Samakal:
2025-05-01@03:27:20 GMT

বৈশাখ উদযাপনের রাজনীতি

Published: 10th, April 2025 GMT

বৈশাখ উদযাপনের রাজনীতি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ সকালে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। ১৯৮৯ সাল থেকে এটা হয়ে আসছে। প্রথমে এই শোভাযাত্রার নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। পরে নাম পরিবর্তন করে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ করা হয়। গত বছর পর্যন্ত এটিই প্রচলিত ছিল। এবার বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার আগে এই শোভাযাত্রার নাম নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। অবশ্য চার-পাঁচ বছর ধরে ‘মঙ্গল’ শব্দ এবং এই শোভাযাত্রার উপকরণ নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক শোনা যায়।  

নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘অমঙ্গলকে দূর করে মঙ্গলের আহ্বান’ জানিয়েই শোভাযাত্রার নামকরণ তখন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ করা হয়েছিল বলে কেউ কেউ দাবি করেন। অন্যদিকে আমাদের দেশে যেহেতু নামকরণ এবং নাম বদলের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে চলছে, তাই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে যাদের আপত্তি, তাদের এ জন্য দায়ী করার সুযোগ থাকছে না। তবে নাম বদলের উদ্দেশ্য যা-ই হোক; তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা শোভাযাত্রাটি বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে– এটা মেনে নিতে কারও আপত্তি থাকার কথা না। 
এবারের নববর্ষ উদযাপনের পরিপ্রেক্ষিত বিগত বছরের মতো নয়, বরং নব্বইয়ের মতো এবারও স্বৈরাচার পতনের ঘটনা ঘটেছে। একই সঙ্গে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ শুধু নববর্ষ উদযাপনের অনুষঙ্গ থাকছে না; উদযাপনের রাজনীতিও আরেকবার দেখা যাচ্ছে। এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে– ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। এই স্লোগানেই পরিষ্কার হচ্ছে– গণতন্ত্রকামী জনতার প্রতিরোধ ও বিক্ষোভের মুখে যেভাবে স্বৈরাচার তকমা নিয়ে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন, এবারের নববর্ষ উদযাপনেও তার সুর শোনা যাবে। 

সাম্প্রতিক সময়ে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র নাম নিয়ে প্রশ্ন তুলে অনেকেই বলছেন, এই নামের মধ্যে সর্বজনীনতা নেই। শোভাযাত্রায় যেসব প্রতীক থাকে, তাতে আপামর বাংলার সংস্কৃতির পরিচয় থাকে না। এটাকে বলা হচ্ছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও আধিপত্য। বলা হচ্ছে, বিগত দেড়-দুই দশকে এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বেশ শক্ত শিকড় ছড়িয়ে ডালপালা বৃদ্ধি করেছে। স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হস্তক্ষেপের মতো প্রতিবেশী ভারতের সংস্কৃতি আমাদের এখানে প্রভাব রাখছে। এই বিবেচনায় শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করার পাশাপাশি এতে বিভিন্ন প্রতীক ব্যবহার করার বিষয়েও আপত্তি আসছে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে যা সর্বজনীন, এমন কিছু ব্যবহার করার দাবিও আছে। 

বিগত আওয়ামী লীগ আমলে মঙ্গল শোভাযাত্রার সময়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুখের আদলের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ প্রতিকৃতি দেখা গিয়েছিল। আবার টুপি-দাড়ি পরিহিত মুসলিমের মুখাবয়ব হাজির করা হয়েছিল। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই মূলত এ দুটি প্রতিকৃতি প্রদর্শন করা হয়। বিরোধী মতকে হেয় প্রতিপন্ন করাই ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। এবার যে নামেই পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা হোক; এখন পর্যন্ত প্রকাশিত সংবাদভাষ্যে জানা যাচ্ছে, এবারের শোভাযাত্রার অন্যতম প্রতীক হবে ফ্যাসিবাদের। শোভাযাত্রার মূল বিষয় ‘ফ্যাসিবাদী প্রতিকৃতি’। যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মুখাবয়বের দু’পাশে থাকবে শিংয়ের মতো। জুলাই বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে মুগ্ধর ‘পানি লাগবে’ বোতলটি পাবে ১৫ ফুট উচ্চতার আদল। তার ভেতরে আরও অনেক পানির বোতল থাকবে শহীদদের স্মরণে। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর প্রথমবারের মতো পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হবে এবার। এখন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে সঠিক মনে না করা, পরিবর্তিত বাংলাদেশে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়– এমন কিছুকে অস্বীকার করা অগণতান্ত্রিক নয়। এটিকে সর্বজনীন করতে হলে নামটা পরিবর্তন করা উচিত। আবার ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’য় যেসব প্রতীক ব্যবহার করা হয়– প্যাঁচা থেকে শুরু করে অনেক কিছু, সেগুলো আমাদের দেশের ধর্মীয় মূল্যবোধ বা চিন্তাভাবনার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এই রকম সাংঘর্ষিক বিষয় থেকে বেরিয়ে এসে সর্বজনীন কোনো প্রতীক ব্যবহার করলে হয়তো আপত্তি থাকবে না। মঙ্গল শোভাযাত্রার বয়স ৪০ বছরের বেশি নয়। এটা স্থায়ী কোনো বিষয় নয়। দেশে দেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় জেঁকে বসা ক্ষমতাধররা জনসাধারণকে মোহগ্রস্ত করতে উৎসবকে ব্যবহার করে। এখানে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ তেমন সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ। এর সঙ্গে পহেলা বৈশাখের সম্পর্ক অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদিও বহুকাল আগে থেকেই বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়ে আসছে। এটি কোনো নতুন ঘটনা নয়। গ্রাম থেকে শহরে সেটি পালিত হতো অন্যমাত্রায়, অন্যভাবে। সেটি এখন বিলুপ্ত হয়ে এসব শহুরে জায়গা দখল করেছে। এর সঙ্গে পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে মেলা ও অর্থনীতিতে যা প্রভাব পড়ে তা নতুন প্রতিযোগিতামূলক বাজারকে চাঙ্গা করে। কিন্তু এসব চাকচিক্যের আড়ালে থাকে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ। আর এই সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কথা না বললেও শোভাযাত্রায় ‘অধর্ম’ ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ধর্মভিত্তিক দলের নেতারা। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেছেন, বাংলা নববর্ষ উদযাপনে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে কোনো কিছু করা যাবে না। ‘নববর্ষের আয়োজনে মূর্তিসহ ইসলাম অসমর্থিত সবকিছু বাদ দিন। বরং এ দেশের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিবেচনা করে ইসলাম সমর্থিত ধারণা ও উপকরণ ব্যবহার করুন।’ (সমকাল, ১০ এপ্রিল ২০২৫)

ধর্মভিত্তিক দলের নেতার অধর্মবিষয়ক জ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ মোকাবিলা করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে নববর্ষ উদযাপন করবে– এমন স্বপ্ন নিয়েই কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছিল। নতুন বছরে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দূর হবে; বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষের নিরাপদ সহাবস্থান নিশ্চিত হবে এবং আর কোনো ফ্যাসিবাদী অবস্থা যাতে তৈরি না হয়– এমন প্রতিজ্ঞা হোক আমাদের সবার। 

এহ্‌সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক, 
সমকাল; কথাসাহিত্যিক

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: নববর ষ উদয প ব যবহ র কর র র জন ত আম দ র আপত ত

এছাড়াও পড়ুন:

যেকোনো উৎসবকে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে রাখার আহ্বান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের

কেবল বাংলা নববর্ষই নয়, যেকোনো উৎসবকে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। 

মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে "বাংলা নববর্ষ: ইতিহাস, সংস্কৃতি ও উত্তরাধিকার" শীর্ষক এক সেমিনারে বাংলা নববর্ষের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ও সামাজিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ অনুরোধ করেন।

সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, কেবল বাংলা নববর্ষই নয়, যেকোনো উৎসবকে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে রাখা জরুরি। রাজনীতির সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পর্ক সঠিকভাবে গড়ে উঠলে কোনো উৎসবই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয় না। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনার যে স্বকীয়তা রয়েছে, তা অক্ষুণ্ন রাখাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। বুদ্ধিভিত্তিক ও সচেতন উদ্যোগের মাধ্যমে ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। বাংলা নববর্ষের প্রতি জনগণের গভীর অনুরাগ রয়েছে, তাই এটিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।

সেমিনারে আইআরডিসি’র সাধারণ সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হকের সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন 
আইআরডিসি-এর সভাপতি ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিলাল হোসাইন।

সেমিনারে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. নাছির আহমেদ তার মূল প্রবন্ধে বাংলা নববর্ষের ঐতিহাসিক বিবর্তন এবং নববর্ষ উদযাপনের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার নিয়ে দুই পর্বে বিশদ আলোচনা করেন। তিনি বলেন, বাংলা নববর্ষ কেবল বাঙালিদের উৎসব নয়, বরং এটি ধর্ম, গোত্র ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল বাংলাদেশির একটি সমন্বিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়া, বাংলা সনের উৎপত্তি, এর অর্থনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মাত্রা নিয়েও তিনি গভীরভাবে আলোকপাত করেন।

এছাড়াও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. রইছ উদ্‌দীন এবং বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফজলে এলাহি চৌধুরী প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন। তাঁরা বাংলা নববর্ষের আন্তর্জাতিক ও  সামাজিক সংহতি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশে এর ভূমিকা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরেন। একইসাথে বাংলা নববর্ষের বহুমাত্রিক তাৎপর্য ও এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করেন।

এসময় সেমিনারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, গবেষক উপস্থিত ছিলেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • উপহার পেল পহেলা বৈশাখে জন্ম নেওয়া জেরিনের পরিবার
  • ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে উৎসবকে রাজনীতি মুক্ত রাখতে হবে: মোহাম্মদ আজম
  • দৃশ্যপটে ‘আনন্দ’, মঙ্গল কোথায়
  • যেকোনো উৎসবকে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে রাখার আহ্বান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের