অবনমনে লেস্টার, শেফিল্ড অনিশ্চিত- কী করবেন হামজা
Published: 21st, April 2025 GMT
এক সময়ের চ্যাম্পিয়ন লেস্টার সিটির পতন অব্যাহতই থাকলো। মৌসুমজুড়েই ভুগতে থাকা দলটি শেষ পর্যন্ত ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ থেকে রেলিগেট হয়ে গেল। রোববার লিভারপুলের কাছে ১-০ গোলে হেরে পাঁচ ম্যাচ হাতে থাকতেই দ্বিতীয় বিভাগে নেমে যাওয়াটা নিশ্চিত হয়ে গেছে লেস্টারের।
৩৩ ম্যাচে মাত্র ৪ জয়, ৬ ড্র এবং ২৩ হার- সব মিলিয়ে সংগ্রহ ১৮ পয়েন্ট। ফলে সাউদাম্পটনের পর দ্বিতীয় দল হিসেবে প্রিমিয়ার লিগ থেকে ছিটকে গেল লেস্টার। তৃতীয় দল হিসেবে অবনমনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে ইপসউইচ সিটি।
প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে এটি লেস্টারের পঞ্চম অবনমন। এর আগে তারা নেমেছিল ১৯৯৪–৯৫, ২০০১–০২, ২০০৩–০৪ ও ২০২২–২৩ মৌসুমে। তাদের চেয়ে বেশি (৬ বার) অবনমন হয়েছে কেবল নরউইচ সিটির।
লেস্টারের হয়ে একাদশে খুব একটা সুযোগ পাচ্ছিলেন না হামজা চৌধুরী। জানুয়ারির শুরুতেই লেস্টার সিটি থেকে ধারে শেফিল্ড ইউনাইটেডে এসেছিলেন হামজা। হামজার বিদায়ের পর লেস্টার যেন আরও বিপাকে পড়েছে। একের পর এক হারে বিপর্যস্ত লেস্টার যেন গোল করতেই ভুলে গেছে।
এদিকে শেফিল্ডের সামনে রয়েছে প্রিমিয়ার লিগে ফেরার সুযোগ। বর্তমানে তারা চ্যাম্পিয়নশিপে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। তবে সরাসরি প্রোমোশনের জন্য লিডস ও বার্নলির পিছনে থাকায় প্লে-অফই এখন তাদের ভরসা। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সেই পর্ব পেরোতে পারলে প্রিমিয়ার লিগে ফিরতে পারে তারা।
সেই ক্ষেত্রে হামজা চৌধুরীর ভবিষ্যৎ নিয়েও শুরু হয়েছে আলোচনা। যদি শেফিল্ড প্রোমোশন পায়, তাহলে হয়তো হামজা সেখানেই স্থায়ী হয়ে যেতে পারেন। আবার এমনও হতে পারে- লেস্টার বা শেফিল্ড নয়, বরং নতুন কোনো প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব খুঁজে নেবেন তিনি।
মাত্র ২৭ বছর বয়সী এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের অভিজ্ঞতা এবং স্কিল অনেক দলের মধ্যমাঠের জন্যই হতে পারে আদর্শ সংযোজন। ফলে আগামী মৌসুমে হামজাকে কোথায় দেখা যাবে- সে প্রশ্ন এখন রয়ে গেছে সময়ের জন্য।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
আমার জন্মঋতু
আমি বন্ধনহীন মৌসুমী বায়ু—, ভ্রমি দেশে দেশে দেশে
শেষে পৌঁছেছি এনে আমার প্রিয় বাংলাদেশে।
তোমার স্পর্শ পেয়ে পেয়ে আমাকে ঝরতে হবে জানি।
তোমার প্রতিটি নদী-নালা, পথ-ঘাট, পুকুর-প্রান্তর,
খাল-বিল, গুহা-গিরি আমাকে করতে হবে জানি।
শরৎ আসার পরে আমাকে মরতে হবে জানি।
(বর্ষার মতো প্রেমিক)
প্রতিটি বর্ষায় আমি কিছু না কিছু কবিতা লিখি। আমাদের পত্রিকাগুলো বর্ষার ওপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। ওই সব পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদকদের মধ্যে কেউ কেউ আমার কাছে বর্ষার ওপর রচিত নতুন কবিতা চান। আমি পারতপক্ষে তাদের নিরাশ করি না। বিষয়ভিত্তিক কবিতা রচনায় আমার মন আজকাল আগের মতো সাড়া দেয় না। তবে বর্ষার কথা ভিন্ন। বর্ষার আগমনে আমার কবিচিত্ত মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা ব্যাঙের মতোই মহানন্দে আত্মপ্রকাশ করে তার প্রিয় সঙ্গমসঙ্গিনীকে খুঁজে বেড়ায়। ফলে প্রতিটি বর্ষায়, তা কোনো পত্রিকা আমার কাছে বর্ষার ওপর কবিতা চান বা না চান, আমি লিখি।
না লিখে পারি না আমার কবিতার সতর্ক পাঠক যদি থেকে থাকেন, তো মানলেন যে, আমার কবিতায় যে ঋতুটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছে, বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে, তার নাম বর্ষা। আমার আরেক প্রিয় ঋতু হলো বসন্ত। বাংলার অন্য সকল কবির মতোই বসন্তেও আমি কম উন্মাদ হই না। তবে বর্ষার তুলনায় কম। এর কারণ, নিশ্চিত জানি আমার জন্মের মধ্যে নিহিত। বর্ষা আমার জন্মসূত্রে পাওয়া ঋতু। আষাঢ় মাসের সপ্তম দিনের এক বৃষ্টিঝরা সকালে আমার জন্য হয়েছিল। এ শুধুই আমার শোনা কথা নয়, আমার স্মৃতিকথাও। আমি কান পাতলেই আমার জন্মগ্রামের আকাশ কালো করে নামা সেই আষাঢ়ীবর্ষণের মার্গসংগীতধ্বনি এখনো স্পষ্ট শুনতে পাই।
বর্ষার ওপর রচিত আমার কবিতাসমূহের একটি পৃথক কাব্যসংকলন আমি প্রকাশ করেছি। বসন্তের ওপরও একটি কাব্যসংকলন আছে। তবে বর্ষার ওপর লেখা আমার কবিতার সংখ্যা যেমন বেশি, মান বিচারেও তারা অধিক গুণী। যে কবিতাটি ওপরে উদ্ধৃত করেছি, কোনো পত্রিকার সাহিত্য পাতার চাহিদা পূরণের জন্য নয়, বর্ষাসিক্ত কবিচিত্তের অন্তর্গত চাহিদা মেটাতেই সেটি সম্প্রতি রচিত হয়েছে। কবিতাটিতে বাংলাদেশকে কল্পনা করা হয়েছে গ্রীষ্মতপ্ত প্রেয়সীরূপে, কবি যেন বিরহী যক্ষ। মৌসুমি বায়ুরূপে বিশ্বভ্রমণ শেষে সে ফিরে এসেছে তার প্রেয়সীর দেহসীমায়। যক্ষপ্রিয়ার দেহের সকল তৃষিত অঞ্চলে সে ঢালবে তার সঙ্গে করে নিয়ে আসা মেঘজলধারা। আকাশ কাঁপিয়ে, শুকনো মাটি ভিজিয়ে নামবে বৃষ্টি। অবিচ্ছিন্ন লয়ে বাংলার তপ্তশুষ্ক মাটি আর মেঘভারেনত আকাশকে সে বেঁধে দেবে অন্তহীন অঝোর বর্ষণে।
এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, যা হয়েছিল নূহের প্লাবনের সময়; এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, মানবমনের ভেতরের সুপ্ত কাম ও বিরহবোধকে যে জাগ্রত করে, ববীন্দ্রনাথের মতো নমিতকামের কবিও তখন বিশ্বাস করেন—এমন দিনেই তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়, এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, পবিত্র বেদে যাকে কল্পনা করা হয়েছে মহান মৃত্যুর সঙ্গে। এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, কবি শহীদ কাদরী যাকে তুলনা করেছেন সন্ত্রাসের সঙ্গে।
আমার জীবনের প্রথম ষোল বছর প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবে আমি আমার জন্মগ্রামে কাটিয়েছি। শহরে যারা জন্মগ্রহণ করেন তাদের জন্মকে সামান্যতম খাটো না করেও বলি, গ্রামে জন্মগ্রহণ করার জন্য আমি নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান বলে মনে করি। প্রকৃতির সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক, তাকে যে আমি খুব কাছের করে চিনেছি, আপন বলে জেনেছি, সেটা সম্ভব হয়েছে অবিচ্ছিন্নভাবে আমি আমার শৈশব-কৈশোর গ্রামের বন-জঙ্গলে কাটাতে পেরেছি বলেই। বাংলার ষড়ঋতুর রূপবৈচিত্র্যকে আমি খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করার যে সুযোগ পেয়েছি, তাকে আমি যে আমার কবিতায় সেভাবে ধরতে পারিনি, তার জন্য দায়ী আমার প্রয়োজনীয় কারাশক্তির অভাব। সে কারণে আমার আত্মগ্লানি আছে বটে, কিন্তু তার নিবিড় সান্নিধ্যলাভের স্মৃতি আমার চির গৌরবের ধন। প্রকৃতিকে আমি কখনো পেয়েছি প্রেয়সীরূপে, কখনো দেখেছি জননীরূপে। আমি বুঝেছি, তার সঙ্গে আমার অস্তিত্ব এক অন্তহীন লীলায় জড়ানো। ফলে বলা যায় একেবারে খোলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে বর্ষার আগমন, অবতরণ ও তার প্রত্যাগমনকে দেহেমনে মিলিয়ে খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। গুনেছি আকাশে আকাশে মেয়ের গুরুগুরু ডাক। বুঝেছি, গ্রীষ্ম-অবসানে আসছে আমার। জন্মসহোদর, আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু বর্ষা। আসছে আষাঢ়। আমার বেসুরো কণ্ঠেও লতিয়ে উঠেছে গান— 'আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।' আহ, কী চমৎকার।
বর্ষা আমাকে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তার সঙ্গে করে। দু কূল প্লাবিত করা নদীর আনন্দে, মাঠে-ঘাটে, ঝালে-বিলে, পুকুরে প্রান্তরে আমি বর্ষাকে তার জলজগৎ বিস্তার করতে দেখেছি। সে আমার কানে কানে বলেছে, আমি কীভাবে আমার দেশপ্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গম করি দেখো। আমি দেখেছি। প্রাণ ভরে
দেখেছি বর্ষার রূপ।
আমি যখন এই বর্ষাবন্দনা লিখছি, তখন আষাঢ় গত হয়েছে। চলছে শ্রাবণ। শ্রাবণের পুরোটাই সামনে পড়ে আছে। বলা যায় এখন বর্ষার ভরা যৌবন। ঢাকায় বসে তার রূপ দেখছি টিভির পর্দা আর পত্রিকার পাতায়। তার প্রকৃত চেহারাটা দেখতে পাচ্ছিনে এখানে। এই নিয়ে কবিতাও লিখেছি। গ্রামে ছোট ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, বর্ষা, কতটা জাঁকিয়ে বসেছে সেখানে। সে জানিয়েছে, যদি বর্ষা বিষয়ে নতুন করে কিছু লিখতেই চাও তো গ্রামে চলে এসো। বর্ষা দেখে যাও। আজ তিন দিন হলো দিন-রাত বৃষ্টি। নদী-নালা, মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর ডুবিয়ে সে মেলে ধরেছে তার চোখজুড়ানো রূপ। আমি চোখ বন্ধ করে, কল্পনায় তার রূপ দেখলাম। মনে পড়ল, কত অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লীজননী।
বাংলার কবির কাছে, কবির চোখে বর্ষার কি আলাদা কোনো রূপ আছে? এর উত্তর সহজ নয়। জীবনানন্দ বলেছেন—সকলেই পবি নয়, কেউ কেউ করি। তার এই স্মরণীয় উক্তিটি ছোট কবিদের ভিড় থেকে বড় কবিদের পৃথক করার প্রয়োজন মেটায়। কিন্তু প্রকৃতির রাজ্যে সব মানুষই যে কমবেশি করি, আমার এই উপলব্ধিকে বাতিল করে না। বাংলার লোককবিদের রচিত কাব্যে, গানে তারই পরিচয় দেখতে পাই। অন্য কবিদের জন্মকথা বলতে পারিনে, তবে আমার কবিজন্ম যে বর্ষামায়ের গর্ভে, সে কথা না বললে নিশ্চিত জানি, স্বর্ণে বসে চিত্রগুপ্ত অকৃতজ্ঞের তালিকায় আমার নামটিও লিপিবদ্ধ করবেন।