প্রতিবছর ঈদের সময় রাজধানী ছাড়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ। এবারও ছেড়েছে। এ সময় কলকারখানা বন্ধ থাকে। যানবাহন চলাচল একেবারেই কমে যায়। মোটকথা, রাজধানীর বায়ুদূষণের সব উৎসই মোটামুটি কমে যায়। তারপরও এবার ঈদুল ফিতরের লম্বা ছুটির সময় রাজধানীবাসী নির্মল বায়ু পায়নি। ঈদের দুই দিন আগে, ঈদের দিন এবং পরের দিনও রাজধানীর বায়ু ছিল অস্বাস্থ্যকর। তবে ২ এপ্রিল কিছুটা ভালো ছিল বায়ুর মান। কিন্তু গড়ে পাঁচ দিনের বায়ু ছিল অস্বাস্থ্যকর।

এ বছরের বায়ুর মান গত বছরের চেয়ে কিছুটা ভালো। তবে ৭–৮ বছর আগেও ঈদের ছুটিতে বায়ুর মান ভালো ছিল।

যদিও চলতি বছর বায়ুর মান গত বছরের চেয়ে কিছুটা ভালো। কিন্তু সাত থেকে আট বছর আগেও বায়ুর মান ঈদের ছুটির মধ্যে এর চেয়ে ভালো অবস্থায় ছিল।

নগরবিদ ও দূষণ গবেষকেরা বলছেন, ছুটির মধ্যেও অস্বাস্থ্যকর বায়ু থাকার অর্থ হলো দূষণ রোধে গৃহীত পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট নয়। ঈদের সময় বায়ু পরিস্থিতি তুলে ধরেছে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার ঈদের ছুটির পাঁচ দিনের গড় বায়ুর মান (একিউআই) ছিল ১৫১। এটি ২০২৪ সালের রেকর্ড ১৯০-এর তুলনায় ভালো। যদিও তা নিরাপদ সীমার অনেক ওপরে। ২০১৬ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত মোট ১০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান এয়ার নাওয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

দূষণের উৎসগুলো ছুটির সময় নিয়ন্ত্রিত থাকে। তারপরও এমন কেন হলো, সেটা খোঁজ করতে হবে। হয়তো উৎসগুলোর নিয়ন্ত্রণ যথাযথ হচ্ছে না। মো.

জিয়াউল হক, পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর

ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ঈদুল ফিতরের সময়ের চেয়ে এবার দূষণ কম হলেও অস্বাস্থ্যকর বায়ু থেকে সুরক্ষা পায়নি নগরবাসী। এতে প্রমাণিত হয়, দূষণের উৎস নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট টেকসই ও কার্যকর কিছু করা হয়নি।

পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি

বায়ুর মান শূন্য থেকে ৫১ হলে তাকে ভালো বলা হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে বায়ুর মান মাঝারি। ১০১ থেকে ১৫০ হলে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ক্ষতিকারক বলে গণ্য হয়। অস্বাস্থ্যকর ধরা হয় যদি বায়ুর মান ১৫১ থেকে ২০০-এর মধ্যে থাকে। খুব অস্বাস্থ্যকর বায়ু বলা হয়, মান যখন ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকে। আর ৩০০-এর বেশি হলে তা হয় দুর্যোগপূর্ণ। দূষণের এই মানদণ্ড পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও কমবেশি মেনে চলে।

ক্যাপসের গবেষণা অনুযায়ী, গত এক দশকে ঈদের ছুটিতে ঢাকার বায়ুর মান ওঠানামা করেছে। ১০ বছরের ঈদের আগে-পরের ৪৫ দিনের হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৭ সালে ঈদুল ফিতরের পরের দুই দিন মান ছিল সর্বনিম্ন ৪২ ও ৩৬। ২০১৯ সালের ঈদুল ফিতরের পরের দিনের মান ছিল ৩৭। কোনো কোনো বছর মান ১৫০-এর ওপরে গিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছে। এবার ঈদুল ফিতরের দিন ৩১ মার্চ বায়ুর গড় মান ছিল ১৫১। এর দুই দিন আগে ২৯ মার্চ ছিল ১৫৫। আর ঈদের পরদিন মান ছিল ১৫০। তবে ২ এপ্রিল ১৪৪-এ নেমে আসে।

রাজধানীতে ঈদুল ফিতরের ছুটির সময় বিভিন্ন এলাকায় দূষণের তারতম্য দেখা গেছে। এর মধ্যে মিরপুর ইস্টার্ন হাউজিংয়ে বায়ুর মান ছিল সবচেয়ে খারাপ। এরপর আছে কল্যাণপুর, মগবাজার ও মহাখালী।

কেন দূষণ কমে না

ঢাকার দূষণে যেসব উৎসের কথা বেশি বলা হয়, এর মধ্যে কলকারখানা, যানবাহন ও ইটভাটার ধোঁয়া, বর্জ্য পোড়ানোর কথা বলা হয়। ঈদের সময় এসব উৎসের প্রায় সব কটি বন্ধ ছিল। তারপরও এমন কেন?

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, দূষণের উৎসগুলো ছুটির সময় নিয়ন্ত্রিত থাকে। তারপরও এমন কেন হলো, সেটা খোঁজ করতে হবে। হয়তো উৎসগুলোর নিয়ন্ত্রণ যথাযথ হচ্ছে না। স্থানীয় উৎসগুলোর পাশাপাশি উপমহাদেশীয় আন্তসীমান্ত বায়ুপ্রবাহ বড় ভূমিকা রাখে।

নগরীর দূষণের কথা উঠলে সরকারের পক্ষ থেকে ভারত ও পাকিস্তান হয়ে আসা দূষিত এই বায়ুপ্রবাহের কথা সব সময়ই উচ্চারিত হয়। সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, বাংলাদেশে দূষিত বায়ুর ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসে।

নগরীর দূষণ বেশি হয় নভেম্বর থেকে মার্চ মাসে। এরপর এপ্রিলে দক্ষিণের বায়ু এবং এর সঙ্গে সৃষ্টি হওয়া কালবৈশাখী ও বৃষ্টিতে দূষণের পরিমাণ কমে আসে। দূষণ কমানোর ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক এই সমাধানের ওপরই এখন পর্যন্ত ভরসা।

নগরবিদ ইকবাল হাবীব প্রথম আলোকে বলেন, পুরো ঢাকা নগরী হলো আস্তরণহীন। নির্মাণকাজ হচ্ছে উন্মুক্তভাবে। সেখানে বালু ও ইট উন্মুক্ত থাকছে। নগরীর বিস্তীর্ণ এলাকা উন্মুক্ত পড়ে আছে। সেখানেও সবুজের কোনো আচ্ছাদন নেই। তাই নগর থেকে মানুষ চলে গেলে কিংবা কারখানা বন্ধ থাকলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। নগরীর দূষণ বাড়ছেই।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ছ ট র সময় ঈদ র ছ ট ত রপরও পর ব শ র ঈদ র নগর র বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

মশা নিধনে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে

চট্টগ্রামে এডিস মশার প্রজনন ও লার্ভার ঘনত্ব গত এক বছরে দ্বিগুণ হয়েছে, আর এর সরাসরি ফল ভোগ করছেন নগরবাসী। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, এবার ডেঙ্গুর চেয়েও চিকুনগুনিয়া ঘরে ঘরে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, যা এক নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। মশা নিধনে কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগের অভাবই এ রোগের দ্রুত বিস্তারের প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। চট্টগ্রামে এভাবে জনস্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রাম নগর এডিস মশাবাহিত রোগের জন্য এখন অতি ঝুঁকিপূর্ণ। গত বছর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগ একই ধরনের জরিপ চালিয়েছিল। এই দুই জরিপের তুলনামূলক চিত্র আমাদের সামনে এক ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরে—এডিস মশার প্রজনন ও লার্ভার ঘনত্ব দুটিই আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

২০২৪ সালে চট্টগ্রামে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব (ব্রুটো ইনডেক্স) ছিল ৩৬ শতাংশ, যা এবার আইইডিসিআরের গবেষণায় পৌঁছেছে ৭৫ দশমিক ২৯ শতাংশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান যেখানে ২০ শতাংশ, সেখানে চট্টগ্রামের এ চিত্র রীতিমতো ভয়াবহ। বাসাবাড়িতেও লার্ভার উপস্থিতি বেড়েছে। গত বছর ৩৭ শতাংশ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেলেও এবার তা প্রায় ৪৮ শতাংশে পৌঁছেছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবার ডেঙ্গুর চেয়ে চিকুনগুনিয়ার রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। আবার অনেকের ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া দুটিই হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জিকা ভাইরাসের উপস্থিতি, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। চলতি বছরেই ৭৬৪ জনের চিকুনগুনিয়া ও ৭৯৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে এবং ডেঙ্গুতে আটজন প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে ছয়জনই মারা গেছেন এই জুলাই মাসে।

সিভিল সার্জন জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, আইইডিসিআরের সুপারিশগুলো সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছে এবং সে অনুযায়ী কাজ চলছে। সিটি করপোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম দাবি করছেন যে মশকনিধনে ক্রাশ কর্মসূচি চলছে এবং নতুন জরিপ অনুযায়ী হটস্পট ধরে কাজ করা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন হলো এ উদ্যোগগুলো কি যথেষ্ট? লার্ভার ঘনত্ব যেখানে তিন-চার গুণ বেশি, সেখানে গতানুগতিক কর্মসূচির ওপর নির্ভর করলে চলবে না।

মশাবাহিত রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার কোনো বিকল্প নেই। এ কাজে সিটি করপোরেশনকে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। বাসাবাড়িতে নানা জায়গায় জমে থাকা স্বচ্ছ পানিও এডিস মশার প্রজননের জন্য যথেষ্ট। ফলে নাগরিকদের সচেতনতা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম শহরকে মশাবাহিত রোগের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে হলে স্থানীয় প্রশাসন, নগর কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে; নগরবাসীকে দ্রুত তৎপর হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মশা নিধনে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে
  • গংগাচড়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ, আতঙ্ক কাটেনি এখনও