মিয়ানমারের রাখাইন সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) অধিকৃত রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপসহ আশপাশের এলাকায় নতুন করে গোলাগুলি ও সংঘাতের খবর পাওয়া গেছে। কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। সংঘাতে উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন সদস্য হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।

মংডু টাউনশিপে মাইকিং করে স্থানীয় রোহিঙ্গাদের আরসার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখার ব্যাপারে সতর্ক করেছে আরকান আর্মি। পাশাপাশি মংডুর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত সাতটি গ্রাম গতকাল শনিবার থেকে ঘিরে রেখেছে তারা। এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীকে ঠেকাতে সীমান্ত পথসহ বিভিন্ন এলাকায় স্থলমাইন পুঁতে রাখছে। মাইন বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। সর্বশেষ আজ রোববার টেকনাফের নাফ নদীর তোঁতারদিয়া সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণে বাংলাদেশি এক জেলের ডান পা উড়ে গেছে।

সীমান্তের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। রাখাইন থেকে প্রকাশিত অনলাইন গণমাধ্যম নিরিঞ্জারার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩ এপ্রিল মংডু টাউনশিপের মায়াওয়াড়ি ও বুচিডং টাউনশিপের খামি গ্রামে বসবাসকারী সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করে চারজনকে (বৌদ্ধ মগ সম্প্রদায়) হত্যা করেছে আরসা সন্ত্রাসীরা। নিহত ব্যক্তিদের বয়স ১৭ থেকে ৪১ বছর। এর আগে ২৯ ও ৩০ মার্চ মংডু টাউনশিপের আশপাশে কয়েকটি গ্রামে আরসার গুলিতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছেন।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৯ মার্চ দুপুরে মোটরসাইকেল আরোহী পাঁচজন আরাকান আর্মির সদস্যের ওপর অতর্কিত হামলা করেন আরসার অন্তত ৬০ জন সদস্য। এ ঘটনায় আরকান আর্মির দুজন সদস্য নিহত হন। মূলত এ ঘটনার পর আরাকান আর্মির সদস্যরা সেখানকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর কড়া নজরদারি রাখছেন। বিকেল পাঁচটার পর কাউকে ঘর থেকে বেরোতে দিচ্ছেন না।

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, ৪ এপ্রিল দুপুরে মংডু টাউনশিপের একটি গ্রামে আরসা সদস্যদের অবস্থানের খবর পেয়ে সেখানে হামলা চালিয়ে দুটি ভারী অস্ত্র জি-৩ রাইফেলসহ গোলাবারুদ জব্দ করে আরাকান আর্মি। এ সময় আরাকান আর্মির গুলিতে আরসার দুজন সদস্য নিহত হন।

১১ মাসের বেশি সময় ধরে লড়াই-সংঘাতের পর গত বছরের ৮ ডিসেম্বর রাখাইন রাজ্যের ৮০-৯০ শতাংশ এলাকা (২৭০ কিলোমিটার) নিয়ন্ত্রণে নেয় আরাকান আর্মি। এরপর রাজ্যের রাজধানী সিথুয়ে (আকিয়াব) দখলে মরিয়া হয়ে ওঠে আরকান আর্মি। চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি দুই মাস রাখাইনে শান্ত অবস্থা বিরাজ করলেও মার্চের শুরু থেকে আবার সংঘাতে জড়ায় দুই সশস্ত্র গোষ্ঠী।

গত ১৭ মার্চ গভীর রাতে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ১০ তলা ভবনের ফ্ল্যাট থেকে আরসার প্রধান কমান্ডার আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনীসহ গোষ্ঠীর ১০ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। এরপর আতাউল্লাহসহ ছয়জনকে পৃথক দুটি মামলায় ১০ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন পুলিশসহ তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আতাউল্লাহসহ গ্রেপ্তার কয়েকজনের বিরুদ্ধে কক্সবাজারের উখিয়া থানায় চারটি ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় একটিসহ মোট পাঁচটি হত্যা মামলা আছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) জসিম উদ্দীন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আতাউল্লাহসহ গ্রেপ্তার আরসা সদস্যরা বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে আছেন। সেখানকার তদন্ত শেষ হলে কক্সবাজারের হত্যা মামলাগুলোতে গ্রেপ্তার দেখানো হবে এবং তাঁদের কক্সবাজারে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

সীমান্তের একাধিক সূত্র ও রোহিঙ্গা নেতারা জানান, আতাউল্লাহর অবর্তমানে আরসা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছেন শেখ বোরহান নামে গোষ্ঠীটির আরেক কমান্ডার। তিনি আতাউল্লাহর বিশ্বস্ত সহযোগী। বর্তমানে তিনি আত্মগোপনে থেকে অডিও বার্তার মাধ্যমে রাখাইনে নতুন করে হওয়া সংঘাতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

আতঙ্কে দুই পারের রোহিঙ্গারা

রাখাইনে আরসা ও আরাকান আর্মির মধ্যে আবার সংঘাত শুরু হওয়ায় আতঙ্কে আছেন রাখাইনে মংডু টাউনশিপে বসবাসরত দেড় লাখ রোহিঙ্গা। কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারাও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছেন ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। উল্টো গত কয়েক মাসে আরাকান আর্মির নির্যাতনের শিকার হয়ে রাখাইন থেকে ৭০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন।

রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সভাপতি মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, রাখাইনে নতুন সংঘাত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রমকে আরও দীর্ঘায়িত করবে। তা ছাড়া রাখাইনে থেকে যাওয়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হতে পারে। সম্প্রতি জান্তা সরকার কক্সবাজারে আশ্রয়শিবিরে থাকা ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আরাকান আর্মি সেখানকার রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদের চক্রান্ত করছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল যাতে তাদের (আরাকান আর্মি) সঙ্গে কথা বলে, তারা এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা কামাল আহমদ বলেন, আতাউল্লাহ ছিলেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী। রাখাইনে বছরব্যাপী চলা যুদ্ধে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে ও জান্তা সরকারের পক্ষে লড়েছিল আরসা। আরসাকে সহযোগিতার জন্য রোহিঙ্গাদের অভিযুক্ত করে আসছে আরাকান আর্মি। এ কারণে দুই মাস ধরে সেখানকার রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন বাড়িয়েছে দখলদার সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। আরসা আবার সংঘাতে জড়ানোয় রোহিঙ্গারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো.

আরিফ হোসাইন বলেন, আশ্রয়শিবিরে আরসা এবং আরএসওর (আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন) মধ্যে কয়েক বছর ধরে গোলাগুলি-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। মার্চের অভিযানে নারায়ণগঞ্জ থেকে আরসাপ্রধান আতাউল্লাহকে গ্রেপ্তারের পর আশ্রয়শিবিরে আরসার তৎপরতা থেমে যায়।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সশস ত র গ ষ ঠ আর ক ন আর ম র ট উনশ প র জন সদস য র খ ইন আরস র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

ট্রাইব্যুনালে গুমের মামলা তদন্ত, বিচারে সহযোগিতা করবে জাতিসংঘের গুমবিষয়ক গ্রুপ: চিফ প্রসিকিউটর

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হওয়া গুমের মামলার তদন্তের পাশাপাশি বিচারে জাতিসংঘের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ সব ধরনের সমর্থন ও সহযোগিতা করবে। আজ সোমবার দুপুরে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।

জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স (ডব্লিউজিইআইডি)-এর ভাইস চেয়ার গ্রাজিনা বারানোস্কা ও আনা লোরেনা ডেলগাদিলো পেরেজ বর্তমানে বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন। এই দুজন ও ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকারবিষয়ক উপদেষ্টা হুমা খানসহ জাতিসংঘের বেশ কয়েকজন প্রতিনিধি আজ দুপুরে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

পরে এ বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের গুমের কেসগুলোকে কীভাবে আমরা ডিল করছি এবং এই কেসের যে তদন্ত, বিচার কোন পর্যায়ে আছে; কী কী চ্যালেঞ্জ আমরা ফেস করছি, এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য কী কী ধরনের সাপোর্ট দরকার, তাঁরা কী ধরনের সাপোর্ট আমাদের দিতে পারেন, সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই বিচার অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সব ধরনের সমর্থন ও সহযোগিতা করতে এই কমিটি প্রস্তুত আছে এবং তাঁরা এটা করবেন।’

গুমের শিকার, এমন ভুক্তভোগীরা সাক্ষী দিতে এসে যাতে বিপদে না পড়েন, সে ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে জানিয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, তাঁরা বলেছেন, যত ধরনের সাহায্য লাগবে, তাঁরা করবেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, বিশেষ করে সাক্ষী সুরক্ষার ব্যাপারটা। এ ব্যাপারে আইন আছে, কিন্তু তা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অনেক ভুক্তভোগী আছেন, তাঁদের হয়তো এমন নিরাপত্তার সংকট আছে, তাঁদের হয়তো এক জায়গা থেকে সরিয়ে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার দরকার হতে পারে। সেটা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে করা কঠিন। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের যদি সহযোগিতা পাওয়া যায়, তাহলে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের জন্য কাজ করা সহজ হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ