করেন। তাঁরা প্রকৃতি, জলবায়ুর পরিবর্তন ও দূষণের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকেন অথবা হারিয়ে যান। পরিবেশদূষণ, দূষিত পানি, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদির সবচেয়ে বড় শিকার নারীরা। নারীর প্রজননস্বাস্থ্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এসবের মাধ্যমে। তাই এদিকে নজর দিতে হবে।
আরও পড়ুন‘আমি কমেন্ট পড়েও দেখি না’, বললেন কারিনা০৮ মার্চ ২০২৫নারীস্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক কিশোরী মাসিকের সময় সঠিক যত্ন ও স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের নিয়ম জানে না। অনেকের আর্থিক সচ্ছলতা নেই। স্যানিটারি ন্যাপকিন সব শ্রেণির নারীর জন্য সহজলভ্য করতে হবে। পিরিয়ড হাইজিন সম্পর্কে সবার জানা থাকা জরুরি, এ নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কথা বলা যেতে পারে।
বয়ঃসন্ধিকালের মতোই মধ্যবয়সে মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি নারীদের জন্য একটি ট্রানজিশনাল পিরিয়ড। এ সময় নানা রকম শারীরিক ও মানসিক জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়, যা নিয়ে কথা বলতে নারীরা সংকোচে থাকেন। সংকোচ ও দ্বিধা ভুলে নিজের শরীর, স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলার, সাহায্য চাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি।
নারী নির্যাতনের চিত্রনিজের বাড়িতে, স্বামী, আত্মীয়স্বজন, মা-বাবার সঙ্গে থেকেও সহিংসতা, মারামরি, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া, পথেঘাটে হয়রানি ও লিঙ্গবৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে। সম্প্রতি নারী হয়রানি ও সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে। এসব শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হবে এবং নীতিনির্ধারণ ও অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে নারীসমাজকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
চিকিৎসকের ভূমিকাধাত্রীবিদ্যার কিছু নৈতিক চ্যালেঞ্জ আছে। স্ত্রীরোগ চিকিৎসকদেরও এ বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত। যেমন রোগী ও তাঁর সঙ্গী বা অভিভাবকদের সহজ ভাষায় বোঝানো—রোগটা কী, কেন হলো, এর চিকিৎসা কী। ভবিষ্যৎতে কী কী হওয়ার আশঙ্কা আছে। বিকল্প চিকিৎসা আছে কি না। সঠিক জ্ঞান দিয়ে চিকিৎসক, রোগীসহ সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেওয়াকে বলে ‘শেয়ারড ডিসিশন’। বর্তমানে চিকিৎসাবিদ্যায় এই শেয়ারড ডিসিশনের গুরুত্ব বেশি।
তবে অনেকে নিজের পছন্দমতো বা বিকল্প পথ বেছে নেন। তা নেওয়ার অধিকার তাঁদের অবশ্যই আছে। সে ক্ষেত্রেও চিকিৎসক তাঁদের পাশে থাকবেন এবং দরকারমতো সব ধরনের সাহায্য করবেন। তাঁদের ক্ষতি হয়, এমন কিছু করবেন না।
নীতিমালা ও কিছু সিদ্ধান্তঅনেক সময় সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে নৈতিক দ্বিধা হয় বা উভয়সংকট দেখা দেয়। যেমন—
একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর জীবন বাঁচাতে গিয়ে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি বা মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
অনেক সময় ধর্ষণ, অবাঞ্ছিত সন্তানের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সন্তানের জন্মগত মারাত্মক ত্রুটি থাকলেও অনেক সময় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান নেওয়ার বিষয়টি সব দেশেই নীতিশাস্ত্র সংশ্লিষ্ট ও সামাজিক ও আইনগত সমস্যা দেখা দেয়।
এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট জাতীয় নীতিমালা নেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করে এবং দরকার হলে মানবাধিকারকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হতে পারে। কিন্তু আগে অসহায় ও বিপদগ্রস্ত নারীটির পাশে দাঁড়াতে হবে, দায়িত্ব এড়ালে চলবে না।
স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসক, নার্সসহ বেশির ভাগই নারী। অথচ এই নারীদেরই অনেক সময় কর্মক্ষেত্রে প্রজননস্বাস্থ্য রক্ষা ও চর্চার অধিকার নেই। করোনা মোকাবিলায় সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে যাঁরা লড়াই করেছেন, তাঁদের সিংহভাগ ছিলেন নারী। নার্সদের ৯৪ শতাংশই নারী এবং করোনা স্বাস্থ্যকর্মীদের ৯০ শতাংশ ছিলেন নারী। যাঁরা স্বাস্থ্যসেবা দেন, তাঁদের স্বাস্থ্য রক্ষাও জরুরি।
শেষকথামানবাধিকার এবং সমতার বিষয়টি অনুধাবন, অনুকরণ, অনুশীলন করা কোনো স্বপ্ন নয়; এটি নিশ্চিত করা সরকার, সমাজ বা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গসমতার জন্য কাজ করা কেবল নারীর বিষয় নয়; এসব অর্জন করতে নারী, পুরুষ, সরকার, রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
শাহ্লা খাতুন, জাতীয় অধ্যাপক, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ
আরও পড়ুনউদ্যোক্তা থেকে যেভাবে দেশের প্রথম সফল নারী অ্যাগ্রো–ইনফ্লুয়েন্সার হলেন পপি০৮ মার্চ ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক ন ক সময় র জন য পর ব শ ক জ কর জন ম দ সরক র সবচ য় প রসব দরক র সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানের সঙ্গে সংঘাত: ইসরায়েলকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা দিতে সৌদি সরকারকে অনুরোধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র
গত জুনে সংঘাতের সময় ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে উপর্যুপরি আঘাত হানছিল। তা প্রতিরোধ করতে গিয়ে দেশটির ভান্ডারে থাকা টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্সে (থাড) টান পড়েছিল। সংঘর্ষ চলাকালে সৌদি আরবের হাতে এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অন্য আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তাদের ছিল। তাই সংকটকালে ইসরায়েলকে কিছু আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দিতে সৌদি আরবকে অনুরোধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু রিয়াদ তাতে রাজি হয়নি।
অনুরোধের বিষয়টি জানেন, এমন দুজন মার্কিন কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
দুজনের একজন বলেন, ‘যুদ্ধ চলাকালে আমরা সবাইকে (মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে মার্কিন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছিল) তাদের সবাইকে (ইসরায়েলকে কিছু ধার দেওয়া) অনুরোধ করেছিলাম। যখন কাজ হলো না, তখন আমরা চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিলাম। শুধু কোনো একটি দেশকে অনুরোধ করা হয়েছিল, তা কিন্তু নয়।’
কিন্তু ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে সাহায্য করার জন্য সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল সৌদি আরব। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলে আসছিলেন, ইরান শুধু ইসরায়েল নয়, সৌদি আরবের জন্যও হুমকি।
তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় এই দেশের হাতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আগেই নিজেদের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হয়েছিল। কিছুদিন আগেও এসব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে হামলা চালিয়েছিল ইয়েমেনের হুতিরা।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যখন সংঘর্ষ চলছিল, ঠিক তখনই নিজেদের কেনা থাড ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার প্রথম ব্যাটারিটি গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল সৌদি আরব। ব্যাটারিটি নিজেদের সার্বভৌম তহবিল দিয়েই কিনেছিল রিয়াদ। ঘটনা হলো, ইসরায়েল ও ইরানের যুদ্ধবিরতির মাত্র ৯ দিন পর ৩ জুলাই সৌদি সেনাবাহিনী এই ব্যাটারি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করেছে।
ইরান-ইসরায়েলের সংঘাতের একপর্যায়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মজুত ফুরিয়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ ছিল। কারণ, তখন ইসরায়েলের বিভিন্ন নিশানায় ব্যাপক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছিল ইরান।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সময় মিডল ইস্ট আই-ই প্রথম জানিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং ইসরায়েলের নিজস্ব আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অ্যারো দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। পরে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও দ্য গার্ডিয়ান নিজেদের প্রতিবেদনে মিডল ইস্ট আইয়ের তথ্য নিশ্চিত করেছিল।
চলতি মাসে এক প্রতিবেদনে গার্ডিয়ান জানিয়েছে, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পর যুক্তরাষ্ট্রের হাতে মাত্র ২৫ শতাংশ প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অবশিষ্ট ছিল, যা পেন্টাগনের পরিকল্পনামাফিক বিশ্বব্যাপী দেশটির সামরিক অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় মজুতের তুলনায় অনেক কম।
এক মার্কিন কর্মকর্তা ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের হাতে কী পরিমাণ প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছিল, সেই গোপন সংখ্যা মিডল ইস্ট আইকে নিশ্চিত করেছেন।
ইরানের হামলা থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা জন্য যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্ট্যান্ডার্ড মিসাইল-৩ (এসএম-৩) ছুড়েছিল। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছিল দেশটির রণতরি আরলি বার্ক ক্লাসের গাইডেড-মিসাইল ডেস্ট্রয়ার থেকে।
ইসরায়েলের তিন স্তরের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তো ছিলই, সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শক্তি। তা সত্ত্বেও যুদ্ধবিরতির আগপর্যন্ত ইসরায়েলি শহরগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছিল ইরান।
যুক্তরাজ্যের দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের পাঁচটি সামরিক স্থাপনায় সরাসরি আঘাত করতে সক্ষম হয়েছিল।
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান যেভাবে বৃষ্টির মতো ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, সেটার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা প্রত্যাশার চেয়ে ভালো করেছে। তবে সংঘাত দীর্ঘ সময় ধরে চলায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার দুর্বল দিকটি বুঝে গিয়েছিল ইরান। তাই তারা ইসরায়েলে বেশি পরিমাণে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে পেরেছিল।
মিচেল ইনস্টিটিউট ফর অ্যারোস্পেস স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ডগলাস বারকি বলেন, দুর্বলতাটা হলো, যুদ্ধের একটা পর্যায়ে আপনার প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মজুত ফুরিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। আমাদের হাতে যে পরিমাণ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আছে, সেগুলো শেষ হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে তৈরি করার সক্ষমতা সীমিত।
গত শুক্রবার দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ঘাটতির এই পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কর্মকর্তা সৌদি আরবের কেনা থাড প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ইসরায়েলে পাঠানোর বিষয়েও রিয়াদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে নিশ্চিত করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সৌজন্য অনুরোধ ও চুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরই সৌদি আরবের সঙ্গে এ বিষয়ে গভীর আলোচনা শুরু হয়েছিল।
উভয় মার্কিন কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে আরও বলেছেন, ইসরায়েলকে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দিতে যুক্তরাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাতকেও অনুরোধ করেছিল। তবে দেশটির কাছ থেকে ইসরায়েল আদৌ কোনো আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পেয়েছিল কি না, এই দুই কর্মকর্তার কেউ তা নিশ্চিত করতে রাজি হননি।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে আমিরাতই প্রথম দেশ, যারা প্রথম থাড কিনেছিল এবং ব্যবহার করেছিল। দেশটি থাড কিনেছিল ২০১৬ সালে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান যেভাবে ইসরায়েলের উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ভেদ করে হামলা চালাতে পেরেছে, তা উপসাগরীয় অঞ্চলের তুলনামূলক কম সুরক্ষিত দেশগুলোকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।