রাজশাহীর পুঠিয়ার আমচাষি মাহবুব ইসলাম একসময় বাগান ধরে ব্যবসায়ীদের কাছে আম বিক্রি করতেন। ব্যবসায়ীরা আম বিক্রি করে টাকা দিতেন। অনেক সময় টাকার জন্য ঘুরতেও হতো তাঁকে। ব্যবসায় ভালো করলে ব্যবসায়ীরা টাকা দিয়ে দিতেন। আর যদি ব্যবসা না হতো, তখন চাষিরা চুক্তি অনুযায়ীও টাকা পেতেন না। এতে মাহবুবের খুব বেশি পোষাত না। তবে তিন থেকে চার বছর ধরে তাঁকে আর আমবাগান ধরে বিক্রি করতে হয় না। আম পরিপক্ব হতে না হতেই বাগানে চলে আসেন ক্রেতা কিংবা নিজেই হাঁটে নিয়ে বিক্রি করেন। এতে মাহবুব দামও ভালো পাচ্ছেন। আড়তদার বা অন্য ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি থাকতে হচ্ছে না তাঁকে।

মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, ‘একসময় আমার বাগানের আম আমি ছুঁতে পারতাম না। বাধ্য হয়ে বাগান ধরে বিক্রি করে দিতে হতো। এখন আমার আম আমি বিক্রি করি। লস হলেও আমার, লাভ হলেও আমার। আগে বাগান ধরে বিক্রি করতে হতো অথবা আড়তদারের কাছে। এখন আম বেচার অনেক বিকল্প পথ তৈরি হয়েছে।’

আমচাষি ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজশাহীতে কয়েক বছর আগেও মুকুল আসার পর চাষিরা আমবাগান বিক্রি করতেন। এ ধরনের রেওয়াজ বহুদিন আগের। সে সময় আরেকটি উপায় ছিল বাজারের আড়তদারের কাছে আম বিক্রি করা। কিন্তু বর্তমানে আম ব্যবসায় তথ্যপ্রযুক্তি আসায় পাল্টে গেছে বিপণনব্যবস্থা। আমের এই বিকল্প বিপণনে যুক্ত হয়েছেন অনেক তরুণসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। চাষিদের কাছ থেকে আম কিনে তাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আম পৌঁছে দিচ্ছেন। আমের মৌসুম শুরু হলেই তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিপণনে।

রাজশাহীর বিশুদ্ধ আম পৌঁছে দিতে বিভিন্ন ফেসবুক পেজের মাধ্যমে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। অনলাইনভিত্তিক এই উদ্যোগের পেছনে তরুণেরাই বেশি জড়িত। এই তরুণেরা রাজশাহীসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। এ ছাড়া আরও অনেকে নানাভাবে আম ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। আছেন নারীরাও। আম পরিবহনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসগুলোও অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায়ীদের সেবায় ভিন্নতা এনেছে।

বাঘার আমচাষি নজরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তাঁর প্রায় ১০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের আম রয়েছে। তিনি জানান, কয়েক বছর আগেও বাগান ধরে আম বিক্রি করতে না পারলে গাছতলায় পড়ে থাকত। ব্যবসায়ী বা আড়তদারেরা যে দাম দিতেন, তাই বিক্রি করতে হতো। টাকাপয়সাও ঠিকঠাক দিতেন না। এখন তিনি বাঘা বা আশপাশের কুরিয়ার থেকেও বিভিন্ন জায়গায় আম পাঠাতে পারছেন। আর এখন যোগাযোগব্যবস্থাও ভালো।

রাজশাহীতে গত ১৫ মে থেকে গুটি আম পাড়া শুরু হয়েছে। এখন আম বেচাকেনা নিয়ে একরকম আমেজ চলছে। মৌসুমের শুরুতে গুটি আমসহ নানা জাতের আম বিভিন্ন কোম্পানি আচার তৈরির জন্য কিনে নেয়। আগে আম শুধু হাটে বিক্রি হতো। এখন আমের হাট ছাড়াও বিভিন্ন রাস্তার পাশে, মোড়ে বসে অনেকেই আম বিক্রি করছেন। রাস্তার ধার থেকে আম কিনে নিয়ে যাচ্ছেন যাত্রীরা।

আলমগীর হোসেন নামের এক তরুণ উদ্যোক্তা জানালেন, তাঁরা ২০১৮ সাল থেকে রাজশাহীর আম কুরিয়ারে করে পাঠাচ্ছেন। বাগান থেকে আম পেড়ে পাঠান তাঁরা। ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করায় তাঁদের এই উদ্যোগ আজও ভালোভাবে টিকে আছে। গত বছরও ১০০ টনের মতো আম শুধু কুরিয়ার করেছেন। তিনি বলেন, আমচাষিরা একসময় চিন্তায় থাকতেন আম বিক্রি নিয়ে। এখন আর তাঁদের চিন্তা করতে হয় না। ক্রেতারা বাগানে চলে যান আম কিনতে। তাঁরাই চাষির বাগান থেকে আম নিয়ে ক্রেতাদের পৌঁছে দেন।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোছা.

উম্মে ছালমা প্রথম আলোকে বলেন, রাজশাহীর আম এখন অনলাইনে বিক্রি হয়। এখানে আমের বহুমুখী বাজার তৈরি হয়েছে। তরুণেরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। আমচাষিদের আম বিক্রি করতে আগের মতো চিন্তা করতে হয় না। এ কারণে আমের ব্যবসা ও বাজার বেড়েছে। এ বছর রাজশাহী থেকে ২০০ টন আম বিদেশেও বিক্রি হওয়ার চুক্তি হয়েছে। রাজশাহীতে আমের বাজার প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বলে তিনি দাবি করেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম ব ক র ব যবস য় এখন আম আড়তদ র আম র ব ম হব ব ন আম ব আমচ ষ

এছাড়াও পড়ুন:

দেশে পাঙাশের বৃহত্তম আড়ত দ্বীপনগর, পাওয়া যায় দেশি-বিদেশি অনেক মাছ

রাজধানীর গাবতলী–মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে বিজিবি মার্কেটে গড়ে ওঠা দ্বীপনগর মাছের আড়ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বেশ জমজমাট থাকে। এই তিন ঘণ্টায় বিক্রি হয় দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মাছ। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে এসব নানা জাতের দেশি-বিদেশি মাছ।

এ আড়তে গরিবের মাছখ্যাত পাঙাশ থেকে শুরু করে রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, কই, শিং, টাকি, মাগুর, পুঁটি, বাইম, চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি ও চাষের মাছ পাওয়া যায়। নদীর পাশাপাশি সাগরের বাইলা, চাপিলা, সুরমা, পোয়া, রিঠা, লইট্টা, টুনা প্রভৃতি মাছ পাওয়া যায়। ওমান, চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা মাছ সরাসরি এখানে আসে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।

আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৬ সালে প্রথমে বিজিবি মার্কেটে মাছ বিক্রি শুরু হয়। তবে ২০০৯ সালে এ বাজারে দ্বীপনগর আড়তের যাত্রা শুরু হলেও বাজার জমে ওঠে ২০১৫ সালের পর থেকে। পরে পাঁচটি হিমাগার ও একটি বরফকল নিয়ে এটি এখন একটি পূর্ণাঙ্গ মৎস্য আড়তে পরিণত হয়, যেখানে ছোট–বড় প্রায় ৪০০ পাইকারি দোকান রয়েছে।

আড়তদার ও বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, দ্বীপনগর আড়তে জ্যান্ত মাছের পাইকারদের বিনা মূল্যে পানি সরবরাহ করায় তাঁদের প্রত্যেকের প্রায় ৫০০ টাকা করে সাশ্রয় হয়। তার ওপর যাতায়াতের সুবিধা ভালো, ওজনে কেউ মাছ কম দেয় না, চুরিও হয় না এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখানে চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবেশে বেচাকেনা করা যায়। এসব কারণে এটি এরই মধ্যে ঢাকার অন্যতম বৃহৎ ও জনপ্রিয় আড়তে পরিণত হয়েছে। ফলে এখানে দিন দিন পাইকার বাড়ছে এবং মোকামও আশপাশে বিস্তৃত হচ্ছে।

দ্বীপনগর আড়তের ‘অটুট বন্ধন মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতি’র সভাপতি মো. ইনসার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে দৈনিক প্রায় ৪০ হাজার কেজি পাঙাশ বিক্রি হয়, যা কারওয়ান বাজারেও হয় না। সব ধরনের মাছ মিলিয়ে দৈনিক দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়।’

* দ্বীপনগর আড়তে পাঙাশ, রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, কই, শিং, টাকি, মাগুর, পুঁটি, বাইম, চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি ও চাষের মাছ পাওয়া যায়।
* নদী ও সাগরের বাইলা, চাপিলা, সুরমা, পোয়া, রিঠা, লইট্টা, টুনা প্রভৃতি মাছও বিক্রি হয়।
* প্রতিবেশী ভারত থেকে শুরু করে ওমান, সুদান, জর্ডান, চীন ও জাপান থেকে আমদানি করা মাছ এখানে বিক্রি হয়।

আড়তদার ও পাইকারদের দাবি, এটি দেশে পাঙাশ মাছের সবচেয়ে বড় আড়ত। এখানে দিনে ৩৫ থেকে ৪০ ট্রাক পাঙাশ মাছ আসে। এসব ট্রাকে ৩০ থেকে ৪০টি করে পাঙাশের ড্রাম থাকে। এর একেকটিতে ৪০ কেজি মাছ থাকে। গড়ে ৩৫টি ট্রাকে ৩৫টি করে ড্রাম এবং প্রতি ড্রামে ৪০ কেজি ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, এখানে দৈনিক ৪৯ হাজার কেজি পাঙাশ মাছ বিক্রি হয়, যার দাম ৬৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

বিশেষ করে রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, শ্যামলী, গাবতলী, সাভার, উত্তরা এবং আবদুল্লাহপুর এলাকার পাইকারেরা দ্বীপনগর আড়তে মাছ কিনতে আসেন। অটুট বন্ধন মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি মনির হোসেন বলেন, কম দামে পাওয়া যায় বলে পাইকারেরা এখানে মাছ কিনতে আসেন। তাঁর নিজস্ব বরফকল রয়েছে। ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বরফের পাটা বিক্রি করেন। তাই বাইরে থেকে বরফ আনতে হয় না।

সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ফোটার আগেই বিভিন্ন এলাকার পাইকারেরা মাছ কিনতে দ্বীপনগর আড়তে চলে আসেন। সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত নিলামের হাঁকডাকে সরগরম হয়ে ওঠে পুরো আড়ত। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা তাজা ও হিমায়িত মাছের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আনা মাছের বেচাবিক্রি শেষ হয়ে যায়। ৯টার পরপরই সব ব্যস্ততা শেষে ধোয়ামোছার কাজ শুরু হয়ে যায়।

সাভার নবীনগর থেকে আসা পাইকার ফরিদুল ইসলাম জানান, তিনি এখান থেকে দৈনিক ১৫০–২০০ কেজি সাগরের মাছ নিয়ে এলাকার বাজারে বিক্রি করেন।

আড়তদারেরা জানান, দেশের সিলেট, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নওগাঁ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, টেকেরহাট, খুলনা, রাজশাহী, মোংলা, সাতক্ষীরাসহ সব অঞ্চল থেকেই মিঠাপানি এবং নদী ও সাগরের মাছ আসে দ্বীপনগর আড়তে। ওমান, সুদান, জর্ডান, জাপান, চীন এবং ভারত থেকেও সামুদ্রিক মাছ আনা হয়।

মেসার্স ঢাকা গাবতলী ফিশ আড়তের স্বত্বাধিকারী মো. আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দৈনিক ৫ টনের মতো মাছ বিক্রি হয়, যার দাম ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার মতো।’ তাঁদের হিমাগারে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২ মাস পর্যন্ত মাছ ঠিক থাকে। প্রয়োজনে তাপমাত্রা আরও কমানো যায় বলে জানান তিনি। তবে আড়তদারদের হিসাবে এসব হিমাগার থেকে দৈনিক ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয়।

৫৫০ টাকা করে বাইম মাছ কেনার পর আদাবর বাজারের একজন পাইকার প্রথম আলোকে জানান, তিনি এই মাছ বিক্রি করবেন ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। পোয়া মাছ কিনেছেন ৩৩০ টাকা কেজি দরে, বেচবেন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। ওই পাইকার আরও জানান, আগে কারওয়ান বাজার থেকে মাছ কিনলেও এখন সুবিধা থাকায় দ্বীপনগরে আসেন। প্রতিদিন পাঙাশ, তেলাপিয়া, রুই মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৫০ থেকে ৭০ কেজি মাছ কেনেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সামুদ্রিক মাছে ভরপুর আড়ত, দাম কেমন
  • একসময় ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের ভবিষ্যৎ তারকা, এখন ক্লাব খুঁজে বেড়াচ্ছেন
  • মেঘনার পাড়ে ‘আড়াই ঘণ্টার হাট’, দৈনিক বেচাকেনা ২৫-২৬ লাখ টাকার টাটকা মাছ
  • দেশে পাঙাশের বৃহত্তম আড়ত দ্বীপনগর, পাওয়া যায় দেশি-বিদেশি অনেক মাছ