নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কি কেবল বলেই যাব, কিছুই করব না আমরা
Published: 10th, March 2025 GMT
নারীর সম–অধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় ১৯০৯ সাল থেকে। প্রথমে নিউজিল্যান্ড, পরে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপজুড়ে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ ১৯৭৭ সালে বিশ্ব নারী দিবসের স্বীকৃতি দেয় এবং দিবসটি পালিত হতে থাকে বিশ্বজুড়ে। নারী দিবসের মূলমন্ত্রই হলো নারীর অধিকার ও সচেতনতা। কিন্তু এত বছর পরও আমরা দেখছি দেশে নারীর শরীর, স্বাস্থ্য ও প্রজননবিষয়ক অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। নারীকে সন্তান ধারণ ও জন্ম দেওয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়। মানবজাতির টিকে থাকা ও বংশবৃদ্ধিতে যা সবচেয়ে জরুরি। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় নারীর অধিকার কতটুকু?
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধপ্রজননসংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত স্বামী ও স্ত্রী মিলে একত্রে নিতে হবে। সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ কখন নেবেন, কয়টি নেবেন, কত বিরতিতে নেবেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কী হবে—এর কোনোটাই নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। এসব বিষয়ে নারীর সঠিক জ্ঞান, সচেতনতা ও অংশীদারত্ব দরকার। এখনো বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক মেয়ের ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায় এবং সন্তান জন্ম দেয়। এই বালিকাদের নিজের শরীর ও স্বাস্থ্য নিয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বা বয়স কোনোটাই হয়নি। তাই প্রজননস্বাস্থ্যে নারীর অধিকার পেতে চাইলে অবশ্যই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে হবে।
আরও পড়ুনমিতা তঞ্চঙ্গ্যা যেভাবে দেশের প্রথম নারী ফরেস্টার০৮ মার্চ ২০২৫গর্ভধারণ–পূর্ববর্তী পরামর্শসন্তান ধারণের আগে প্রি–কনসেপশনাল পরামর্শ আমাদের দেশে খুব একটা প্রচলিত নেই। কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই যেকোনো সময় অপরিকল্পিতভাবে বেশির ভাগ দম্পতি সন্তান নেন। এতে যেসব জটিলতার সৃষ্টি হয়, তার মূল ভুক্তভোগী নারী। প্রি–কনসেপশন বা গর্ভধারণ–পূর্ববর্তী পরামর্শ ও রুটিন চেকআপ সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা দরকার। সন্তান নেওয়ার আগে একজন নারী যথেষ্ট ফিট ও সম্পূর্ণ সুস্থ কি না, তাঁর পুষ্টিমান, জীবনযাত্রার মান কেমন, তা নির্ণয় করতে হবে।
রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের সমস্যা, রক্তশূন্যতা ইত্যাদি নারীর গর্ভাবস্থা ও প্রসবের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে মা–শিশু উভয়েরই জীবন বিপন্ন হতে পারে। তাই আগেভাগেই এসব স্ক্রিনিং করে যথাযথ পরামর্শ নেওয়া জরুরি। প্রতিটি সন্তানকামী নারীকে অন্তত তিন মাস আগে থেকে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট দিতে পারলে অনাগত শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যায়। এসব প্রোগ্রাম জাতীয় ও সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসা উচিত।
গর্ভকালীন যত্ন ও পরিচর্যাগর্ভাবস্থায় একজন নারীর সঠিক পরিচর্যার জন্য যথাসময়ে প্রসবপূর্ব চেকআপ, টিকা, প্রয়োজনীয় সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রসব বা ডেলিভারি যেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা হাসপাতালে হয়, তা নিশ্চিত করা এবং বাড়িতে প্রসবের হার কমানোও গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয় কেবল নারীস্বাস্থ্যের জন্যই যে জরুরি, তা নয়; এসব নারীর মৌলিক অধিকার।
মাতৃমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও দুঃখজনকভাবে এখনো বাংলাদেশে প্রসবকালীন জটিলতায় হাজার হাজার নারী মারা যাচ্ছেন এবং আরও অনেক নারী শিকার হচ্ছেন স্থায়ী জটিলতার। প্রসব–পরবর্তী রক্তক্ষরণ, ফিস্টুলা, প্রোল্যাপস ইত্যাদি সমস্যায় হাজারো নারীর জীবন চিরকালের জন্য অভিশপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই প্রসবকালীন যত্ন ও পরিচর্যা নারীর অধিকার হিসেবে বিবেচ্য হতে হবে, আর এতে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকার সবারই কর্তব্য এবং দায় আছে।
নারী ও শিশুবান্ধব পরিবেশপ্রসবের পর স্তন্যদানে সহায়তা, প্রসব–পরবর্তী চেকআপ, পরবর্তী সন্তান নেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বিষয়ে নারীকে জ্ঞান দিতে হবে। সন্তান ধারণ ও জন্মদানের বিষয়ে জনকল্যাণমুখী সরকারের দায়িত্ব থাকতে হবে। একজন মা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক যত্ন পেলেই কেবল একটি সুস্থ–সবল সন্তান জন্ম দিতে পারবেন।
কর্মজীবী নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ও কর্মক্ষেত্রে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র ইত্যাদি বিষয়ে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। এখানে সন্তান জন্ম দেওয়া ও তাকে বড় করার দায়িত্ব মায়ের ওপরই চাপিয়ে দেওয়া হয়। পরিবার, অফিস, সমাজ বা রাষ্ট্র কোনো সহযোগিতা করতে নারাজ। যেহেতু এখন বিপুলসংখ্যক নারী বাইরে কাজ করেন, তাই নারী ও শিশুবান্ধব কর্মক্ষেত্র এখন সময়ের দাবি।
পরিবেশদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবআমাদের দেশে ৩০ শতাংশ কৃষিখাদ্য উৎপাদন করেন নারীরা। কিন্তু তাঁদের ২০ শতাংশের বেশি উদ্যোক্তারই নিজস্ব জমি নেই। আমাদের মাঠেঘাটে খেটে খাওয়া নারীদের মধ্যে ৬০ শতাংশই বিধবা অথবা তাঁদের স্বামী নেই। অনেকেই গার্মেন্টস, অন্যান্য কারখানা ও বাইরে কাজ করেন। তাঁরা প্রকৃতি, জলবায়ুর পরিবর্তন ও দূষণের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকেন অথবা হারিয়ে যান। পরিবেশদূষণ, দূষিত পানি, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদির সবচেয়ে বড় শিকার নারীরা। নারীর প্রজননস্বাস্থ্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এসবের মাধ্যমে। তাই এদিকে নজর দিতে হবে।
আরও পড়ুন‘আমি কমেন্ট পড়েও দেখি না’, বললেন কারিনা০৮ মার্চ ২০২৫নারীস্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক কিশোরী মাসিকের সময় সঠিক যত্ন ও স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের নিয়ম জানে না। অনেকের আর্থিক সচ্ছলতা নেই। স্যানিটারি ন্যাপকিন সব শ্রেণির নারীর জন্য সহজলভ্য করতে হবে। পিরিয়ড হাইজিন সম্পর্কে সবার জানা থাকা জরুরি, এ নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কথা বলা যেতে পারে।
বয়ঃসন্ধিকালের মতোই মধ্যবয়সে মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি নারীদের জন্য একটি ট্রানজিশনাল পিরিয়ড। এ সময় নানা রকম শারীরিক ও মানসিক জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়, যা নিয়ে কথা বলতে নারীরা সংকোচে থাকেন। সংকোচ ও দ্বিধা ভুলে নিজের শরীর, স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলার, সাহায্য চাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি।
নারী নির্যাতনের চিত্রনিজের বাড়িতে, স্বামী, আত্মীয়স্বজন, মা-বাবার সঙ্গে থেকেও সহিংসতা, মারামরি, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া, পথেঘাটে হয়রানি ও লিঙ্গবৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে। সম্প্রতি নারী হয়রানি ও সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে। এসব শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হবে এবং নীতিনির্ধারণ ও অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে নারীসমাজকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
চিকিৎসকের ভূমিকাধাত্রীবিদ্যার কিছু নৈতিক চ্যালেঞ্জ আছে। স্ত্রীরোগ চিকিৎসকদেরও এ বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত। যেমন রোগী ও তাঁর সঙ্গী বা অভিভাবকদের সহজ ভাষায় বোঝানো—রোগটা কী, কেন হলো, এর চিকিৎসা কী। ভবিষ্যৎতে কী কী হওয়ার আশঙ্কা আছে। বিকল্প চিকিৎসা আছে কি না। সঠিক জ্ঞান দিয়ে চিকিৎসক, রোগীসহ সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেওয়াকে বলে ‘শেয়ারড ডিসিশন’। বর্তমানে চিকিৎসাবিদ্যায় এই শেয়ারড ডিসিশনের গুরুত্ব বেশি।
তবে অনেকে নিজের পছন্দমতো বা বিকল্প পথ বেছে নেন। তা নেওয়ার অধিকার তাঁদের অবশ্যই আছে। সে ক্ষেত্রেও চিকিৎসক তাঁদের পাশে থাকবেন এবং দরকারমতো সব ধরনের সাহায্য করবেন। তাঁদের ক্ষতি হয়, এমন কিছু করবেন না।
নীতিমালা ও কিছু সিদ্ধান্তঅনেক সময় সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে নৈতিক দ্বিধা হয় বা উভয়সংকট দেখা দেয়। যেমন—
একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর জীবন বাঁচাতে গিয়ে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি বা মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
অনেক সময় ধর্ষণ, অবাঞ্ছিত সন্তানের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সন্তানের জন্মগত মারাত্মক ত্রুটি থাকলেও অনেক সময় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান নেওয়ার বিষয়টি সব দেশেই নীতিশাস্ত্র সংশ্লিষ্ট ও সামাজিক ও আইনগত সমস্যা দেখা দেয়।
এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট জাতীয় নীতিমালা নেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করে এবং দরকার হলে মানবাধিকারকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হতে পারে। কিন্তু আগে অসহায় ও বিপদগ্রস্ত নারীটির পাশে দাঁড়াতে হবে, দায়িত্ব এড়ালে চলবে না।
স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসক, নার্সসহ বেশির ভাগই নারী। অথচ এই নারীদেরই অনেক সময় কর্মক্ষেত্রে প্রজননস্বাস্থ্য রক্ষা ও চর্চার অধিকার নেই। করোনা মোকাবিলায় সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে যাঁরা লড়াই করেছেন, তাঁদের সিংহভাগ ছিলেন নারী। নার্সদের ৯৪ শতাংশই নারী এবং করোনা স্বাস্থ্যকর্মীদের ৯০ শতাংশ ছিলেন নারী। যাঁরা স্বাস্থ্যসেবা দেন, তাঁদের স্বাস্থ্য রক্ষাও জরুরি।
শেষকথামানবাধিকার এবং সমতার বিষয়টি অনুধাবন, অনুকরণ, অনুশীলন করা কোনো স্বপ্ন নয়; এটি নিশ্চিত করা সরকার, সমাজ বা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গসমতার জন্য কাজ করা কেবল নারীর বিষয় নয়; এসব অর্জন করতে নারী, পুরুষ, সরকার, রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
শাহ্লা খাতুন, জাতীয় অধ্যাপক, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ
আরও পড়ুনউদ্যোক্তা থেকে যেভাবে দেশের প্রথম সফল নারী অ্যাগ্রো–ইনফ্লুয়েন্সার হলেন পপি০৮ মার্চ ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক ন ক সময় র জন য পর ব শ ক জ কর জন ম দ সরক র সবচ য় প রসব দরক র সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
গুম করা হতো তিনটি ধাপে
শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ভিন্নমত পোষণকারী ব্যক্তিদের কীভাবে গুম করা হতো, সেটি গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কমিশন বলেছে, ‘তিন স্তরের পিরামিড’–এর মাধ্যমে গুমের বিষয়টি বাস্তবায়ন করা হতো।
এই পিরামিডের সর্বোচ্চ স্তরে ছিল ‘কৌশলগত নেতৃত্ব’। যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ছিলেন।
পিরামিডের দ্বিতীয় স্তরে ছিলেন বিভিন্ন বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। আর পিরামিডের তৃতীয় স্তরে থাকা বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার সদস্যরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতেন।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ৪ জুন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে গুমের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশনের কাছে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৫০টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ ৩৪৫ জন।
আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থায় গত সাড়ে ১৫ বছরে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, যেখানে গুমের ঘটনায় নীরব সম্মতি থাকার বিষয়টি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছিল বিষয়টি (গুমের মতো গুরুতর অপরাধেও নীরব থাকা)। গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি তখন অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হতো না।
■ গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে ১,৮৫০ অভিযোগ এসেছে। ■ যাচাই-বাছাই হয়েছে ১,৩৫০টি। ■ এখনো নিখোঁজ ৩৪৫ জন।গুমের মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার মধ্যে নীরবতা কেন ছিল, তা খুঁজেছে কমিশন। এর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে তখন বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার ভেতরে বিষয়টি (গুম) অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো না। বরং সেগুলোকে হয়তো একটি বৃহত্তর অভিযানের অংশ হিসেবে দেখা হয়েছে, যা বাহিনীর অভ্যন্তরে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ এবং ‘জনশৃঙ্খলা রক্ষার’ প্রয়োজনে স্বাভাবিক ও দায়িত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে এসব কাজকে বিচ্যুতি নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের নির্দেশ অনুযায়ী নিয়মিত দায়িত্ব হিসেবেই পালন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িত একজন কর্মকর্তার নথিতে তৎকালীন র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের (পরে পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে অবসরে যান, এখন পলাতক) মূল্যায়ন ছিল, ওই কর্মকর্তা কর্মদক্ষতার দিক থেকে ‘খুবই সন্তোষজনক’ এবং তাঁর নেতৃত্বগুণ ‘উচ্চমানের’।
ওই কর্মকর্তা সম্পর্কে বেনজীর আরও লিখেছিলেন, তিনি ‘ভদ্র’, ‘সৎ স্বভাবের’ এবং ‘অত্যন্ত দক্ষ’। ওই কর্মকর্তা সম্পর্কে নথিতে কোনো নেতিবাচক তথ্য লেখা হয়নি। যদিও তিনি গুমের ঘটনায় জড়িত ছিলেন।
অবশ্য অন্য একজন কর্মকর্তার বিষয়ে নথিতে দুর্নীতি ও অসদাচরণের অনেক অভিযোগ লেখা আছে। এমনকি সেখানে বিস্তারিতভাবে বলা আছে, ওই কর্মকর্তা নিয়মিতভাবে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার তৎকালীন পরিচালক জিয়াউল আহসানের (পরে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার বা এনটিএমসির মহাপরিচালক হন, এখন কারাগারে) কাছে ‘ফিশ থেরাপি’ (মাছ উপহার) পাঠাতেন। তবে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে তাঁর জড়িত থাকার বিষয়ে কোনো তথ্য নথিতে উল্লেখ নেই।
গণ–অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠন করে। এই কমিশনকে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ (সত্য উন্মোচন) শীর্ষক প্রথম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয় গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। সেখানে গত ১৫ বছরে সংঘটিত বিভিন্ন গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায় গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন।
কমিশনের প্রতিবেদনে একটি বন্দিশালায় প্রহরীর দায়িত্ব পালন করা একজনের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। বন্দিশালায় প্রথম গিয়ে ওই প্রহরী আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাঁকে বলা হয়েছিল, ‘বন্দীদের সাথে কখনো স্বাভাবিক আচরণ করা যাবে না, যেটা স্বাভাবিক মানুষের সাথে করা হয়। তাদের সবকিছু থেকে বঞ্চিত রাখতে হবে, সব অধিকার থেকে। যাতে সে কষ্ট অনুভব করতে পারে।’
ওই প্রহরী কমিশনকে বলেছেন, বন্দিশালার দায়িত্ব থেকে তিনি অব্যাহতি চেয়েছিলেন। তখন তাঁকে বলা হয়েছিল, দায়িত্ব পালন না করলে তাঁর প্রাণের ঝুঁকি আছে।
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে গুমগত ৬ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গুমে জড়িত ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। তাঁদের মধ্যে ছয়জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনই ডিজিএফআইয়ের (প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর) সাবেক মহাপরিচালক এবং একজন সাবেক পরিচালক। তাঁরা হলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আবেদীন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ সাইফুল আলম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ তৌহিদ-উল-ইসলাম।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ছয় কর্মকর্তা যখন ডিজিএফআইয়ের উচ্চ পদে ছিলেন, তখন সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও হাসিনুর রহমান এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান গোপন বন্দিশালায় আটক ছিলেন।
মেজর জেনারেল পদমর্যাদার একজন সেনা কর্মকর্তা গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে স্বীকার করেছেন, তিনি যখন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (সিটিআইবি) পরিচালক ছিলেন, তখন আমান আযমীর গুমের বিষয়ে তিনি সাইফুল আলম ও আহমেদ তাবরেজ শামসকে জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া ডিজিএফআইয়ের একজন কর্মকর্তা কমিশনকে বলেছেন, আমান আযমী ও মাইকেল চাকমাকে গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠা ডিজিএফআইয়ের অন্তত তিনজন কর্মকর্তা গত নভেম্বর পর্যন্ত পিআরএলে (অবসরোত্তর ছুটি) ছিলেন। তাঁরা তখনো সেনা আইনের অধীন ছিলেন। বিশেষ করে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে তাঁদের সেনাবাহিনীর অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ত। এখন তাঁদের হদিস নেই।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সমন্বিতভাবে অন্যায় নির্দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। কারণ, কর্মকর্তারা অন্যায় আদেশ মানতে বাধ্য নন। এই নীতির কথা সবাই জানতেন। কিন্তু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কর্তব্যে চরম অবহেলা ছিল। তাঁরা অধস্তনদের দিকনির্দেশনা বা মানসিক সহায়তার কোনো উদ্যোগ নেননি।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের ন্যায়সংগত আদেশ পালন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে কোনো অন্যায় আদেশ পালনে কেউ বাধ্য নন। গুম–খুনের আদেশ যাঁরা বাস্তবায়ন করেছেন, তাঁদের বিচক্ষণতার অভাব রয়েছে। এসব অন্যায় আদেশ বাস্তবায়ন করা তাঁদের দায়িত্ব নয়, সেটি তাঁরা অনুধাবন করতে পারেননি। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় বিচারহীনতার একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল।