দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। সেখানে কিছু বিষয়ে তাকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। 

বুধবার (১৬ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির ৮ সদস্যের প্রতিনিধিদল।  বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সই করা এই চিঠিটি প্রধান উপদেষ্টাকে দেওয়া হয়।

অধ্যাপক ইউনূসকে দেওয়া চিঠিতে বিএনপি লিখেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিটি লড়াইয়ের নেতৃত্ব দানকারী কিংবা গর্বিত সক্রিয় অংশীদার হিসেবে বিএনপি তার অবস্থান থেকে প্রতিটি লড়াইয়ের সুফল জনগণের জন্য কার্যকর করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে এবং করছে।

আরো পড়ুন:

জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার চিন্তা ইসির

খালেদা জিয়ার সঙ্গে লন্ডনে জামায়াত আমিরের সাক্ষাৎ, ছিলেন তারেক রহমানও

বিএনপি মনে করে যে, জনগণের স্বার্থরক্ষা ও স্থায়ী কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য গণতান্ত্রিক শাসনের বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংস্কার একটি সদা চলমান অনিবার্য প্রক্রিয়া।

বিগত ফ্যাসীবাদী পতিত সরকারের মত ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’ যেমন জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের অপকৌশল ছিল এখনও কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ‘আগে সংস্কার পরে গণতন্ত্র’ তেমনি ভ্রান্ত কূটতর্ক।

বিএনপি লিখেছে, আজ যারা সংস্কারের কথা বেশি বেশি বলেন এবং বিএনপিকে সংস্কারের বিপক্ষের শক্তি বলে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা করছেন তাদেরকে আমাদের ভিশন-২০৩০ এবং রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা কর্মসূচিতে যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে ও যে সব পরিবর্তনের আকাঙক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছে তার প্রতি দৃষ্টি দিতে বলছি।

৩১ দফায় বিএনপি আরও বলেছে, এসব প্রস্তাবের চেয়ে ভালো কোনো প্রস্তাব কেউ দিলে জনস্বার্থে তা সাদরে গ্রহণ করা হবে। অর্থাৎ সংস্কারের চলমান প্রক্রিয়া বিএনপির ঘোষণারই অংশ। 

বিএনপি মনে করে যে, সব পরিবর্তনই সংস্কার নয়। সংস্কারের উদ্দেশ্য ইতিবাচক ও গঠনমূলক পরিবর্তন। এ ব্যাপারে বিএনপি সব প্রস্তাব নিয়েই যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনারকে স্বাগত জানায়।

চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, অযথা সময়ক্ষেপণ করে জনগণকে তাদের ভোটাধিকার তথা রাষ্ট্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার কৌশলকে বিএনপি সমর্থন করে না। এটা দল কিংবা গোষ্ঠীস্বার্থে এবং রাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে হেয় ও অপ্রাসঙ্গিক করার অপচেষ্টা মাত্র। 

দেশ ও জনগণের স্বার্থে জনগণের সম্মতি নিয়ে ৩১ দফায় বর্ণিত এবং ঐকমত্যে গৃহিত সব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিএনপি সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে।

চিঠিতে বলা হয়েছে—অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রতি বিএনপির আবেদন, ২০২৪ সালের ২১ নভেম্বর এবং ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আমরা আপনাকে লিখিতভাবে আমাদের উদ্বেগের কথা এবং কয়েকটি পরামর্শ জানিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে সেসব বিষয় আপনাদের অবস্থান আমরা জানতে পারিনি কিংবা এসব বিষয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। 

উল্লেখ্য, ফ্যাসিস্ট সরকারের দ্বারা বৈষম্যের শিকার ও পদোন্নতি বঞ্চিত প্রশাসন ক্যাডারের ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে সচিবসহ বিভিন্ন পদে ভুতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হলেও তাদের একজনকেও এখন পর্যন্ত পদায়ন না করে পতিত সরকারের অপশাসনের দোসর ও সুবিধাভোগীদের দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করার ফলে সরকারের কার্যক্রম ও উন্নয়ন প্রয়াস ব্যহত হচ্ছে।

অন্যান্য ক্যাডারে বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ভুতাপেক্ষ পদোন্নতি ও পদায়ন নিশ্চিত করা যৌক্তিক বিধায় তা দ্রুত সম্পন্ন করা জরুরি বলে বিএনপি মনে করে। 

‘আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি, যে কোনো রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী ও তার সরকারের বক্তব্য ও মতামতে সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি এর কিছু ব্যতিক্রম আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। ’

প্রধান উপদেষ্টাকে লেখা চিঠিতে বিএনপি বলেছে, আমরা আপনাকে সমর্থন জানিয়েছি এবং আপনার উপরই আস্থা রাখতে চাই। কিন্তু আপনার সরকারের কিছু ব্যক্তি এবং আপনাকে সমর্থনকারী বলে দাবিদার কতিপয় ব্যক্তি ও সংগঠনের প্রকাশ্য বক্তব্য ও অবস্থান জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। আশা করি, আপনি এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। 

আমরা আগেও বলেছি এবং এখনও বলতে চাই যে, দেশের জনগণকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার যে মহান দায়িত্ব আপনার উপর অর্পিত হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব আপনি তা পালন করবেন।

একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যে সব আইন, বিধি, বিধান সংস্কারে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহে যেসব পরিবর্তন জরুরি তা সম্পন্ন করার মাধ্যমে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্ভব বলে আমরা মনে করি।

এ ব্যাপারে ইতোপূর্বে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে প্রদত্ত আপনারই আশ্বাস অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী রোড ম্যাপ ঘোষণার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আমরা আপনার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

আমরা এনআইডি প্রকল্প নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাখার এবং নির্বাচনী এলাকা পুনঃনির্ধারনের বিষয়ে আইনি জটিলতা দ্রুত নিরসনেরও প্রস্তাব করছি।

একই সঙ্গে পতিত ফ্যাসিবাদী দল ও সেই দলীয় সরকারের সঙ্গে যারাই যুক্ত ছিল তাদের বিচার দ্রুত করে রাজনীতির ময়দানকে জঞ্জালমুক্ত করার; জুলাই-আগস্ট অভূত্থানে নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ ও সুচিকিৎসার দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার এবং দ্রব্যমূল্য ও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়নের অধিকতর উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।

একই সঙ্গে ১/১১’র অবৈধ সরকার এবং পতিত ফ্যাসীবাদী সরকারের আমলে করা সব মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা অনতিবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি পুনঃর্ব্যক্ত করছি।

আমরা আপনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সব ইতিবাচক কর্মপ্রয়াস সমর্থন প্রদান অব্যহত রাখার সিদ্ধান্ত পুর্ণব্যক্ত করে প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ যথা শিগগিরই ঘোষণার মাধ্যমে জনমনে সৃষ্ট সব বিভ্রান্তি অবসানের আহ্বান জানাচ্ছি।

এর আগে বুধবার দুপুর ১২টার পর যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। এতে প্রতিনিধিদলের ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাউদ্দিন আহমেদ ও ইকবাল আহসান মাহমুদ টুকু।

ঢাকা/এনএইচ

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব এনপ গণত ন ত র ক প রস ত ব ব এনপ র সরক র র জনগণ র র জন য ক ত কর র জন ত আপন র

এছাড়াও পড়ুন:

রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে জনগণের হিস্যা কোথায়

নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুরু হতেই কিছু পরিচিত দৃশ্য আবার চোখে পড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজ নিজ অবস্থানকে একমাত্র ন্যায়সংগত দাবি হিসেবে তুলে ধরা, ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থতা এবং একে অপরের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা। রাজনৈতিক অচলাবস্থা বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিকে শুধুই অচলাবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। এটি বরং রাজনৈতিক চিন্তার দেউলিয়াত্বের প্রকাশ এবং রাজনীতি জনগণের চাহিদা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার একটি সংকেত। এর কেন্দ্রে রয়েছে একটি প্রশ্ন, যা আমরা এখনো করিনি: রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ আসলে কী?

২.

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের জাতীয়তাবাদের অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে—কখনো ‘বাংলাদেশি’ বনাম ‘বাঙালি’, কখনো ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বনাম ‘ইসলামপন্থা’ পরিচয়ের মাধ্যমে। কিন্তু এই শব্দগুলো বাস্তবে অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে; একদিকে জাতিসত্তার বৈচিত্র্যকে একরৈখিক করে তুলেছে, অন্যদিকে সংখ্যালঘু এবং নারীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে।

এই জাতিগত ও আদর্শগত পরিচয়ের সংকোচনের সঙ্গে সঙ্গে সংকুচিত হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও। রাজনৈতিক দলগুলো জনসেবার বাহন না হয়ে পরিণত হয়েছে আত্মরক্ষামূলক ক্ষমতার বাহনে। পুরোনো দলগুলো যেমন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, গরিবের পক্ষে কথা বলার দাবি করা বিভিন্ন বামপন্থী দল, এমনকি নাগরিকদের সক্রিয়তা নিয়ে কথা বলা নতুন দল এনসিপিও একই ছকে চলছে; প্রকাশ্যে জনগণের নামে বৈধতা চাওয়া আর ভেতরে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে দল চালানো।

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল আনুগত্যের বিনিময়ে সুযোগের এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। দলগুলো রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করে, পৃষ্ঠপোষকতা বিতরণ করে এবং অনুগত একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখে। স্থানীয় সরকার, যেখানে গণতন্ত্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সংযোগ থাকার কথা, তা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়েছে। আমাদের গণতন্ত্রের স্বল্প ইতিহাস বলে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা প্রায়ই জনগণের পক্ষে কথা বলা প্রতিনিধি নন, বরং তারা মধ্যস্থতাকারী মাত্র। এই ব্যবস্থায় নেতৃত্ব নয়, আনুগত্যই পুরস্কৃত হয়।

৩.

প্রায় সব রাজনৈতিক দলই অভ্যন্তরীণ দলীয় কার্যক্রমের দিক থেকে গণতান্ত্রিক নয়। নেতৃত্ব প্রায়ই বংশগত বা দীর্ঘদিন ধরে একচেটিয়াভাবে ধরে রাখা হয়। দলের মধ্যে ভিন্নমত দিলে শাস্তি হয়। কর্মীরা মিছিল-মিটিং বা গ্রেপ্তারে সামনে থাকলেও, নীতিনির্ধারণে তাঁদের কোনো অংশ থাকে না। দলের ভেতরে গণতন্ত্রের এই অভাব বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই প্রতিফলন। দলগুলো এখন প্রায় শূন্য খোলসে পরিণত হয়েছে।

সংসদেও এর প্রতিফলন স্পষ্ট। অনেক সংসদ সদস্যই তাঁদের নির্বাচিত এলাকার বাসিন্দা নন। তাঁরা সেসব এলাকায় বড় হননি, সেখানকার মানুষের সঙ্গে বসবাসও করেন না—সম্পর্ক থাকে কেবল প্রতীকী; বরং প্রাক্তন মন্ত্রী, নেতা কিংবা দলের উচ্চপদস্থ সদস্যদের সন্তান-স্বজনদেরই একপ্রকার উত্তরাধিকারসূত্রে সেখানে পাঠানো হয়। স্থানীয় নেতাদের ক্ষেত্রেও প্রায়ই একই পদ্ধতি অনুসৃত হয়। রাজনীতির প্রতিটি স্তরে—থানা ইউনিট থেকে জাতীয় মনোনয়ন পর্যন্ত—ক্ষমতার প্রবেশাধিকার নির্ধারিত হয় বংশানুক্রম, আনুগত্য এবং আঞ্চলিকতার এক অঘোষিত নিয়মে; যেখানে কোনো নির্দিষ্ট এলাকা একটি নির্দিষ্ট পরিবার বা গোষ্ঠীর সম্পত্তির মতো গণ্য হয়।

নির্বাচনী প্রচারণা ব্যয়বহুল এবং মনোনয়ন একটি লেনদেনভিত্তিক প্রক্রিয়া—সম্পদ, সম্পর্ক এবং আনুগত্যই এখানে মুখ্য। নির্বাচন মানে পোস্টার, মাইকিং আর আগেভাগে অর্থ ব্যয় করে মিছিল-মিটিংয়ের মৌসুম। সাধারণ নাগরিকের জন্য রাজনীতিতে প্রবেশ প্রায় অসম্ভব—যতক্ষণ না তিনি একই স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও সুবিধাবাদের সংস্কৃতি গ্রহণ করেন। এমনকি যাঁরা সাম্প্রতিক সময়ে বিপ্লবী ভাষায় কথা বলছিলেন, তাঁরাও দ্রুত এই একই ছকে ঢুকে পড়েছেন।

রাজনৈতিক দলগুলো যখন তাদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়, তখন অন্যরা সেই শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে আসে। সুশীল সমাজ নিজেদের গণতন্ত্রের প্রধান রক্ষক মনে করতে শুরু করে। আমলারা ও বিচারপতিরা নিজেদের সাংবিধানিক সীমার বাইরে গিয়ে হস্তক্ষেপ করেন। সেনাবাহিনী নিজেদের একটি স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু এটি গণতন্ত্রের সুস্থ বিকাশ নয়, বরং এটি রাজনৈতিক বিকৃতি ও শাসনক্ষমতার দায়িত্বহীন পুনর্দখল।

৪.

এমন পরিস্থিতিতে মানুষের প্রকৃত চাহিদাগুলো উপেক্ষিতই থেকে যায়। ত্রাণ বিতরণ হয় দলের পতাকা লাগিয়ে, ছবি তোলা হয় এবং বিনিময়ে ভোট চাওয়া হয়। কিন্তু দেশের অধিকাংশ ভোটার, যাঁদের বেশির ভাগই গ্রামীণ ও দরিদ্র, তাঁদের দয়া নয়, অধিকার প্রয়োজন। তাঁরা একটি বৈষম্যমূলক ও বিকৃত ব্যবস্থার শিকার—যেখানে সুবিধা, সম্পদ ও সুযোগ বণ্টিত হয় ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছেমতো। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই এমন কোনো কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলে না, যা এই বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। কারণ, এমন সংস্কার বাস্তবায়ন করলে যে ব্যবস্থা থেকে তাঁরা লাভবান হচ্ছেন, সেটাই বদলে দিতে হবে।

কেউ ভূমি সংস্কার, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ কিংবা পুলিশের নিয়োগপদ্ধতি নিয়ে কথা বলতে চায় না। যেখানে সংস্কার থেমে যায়, সেখানে ক্ষমতা শুরু হয়। কাঠামোগত সংস্কার কোনো নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বা কৌশল নয়। স্পষ্ট করে বললে, এ ধরনের পরিবর্তন নির্বাচনের আগে সমীচীন নয় আর এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে এর বাস্তবায়নও সম্ভব নয়। এমন সংস্কার সফল হতে হলে একটি এমন সরকার প্রয়োজন, যারা সংবিধানকে শুধু ভাষণে নয়, বরং বাজেট, প্রাতিষ্ঠানিক নকশা এবং নীতিনির্ধারণে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে।

বর্তমান রাজনৈতিক সংঘাত আদর্শগত মতপার্থক্য নয়—এটি রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লড়াই। অতীতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালত প্রভাবশালীদের রক্ষা করতে এবং ভিন্নমত দমন করতে ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি নাগরিক সমাজের আন্দোলনগুলোকেও চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে বা অভিজাত গোষ্ঠীর স্বার্থের সঙ্গে একীভূত করে ফেলা হয়েছে। জনতার আন্দোলন প্রচার পায়; কিন্তু পরে তা দমন করা হয় অথবা নিস্তেজ হয়ে যায়। এনজিওগুলোর গোলটেবিল বৈঠকগুলোতে আশার কথা শোনা যায়, কিন্তু সেখান থেকে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলায় না।

৫.

এ রকম প্রেক্ষাপটে অনেকেই শুদু সংবিধানকেই দোষারোপ করছে, যেন এর দায় শুধু কাগজের শব্দগুলোর, যারা বছরের পর বছর সংবিধান উপেক্ষা করেছে, তাদের নয়। বাংলাদেশের সংবিধান ছিল একটি প্রতিশ্রুতি—কেবল সার্বভৌমত্বের নয়, বরং ন্যায়বিচারের। এই সংবিধান রাষ্ট্রকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সমতা, বৈষম্যহীনতা, মর্যাদা, ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের। এটি এমন এক অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতিসত্তার ছবি এঁকেছিল, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, বরং প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মর্যাদা স্বীকৃত।

সংবিধানের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পরিণতি বাস্তব এবং গভীর। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা, পুলিশি নির্যাতন এবং প্রাতিষ্ঠানিক দায়মুক্তি—এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো একটি কাঠামোগত চিত্রের অংশ, যা বারবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে। এই চক্রে কোনো একক দল বা সরকার সম্পূর্ণভাবে দায়ী নয়। ঠিক এই কারণেই প্রয়োজন একটি সামগ্রিক জবাবদিহি, কেবল একটি সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি।

যদি রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহি না থাকে, আর যদি নির্বাচন কেবল ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়, তবে এটি শুধু শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা নয়—এটি একটি প্রজন্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। ১৯৯১ সালের পর যারা বড় হয়েছে, তাদেরকে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা পেয়েছে ক্ষমতাবানদের মধ্যে বোঝাপড়া, যেখানে জনতার কণ্ঠ নেই; বিপ্লবের বুলি আছে, কিন্তু বাস্তবে কোনো পরিবর্তন নেই।

এর ফলে আবারও সেই প্রশ্ন ফিরে আসে—রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ আসলে কী? তারা কার কাছে জবাবদিহি করবে? তাদের কাজ কি শাসন, দখল নাকি জনগণের সেবা? যদি রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের সেবা না করে, তাহলে সেটা করবে কে?

ড. সিনথিয়া ফরিদ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, শিক্ষক ও গবেষক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইরানের শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করার আহ্বান সাবেক শাহের পুত্রের
  • আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন ইশরাক হোসেন
  • আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিলেন ইশরাক হোসেন
  • আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা ইশরাকের
  • রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে জনগণের হিস্যা কোথায়
  • বাজেটের ত্রুটি সংশোধনের আহ্বান
  • ড. ইউনূসকে দেশের কাজে যুক্ত রাখতে চায় বিএনপি
  • জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন ইরানের প্রেসিডেন্ট
  • সহসাই রাজনীতির কালো মেঘ কেটে যাবে: ডা. জাহিদ  
  • ‘সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মানবে না জনগণ’