Prothomalo:
2025-11-03@05:41:33 GMT

রাজনীতির মেরুকরণ জটিল হচ্ছে

Published: 25th, April 2025 GMT

প্রবাদ আছে, ‘রাজনীতিতে এক সপ্তাহ একটা লম্বা সময়’। কয়েক সপ্তাহ আগেও যেসব জিনিস মনে হচ্ছিল সহজভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, এখন ধীরে ধীরে সেগুলো জটিল হচ্ছে। রাজনীতিতে অনেক অংশীদার—সরকারে ও বাইরে, তাদের সবার ভেতর কেমন একটা অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন দিন দিন রাজনীতির মেরুকরণ আরও জটিল হচ্ছে।

পাঁচ বছর বনাম এক বছর

অন্তর্বর্তী সরকার কত দিন থাকবে, এ বিতর্ক কখনো প্রকাশ্যে, কখনো বা আড়ালে চলছেই। পেন্ডুলাম দুলছে এক বছর ও পাঁচ বছরের মধ্যে। ড.

মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, চলতি বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যেই নির্বাচন হবে। তবে অনেকেই মনে করেন, এই সময়সীমার একটা বড় শর্ত হলো, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে সংস্কার প্রশ্নে ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে একমত হবে। যদি তারা একমত না হতে পারে, তাহলে কী হবে?

মাঝেমধ্যে পাঁচ বছরের দিকে পেন্ডুলাম দুলছে। সেটাও আসছে সরকারের কাছের লোকদের থেকে, জুলাই আন্দোলনে জড়িত নেতাদের থেকে এবং সবচেয়ে বেশি সোচ্চার বিদেশে থাকা কতিপয় ইউটিউবার, যাঁদের কথা এ দেশে অনেকেই মন দিয়ে শোনেন। গত ১৫ মার্চ এক বক্তব্যে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জুলাইয়ের নেতাদের বলেন, ‘আরও অন্তত পাঁচ-দশ বছর তোমরা আমাদের নেতা থাকো।’ জুলাইয়ের নেতারা কিছু আছেন এখন সরকারে, কিছু সরকারের বাইরে। কাকে তিনি উদ্দেশ করেছেন?

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ১০ এপ্রিল বলেন, ‘সাধারণ মানুষ এই সরকারকে আরও পাঁচ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে দেখতে চাইছে’। সরকারের আরেক উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘আমরা অনির্বাচিত, এই কথা কে বলল?’

এগুলো সরকারের পক্ষে কোনো সমন্বিত প্রচেষ্টা হয়তো নয়। তবে এই পরিমণ্ডলে আকাঙ্ক্ষা আছে অন্তর্বর্তী সরকারকে দীর্ঘায়িত করার। এনসিপি নেতা সারজিস আলমও সম্প্রতি বলেছেন, ‘প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন স্টেটসম্যানকে পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশের একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার আজীবন থাকবে।’ কেউ কেউ বিএনপির সঙ্গে কোয়ালিশন বা হ্যাঁ-না ভোট—এই সব বিকল্পও তুলে ধরছেন।

যাঁরা এ দেশের রাজনীতিবিদদের ওপর খুব ভরসা রাখেন না, তাঁদের এই সব আলোচনা ও আকাঙ্ক্ষা থাকবেই। তাই বলে রাজনীতিবিদেরা বসে থাকবেন কেন?

সংস্কার

ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলছে। কোথায় কী সংস্কার এবং এতে লাভ কী হবে, তা নিয়ে জনগণ অনেকটা অন্ধকারে। তবে যেটুকু জানা গেছে সংবাদপত্রে, জাতীয় মূলনীতি, জুলাই সনদ ইত্যাদি নিয়ে কথা হচ্ছে। জাতীয় পরিচিতিও পোক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে।

দেশের সংবিধানে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ববাদ, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার কী লেখা আছে বা কী লেখা হলে খুব একটা বড় সংস্কার হবে, তা নিয়ে আমরা বেশি সময় নষ্ট করছি। বিশ্বের অনেক দেশে কোনো লিখিত সংবিধান নেই। কিন্তু তাদের দেশ ও সরকার ভালোভাবেই চলছে।

কাগুজে পরিবর্তনের চেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। হাসিনার স্বৈরাচারী সরকার গত তিনটা নির্বাচন যেভাবে করেছে, তা বর্তমান সংবিধানের কোথাও লেখা নেই। হাসিনা নিরপেক্ষ নির্বাচনের পদ্ধতিটাও তাঁর দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে নাকচ করিয়ে নিলেন।

তাই বলে সংস্কার লাগবে না? অবশ্যই লাগবে, শুধু যেগুলো অর্থবহ হবে দেশের জনগণের জন্য। তার একটা হলো—স্বাধীন বিচার বিভাগ, অন্যটা রাজনীতিবিদদের ধরাছোঁয়ার বাইরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাঠামো। এই দুই বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলে দেশ অনেক উপকৃত হবে। মোহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ইতিহাসে ‘সেরা নির্বাচন’ করবে। তাঁর এই উক্তিকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তবে একটা নির্বাচন ভালো হলেই সংস্কার সফল হবে, তা ভাবার কারণ নেই। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তীকালে একটা সুন্দর নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছিল। তারপর রাজনীতিকেরা সব তছনছ করলেন।

বিএনপি চেনা পথেই হাঁটছে

সংস্কার নিয়ে বিএনপির খুব উৎসাহ নেই, তারা তা খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছে। তারা চায়, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন। সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষিতে তারা নরম-গরম দুই সুরই বজায় রাখছে। বিএনপি নেতা তারেক জিয়া বলেছেন, ‘এয়ারকন্ডিশনের ভেতরে বড় বড় দামি অফিসে বসে তারা সংস্কারের কথা বলছে’। আসলে আজকাল সব বড় রাজনৈতিক নেতাই গুলশান-বনানীতে এয়ারকন্ডিশন বাড়িতে থাকছেন, পাঁচতারা হোটেলে তাঁদের ইফতার পার্টি হচ্ছে।

রাজনীতির এই পরিবর্তিত সময়ে বিএনপি নিজেদের কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। সেই পুরোনো দিনের হানাহানি, চাঁদাবাজি ও দখলদারি দিন দিন বাড়ছে। আগে অপকীর্তিকারীদের বহিষ্কার করা হতো, আবার দলে টানা হতো, সেই সবও এখন থেমে গেছে। বিএনপিকে নিয়ে জনগণের প্রশ্ন বাড়ছে। নতুন রাজনীতির সঙ্গে তাল মেলাতে হলে তাদের নতুন কিছু করতে হবে।

এনসিপি সক্রিয়

এনসিপি জাতীয় রাজনীতিতে সব বিষয়ে দারুণ সোচ্চার। ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’ নিয়ে তাদের উৎসাহ সম্ভবত কিছুটা কমেছে। তবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আমূল পরিবর্তন চায় তারা। অধ্যাপক ইউনূসের দেওয়া নির্বাচনী সময়সীমার মধ্যে এই পরিবর্তন সম্ভব কি না, তা নিয়ে হিসাব-নিকাশ না করেই তারা পরিবর্তনটা আগে চায়। আগেভাগে নির্বাচন নিয়ে ইসির তৎপরতা ও প্রস্তুতিতে এনসিপি সন্দেহ প্রকাশ করেছে এবং তা তারা ইসিকে জানিয়ে দিয়েছে। আসলে দলীয় কার্যক্রমে তারা অনেক পিছিয়ে। নির্বাচন যত পেছাবে, তারা আরও সময় পাবে দল গোছানোর।

সম্প্রতি এনসিপির তৃতীয় সাধারণ সভা হয়েছে দলীয় কার্যালয়ে। এই সভা নিয়ে একটি বাংলা দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সাধারণ সভায় দলীয় কার্যক্রম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কেউ কেউ। তাঁরা বলেন, নানা কর্মকাণ্ডে আমাদের ৬০ ভাগ রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে। বাকি ৪০ ভাগ কতটুকু ধরে রাখতে পারব, এটা নিয়েও শঙ্কা আছে।’

এই সভা নিয়ে যে যেভাবে রিপোর্ট করুক না কেন, দুটো জিনিস পরিষ্কার—এনসিপির ভেতরে সব ভালো যাচ্ছে না এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একমাত্র এনসিপিতেই কর্মীরা খোলাখুলি নেতাদের সমালোচনা করতে পারেন। এনসিপি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রস্তুতিতেও সমানতালে সচল।

দলীয় মেরুকরণ

সাম্প্রতিক রাজনীতির সবচেয়ে বড় খবর হলো, জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান লন্ডনে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। তারেক জিয়ার বাসায় ও তাঁর উপস্থিতিতে এ সাক্ষাৎ ঘটেছে। কিছু বিষয়ে নিশ্চিতভাবে তাঁরা একমত হয়েছেন। দুই দলের মধ্যে যে বাক্যযুদ্ধ ও বিষোদ্‌গার চলছিল, তা বন্ধ করা এবং নির্বাচনের সময়সূচির ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীর দাবি এখন বিএনপির সঙ্গে মোটামুটি সমন্বিত। এই ঐকমত্যের সূত্র ধরে সামনে কোনো নির্বাচনী ঐক্য হবে কি না, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

বাংলাদেশের নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি যাঁরা অনুসরণ করেন, তাঁরা জানেন, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, রাজনৈতিক দলগুলো তত জোটবদ্ধ হবে। সম্ভবত দুটো জোট গঠিত হবে। একটা বিএনপির নেতৃত্বে, দ্বিতীয়টায় থাকবে এনসিপি। জাতীয় গ্র্যান্ড কোয়ালিশন ছাড়া এই দুই দলের একজোট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। জামায়াতে ইসলামী এর মধ্যেই ৩০০ আসনে তাদের প্রার্থী বাছাই করে রেখেছে। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে সরকারে যেতে তারা যেকোনো একটা জোটে যোগ দিতে পারে। বাম দলগুলো ছাড়া, বর্তমানে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন কোনো বড় আদর্শগত বিরোধ নেই, কেউ কারও জন্য অচ্ছুত নয়। এরা সবাই ‘মার্চ ফর গাজা’ সমাবেশে একই মঞ্চে দাঁড়িয়েছিল। ক্ষমতার অংশীদার হতে অন্য দলগুলো এই দুই জোটের একটাকে বেছে নেবে। তবে কে কোনদিকে ঝুঁকবে, তা বুঝতে আরও সময় লাগবে।

সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত র চ বছর র ব এনপ র সরক র র বল ছ ন র র জন এনস প ইউন স র একট

এছাড়াও পড়ুন:

বিএনপি ও জামায়াতের কাছে কেন আরপিওর ২১ ধারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল

নির্বাচনের আগেই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এ নিয়ে গত ছয় দিনে দল দুটির পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যেই নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন আরপিওর ২১ ধারার সংশোধনীর পরিবর্তন। জামায়াত মনে করে, সরকার বিএনপির চাপে নতি স্বীকার করে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত খসড়া সংশোধনী বাতিল করেছে। আর বিএনপি মনে করে, জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সরকার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশের খসড়ায় ২১ ধারার পরিবর্তন করে; যা গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদিত হয়। আরপিওর ২১ ধারা সংশোধনীর ওই পরিবর্তন বহাল থাকলে কোনো দল জোটগত নির্বাচন করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে বাধ্য ছিল। ৩০ অক্টোবর সেটি আবার পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত হয়। তাতে জোটগত নির্বাচন করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা থাকছে না। এতে জামায়াত বেশ ক্ষুব্ধ হয়।

যদিও সরকারের দিক থেকে এই নতুন সিদ্ধান্তের তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে সরকার-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সেটি শুধু বিএনপির দাবির কারণে নয়, ছোট বিভিন্ন দলেরও দাবি ছিল।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার নিশ্চিত করেছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবেই। আমরা সরকারের কথায় বিশ্বাস করি। সুতরাং এখন থেকে আমাদের সব কার্যক্রম নির্বাচনকেন্দ্রিক। এখন সরকার তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কীভাবে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে, সেটি তাদের বিষয়। তবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারকে যতটুকু সহযোগিতা দেওয়া দরকার, সেটা বিএনপি করবে।’

বাংলাদেশের শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যতই সময় যাচ্ছে...একটা পুরোপুরি নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চলছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

এ দিকে আজ সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির নিয়মিত সভা হবে। তবে অন্য দিন রাতে সভা হলেও আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় সভা বসবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আজকের সভায় আলোচ্যসূচিতে প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করার বিষয় থাকবে। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন–সংক্রান্ত বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে।

হঠাৎ কেন সামনে এল আরপিওর সংশোধনী

আরপিওর ২১ ধারার সংশোধন বিএনপি ও জামায়াতের কাছে হঠাৎ করে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫–এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন হয়। আরপিওর ২১ ধারার এই সংশোধনীর ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো। এতে জামায়াত খুশি হলেও বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো অস্বস্তিতে পড়েছিল। এ কারণে এর পরিবর্তন চেয়ে বিএনপি নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও আইন উপদেষ্টাকে পৃথক চিঠি দেয়। এর পরেই সরকার আরপিওর ২১ ধারার পরিবর্তন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, নতুন সিদ্ধান্তে বিএনপি উপকৃত হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো, এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ভোটের হিসাব-নিকাশে ক্ষতিগ্রস্ত হতো বিএনপি। অন্য দিকে এতে লাভবান হয় জামায়াতসহ তার মিত্র দলগুলো। এর হিসাবটা হচ্ছে, ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আছে একসঙ্গে নির্বাচন করার জন্য এবং সংসদ সদস্য পদে জোটের প্রার্থী হওয়ার আশায়। সে ক্ষেত্রে বিএনপির ‘ধানের শীষ’ প্রতীককে ছোট দলগুলোর নেতারা জয়ের ক্ষেত্রে ‘ভরসা’ হিসেবে দেখেন।

...যে কারণে ফ্যাসিজমের যে রাস্তা, আমরা সংস্কারে বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, এগুলো ওনারা বন্ধ করতে দিচ্ছে না। সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের নায়েবে আমির, জামায়াত

এখন জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হলে ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করতে খুব আগ্রহী হবে না। এর কারণ দুটি। প্রথমত, বিএনপির সমর্থন পেলেও ব্যক্তি জনপ্রিয়তা না থাকলে ছোট দলগুলোর নেতাদের নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে জেতা কঠিন হয়ে পড়বে। অন্য দিকে জোটের প্রার্থী হিসেবে বিএনপি আসন ছাড় দিলেও দলের কেউ বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলে ভোটে জেতা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে বিদ্রোহীকে সরাতে বিএনপির নেতৃত্ব কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সে প্রশ্নও আছে।

এ ছাড়া এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতে যে আটটি দল আছে, তারা আরপিওর ওই ধারা পরিবর্তনের পক্ষে। অর্থাৎ দলগুলো জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে—এর পক্ষে। এর জন্য দলগুলো যৌথ কর্মসূচিও করছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জামায়াত যে নির্বাচনী জোট বা নির্বাচনী সমঝোতা করতে চাইছে, সে দলগুলো পরস্পর আস্থাশীল। তাদের কাছে ‘দাঁড়িপাল্লা’ বা ‘হাতপাখা’ বা ‘রিকশা’ প্রতীক কোনো বিষয় নয়। সমঝোতা হলে সবাই ওই প্রতীকের পক্ষে এক হয়ে কাজ করবে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা নেই। অন্যদিকে বিএনপির জোটের ক্ষেত্রে ভাবনা হচ্ছে, ধানের শীর্ষ প্রতীক না দিলে ভোটের আগেই আসন হারানোর আশঙ্কা থাকবে।

গতকাল সকালে এক বিবৃতিতে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার দাবি করেন, একটি দলের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে সরকার আরপিওর সর্বশেষ সংশোধনী বাতিল করেছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) বাতিল করা হলে সেটি ন্যক্কারজনক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হবে।

আরপিওর ২১ ধারার এই সংশোধনীর ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো। এতে জামায়াত খুশি হলেও বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো অস্বস্তিতে পড়েছিল। এ কারণে এর পরিবর্তন চেয়ে বিএনপি নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও আইন উপদেষ্টাকে পৃথক চিঠি দেয়।

ঐকমত্য কমিশন সুপারিশের পর থেকেই উত্তাপ

২৮ অক্টোবর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সুপারিশ জমা দেয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে—সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। এই সময়ের মধ্যে সংবিধান সংশোধন না করলে আপনা–আপনি সেটা সংবিধানে যুক্ত হবে। এ ছাড়া গণভোট কবে, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিন নাকি তার আগে—সেটা ঠিক করবে সরকার।

চরম অনৈক্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত ছিল, তারা কীভাবে হারানো ঐক্য ফিরে পেতে পারে, সেটি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা দরকার।অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ

বিএনপি প্রথমত ক্ষুব্ধ হয় বাস্তবায়নের সুপারিশ থেকে ভিন্নমত বাদ দেওয়ায়। এ ছাড়া সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন, ২৭০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া, সেটা না হলে আপনা-আপনি সংবিধানে যুক্ত হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে দলটির আপত্তি আছে। দলটি গণভোট আগে নয়, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে চায়। জামায়াতের অবস্থান এর পুরো বিপরীত।

এসব নিয়ে পরস্পরকে লক্ষ্য করে দল দুটির রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতি ক্রমেই বাড়তে থাকে। জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে এটা আসছে যে জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এমন বক্তব্য অবশ্য বিএনপি আরও আগে থেকেই দিয়ে আসছে।

গতকাল দুপুরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা দেখছি যে বাংলাদেশের শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যতই সময় যাচ্ছে, ততই বাংলাদেশে একটা অ্যানার্কিক সিচুয়েশন, একটা পুরোপুরি নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চলছে।’

জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে এটা আসছে যে জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এমন বক্তব্য অবশ্য বিএনপি আরও আগে থেকেই দিয়ে আসছে।

এর আগের দিন শনিবার বিএনপির মহাসচিব জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নির্বাচনকে যতটা বাধা সৃষ্টি করেছেন, সেটা আপনারা করেছেন।’

পাল্টা বক্তব্য এসেছে জামায়াতের দিক থেকেও। দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের গতকাল বিকেলে ঢাকায় এক সেমিনারে বলেছেন, ‘বিএনপি ভেতরে-ভেতরে আবার ফ্যাসিস্ট হওয়ার একটা খায়েশ আছে মনে হচ্ছে। যে কারণে ফ্যাসিজমের যে রাস্তা, আমরা সংস্কারে বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, এগুলো ওনারা বন্ধ করতে দিচ্ছেন না।’

অবশ্য সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে বিএনপিকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপি যতই উসকানি দিক, জামায়াত বিএনপির সঙ্গে বিরোধে জড়াতে চায় না। মানুষের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক আছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দূর করে স্পষ্ট করা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। সুতরাং আসুন আমরা সব ভুলে আলোচনায় বসি।’

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে এই মুখোমুখি অবস্থা চলতে থাকলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে। অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, একটা চরম অনৈক্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত ছিল, তারা কীভাবে হারানো ঐক্য ফিরে পেতে পারে, সেটি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা দরকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ