কথিত ৭৩০ কোটি টাকা রেমিট্যান্সে কী কী ‘অনিয়ম’ থাকতে পারে
Published: 21st, March 2025 GMT
অর্থনীতির বিষয়গুলো আমি খুব ভালো বুঝি না। বুঝতে চাইলেও অনেক সময় ঠিকমতো বোঝা হয়ে ওঠে না। তাই বলে আমি যে অর্থনীতি বুঝতে চেষ্টা করি না তা নয়। এইতো ১৬ মার্চ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনে এক মতবিনিময় সভায় জানালেন, রেমিট্যান্সের নামে এক ব্যক্তি ৭৩০ কোটি দেশে এনেছেন। শিরোনামটা পড়ে আমার খুব ভালো লাগল, আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম।
আমাদের দেশ এখন দারুণ অর্থনৈতিক দুর্দশায়। বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে সচল রাখছে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে বিদেশি মুদ্রার আয় দিন দিন কমছে। বিদেশিরা ডলার নিয়ে আসছে না আমাদের দেশে লগ্নি করতে। এইসময় বিদেশ থেকে ৭৩০ কোটি সমান বৈদেশিক মুদ্রা আসা দেশের জন্য দারুণ সুখবর, যেন হঠাৎ লটারি পাওয়ার মতো।
খবরটা পুরা পড়লাম। মনে হলো এনবিআর চেয়ারম্যান টাকাটা পেয়ে খুশি নন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা আইন করলাম যে, আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরা যারা কঠোর পরিশ্রম করে বিদেশ থেকে টাকা উপার্জন করে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশে নিয়ে আসে, তাদের ক্ষেত্রে আমরা বললাম, তাদের এই আয়টা ট্যাক্স ফ্রি হবে বাংলাদেশে।.
রেমিট্যান্সের নামে এক ব্যক্তির এত বিপুল অর্থ আনার ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছে বলে মনে করছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। কিন্তু কোথায় নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছে, তা তিনি খুলে বলেননি। এখানে উল্লেখ্য যে রেমিট্যান্স হিসেবে এই পরিমান অর্থ এসেছে গত ৯/১০ বছরে।
আমার থেকে পুরো ব্যাপারটা খুব ঘোলাটে মনে হলো। আর এনবিআর চেয়ারম্যান এই ঘটনাটা এত ঘটা করে বলার প্রয়োজনই বা কী ছিল? তিনি কি প্রবাসীদের সাবধান করে দিচ্ছেন-খবরদার, এত টাকা পাঠাবেন না। নিশ্চয় ঘাপলা আছে। আপনি বাঙালি মানুষ, বিদেশে এত টাকা পেলেন কোথায়?
জানি না এটাতে কী ঘাপলা আছে? চেয়ারম্যান সাহেবও খোলাসা করে বলেননি কিছু। কিন্তু যাদের কোনো ঘাপলা নেই, চেয়ারম্যানের কথা শুনে তারা কি গুটিয়ে যাবেন না? কী দরকার নিজের টাকা নিয়ে এত কথা শোনার বা এত ঝামেলা সাইবার। এখন অনেক বাংলাদেশি বিদেশে অনেক বড় বড় ব্যবসা করেন। যেদিন এনবিআর চেয়ারম্যান এই সব নিয়ে কথা বলছিলেন, তার দুই দিন আগেই প্রথম আলোর একটা শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশের রবিন যেভাবে অস্ট্রেলিয়ার ধনকুবের’। জনাব রবিন যদি বাংলাদেশে বড় অঙ্কের একটা টাকা পাঠাতে চান, এই খবর পড়ার পর তার কী প্রতিক্রিয়া হবে?
এনবিআর চেয়ারম্যান বিজ্ঞ মানুষ। আশা করি তিনি কোন বিবেচনা থেকে এই প্রসঙ্গটি তুলেছেন এবং ওই ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করেছেন তা পরিষ্কার করবেন। ওই তো বাংলাদেশের কোনো একটা ব্যাংকের গ্রাহক। তার প্রাইভেসি রাখার দায়িত্ব এনবিআর-এর। চেয়ারম্যান তা করেননি বলেই জনাব সৈয়দ মোহাম্মদ ফারুকী হাসানকে আজ নিজের পরিচয় দিয়ে বলতে হলো, আমি অনিয়ম করিনি, আমি চুরি করে টাকা আনিনি।পশ্চিমা দেশগুলোতে যারা ব্যাংকিং করেন তারা জানেন, সেখানে ব্যাংকিং খাতে লেনদেনে বড় ছোট অনেক জোচ্চুরি হয়। হারিয়ে যাওয়া ক্রেডিট কার্ডের অপব্যবহার, অবৈধভাবে অন্যের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা, অবৈধ ওয়্যার ট্রান্সফার এই সব লেগেই আছে।
সারা বিশ্বে ২০২৪ সালে ব্যাংকিং জালিয়াতিতে ৪৫ বিলিয়ন ডলার ব্যাংকগুলোকে গচ্চা দিতে হয়েছে। বিদেশে ব্যাংকগুলো গচ্চা যাওয়া টাকাকড়ি নিয়ে খুব উচ্চবাচ্য করে না কখনো, যাতে করে ব্যাংকিংয়ের ওপর গ্রাহকদের বিশ্বাস উঠে যেতে পারে। এই সব নিয়ম অনিয়ম নিয়ে সরকার বা ব্যাংকগুলি চুপি চুপি সামাল দেয়, মুখে রা শব্দও বের করে না। গ্রাহকেরা নিশ্চিন্তে ব্যাংকগুলোতে টাকা পয়সা জমা রাখেন। গ্রাহকেরা বিশ্বাস রাখে ব্যাংকগুলোতে টাকা রাখতে বা লেনদেন করতে তাদেরকে সমস্যা বা ক্ষতি পোহাতে হবে না। এই বিশ্বাসটা জরুরি যে নিজের টাকা নিয়ে কোনো অর্থনৈতিক সংস্থা তাদেরকে হেনস্তা করবে না। অবৈধ যেকোনো ব্যাপার হলে, তা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দেখবে।
আমরা আর একটু খতিয়ে দেখতে পারি, কথিত এই ৭৩০ কোটি টাকা রেমিট্যান্সে কী কী অনিয়ম থাকতে পারে। যে দেশে থেকে তিনি টাকাটা আয় করেছেন বা পাঠিয়েছেন, সে দেশে কি তিনি আয়কর দিয়েছেন। সেটা দেখার দায়িত্ব কি বাংলাদেশের? সুইস ব্যাংকে কত কত দেশের লোক টাকা জমা রাখে নিঃশব্দ ভাবে। সুইজারল্যান্ড কি এই সব খবর রাখে? আরেকটা ব্যাপার হতে পারে তিনি কীভাবে আয় করেছেন টাকাটা? সেটাও কি বাংলাদেশের জানার দরকার?
আরও বড় ব্যাপার হলো টাকাটা কি বাংলাদেশ থেকে বাইরে নেওয়া হয়েছিল আগে, এখন আবার ফিরে আনা হচ্ছে আয়কর ছাড়ের আশ্রয়ে? এ ক্ষেত্রেও টাকা পাচার করে নেওয়াটা বেআইনি, কিন্তু নিয়ে আসাটা বা রেমিট্যান্স করা বেআইনি নয়। দুইটাকে পৃথকভাবে দেখতে হবে।
আরও প্রশ্ন আসবে, যখন বিগত সরকারের আমলে এত এত লোক ব্যাংক লুট করে টাকা বিদেশে নিল, সেই সব টাকা এখন কি বিদেশে থেকে গেলে ভালো হবে নাকি ট্যাক্স ছাড় দিয়ে দেশে আনা দেশের জন্য লাভজনক? আগেই আমি বলেছি এই সব বিষয়ে আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। তাই এই সবের উত্তর খোঁজা আমার জন্য অযথা সময় নষ্ট। অন্য যারা বিশেষজ্ঞ তারা ব্যাপারগুলো খতিয়ে দেখতে পারেন। আমি শুধু বুঝি এই সব ব্যাপারগুলো ব্যাংকের গ্রাহকদের আতঙ্কিত না করেও চুপ চাপ সুরাহা করা যেতে পারে।
আমি এই লেখাটা শেষ করার আগেই প্রথম আলোতে একটা খবর বের হলো-‘৭৩০ কোটি টাকার প্রবাসী আয় নিয়ে যা বললেন প্রতীক গ্রুপের চেয়ারম্যান ফারুকী হাসান।’ প্রতীক গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ ফারুকী হাসান বলেছেন, ‘বৈধ আয়ের অর্থই তিনি দেশে এনেছেন। নিয়ম মেনে সেই অর্থ আয়কর নথিতেও দেখিয়েছেন। এ জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর থেকে তিনি প্রত্যয়ন সনদও পেয়েছেন।’
জনাব হাসানের এই অবস্থানকে স্বাগত জানাই। কারণ তিনি নিজেই পত্রিকায় ফোন করে তার অবস্থান জানিয়েছেন এবং স্পষ্ট করে বলেছেন, এই টাকা আমার বৈধ আয়ের টাকা। এতে কোনো ঘাপলা নেই। জনাব হাসানকে আমরা বহবাও দিতে পারি এই কারণে যে, টাকাটা যে তিনি দেশে নিয়ে এসেছেন। তিনি বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারতেন, ম্যানহাটন-প্যারিসে বাড়ি কিনতে পারতেন। তিনি দেশে নিয়ে আসছেন এই বৈদেশিক মুদ্রা, এই দুর্দিনে দেশের বড় উপকার হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বিজ্ঞ মানুষ। আশা করি তিনি কোন বিবেচনা থেকে এই প্রসঙ্গটি তুলেছেন এবং ওই ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করেছেন তা পরিষ্কার করবেন। ওই তো বাংলাদেশের কোনো একটা ব্যাংকের গ্রাহক। তার প্রাইভেসি রাখার দায়িত্ব এনবিআর-এর। চেয়ারম্যান তা করেননি বলেই জনাব সৈয়দ মোহাম্মদ ফারুকী হাসানকে আজ নিজের পরিচয় দিয়ে বলতে হলো, আমি অনিয়ম করিনি, আমি চুরি করে টাকা আনিনি।
উন্নত বিশ্বে এমন কিছু ঘটলে ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করার কারণে বড় অঙ্কের দাবি করে কোর্টে চরিত্রহানির মামলা হয়ে যেত। আমরা এখানে শুধু চাইব, এই ঘটনাগুলো যেন আর না ঘটে। ব্যাংকিং এবং রেমিট্যান্সের যেতো নিয়ম অনিয়ম যেন গ্রাহকদের লোক সম্মুখে হেনস্তা না করে আড়ালেই মীমাংসা করা হয়। বড় পরিমাণ হোক বা ছোট হোক, কেউই চায় না তার আর্থিক লেনদেন নিয়ে জনসম্মুখে আলোচনা হোক।
সালেহ উদ্দিন আহমদ কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র গ র হক ৭৩০ ক ট কর ছ ন প রব স ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার যেভাবে হলে ভালো হয়
অন্তর্বর্তী সরকার গত ১২ মে একটি অধ্যাদেশ জারি করে ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড’ (এনবিআর) এবং ‘অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ’ (আইআরডি)-এর বিলুপ্তি ঘোষণা করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি নতুন বিভাগ– ‘রাজস্বনীতি বিভাগ’ এবং ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ গঠনের প্রস্তাব করেছে। তবে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিপুল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে সরকার গত ২২ মে পুরো সংস্কার প্রস্তাবটি স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। সরকার অংশীজনের সঙ্গে আরও আলোচনা করে তা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে।
দেশের মোট রাজস্বের ৯১ ভাগই কর-রাজস্ব, যার প্রায় পুরোটাই আদায় করে এনবিআর। সে কারণে এনবিআরের সংস্কার এত গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবীর বহু দেশেই রাজস্বনীতি প্রণয়ন এবং রাজস্বনীতি বাস্তবায়ন বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পৃথক সংস্থার হাতে আছে; উভয়ের মধ্যে একটি বিভাজন বা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ থাকে। রাজস্বসংক্রান্ত আইন যেমন– শুল্ক আইন, আয়কর আইন তেমনি অর্থ আইন সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান যেমন– আয়কর ও শুল্কবিধি, সময়ে সময়ে জারিকৃত স্ট্যাটিউটরি রেগুলেশনস অর্ডার (এসআরও) এবং বিভিন্ন ধরনের করের হার নির্ধারণ রাজস্বনীতির অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, এসব কর আইন ও বিধিবিধানের প্রয়োগ এবং রাজস্ব আদায় করা রাজস্ব ব্যবস্থাপনার অংশ। প্রায় সব দেশেই রাজস্বনীতি প্রণয়নের দায়িত্বটি থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে এবং এই নীতি বাস্তবায়ন বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বটি পালন করে সেই মন্ত্রণালয়েরই অধীন কোনো কার্যনির্বাহী বিভাগ/অধিদপ্তর বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা (স্ট্যাটিউটরি বডি)। এটি লোক প্রশাসনের মৌলিক নীতি-ব্যবস্থাপনা বিভাজনের স্বীকৃত পন্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তা সব সেক্টরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
বাংলাদেশে কর বা রাজস্বনীতি প্রণয়নের দায়িত্ব (অন্তত তাত্ত্বিকভাবে) পালন করে আসছিল অর্থ মন্ত্রণালয়েরই একটি অংশ ‘অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ’, যদিও বাস্তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারাই খসড়া আইন, বিধিবিধান, এসআরও এবং কর প্রস্তাব তৈরি করে তা আইআরডিতে প্রেরণ করে থাকে। অন্যদিকে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ রাজস্বনীতির প্রয়োগ এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সরাসরি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডই পালন করে আসছে। রাজস্বনীতি এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মধ্যে কোনো বিভাজন বা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ নেই– সেটি বলা যায় না।
এদিক থেকে করনীতি ও কর ব্যবস্থাপনার বিভাজন বাংলাদেশের জন্য নতুন কোনো সংস্কার বা অনন্য বিষয় নয়। নতুন প্রস্তাবে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বর্তমানের সংবিধিবদ্ধ সংস্থা ‘এনবিআর’-এর স্থলে প্রস্তাবিত ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’কে (যা অর্থ মন্ত্রণালয়েরই একটি অংশ) দেওয়া হয়েছে, যা কার্যত ‘সোনার পাথর বাটি’ বলে মনে হয়। কারণ মন্ত্রণালয়ের তো নীতিনির্ধারণের কাজই করার কথা। পৃথিবীর কোনো দেশেই রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকে না। এটি থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন এক বা একাধিক কার্যনির্বাহী সংস্থা যেমন– সরকারি বিভাগ/অধিদপ্তর বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার হাতে। প্রস্তাবিত সংস্কার বাস্তবায়ন করা হলে রাজস্বনীতি এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মধ্যে যেমন সমন্বয় কঠিন হয়ে পড়বে (কারণ কেউ কারও অধীন মেনে নেবে না), তেমনি রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব আদায় আরও জটিল হয়ে পড়বে। কারণ এতে ব্যবস্থাপনার মধ্যে অতিরিক্ত আরও একটি স্তর বাড়বে, শীর্ষ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান এবং মাঠ পর্যায়ের ইউনিটগুলোর বর্তমান সহজ আন্তঃসংযোগ কঠিন হয়ে পড়বে এবং শীর্ষ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ভাবধারার উদ্ভব ঘটবে। তবে ‘রাজস্বনীতি প্রণয়ন ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’র সংস্কারগুলো নিম্নরূপ হতে পারে বলে আমি মনে করি:
এক. রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটির স্থলে দুটি বোর্ড গঠন: বর্তমানের একটি রাজস্ব বোর্ডের স্থলে দুটি রাজস্ব বোর্ড বা সংস্থা গঠন করা যায়-(ক) একটি প্রত্যক্ষ করের (আয়কর) জন্য, (খ) অপরটি পরোক্ষ করের (শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি) জন্য, ভারতে যেমন আছে। অনেকেই মনে করেন, দুটি বোর্ডের মধ্যে আয় বাড়ানোর জন্য প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে এবং কর ব্যবস্থাপনা অধিকতর লক্ষ্যভিত্তিক হবে। অন্যদিকে এনবিআরে আগে থেকেই উক্ত দুই দিকেই পর্যাপ্ত এবং সমসংখ্যক সদস্য থাকায় দুটি বোর্ড গঠিত হলে কোনো ব্যয় বাড়বে না। ভারতের মতো এই সংস্থা দুটির প্রধান হবেন যথাক্রমে বিসিএস আয়কর এবং বিসিএস শুল্ক ক্যাডারের জ্যেষ্ঠতম কর্মকর্তা এবং তাদের সরকারের একজন সচিবের পদমর্যাদা দেওয়া যেতে পারে। বোর্ডের অন্য সদস্যরা জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ক্যাডার হতে নিয়োগ পাবেন।
দুই. এনবিআরে বেসরকারি খাত থেকে
অ-নির্বাহী সদস্য নিয়োগ বা পরামর্শ কমিটি গঠন : এনবিআরের স্থলে যদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের জন্য দুটি পৃথক বোর্ড গঠন করা হয়, তবে কর্ম-সম্পাদনে সাফল্য, দক্ষতা, করদাতাদের সেবা প্রদান, কর্ম-কৌশল এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে বোর্ডকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য বোর্ডের অধীনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, পেশাজীবী এবং বেসরকারি খাতের নির্বাহীদের বোর্ডের অ-নির্বাহী সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে তাদের নিয়ে বোর্ডের পরামর্শ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তবে করনীতি প্রণয়ন এবং কোনো ব্যক্তি-বিশেষ বা প্রতিষ্ঠানের কর নির্ধারণ বিষয়ে অ-নির্বাহী সদস্যদের অথবা পরামর্শ কমিটির সদস্যদের পরামর্শ দেওয়ার কোনো ক্ষমতা থাকবে না।
সিঙ্গাপুরের ‘ইনল্যান্ড রেভিনিউ অথরিটি অব সিঙ্গাপুর’-এর উপদেষ্টা বোর্ডে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বেশ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি রয়েছেন। ‘সিঙ্গাপুর কাস্টমস’-এর পরামর্শক কমিটিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পোর্ট অথরিটি, এয়ারলাইনস, লজিস্টিকস কোম্পানি এবং ফ্রেইট অ্যাসোসিয়েশন প্রতিনিধিরা উপদেষ্টা পরিষদে অ-নির্বাহী সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। যুক্তরাজ্যে এইচএমআরসি পরিচালনার জন্যও একটি বোর্ড রয়েছে এবং এতে বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকজন পেশাজীবী অ-নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত আছেন। বোর্ডের অ-নির্বাহী পরিচালক পদে কর, অ্যাকাউন্ট্যান্সি, তথ্যপ্রযুক্তি, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, ইত্যাদি বিষয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পেশাজীবী এবং বেসরকারি খাতের নির্বাহীদের নিয়োগ দেওয়া হয়। বেসরকারি খাতের পরিচালকদের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা এবং পেশাদার ব্যাকগ্রাউন্ড বোর্ডের পরামর্শের জন্য একটি বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে এবং তাতে বোর্ডের কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কর্ম-কৌশল নির্ধারণে গুণগত পরিবর্তন আশা করা যায়।
তিন. ‘রাজস্বনীতি বিভাগ’ কীভাবে গঠিত হওয়া উচিত: ‘রাজস্বনীতি বিভাগ’ মূলত কাস্টমস ও আয়কর এবং অর্থ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য ক্যাডার সদস্যদের দ্বারা গঠিত হওয়া উচিত। কারণ, এটি একটি অত্যন্ত বিশেষায়িত কাজ, অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর মতো নয়। সাধারণ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পক্ষে রাজস্বনীতি কার্যক্রম কার্যকরভাবে পরিচালনা করা সহজ হবে না, কারণ এটির জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ জ্ঞান এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনার বাস্তব অভিজ্ঞতা। তবে সেই সঙ্গে বাজার থেকে অর্থনীতিবিদ ও অন্য পেশাজীবীদেরও ‘রাজস্বনীতি বিভাগে’ আনতে হবে। এই জনবল নীতির পাশাপাশি, ‘রাজস্বনীতি বিভাগ’কে পরিকল্পনা কমিশনের মতো একটি বিশেষ স্বাধীন সংস্থার আদলে পরিচালিত হতে হবে এবং এর গঠন কাঠামো ফ্ল্যাট বা সমতল হতে হবে, যেখানে একাধিক সদস্য সমান পদমর্যাদা ও অবস্থানে থাকবেন। এটি যেন সচিব, অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্ম সচিব ইত্যাদির মতো আমলাতান্ত্রিক ও পদসোপান-ভিত্তিক (হায়ারার্কিকেল) কাঠামোতে পরিণত না হয়।
ফিরোজ আহমেদ: সদস্য, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন; সাবেক কর্মকর্তা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক
firozlxp@gmail.com