বিএনপি সমঝোতা চায়, ক্ষমা ও আওতা ঠিক হবে পরে
Published: 3rd, May 2025 GMT
সংসদের বাইরে সংবিধান সংস্কার আইনানুগ হবে না বলে মনে করছে বিএনপি। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে রাষ্ট্রে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হোক– তাও কাম্য নয় দলটির। আওয়ামী লীগের বিচার চায় বিএনপি; তবে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ নয়। সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাজনীতির জরুরি সব বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব আহাম্মদ
সমকাল: বিএনপির ৩১ দফায় বলা হয়েছে– ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সমতা নিশ্চিত করা হবে। সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবে মূলনীতি হিসেবে ‘আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনর্বহালের কথা বলা হয়েছে। একে সাংঘর্ষিক মনে করেন কিনা?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: সংবিধান ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ দিয়ে শুরু। পঞ্চম সংশোধনীতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সংবিধানের প্রস্তাবনা ও মূলনীতিতে ‘আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস’ যুক্ত করলেও ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সমতা নিশ্চিত করা হয়। সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ৪১ অনুচ্ছেদে ধর্ম পালন ও প্রচারের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। এত সুরক্ষা সংবিধানে এ কারণেই রাখা হয়েছে, যাতে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সমতা থাকে। এ কারণে সংবিধানের মূলনীতিতে ‘আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনর্বহাল করলেও ধর্মীয় স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে না। বৈষম্য হবে না। বরং বৃহত্তম ধর্মবিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতিকে সম্মান দেওয়া এবং ধারণ করা হবে।
সমকাল: বিএনপি ৩১ দফায় অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করার কথা বলছে। রিকনসিলিয়েশন বা সমঝোতা কি আওয়ামী লীগের জন্যও প্রযোজ্য হবে?
সালাহউদ্দিন আহমেদ : রিকনসিলিয়েশনের সেরা নজির রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। মূল কথা হচ্ছে, রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা আনা। কত লাখ, কত হাজার মানুষের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়? তা করতে গেলে তো রাষ্ট্রে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে। ভালো হচ্ছে, রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে সমাধানের দিকে যাওয়া। বিএনপি সেদিকে গেছে, যাতে রাষ্ট্রে শান্তি, স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা যায়।
সমকাল: আওয়ামী লীগের যারা সরাসরি অপরাধে যুক্ত ছিলেন না, এটা কি তাদের রাজনৈতিক পরিসর করে দেওয়ার চিন্তা? আর আওয়ামী লীগের যারা পালিয়ে গেছেন, তারা কি এর অন্তর্ভুক্ত হবেন?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: কারা রিকনসিলিয়েশনের সুযোগ পাবে, তা বিধিবিধানে উল্লেখ থাকবে। বিএনপি রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রে শান্তি বজায় রাখতে চায়– এটাই
মূল কথা।
সমকাল: এই বিধিবিধান কি প্রস্তাব করা হয়েছে? ৩১ দফা প্রণয়নের সময় কি এর পরিকল্পনা করা হয়েছে?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: এখনও বিস্তারিত বলার সময় আসেনি। বিএনপি যদি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়, তখন সবার সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঠিক করা হবে, রিকনসিলিয়েশন কমিশন কীভাবে হবে; বিধিবিধান কী হবে।
সমকাল: বিএনপি ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ৩১ দফা দিয়েছে। এর পর ৫ আগস্ট ঘটেছে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গত ফেব্রুয়ারিতে সমকালকে বলেছিলেন, ‘জাতিসংঘসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দিক থেকে রিকনসিলিয়েশন কমিশনের প্রস্তাব আছে’। এর মাধ্যমে কি আদতে আওয়ামী লীগকে সাধারণ ক্ষমার কথা বলা হচ্ছে? বা বিএনপিও একই রকম ভাবছে?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: এখনই বিস্তারিত বলব না। বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে তখন ব্যাপকভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে। তখন ঠিক হবে, কারা রিকনসিলিয়েশনের আওতায় পড়বে।
সমকাল: সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গেও বিএনপির মতৈক্য হচ্ছে না। অন্যেরা আনুপাতিক পদ্ধতির উচ্চকক্ষ চাইছে। অতীত বলছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সংসদ নির্বাচনে ৪০ থেকে ৪৮ শতাংশ ভোটে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেয়ে সংবিধান বদল করেছে, যা সংঘাত সৃষ্টি করেছিল। আনুপাতিক উচ্চকক্ষ থাকলে অমন পরিস্থিতি হতো না বলে এর সমর্থকরা যুক্তি দিচ্ছেন। তারপরও বিএনপি কেন আনুপাতিক উচ্চকক্ষের বিরোধিতা করছে?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: সংবিধানকে গণতান্ত্রিক করতে বিএনপিই সংস্কারের কথা বলেছে। এ অঙ্গীকার এখনও রয়েছে। সংবিধান সংশোধনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে। নিম্নকক্ষে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে যে সংশোধনী আনা হবে, তাতে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে ৯০ শতাংশের বেশি মিল থাকবে। কিন্তু উচ্চকক্ষে আনুপাতিক পদ্ধতি রাষ্ট্র পরিচালনায় অসুবিধার সৃষ্টি করবে।
সমকাল: ১৯৯১ সালে একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনীর সময় বিএনপির তো দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। বিরোধী দলের সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন করেছিল। ভবিষ্যতে তা হতে অসুবিধা কোথায়?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: ১৯৯১ সালে সংসদীয় পদ্ধতি চালুর রূপরেখায় তিন জোট সই করেছিল। কিন্তু এখন আনুপাতিক পদ্ধতির উচ্চকক্ষে ঐকমত্য নেই। ঐকমত্য হলে ভিন্ন কথা।
সমকাল: সবার ঐকমত্যে তো জুলাই সনদ হবে। তাহলে তো সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্ন নেই। সংসদে যারা যাবেন, তারা সবাই মিলে সংশোধনী পাস করবেন।
সালাহউদ্দিন আহমেদ: তখন কিন্তু প্রশ্ন আসবে, আনুপাতিক পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ মানলে নিম্নকক্ষের ক্ষেত্রে কেন মানেন না? তাই বিএনপি আনুপাতিক চায় না।
সমকাল: যেসব দেশে এককেন্দ্রিক সরকার আছে, সেখানে নিম্নকক্ষের নির্বাচন বাংলাদেশের মতোই ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে হয়। উচ্চকক্ষের আসন প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে বণ্টন হয়। জাপান, স্পেন, ইতালি এর ভালো উদাহরণ।
সালাহউদ্দিন আহমেদ: ওইসব দেশ কিন্তু উচ্চকক্ষের ক্ষমতা কমাচ্ছে। বিএনপি চায়, বাংলাদেশে উচ্চকক্ষ কার্যকর হোক। আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের নেই। আবার আইন প্রণয়নেও সমস্যা হবে। বিএনপি বাস্তববাদী দল। আনুপাতিক নির্বাচনে কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। সরকার গঠনে অন্যদের দ্বারস্থ হতে হবে। কোয়ালিশন করতে গেলে অনেক দাবি-দাওয়া মানতে হয়। অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে।
সমকাল: কমিশনের সুপারিশ মানলেও নিম্নকক্ষে বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সরকার গঠন করবে। নিম্নকক্ষে পাস হওয়া আইন উচ্চকক্ষ আটকাতে পারবে না। শুধু সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে। নিম্নকক্ষের বাকি সব ক্ষমতা অক্ষুণ্ন থাকবে। তাই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তো শঙ্কা থাকার কথা নয়।
সালাহউদ্দিন আহমেদ: বিএনপি আনুপাতিক নির্বাচনকে উৎসাহিত করবে না।
সমকাল: আপনারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চাচ্ছেন। অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন– এ নিয়ম অতীতে সমস্যা করেছিল। বিএনপি কেন তাতে ফিরতে চায়?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: এ বিষয়ে বিকল্প প্রস্তাব দিতে ঐকমত্য কমিশন ও বিএনপি একমত।
সমকাল: বিচার বিভাগকে বাদ দিলে কে নেবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: বিচার বিভাগকে এর মধ্যে না জড়ালেই ভালো। তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির কারণে বিচার বিভাগকে পক্ষপাতদুষ্ট করে ফেলা হয়। চর্চার মাধ্যমে গণতন্ত্র একটি পর্যায়ে উপনীত হলে তখন হয়তো আর তত্ত্বাবধায়ক প্রয়োজন হবে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই উচ্চতায় পৌঁছাতে পারিনি বলেই অনির্বাচিত সরকারের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। অনেকটা ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’। তবে এ নিয়ে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে।
সমকাল: অনেক বছর ধরে আলাপ রয়েছে– অবারিত সাংবিধানিক ক্ষমতায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্রাটের চেয়েও ক্ষমতাবান। এই ক্ষমতা কমাতে সংস্কার কমিশন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব করেছে। বিএনপি এর বিরোধিতা করছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ: হ্যাঁ। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে রাষ্ট্রে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি বিএনপির কাম্য নয়। এর মাধ্যমে কীভাবে রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গকে শক্তিশালী করা যায়, বিএনপি সে প্রস্তাব করছে। যদি বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসে, জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে, গণমাধ্যম স্বাধীন হয়, প্রশাসন দলীয়করণমুক্ত হয়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্ত হয়, তখন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে ভারসাম্য আনতে হবে না। তখন আইনসভা, বিচার বিভাগ নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। এতে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হবে।
সমকাল: ২০০৪ সালে দুদক আইন হয় বিএনপির সময়ে। আইন অনুযায়ী দুদক শক্তিশালী। সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে অবারিত ক্ষমতা দিয়েছে। এত ক্ষমতা, সাংবিধানিক শক্তির পরও কি প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর হতে পেরেছে? বলা হয়, নির্বাহী বিভাগের চাপে পারে না।
সালাহউদ্দিন আহমেদ: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে এত অবক্ষয় হতো না। প্রতিষ্ঠানগুলো দেখেছে, ক্ষমতাসীনরাই ক্ষমতায় থাকবে। তাই তারা বশংবদ হয়েছে। যতই ক্ষমতা থাকুক, চর্চা করেনি। গোড়ার কথা হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। ক্ষমতার পালাবদল হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের আজ্ঞাবহ হবে না।
সমকাল: ২০০৮ সালের নির্বাচন কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হয়েছিল। বিএনপি জোটের নিশ্চয়ই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছিল না।
সালাহউদ্দিন আহমেদ: ছিল না। কারণ, সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়েছিল বিএনপি যাতে বড় বিরোধী দল হতে না পারে।
সমকাল: তাহলে কীভাবে আশা করেন, পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের পক্ষে নিতে ক্ষমতাসীনরা এমনকি বিএনপিও কিছু কিছু ভুল পদক্ষেপ নিয়েছিল। এখন তো পরিস্থিতি ভিন্ন। ঐকমত্যের ভিত্তিতে এমন একটি পদ্ধতি দাঁড় করানো হবে, যাতে কেউ প্রভাবিত করতে না পারে।
সমকাল: স্বাধীন গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কথা বলছেন। কিন্তু নিয়োগের ক্ষমতা যদি এককভাবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকে, তাহলে তারা কীভাবে স্বাধীন হবে? যেমন আপনি গুম হওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ করা মানবাধিকার কমিশন টুঁ শব্দ করেনি। ওই কমিশনের তো ব্যাপক ক্ষমতা ছিল। ভবিষ্যতেও যদি প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ করা মানবাধিকার কমিশন থাকে, তারাও সরকারের বিরুদ্ধে বলবে না।
সালাহউদ্দিন আহমেদ: একই কথা ঐকমত্য কমিশনও বলছে। কিন্তু বিকল্প হিসেবে তারা যেসব প্রস্তাব করেছে, তাতে মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাই থাকবে না। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, তিন বাহিনীর প্রধানসহ সব নিয়োগ যদি প্রধানমন্ত্রীর হাতের বাইরে থাকে, তাহলে তিনি সরকার চালাবেন কীভাবে!
আবার বলা হচ্ছে, সংসদহীন অবস্থায়ও এনসিসি থাকবে। তখন এনসিসির পাঁচ সদস্যের মধ্যে রাষ্ট্রপতি ছাড়া বাকিরা হবেন অনির্বাচিত। এতে রাষ্ট্রে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। রাজনৈতিক দল এবং জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহি থাকে। সেই জায়গা থেকে বলেছি, অনির্বাচিত বডির কাছে জবাবদিহিহীন ক্ষমতা দেওয়া যায় না। চিন্তা করতে হবে, এর চেয়ে ভালো বিকল্প কী হতে পারে। নির্বাহী বিভাগের কাছ থেকে যাতে সব ক্ষমতা চলে না যায়, তা দেখতে হবে।
সমকাল: ভারতে গত এক দশকে ধীরে ধীরে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বাড়ছে। গণতন্ত্রও ভঙ্গুর হচ্ছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ: ভারতে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করে। বাংলাদেশে বিচার বিভাগকে একই রকম শক্তিশালী করতে চায় বিএনপি, যাতে তা গণতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে কাজ করে। সরকার যাতে আইনের বাইরে কিছু করতে না পারে।
সমকাল: বিএনপি সংস্কার বাস্তবায়নে পরবর্তী সংসদের কথা বলছে। বিএনপি যেসব সুপারিশে একমত হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও। পঞ্চম সংশোধনী, একাদশ সংশোধনী সংসদে অনুমোদনের আগেই কার্যকর হয়েছিল। এবার কেন নয়?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: একাদশ সংশোধনী জাতীয় ঐকমত্যে সংসদে অনুমোদনের আগে কার্যকর হয়েছিল। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে পদে বহাল রেখেই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয়েছিল। কোনো পক্ষই এর বিরোধিতা করেনি। আর পঞ্চম সংশোধনী আগেই কার্যকর হয়েছিল সামরিক আইনের মাধ্যমে। পরে কিন্তু সংসদের অনুমোদন নিতে হয়েছে।
সমকাল: তাহলে অনুমোদনের অঙ্গীকার করে এবার সংসদের বাইরে সংবিধান সংশোধনের ঐকমত্যে আসা যায় না?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: এখন তো সংবিধান বিলুপ্ত হয়নি। সরকার, আদালত চলছে সংবিধান অনুযায়ী। তাই রাজনৈতিক ঐকমত্য হলেও পরবর্তী সংসদে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। একাদশ সংশোধনী কতটা সাংবিধানিক ও আইনানুগ– এটা নিয়ে কিন্তু অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এবারও সংসদের বাইরে এগুলো করলে আইনানুগ হবে না।
সমকাল: নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলছেন। কিন্তু ইতোমধ্যে জামায়াত ও এনসিপি কমিশনকে স্বচ্ছতা প্রমাণের কথা বলছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিএনপির তালিকা থেকে এসেছেন বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। কমিশন বিএনপির প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট– এমন অভিযোগও উঠছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ: নাসির উদ্দিনের নাম আরও অনেক দলের পক্ষ থেকে এসেছিল। বিএনপি তো নিয়োগ দেয়নি। নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এখনও কমিশনের নিরপেক্ষতায় ঘাটতি দেখছি না। সংস্কার কমিশনের যেসব প্রস্তাব রয়েছে, তাতে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা খর্বের বিষয় রয়েছে। কমিশন এর বিপক্ষে মতামত দিয়েছে। এ কারণে বিএনপি ও নির্বাচন কমিশনের মতামত কাছাকাছি মনে হচ্ছে। এ দায় তো বিএনপির নয়।
সমকাল: টানা তিনটি বাজে নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় প্রশ্ন আসে, ভবিষ্যতে প্রহসনের ভোট হলে নির্বাচন কমিশন কোথায় জবাবদিহি করবে?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: বিএনপি আইনের প্রস্তাব করেছে। সংস্কার কমিশন কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচন কমিশনকে শাস্তির আওতায় আনতে সুপারিশ করেনি। বিএনপির দাবিতে ২০১৪ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সমকাল: সুপারিশে রয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত হলে নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। বিএনপি এর বিরোধিতা করছে। এতে কি আওয়ামী লীগ সুবিধা পাবে?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: পৃথিবীব্যাপী রীতি হলো– দণ্ডিত হওয়ার আগে যে কাউকে নিরপরাধ গণ্য করতে হবে। বাংলাদেশে যদি আমরা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নির্বাচনে অযোগ্যের বিধান করি, পৃথিবীর কেউ তা সমর্থন করবে না। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এই বিধান প্রয়োগ করলে বিএনপিই খুশি হতো। বিএনপিই আওয়ামী লীগের বিচারের প্রধান প্রবক্তা। কিন্তু তা আইনের মাধ্যমে, যথাযথভাবে করতে হবে।
সমকাল: তাহলে আপনারা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে দেখছেন?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: ৫ আগস্ট জনগণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার অধিকার আছে কিনা– তা মানুষ ঠিক করবে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার করতে সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদ যে সুযোগ দিয়েছে, তা কাজে লাগাতে আইন সংশোধন করতে হবে। কিন্তু সরকার আইন সংশোধন থেকে পিছিয়ে এসেছে। বিএনপি আবারও দাবি করছে, আইন সংশোধন করা হোক। আদালত আওয়ামী লীগের ভাগ্য নির্ধারণ করুক। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি নির্বাহী আদেশে কাউকে নিষিদ্ধ করা ঠিক মনে করে না।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সালাহউদ্দিন আহমেদ: সমকালকেও ধন্যবাদ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ল হউদ দ ন আহম দ গণত ন ত র ক ন ম নকক ষ র র প রস ত ব ন র প রস ত ক র যকর হ ভ রস ম য র জন ত ক ব এনপ র য় ব এনপ ও ব এনপ য় গ কর কর ছ ল হয় ছ ল আওয় ম সমক ল র সময় আইন র
এছাড়াও পড়ুন:
এনসিপি-গণসংহতি আন্দোলনের বৈঠক: নির্বাচনের ঘোষিত সময়ে সংস্কারে ঐক্য
আওয়ামী লীগের বিচার এবং নির্বাচনের ঘোষিত সময়ের মধ্যে মৌলিক সংস্কারে একমত হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণসংহতি আন্দোলন। বৈঠকে এসব বিষয়ে একমত হয়েছেন দুই দলের শীর্ষ নেতারা।
আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরে এনসিপির অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে বৈঠকে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুম, আশরাফ উদ্দীন মাহাদী, অনিক রায়, যুগ্ম সদস্যসচিব মোল্লা ফারুক এহসান শুভ্রসহ অন্য নেতারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষে প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বে নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল, রাজনৈতিক পরিষদ সদস্য তাসলিমা আখতার, হাসান মারুফ রুমি ও মনির উদ্দিন পাপ্পু প্রমুখ অংশ নেন।
বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জোনায়েদ সাকি বলেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের দায়টাকে আমরা বিচারের আওতায় দেখতে চাই। আমরা চাই, সংস্কারে একটা ন্যূনতম ঐকমত্য দ্রুত তৈরি হোক। সেই সংস্কার কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সে বিষয়েও যাতে আমরা একটা ঐকমত্যে আসতে পারি। নির্বাচনের ঘোষিত সময়সীমার মধ্যে সংস্কার কাজটাকে যাতে আমরা উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে নিতে পারি, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
সাকি আরও বলেন, আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগের যারা গত ১৫ বছরের গুম-খুন, হামলা-মামলা ও লুটপাটে যুক্ত এবং সর্বশেষ জুলাই-আগস্টে হত্যাকাণ্ডে যারা দায়ী, তাদের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, নারী আসন, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণসহ বিভিন্ন মৌলিক সংস্কার বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, গণসংহতি আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের অনেক এজেন্ডায় ঐকমত্য আছে, কিছু বিষয়ে মতপার্থক্যও রয়েছে। রাষ্ট্র পুনর্গঠন, সংবিধান সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আলোচনা আমরা গুরুত্বের সঙ্গে এগিয়ে নেব।
জোনায়েদ আরও সাকি বলেন, একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু করতে হবে, যা শহীদের স্বপ্ন ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে। তিনি বলেন, সংস্কারের মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে।
প্রসঙ্গত, গত রোববার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গেও বৈঠক করেছে গণসংহতি আন্দোলন। রাজনৈতিক সংকট সমাধানে বহুপাক্ষিক আলোচনার ধারা অব্যাহত রাখতে দলটি সক্রিয় রয়েছে।
বৈঠকে দুই দল আগামী দিনগুলোতে নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও শক্তির সঙ্গে সমঝোতা তৈরির চেষ্টা করা হবে বলেও জানান তারা।