ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ সকালে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। ১৯৮৯ সাল থেকে এটা হয়ে আসছে। প্রথমে এই শোভাযাত্রার নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। পরে নাম পরিবর্তন করে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ করা হয়। গত বছর পর্যন্ত এটিই প্রচলিত ছিল। এবার বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার আগে এই শোভাযাত্রার নাম নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। অবশ্য চার-পাঁচ বছর ধরে ‘মঙ্গল’ শব্দ এবং এই শোভাযাত্রার উপকরণ নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক শোনা যায়।
নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘অমঙ্গলকে দূর করে মঙ্গলের আহ্বান’ জানিয়েই শোভাযাত্রার নামকরণ তখন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ করা হয়েছিল বলে কেউ কেউ দাবি করেন। অন্যদিকে আমাদের দেশে যেহেতু নামকরণ এবং নাম বদলের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে চলছে, তাই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে যাদের আপত্তি, তাদের এ জন্য দায়ী করার সুযোগ থাকছে না। তবে নাম বদলের উদ্দেশ্য যা-ই হোক; তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা শোভাযাত্রাটি বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে– এটা মেনে নিতে কারও আপত্তি থাকার কথা না।
এবারের নববর্ষ উদযাপনের পরিপ্রেক্ষিত বিগত বছরের মতো নয়, বরং নব্বইয়ের মতো এবারও স্বৈরাচার পতনের ঘটনা ঘটেছে। একই সঙ্গে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ শুধু নববর্ষ উদযাপনের অনুষঙ্গ থাকছে না; উদযাপনের রাজনীতিও আরেকবার দেখা যাচ্ছে। এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে– ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। এই স্লোগানেই পরিষ্কার হচ্ছে– গণতন্ত্রকামী জনতার প্রতিরোধ ও বিক্ষোভের মুখে যেভাবে স্বৈরাচার তকমা নিয়ে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন, এবারের নববর্ষ উদযাপনেও তার সুর শোনা যাবে।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র নাম নিয়ে প্রশ্ন তুলে অনেকেই বলছেন, এই নামের মধ্যে সর্বজনীনতা নেই। শোভাযাত্রায় যেসব প্রতীক থাকে, তাতে আপামর বাংলার সংস্কৃতির পরিচয় থাকে না। এটাকে বলা হচ্ছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও আধিপত্য। বলা হচ্ছে, বিগত দেড়-দুই দশকে এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বেশ শক্ত শিকড় ছড়িয়ে ডালপালা বৃদ্ধি করেছে। স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হস্তক্ষেপের মতো প্রতিবেশী ভারতের সংস্কৃতি আমাদের এখানে প্রভাব রাখছে। এই বিবেচনায় শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করার পাশাপাশি এতে বিভিন্ন প্রতীক ব্যবহার করার বিষয়েও আপত্তি আসছে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে যা সর্বজনীন, এমন কিছু ব্যবহার করার দাবিও আছে।
বিগত আওয়ামী লীগ আমলে মঙ্গল শোভাযাত্রার সময়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুখের আদলের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ প্রতিকৃতি দেখা গিয়েছিল। আবার টুপি-দাড়ি পরিহিত মুসলিমের মুখাবয়ব হাজির করা হয়েছিল। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই মূলত এ দুটি প্রতিকৃতি প্রদর্শন করা হয়। বিরোধী মতকে হেয় প্রতিপন্ন করাই ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। এবার যে নামেই পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা হোক; এখন পর্যন্ত প্রকাশিত সংবাদভাষ্যে জানা যাচ্ছে, এবারের শোভাযাত্রার অন্যতম প্রতীক হবে ফ্যাসিবাদের। শোভাযাত্রার মূল বিষয় ‘ফ্যাসিবাদী প্রতিকৃতি’। যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মুখাবয়বের দু’পাশে থাকবে শিংয়ের মতো। জুলাই বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে মুগ্ধর ‘পানি লাগবে’ বোতলটি পাবে ১৫ ফুট উচ্চতার আদল। তার ভেতরে আরও অনেক পানির বোতল থাকবে শহীদদের স্মরণে। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর প্রথমবারের মতো পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হবে এবার। এখন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে সঠিক মনে না করা, পরিবর্তিত বাংলাদেশে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়– এমন কিছুকে অস্বীকার করা অগণতান্ত্রিক নয়। এটিকে সর্বজনীন করতে হলে নামটা পরিবর্তন করা উচিত। আবার ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’য় যেসব প্রতীক ব্যবহার করা হয়– প্যাঁচা থেকে শুরু করে অনেক কিছু, সেগুলো আমাদের দেশের ধর্মীয় মূল্যবোধ বা চিন্তাভাবনার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এই রকম সাংঘর্ষিক বিষয় থেকে বেরিয়ে এসে সর্বজনীন কোনো প্রতীক ব্যবহার করলে হয়তো আপত্তি থাকবে না। মঙ্গল শোভাযাত্রার বয়স ৪০ বছরের বেশি নয়। এটা স্থায়ী কোনো বিষয় নয়। দেশে দেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় জেঁকে বসা ক্ষমতাধররা জনসাধারণকে মোহগ্রস্ত করতে উৎসবকে ব্যবহার করে। এখানে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ তেমন সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ। এর সঙ্গে পহেলা বৈশাখের সম্পর্ক অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদিও বহুকাল আগে থেকেই বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়ে আসছে। এটি কোনো নতুন ঘটনা নয়। গ্রাম থেকে শহরে সেটি পালিত হতো অন্যমাত্রায়, অন্যভাবে। সেটি এখন বিলুপ্ত হয়ে এসব শহুরে জায়গা দখল করেছে। এর সঙ্গে পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে মেলা ও অর্থনীতিতে যা প্রভাব পড়ে তা নতুন প্রতিযোগিতামূলক বাজারকে চাঙ্গা করে। কিন্তু এসব চাকচিক্যের আড়ালে থাকে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ। আর এই সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কথা না বললেও শোভাযাত্রায় ‘অধর্ম’ ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ধর্মভিত্তিক দলের নেতারা। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেছেন, বাংলা নববর্ষ উদযাপনে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে কোনো কিছু করা যাবে না। ‘নববর্ষের আয়োজনে মূর্তিসহ ইসলাম অসমর্থিত সবকিছু বাদ দিন। বরং এ দেশের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিবেচনা করে ইসলাম সমর্থিত ধারণা ও উপকরণ ব্যবহার করুন।’ (সমকাল, ১০ এপ্রিল ২০২৫)
ধর্মভিত্তিক দলের নেতার অধর্মবিষয়ক জ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ মোকাবিলা করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে নববর্ষ উদযাপন করবে– এমন স্বপ্ন নিয়েই কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছিল। নতুন বছরে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দূর হবে; বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষের নিরাপদ সহাবস্থান নিশ্চিত হবে এবং আর কোনো ফ্যাসিবাদী অবস্থা যাতে তৈরি না হয়– এমন প্রতিজ্ঞা হোক আমাদের সবার।
এহ্সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক,
সমকাল; কথাসাহিত্যিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: নববর ষ উদয প ব যবহ র কর র র জন ত আম দ র আপত ত
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ চলবে: হামাস
স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়ার প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে হামাস। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া এক ঘোষণাপত্রের অস্ত্র ত্যাগের আহ্বানের জবাবে সংগঠনটি এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার হামাসের সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দখলদারির অবসান এবং জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ও সম্পূর্ণ সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ থামবে না তারা।
মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘গাজায় যুদ্ধ বন্ধে হামাসকে (এই উপত্যকায়) তার শাসনের অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ ও সমর্থনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। সার্বভৌম ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ।’
সৌদি আরব, কাতার, ফ্রান্স ও মিসরসহ ১৭টি দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লিগ ঘোষণাপত্রটি সমর্থন করেছে। এটি ‘দ্য নিউইয়র্ক’ ঘোষণাপত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
বৃহস্পতিবার আলাদা এক বিবৃতিতে প্রতি শুক্রবার, শনিবার ও রোববার বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তাদের মিত্র দেশগুলোর দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ করার আহ্বান জানিয়েছে হামাস। ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
অনাহারে মৃত্যু ১৫৪গাজায় কর্মরত চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, উপত্যকাটিতে অনাহারে আরও দুই শিশু এবং এক তরুণ মারা গেছে। এ নিয়ে সেখানে অনাহারে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫৪ জনে। তাদের মধ্যে শিশু ৮৯টি।
গাজায় প্রায় ২১ লাখ মানুষের বসবাস। উপত্যকাটিতে গত মার্চ থেকে নতুন করে অবরোধ শুরু করে ইসরায়েল। ফলে সেখানে ত্রাণবাহী কোনো ট্রাক প্রবেশ করতে পারছিল না। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সম্প্রতি কিছুদিন ধরে গাজায় সীমিত পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে ইসরায়েল। এই ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য।
ত্রাণ নিতে প্রাণহানি ১৩৭৩জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জানিয়েছে, গাজায় গত মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত ত্রাণ আনতে গিয়ে মোট ১ হাজার ৩৭৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৮৫৯ জন মারা গেছেন বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে। গত মে মাসের শেষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটি ইসরায়েলি সেনাদের সহায়তায় গাজার কয়েকটি স্থানে ত্রাণ দিচ্ছে।
বাকি ৫১৪ জন মারা গেছেন ত্রাণবাহী ট্রাকের আশপাশে। তাঁরা ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অধিকাংশই ইসরায়েলের সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার সকালে গাজায় অন্তত আরও ৪২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ত্রাণ আনতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন। এই নিয়ে প্রায় ২২ মাসের সংঘাতে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের হামলা নিহত হয়েছেন অন্তত ৬০ হাজার ৩৩২ জন।
গাজায় স্টিভ উইটকফশুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ গাজা সফর করেছেন। তিনি উপত্যকাটির রাফা এলাকায় জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রও ঘুরে দেখেন। এ সময় ইসরায়েলে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হুকাবি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাজায় ছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে উইটকফ নিজেই এই কথা জানিয়েছেন। আগের দিন তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উইটকফ বলেছেন, ‘মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে ও তথ্য সংগ্রহ করতে আমরা গাজায় গিয়েছিলাম। গাজার মানবিক পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট ধারণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য, যাতে করে গাজাবাসীর জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছাতে পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করা যায়।’
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষ দূত ও আবাসন খাতের সাবেক আইনজীবী উইটকফের আন্তর্জাতিক নীতি ও মানবিক সহায়তা-সংক্রান্ত কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তা সত্ত্বেও তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানের চেষ্টার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধেও কূটনীতি চালাচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন।