বাংলাদেশে বারবার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের উত্থানের কারণ অনুসন্ধান এবং তার একটি বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা খুবই দরকার। রোগ যথাযথভাবে নিরূপিত না হলে রোগের চিকিৎসাও যথাযথ হয় না।

গত বছরের ৫ আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর ছাত্রনেতৃত্ব সংবিধান পুনর্লিখনসহ যেভাবে দাবিদাওয়া উপস্থাপন করছে, তাতে কর্তৃত্ববাদ উত্থানের সব দায় বিদ্যমান সংবিধানের ওপর চাপানো হচ্ছে। নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নসহ দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ঘোষণার দাবিতে তারা খুব সোচ্চার।

১৯৭১ সালে এক সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার প্রতিফলনসহ গণতন্ত্রকে অন্যতম মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়।

সংবিধানের প্রস্তাবনা ও মূলনীতিতে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রাধান্য এবং পুরো সাংবিধানিক কাঠামো গণতান্ত্রিক হলেও বারবার এখানে স্বৈরতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী শাসন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। শাসকগোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন সময় সংবিধানে নানা সংশোধন এনেছে যা সংবিধানের মূল চরিত্রকে বিকৃত করেছে এবং নানান বিতর্ক তৈরি করেছে।

এরপরও যে বিষয় খতিয়ে দেখা দরকার তা হলো, বারবার কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রত্যাবর্তনের দায় কি বর্তমান সংবিধানের নাকি এর বীজ লুকিয়ে রয়েছে অন্য কোথাও? এর জন্য প্রথমেই প্রয়োজন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টি ফেলা। রাজনীতির প্রাণভোমরা হলো রাজনৈতিক দল। সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দলে গণতন্ত্রের চর্চা। দলে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে সমাজ ও রাষ্ট্রে তার প্রতিফলন অবশ্যই ঘটবে।

আমাদের দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনতার পর কয়েক যুগ ধরে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়ে আসছে। অগণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের মাধ্যমে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি ও নেতৃত্বের বংশানুক্রমিক ধারা চলছে দীর্ঘ সময় ধরে। ফলে আদর্শের জায়গা দখল করে নিয়েছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি। টাকা ও পেশিশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতির নিয়ামক শক্তি। নেতা নির্বাচনের বিষয়টি হয়েছে ব্যক্তির ইচ্ছা ও পছন্দনির্ভর। ফলে চাটুকারিতা, তোষামোদি, অন্ধ আনুগত্য ও দুর্নীতি দলগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি হয়েছে টাকা উপার্জনের লাভজনক পেশা।

এ ছাড়া নির্বাচন টাকার খেলায় পরিণত হওয়ায় নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদেরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। এসব কারণে চিরকালীন ক্ষমতার নেশা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে ক্ষমতায় থাকার জন্য নির্বাচনসহ রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিকভাবে ব্যবহার করে এসব প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল ও অকার্যকর করা হয়েছে। যখন যে দলই ক্ষমতায় এসেছে, তারা নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেছে, তাদের ঠিকভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। প্রশাসন, বিচার বিভাগ থেকে আরম্ভ করে সর্বত্র এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি।

আরও পড়ুনহাসিনার পতন হলেও স্বৈরাচারী শাসনের যেসব খুঁটি এখনো অক্ষুণ্ন১০ আগস্ট ২০২৪

অন্যদিকে দেখা গেছে, যখন কেয়ারটেকার সরকার স্বল্পকালের জন্য এসেছে, তখন সব প্রতিষ্ঠান নির্ভয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনও করেছে। সুতরাং রাজনৈতিক সংস্কৃতির গণতন্ত্রায়ণ ও পরিশুদ্ধকরণ ছাড়া শুধু কাঠামোগত সংস্কারে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা কখনো সম্ভব নয়। এ দেশে সামরিক শাসন, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনসহ নানা কারণে গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হয়েছে। ফলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যেমন বিকাশ ঘটেনি, তেমনি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোও শক্তিশালী হতে পারেনি।

অথচ দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রহীনতা, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির চর্চা, টাকা ও পেশির দৌরাত্ম্য—সব মিলিয়ে রাজনীতিতে যে অগণতান্ত্রিক ও অবক্ষয়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার সংস্কারের কোনো অর্থবহ ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু সংবিধানকে ফ্যাসিবাদী বলে ছুড়ে ফেলে নতুন সংবিধান রচনার কথা একধরনের অপরিপক্ব ও অবাস্তব চিন্তা ছাড়া আর কিছু নয়।

রাজনীতিতে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও পারিবারিক রাজনীতির চর্চা বহাল রেখে বর্তমানের দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা একেবারেই অসম্ভব। দলের মধ্যে পরিশীলিত রাজনীতি, গণতন্ত্রের চর্চা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ‘পলিটিক্যাল পার্টি আইন’ করে ব্যাপক সংস্কারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। অথবা নির্বাচন কমিশন আইনে সংশোধন এনে কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনসহ নিবন্ধনসংক্রান্ত কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা দরকার। একই ব্যক্তি যাতে সরকারপ্রধান ও দলের প্রধান না হতে পারেন, সে-সংক্রান্ত আইন করা দরকার।

বাংলাদেশে স্বৈরশাসন বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থানের জন্য শুধু সংবিধানকে দোষারোপ করার একদেশদর্শী মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে অপশাসনের পেছনের কারণ যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দায়কে চিহ্নিত করতে হবে। কারণ, সংবিধানের কোথাও একদলীয় নির্বাচনের কথা বলা হয়নি। নির্বাচন কমিশন আইনেও নেই। শুধু সব প্রতিষ্ঠানে দলীয় নিয়ন্ত্রণ বহাল করার মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দলীয় সরকার এটা করেছে। একমাত্র নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল ছাড়া সব সময় এটা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো এটা করে দলে ও সামগ্রিক রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ না হওয়ার কারণে।

বাংলাদেশের রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের কারণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে না খুঁজে শুধু সংবিধানকে দোষারোপ করে রাজনীতির প্রকৃত সংস্কার কখনো হবে না। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই সংবিধান প্রণীত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটি বহুমাত্রিক চেতনা। ৯০ ও ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার আধার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

কারণ, ৯০-এর গণতন্ত্র ও ২৪-এর বৈষম্যবিরোধী চেতনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই অংশ। এ চেতনার বাস্তবায়ন না হওয়ায় মূলত জাতি তথা ছাত্র-জনতা ফুঁসে উঠেছে এবং গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। সুতরাং, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাগ্রত গণ-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য অবশ্যই সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে কিছু সংস্কার করতে হবে। সে ব্যাপারে ইতিমধ্যে প্রক্রিয়া চলমান।

বিভিন্ন সংশোধনীর কারণে বর্তমানে সংবিধানে নানান সীমাবদ্ধতা ও দোষত্রুটি থাকা সত্ত্বেও আমি মনে করি সংবিধানের কাঠামো গণতান্ত্রিক। এ ছাড়া সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সংবিধান হালনাগাদ করা ও জনস্বার্থে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়। যেমন ৭০ অনুচ্ছেদের বিলুপ্তি, দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রবর্তন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিতকরণের জন্য একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও দলের প্রধান না হওয়ার সাংবিধানিক বিধান ইত্যাদি। এ ছাড়া সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে সন্নিবেশিত জনস্বার্থবিরোধী অনুচ্ছেদগুলো বাতিল করা—সেটা অবশ্যই করতে হবে।

এ জন্য সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। তারা সুপারিশও প্রদান করেছে। ঐকমত্য ও যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে পরবর্তী সংসদ এটা বাস্তবায়ন করবে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংবিধান-বিশারদ ড.

কামাল হোসেন এ বিষয়ে তাঁর বিজ্ঞ মতামত প্রদান করেছেন। কিন্তু পুনর্লিখনের নামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লিখিত সংবিধান উপড়ে ফেলা কখনো জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

বাংলাদেশে স্বৈরশাসন বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থানের জন্য শুধু সংবিধানকে দোষারোপ করার একদেশদর্শী মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে অপশাসনের পেছনের কারণ যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দায়কে চিহ্নিত করতে হবে। কারণ, সংবিধানের কোথাও একদলীয় নির্বাচনের কথা বলা হয়নি। নির্বাচন কমিশন আইনেও নেই। শুধু সব প্রতিষ্ঠানে দলীয় নিয়ন্ত্রণ বহাল করার মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দলীয় সরকার এটা করেছে। একমাত্র নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল ছাড়া সব সময় এটা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো এটা করে দলে ও সামগ্রিক রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ না হওয়ার কারণে।

সংবিধানে নেতা নির্বাচন, সরকার গঠনবিষয়ক সব বিধানই গণতান্ত্রিক। শুধু ৭০ অনুচ্ছেদ ছাড়া নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগসংক্রান্ত বিধানগুলো গণতান্ত্রিক বিধিবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তবে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য বিচার বিভাগের সচিবালয় অবশ্যই সুপ্রিম কোর্টের অধীনে দিতে হবে।

সুতরাং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সে জন্য ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারা শুরু করতে হবে। পাশাপাশি কাঠামোগত সংস্কারও প্রয়োজন। তবে সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও দলে গণতন্ত্রচর্চার সংস্কৃতি না গড়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কখনো সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের অবিরাম চর্চার মধ্য দিয়েই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকশিত হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোও কার্যকর ও শক্তিশালী হয়। সেটাই নিশ্চিত করা দরকার।

হাসান চৌধুরী প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক স স ক ত র র জন ত ক স স ক ত র জন ত ক স স ক ত র ব যবহ র কর র জন ত ক দ র ক র জন ত র জন ত র র জন ত ত ক সরক র র প কর দল য় ন আম দ র ণ র জন র জন য ন র জন ক ষমত দরক র দলগ ল

এছাড়াও পড়ুন:

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানে এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার এক নতুন ধরনের হুমকি নিয়ে এসেছে। এটি শুধু প্রচলিত কারচুপির পদ্ধতিগুলোকেই আরও সফিসটিকেটেড বা কৌশলী করে তুলবে না; বরং আমাদের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে জনগণের বিশ্বাস, সেটিই নষ্ট করে দিতে পারে।

নির্বাচনে এআইয়ের প্রভাব কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, এটি একটি বাস্তব ঝুঁকি। এআই-চালিত টুলগুলো ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতা বা কর্মকর্তাদের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ‘ডিপফেক’ (ভুয়া অডিও, ভিডিও এবং ছবি) তৈরি করা সম্ভব।

এই ডিপফেকগুলো সহজেই মিথ্যা কেলেঙ্কারি ছড়াতে পারে, যা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই-চালিত বটগুলো সেকেন্ডের মধ্যে এমন সব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, যা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য ব্যাপক জনসমর্থনে বা বিরোধিতায় ভূমিকা রাখতে পারে।

যখন জনগণ দেখতে পাবে, তারা যা দেখছে বা শুনছে, তার মধ্যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, তা বোঝা কঠিন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কর্তৃপক্ষ এবং পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে সন্দেহ ঢুকে যাবে। এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।

এআই অ্যালগরিদমগুলো বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট ভোটারদের লক্ষ করে তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও দুর্বলতা অনুযায়ী রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে পারে। এই ‘মাইক্রো টার্গেটিং’-এর মাধ্যমে ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করা বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ভোটদানের সময় বা স্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখাও সম্ভব।

আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে

এআই শুধু মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি নির্বাচনী পরিকাঠামোর ওপর সাইবার হামলাও জোরদার করতে পারে। এআই-চালিত টুলগুলো আরও সফিসটিকেটেড ফিশিং আক্রমণ তৈরি করে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে বা এমন ম্যালওয়্যার তৈরি করতে পারে, যা প্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এ ধরনের আক্রমণ ভোটার ডেটাবেজ বা ভোটিং মেশিনকে লক্ষ্য করে করা যেতে পারে। সেটি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন বা পুরো প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপত্তির সমাধান কী? এ প্রশ্নের জবাব হিসেবে প্রথমেই মনে রাখা দরকার, এই গুরুতর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে এক্সপ্লেইনেবল এআই (এক্সএআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এআই মডেলের সিদ্ধান্তগুলো মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলে এক্সএআই। এটি এআইয়ের স্বচ্ছতা বাড়ায়।

ডিপফেক শনাক্তকরণ: এক্সএআই ব্যবহার করে এমন টুল তৈরি করা সম্ভব, যা কেবল ডিপফেক শনাক্ত করে না; বরং কেন একটি বিষয়বস্তু জাল বলে চিহ্নিত হয়েছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেয়। এর ফলে মানব ফ্যাক্ট-চেকাররা বিশ্লেষণ যাচাই করতে পারেন এবং জনগণের আস্থা তৈরি হয়।

প্রচারণার নিরীক্ষা: এক্সএআই রাজনৈতিক প্রচারণায় এআই ব্যবহারের নিরীক্ষা করতে পারে। এটি বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারে, কীভাবে একটি অ্যালগরিদম তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পক্ষপাতদুষ্ট বা কারসাজিমূলক টার্গেটিং কৌশলগুলো প্রকাশ করতে সাহায্য করে।       

নিরাপত্তা বৃদ্ধি: সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক্সএআই হুমকির শনাক্তকরণ সিস্টেমকে উন্নত করতে পারে। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে, কেন একটি নির্দিষ্ট কার্যকলাপকে ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।

অংশগ্রহণকারীদের করণীয়: এআইয়ের হুমকি মোকাবিলায় সব গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারীকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতাদের প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তাঁরা প্রতারণামূলক এআই জেনারেটেড কনটেন্ট বা ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রচারে জড়িত হবেন না। তাঁদের উচিত এআইয়ের যেকোনো বৈধ ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা এবং এআই জেনারেটেড কনটেন্টে সুস্পষ্ট লেবেল ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রচারে এআই ব্যবহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিয়ম ও প্রবিধান তৈরি এবং প্রয়োগ করতে হবে। তাদের উচিত এআই-চালিত টুলগুলোতে বিনিয়োগ করা এবং ভোটারদের সচেতন করার জন্য বড় আকারের প্রচার চালানো।

এ ছাড়া একটি যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন দল গঠন করা প্রয়োজন, যারা নির্বাচনের আগপর্যন্ত কমিশনকে এআই এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা দেবে। তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে এআইয়ের হুমকি সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত মোকাবিলা করার জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রটোকল স্থাপন করা জরুরি। সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের উচিত ফ্যাক্ট-চেকিং এবং জনগণের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।

আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এআইয়ের ক্ষমতা যেমন বিশাল, তেমনি এর অপব্যবহারের বিপদও কম নয়।

জনগণের বিশ্বাস এবং একটি ন্যায্য নির্বাচনের অধিকার নিশ্চিত করতে এখনই আমাদের সবাইকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, বাংলাদেশ সরকারের একটি সম্মিলিত গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) দল গঠন করা। এই বিশেষজ্ঞ দল এআই-সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো ক্রমাগত বিশ্লেষণ ও অনুমান করবে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে।

অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন এআইয়ের সাবেক অধ্যাপক, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত এআরআইটিআইয়ের সাবেক পরিচালক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটা এখানে অস্বাভাবিক কিছু নয়
  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে
  • মিয়ানমারে ডিসেম্বরে নির্বাচনের ঘোষণা জান্তা সরকারের, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার
  • বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সরাসরি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পক্ষে
  • ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লুলার প্রতিবাদে অন্যরাও শামিল হোক
  • এমন কিছু করবেন না যাতে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়: মির্জা ফখরুল
  • সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ৭ দিনের রিমান্ডে
  • বিতর্কমুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব‍্যবস্থা না হলে গণতন্ত্র আবার হুমকিতে পড়বে: এবি পার্টি
  • মানুষ ঠিকমতো ইভিএম বোঝে না, পিআর বুঝবে কী করে: মির্জা ফখরুল