তখন বাংলাদেশ টেলিভিশন রামপুরা কেন্দ্রের পেছনে বিস্তৃত প্রান্তর। খানাখন্দে পানি পূর্ণ। মাঝেমধ্যে দু’একটা ঝুপড়ি বাড়ি। বিটিভির একটাই ভবন। পূর্ব ব্লকের জানালায় দাঁড়ালে দূরের নন্দিপাড়া গ্রাম দেখা যায়। বেশি দিন আগের কথা নয়, গত শতকের ১৯৯৬-৯৭ সাল হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি কাজ করি সংগঠক হিসেবে টেলিভিশনের বিতর্ক ইউনিটে। প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে আসেন বরেণ্যজন। পরিচয় ও কথা হয় প্রাজ্ঞজনদের সঙ্গে। দিনক্ষণ মনে নেই, তবে একবার প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৎকালীন শিক্ষক আবু আহসান মো.

সামসুল আরেফিন সিদ্দিক। সংক্ষেপে আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। সেদিনই স্যারের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। 

তখন বিটিভিতে ম্যানুয়ালি সেট ও লাইট ঠিক করা হতো। রেকর্ডিং হতো বেটাকমে। সেট তৈরি করে আলোকসজ্জার লোকজন লম্বা লাঠি দিয়ে উপরে ঝুলানো লাইটের আলোক প্রক্ষেপণ ঠিকঠাক করতো। প্রোগ্রামের টাইম সিডিউল ঠিকঠাক থাকতো না। আমন্ত্রিত বিচারকরা এ নিয়ে তাদের সময় ক্ষেপণের জন্য বিরক্তি প্রকাশ করতেন। দু’একজন ব্যতিক্রমের মাঝে আরেফিন সিদ্দিক স্যারকে দেখতাম ধৈর্য ধরতে। তিনি বরাবরই স্বল্পভাষী মানুষ। বাস্তবিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে মৃদুস্বরে অনেক সময় বলতেন, ‘একটু তাড়াতাড়ি রেকর্ড করা গেলে সুবিধা হয়।’ 

স্যারের সেই কথার মধ্যে অনুরোধ প্রবণতা ছিল। কিন্তু অন্যরা এতে স্পষ্টতই বিরক্ত হতেন এবং অনেকে অভিযোগ করতেন। আমাদের অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ আলী ইমাম অবস্থার সবটাই জানতেন। তবুও দেখানিপনার জন্য আমাদের উপর হম্বি-তম্বি করতেন। আমি তখন লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলাম। আরেফিন স্যার আলাপচারিতায় জেনে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা করতে বলেছিলেন। সেই সূত্রেই বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিনায় তাঁর সঙ্গে আমৃত্যু যোগাযোগ।

স্যারকে দূর এবং কাছ থেকে খনিক দেখার সুযোগ হয়েছে দীর্ঘসময়। পর্যবেক্ষণ করেছি অনেক কিছু। স্যারের চারিত্রিক গুণাবলীর ভেতর অনেকগুলো বিষয় ছিল যা আজকের সমাজে কমতির দিকে। তাঁর মতো ধৈর্যশীল শ্রোতা আমি আমার জীবনে দ্বিতীয়জন দেখি নাই। অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে দলমত নির্বিশেষে সবার কথা শুনতেন। কথার পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিতেন কম। সবার মত গ্রহণ না করলেও অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গি দেখাতেন। স্যারের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বিভিন্ন অনুষ্ঠান মঞ্চে, সফরে অনেক জায়গায় সময় যাপনে জেনেছি তাঁর স্থিরতা ও অবলোকন করছি নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তেজনা প্রশমন করে কথা ও সিদ্ধান্ত জানানোর দক্ষতা। 

বর্তমান সমাজ প্রায় তিনদশক ধরের বড় বেশি অস্থির। চারপাশের মানুষ কেউ কাউকে যেন সহ্য করতে পারেন না। অল্পতেই মানুষ বিভিন্ন ইস্যুতে তাতিয়ে ওঠেন। চুন থেকে পান খসলেই কাছের মানুষকেও একহাত নিতে ছাড়েন না। আরেফিন সিদ্দিক স্যার এ ক্ষেত্রে বিরলপ্রজ। তাঁর কথায় আক্রমণ ও প্রতিহিংসা পাইনি। শুনতেন বেশি ও ধৈর্য্য নিয়ে শোনার পর ছোট করে মৃদু কণ্ঠে বলতেন। বক্তব্যের দৃঢ়তা ছিল কিন্তু কণ্ঠ নরম।

স্যারের চরিত্রের অনন্য সম্পদ তাঁর রুচি ও ব্যক্তিত্ববোধ। ভাষার ব্যবহারে শালীন ছিলেন, অতিকথন ও বাক্যব্যয়ে অপরকে ঘায়েল করার কৌশল নিতেন না। বরং সুনির্দিষ্ট করে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের শিরদাঁড়া এতটাই উতঙ্গে ছিল যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রাষ্ট্রীয় পদক্রমে যেখানেই থাকুক তাঁর উপস্থিতি কোনো অনুষ্ঠানে আলাদা করে জানান দিতো। পদের চেয়ে বড় হয়ে উঠতেন ব্যক্তি আরেফিন সিদ্দিক। ব্যক্তি মানুষের রাগ ও অভিমান লুকানোর অপরিসীম ক্ষমতা ছিল তাঁর। কোনো বিষয়ে রেগে গেলেন কিনা চেহারা ও কণ্ঠে বোঝা যেত না কিংবা বুঝতে দিতেন না। ঘনিষ্ঠজনদের বলতে শুনেছি ‘স্যার খুশি হলেন না বেজার হলেন বুঝতে পারিনি কখনো।’ নিজের রাগ, জেদ, অভিমান ইত্যাদির প্রতিক্রিয়া আচরণে প্রকাশ না করে নিজের ভেতর অবদমিত করে রাখার গুণ ছিল তাঁর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানাবিধ ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কাজের কারণেই অনেকে প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন। এটা আমাদের সমাজের প্রবঞ্চ। আরেফিন সিদ্দিক স্যারও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর কাজের সঙ্গে যাদের সহমত ছিল অন্যদের বিষয়ের মতো স্বাভাবিক ও প্রফেশনাল। তিনি উপাচার্যের কার্যালয়ের ভারি পরিবেশ ভেঙে দিয়ে সেবা গ্রহীতার জন্য সহজ করে দিয়েছিলেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩-এ শিক্ষকদের দায়িত্ব পালনে অনেক স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তবে ইংরেজিতে জারি করা এ আদেশে একটি বিষয়ে জোর দেয়া আছে। দায়িত্ব পালনে শিক্ষকদের ‘কৌলণ্যবোধ’ বজায় রেখে দায়িত্ব পালনের কথা বলা আছে। এই যে ‘কৌলণ্যবোধ’, এই একটি শব্দের পরিসর ব্যাপক। এই বিষয়টি মগজে থাকলে মার্জিত মানুষকে দায়িত্বপালনে নানা নিয়মনীতির জালের ভেতর রাখার প্রয়োজন পড়ে না। কৌলণ্যবোধে জাগরুক মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করেন। শিক্ষক হিসেবে স্যারের এই গুণগুলো ছিল। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যয়ন বিভাগ খোলার প্রাক্কালে বিভিন্ন সময় আমার সঙ্গে স্যারের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এরূপ একটি বিষয় পঠিত হয় বিধায় সেই বিভাগের কোর্স আউট লাইন সংগ্রহ করে এনে যখন স্যারের সাথে বসা হলো, দেখলাম একটি বিভাগের প্রাথমিক কোর্স আউট লাইনে কী কী বিষয় থাকলে বিভাগটি তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক শিক্ষায় এগিয়ে যায়, জ্ঞানমুখী শিক্ষার সঙ্গে কর্মমুখী শিক্ষার সংযোগ ঘটে, সে বিষয়ে স্যারের দিকনির্দেশনা ও দূরদর্শিতা দেখে মুগ্ধ হয়েছি!

আরেফিন সিদ্দিক স্যার নেতৃত্ব দেওয়ার প্রয়োজনে দল করতেন বটে কিন্তু একটা সার্বজনীনতা ছিল। দিন শেষে বড় ক্যানভাসে ভাবনার পরিমণ্ডল ছিল। চারপাশকে পাশাপাশি দেখতেন না বরং অনেক উঁচু থেকে নিজের দৃষ্টির প্রক্ষেপণ ঘটাতেন। এ জন্য সমাজের নানা ক্ষুদ্রত্ব তাঁর আচরণে সাক্ষাতে পাওয়া যেত না।

দীর্ঘদিন বড় দায়িত্বে থাকলে অনেক বিষয় নিয়ে কাজ করতে হয়। কখনও তাতে মানুষের চাহিদা পূরণ হয়, কখনও হয় না। , মানুষ সাধারণত ব্যক্তিচাহিদা পূরণ না হলে কার্যকরণের দিকে না তাকিয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তির প্রতি আঙুল তোলে- এটা আমাদের সমাজের বহমান কালচার। আরেফিন সিদ্দিক স্যারকেও এর মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের কাছে তিনি সজ্জন, আন্তরিক ও দায়িত্বপ্রবণ মানুষ ছিলেন। 

উপাচার্যের দায়িত্বকালে দিনে তো বটেই, রাত ১টা-২টা পর্যন্ত অনেক সময় ভিসির বাংলোয় বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কাজে স্যারের অফিস চালু থাকতো। দায়িত্ব পালনে এমন আন্তরিক উপাচার্য বিরল। তাঁর কর্মকালে এই বিষয়টি বজায় ছিল। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে জ্ঞান বিস্তারের প্রবণতা আমি কখনও দেখিনি। তিনি অন্যের মত কানেকটিং করে নিজের মত দিতেন। ভাষা ও শব্দ চয়নে সারল্য ছিল কিন্তু আখেরে তিনি একটা ম্যাসেজ দিতেন নিজস্ব। পত্র-পত্রিকার সাক্ষাৎকারে কঠিন করে কোনো বিষয় উপস্থাপন না করে সাধারণের বোধগম্য করে উপস্থাপন করতেন। গণ-যোগাযোগের ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক হিসেবে এটা তাঁর বিশেষ পারঙ্গমতা। শিক্ষা সর্ম্পকে স্যারের বক্তব্য বাস্তবধর্মী ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ‘শিক্ষা, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সর্ম্পকে আমরা অনেকেই এক ধরণের মনোদ্ভূত (Impressionistic) ধারণ পোষণ করি।... শিক্ষার সঙ্গে মাটির সংযোগ একান্ত প্রয়োজন। নিজস্ব ভূগোল, প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলে অভিযোজনে অসমর্থ কোনো কিছু স্থায়ী ও শিকড়ায়িত হতে পারে না। এখন তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য চেতনার সমন্বয় সাধন এবং দুইয়ের সংশ্লেষ ঘটিয়ে আমাদের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য আবিষ্কার ও সংরক্ষণ করা।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক হল ও স্থাপনা আরেফিন সিদ্দিক স্যারের সময়ে হয়েছে। নতুন বিভাগ সৃজন করেছেন অনেক। যদিও এসব বিভাগের কতটা কর্মমুখী শিক্ষার জন্য আবশ্যক ছিল সে প্রশ্ন তোলা যায়। বর্হিবিশ্বের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষা সহযোগিতা চুক্তিও হয়েছে বেশ কিছু। এসব কাজের ভালো-মন্দ ব্যবচ্ছেদের সঙ্গে উদ্যোগের পরিকল্পিত দার্শনিক ভীত ছিল ইতিবাচক।

যে কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাজের সমালোচনা করাই যায় কিন্তু একইসঙ্গে সহযোগিতা চারপাশ থেকে কেমন ছিল সেই পরিমাপকের ব্যারোমিটারের পারদের খোঁজ রাখতে হবে। মরিয়াই বাঙালি মহান হন- কথাটা প্রয়োগিক সত্য। কর্মজীবনে মানুষের বড় অর্জনকে না দেখে ছোট ছোট ভ্রান্তিগুলো দেখে। তারচেয়ে বড় নিজের স্বার্থসিদ্ধ কতটা অর্জিত হলো বা না হলো সেই বিচারে উদিষ্ট মানুষকে বিবেচনা করি। এ জন্য মানুষকে মূল্যায়নে সুবিবেচনা প্রসূত বিষয়টি অনেক সময় অধরা থেকে যায়। তবে মৃত্যুতে বাঙালি মানুষকে মহান করে জানে– যেন ধূপ, কর্পূর ও আতরের ঘ্রাণে দোষগুলো উড়ে যায়।

আমার দেখা ব্যক্তি আরেফিন সিদ্দিক অনন্য। এতো ধৈর্যশীল ও বিমুগ্ধ শ্রোতার সাথে আমার পরিচয় হয়নি। হয়তো হবেও না। স্মৃতিতর্পণে বিশাল নামের (আবুল আহসান মোহাম্মদ সামসুল আরেফিন সিদ্দিক) মানুষটি মানুষ হিসেবে কৃতবিদ্য। কবি নজরুলের একটি পঙ্‌ক্তি মনে পড়ে-
উষর মরুর ধূসর বুকে 
যদি একটা শহর গড়
একটি মানুষ, মানুষ হওয়া
তার চেয়ে অনেক বড়।

আমার স্মৃতিপটে সেই মানুষটি শ্রদ্ধেয় আরেফিন সিদ্দিক স্যার।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক

তারা//

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আর ফ ন স দ দ ক স য র উপ চ র য র অন ক স আম দ র র জন য করত ন

এছাড়াও পড়ুন:

প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত

বাংলাদেশের মেকআপ আর্ট জগতে নীরবে নতুনত্ব যোগ করে যাচ্ছেন সোনালী মিতুয়া। তার শৈল্পিক ইলিউশন এবং বডি পেইন্টিংগুলো আন্তর্জাতিক মানের, যা দেখে চোখ ফেরানো দায়। বর্তমানে ফিনল্যান্ডে মেকআপের ওপর উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন এই শিল্পী, যার ক্যানভাসে শৈশবের প্রথম গন্ধ ছিল তেল রং আর থিনারের তীব্রতা। মেকআপ ব্যবহার করে তিনি যে ক্যানভাস তৈরি করেন-তা এক কথায় অনন্য, অসাধারণ। 

সোনালী মিতুয়া কখনও তার মুখে ফুটে ওঠে ফাটল ধরা পৃথিবী, যেখান থেকে গজিয়ে ওঠে সবুজ লতা। কখনও দেখা যায় তার মুখটাই এক অর্ধেক যন্ত্র, অর্ধেক প্রকৃতি, যেন মানুষ আর মেশিনের মাঝের এক অদ্ভুত, কাব্যময় দ্বন্দ্ব।আর কখনও সেই মুখটাই অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, শুধু দেখা যায় এক ভয়ঙ্কর কালো গহ্বর — যেন মানুষের শূন্য আত্মা। এগুলো কোনো সিনেমার দৃশ্য না।এগুলো এক তরুণী মেকআপ আর্টিস্টের সৃষ্ট জীবন্ত শিল্পকর্ম।

আরো পড়ুন:

একা বাস করতে পারে যে পাখি

কেউ কটূক্তি করলে কী করবেন?

সোনালী মিতুয়ার মেকআপে একটা গল্প, একটা দর্শন, একটা গভীর বার্তা লুকিয়ে থাকে। যেখানে অধিকাংশ মানুষ মেকআপকে শুধু প্রসাধনের জগতে দেখে, সে সেখানে মেকআপকে তুলেছে এক উচ্চমাত্রার শিল্প হিসেবে। তার হাতে রঙ মানে—চামড়ার ওপরে নয়, বরং আত্মার ভাষা প্রকাশের এক মাধ্যম।

তার কাজে দেখা যায় প্রস্থেটিক মেকআপের প্রভাব— যেখানে মুখ বদলে যায়, গড়ে ওঠে নতুন রূপ, নতুন চরিত্র। এমন কৌশল একদিন তাকে সিনেমার পর্দায় প্রস্থেটিক আর্টিস্ট হিসেবে বড় জায়গায় নিয়ে যাবে—
এ কথা বলার জন্য বিশেষজ্ঞও হতে হয় না। 

এই মেয়েটির সবচেয়ে বড় শক্তি তার কল্পনাশক্তি। সে মুখের ভেতরেই ফুটিয়ে তোলে গল্প—একদিকে প্রকৃতি, ফুল, প্রজাপতি; অন্যদিকে প্রযুক্তি, ধ্বংস আর শূন্যতা। দেখলে মনে হয়, এই দুইয়ের টানাপোড়েনেই গড়ে উঠেছে তার শিল্পজগৎ।

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য এই মেয়েটি এক অনুপ্রেরণা। সে প্রমাণ করছে—শিল্পের ভাষা যদি শক্ত হয়, তাহলে দেশের সীমা পেরিয়ে বিশ্বেও পৌঁছানো যায়। যেখানে মেকআপকে এখনো অনেকেই কেবল সাজের কাজ মনে করেন, এই মেয়েটি সেখানে দেখিয়েছে — মেকআপও হতে পারে দর্শন, প্রতিবাদ আর সৃষ্টির ক্যানভাস। 

তিনি জানেন,  প্রস্থেটিক আর্টে (বিশেষত কৃত্রিম অঙ্গ, ক্ষত বা ফ্যান্টাসি চরিত্র তৈরি) করা যায় দক্ষতার সাথে।  বর্তমানে বাংলাদেশের সিনেমায় যেখানে প্রস্থেটিকের ব্যবহার খুবই সীমিত, সেখানে সোনালী মিতুয়ার মতো একজন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পী আছেন, তার হাতেই তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসের চরিত্রদের নিখুঁত রূপ, অথবা আমাদের ফ্যান্টাসি সিনেমার ভিনগ্রহের প্রাণী।

সোনালী মিতুয়ার কাজগুলো দেখলেই বোঝা যায়, তিনি মেকআপকে স্রেফ সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন না, বরং এটিকে একটি শক্তিশালী গল্প বলার হাতিয়ার মনে করেন। 

একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষ প্রকৃতির মাঝে ফাটল ধরা পাথরের মতো এক রূপ ধারণ করেছেন। সবুজ, হলুদ ও লালের মিশ্রণে চোখের অংশটি গভীর এবং রহস্যময়, আর ফাটলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা লতা-পাতা জীবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি তার পরিবেশ-সচেতনতা এবং ফ্যান্টাসি আর্টের দক্ষতা প্রমাণ করে।

সাদাকালো স্কেচের মতো দেখতে এই মেকআপটি অত্যন্ত কঠিন এবং চোখে পড়ার মতো। মুখের প্রতিটি অংশে পেন্সিল বা চারকোল দিয়ে আঁকা হ্যাচিংয়ের মতো স্ট্রোকগুলো ত্রিমাত্রিক চেহারাটিকে দ্বিমাত্রিক কমিক-বুক বা নয়ার চলচ্চিত্রের চরিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে।

চোখ ও মুখের চারপাশে মাকড়সার জাল এবং ফুলা, রক্তবর্ণ চোখের পাপড়ি ভীতি ও কষ্টের এক শক্তিশালী অনুভূতি জাগায়। এটি বিশেষ করে হ্যালোইন বা হরর থিমের জন্য পারফেক্ট।

গভীর অন্ধকারে তোলা এই ছবিটি ‘অন্ধকার গহ্বর’ বা ‘কৃষ্ঞগহ্বর’ থিমের একটি চমকপ্রদ ইলিউশন মেকআপ। নিখুঁত কনট্যুরিং এবং রঙের ব্যবহারে মুখের এক অংশে যেন সত্যিই একটি ফাঁকা, গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কারা বেশি কাঁদেন? 
  • বর্তমান সংকটের জন্য সরকার দায়ী, দলগুলোর চাপে সিদ্ধান্ত বদল
  • প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত