বরগুনার থানাপাড়া এলাকার আজমেরী মোনালিসা জেরিন (২৫) ছিলেন একজন নারী উদ্যোক্তা। ঘরে বসে জন্মদিনের কেক তৈরি করতেন। এ কেকের খ্যাতি ছিল পৌর শহরে। কিন্তু আজমেরীর আকস্মিক মৃত্যু সেই সফল উদ্যোক্তাজীবনকে থামিয়ে দিয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।
চিকিৎসায় অবহেলা এবং বরগুনা পৌর শহরে মশকনিধনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের উদাসীনতাকেই আজমেরীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হচ্ছে। এখন বরগুনা জেলা, বিশেষ করে পৌর শহর ডেঙ্গুর হটস্পট। ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। রোগটি গ্রামাঞ্চলেও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এ পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ১৫ জন। এর মধ্যে শুধু বরগুনা জেলাতেই আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ২০৪ জন। অর্থাৎ মোট আক্রান্তের ২৪ শতাংশ এ জেলার। শহরসহ বিভিন্ন স্থানে মশা বাড়ছে। বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। এসব আক্রান্ত ব্যক্তির ভিড় জমছে হাসপাতালে। তাঁদের সামাল দিতে হিমশিম অবস্থা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের।
বরগুনা কেন ডেঙ্গুর হটস্পট
বরিশাল বিভাগে বরগুনা নতুন ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে ২ হাজার ১৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বিভাগের ৫৮ শতাংশ রোগী এই বরগুনার বাসিন্দা। চলতি বছর মারা যাওয়া চারজনের মধ্যে তিনজনই বরগুনার বাসিন্দা ছিলেন। গত বছর বিভাগে ৮ হাজার ৪৫৭ জন হাসপাতালে এসেছিলেন। এর মধ্যে বরগুনারই ছিলেন ২ হাজার ৩৬৭ জন।
দক্ষিণের এই জেলায় কেন ডেঙ্গু এতটা মারাত্মক রূপ নিল—এমন প্রশ্ন করা হলে বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ প্রশ্নের আসলে সুনির্দিষ্ট জবাব দেওয়া কঠিন। আমরা গত দুই বছর কীটতত্ত্ববিদদের নিয়ে গঠিত টিম পাঠিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছি, এখানে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শতভাগই স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশার অস্তিত্ব রয়েছে ব্যাপকহারে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু বা এ ধরনের রোগের কারণ অনুসন্ধানের কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আইইডিসিআরের এবারের প্রাক্-বর্ষা মশার জরিপে বরিশাল বিভাগে দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া যায় অপেক্ষাকৃত বেশি। এ প্রতিবেদনটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়েছে। তবে বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডলের কাছে মশা জরিপের কোনো ফলাফল নেই বলে জানান তিনি।
সরকারের একটি জরিপের ফলাফল কেন মাঠপর্যায়ে গেল না, তা ‘বিস্ময়কর’ বলে মনে করেন মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, জরিপের তথ্য–উপাত্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে দেওয়া হয়েছিল।
ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে অন্য রোগীদের চিকিৎসা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আমরা ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিতেই হিমশিম খাচ্ছি।তাসকিয়া সিদ্দিকী, আরএমও, বরগুনা ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালশয্যার চেয়ে রোগী বেশি হাসপাতালে
গতকাল মঙ্গলবার বরগুনা ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৭৮ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এখন ১৫৮ জন রোগী চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে ১৯ জন শিশু। হাসপাতালের শয্যা ২৫০ হলেও এর মধ্যে ৫০টি শয্যা ডেঙ্গুর জন্য বরাদ্দ হয়েছে।
গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ওই হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, মেঝে, করিডর ও সিঁড়ির পাশে রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। মশারি টাঙানোর ব্যবস্থা না থাকায় রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনেরাও ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
সদর উপজেলার মনির খান তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে তিন দিন ধরে এই হাসপাতালে আছেন। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে স্যালাইনের ব্যবস্থা নেই। বাইরে থেকে কিনে এনে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।’
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) তাসকিয়া সিদ্দিকী বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে অন্য রোগীদের চিকিৎসা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আমরা ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিতেই হিমশিম খাচ্ছি। তার ওপরে এখানে চিকিৎসক–সংকট প্রকট। তাই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা অসহায় বোধ করছি।’
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বরিশালে প্রথমবার ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। সেই বছর ১৮ জনের মৃত্যু হয় এবং ১০ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়। ২০২৩ সালে আক্রান্ত হয়েছিলেন সর্বোচ্চ ৩৮ হাজার ৬৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ২০৯ জনের। ২০২৪ সালে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৮ হাজার ৪৫৭ জন এবং মারা যান ৫৮ জন ডেঙ্গু রোগী।
২০১৯ সালে বরিশালে প্রথমবার ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। সেই বছর ১৮ জনের মৃত্যু হয় এবং ১০ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়। ২০২৩ সালে আক্রান্ত হয়েছিলেন সর্বোচ্চ ৩৮ হাজার ৬৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ২০৯ জনের। ২০২৪ সালে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৮ হাজার ৪৫৭ জন এবং মারা যান ৫৮ জন ডেঙ্গু রোগী।মশা আছে, প্রতিরোধ নেই
বরগুনা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দিনরাত সমানভাবে শহরের সর্বত্র বাড়িঘরে মশার উপদ্রব থাকে। মশার কয়েল, ধূপ জ্বালিয়ে ধোঁয়া দেওয়ার পরেও মশার উপদ্রব কমে না। মশার উপদ্রব কমাতে পৌরসভার পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও তারা অনেকটাই উদাসীন বলেও অভিযোগ করেন অনেকে।
বরগুনা পৌর শহরের বালিকা বিদ্যালয় সড়কের বাসিন্দা জুয়েল তালুকদার বলেন, মশার উপদ্রবে তাঁরা অতিষ্ঠ। মশার উৎপাত থেকে রক্ষার জন্য বাসায় সার্বক্ষণিক কয়েল জ্বালিয়ে রাখেন। সন্ধ্যার আগে ধুপ জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিলে সামান্য সময়ের জন্য স্বস্তি মিললেও তা বেশিক্ষণ থাকে না।
বরগুনা জেলা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক হাসানুর রহমান বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে শহরে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। শহরের বিভিন্ন জায়গায় এখনো জলাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক স্থানে ময়লা–আবর্জনা আছে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বরগুনা পৌরসভার সচিব মো.
ডেঙ্গু পরিস্থিতি বরগুনা শহরের বাসিন্দাদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরের ডিকেপি সড়কের বাসিন্দা শারমিন জাহানের আট বছরের মেয়ে সানজিদা এপ্রিল মাসে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বরগুনা থেকে বরিশাল হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। তার চিকিৎসায় অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা।
শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়ে সুস্থ হলেও এখনো আতঙ্গ কমেনি। কারণ, শহরের প্রায় ঘরেই দু-একজন ডেঙ্গু রোগী আছেন। শহরের সর্বত্র এখন দিনরাত মশার দাপট। তাই এখন দিনেও মশার কয়েল জ্বালিয়ে রাখেন, সন্ধ্যা হলে বাচ্চাদের নিয়ে মশারি খাটিয়ে বসে থাকেন।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বর শ ল ব ভ গ প রথম আল ক হয় ছ ল ন শহর র ব প র শহর বরগ ন র র জন য হয় ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
ফেসবুকে বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য না করার নির্দেশনা সিলেট জেলা বিএনপির
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দায়িত্বহীন, অশালীন বা বিদ্বেষপূর্ণ পোস্ট, মন্তব্য কিংবা তথ্য শেয়ার থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে সিলেট জেলা বিএনপি। দলের কেউ এ নির্দেশনা লঙ্ঘন করলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।
গতকাল রোববার রাতে জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিবৃতিটি গণমাধ্যমে পাঠিয়েছেন জেলা বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক মাহবুব আলম।
এদিকে দলের একজন জ্যেষ্ঠ নেতার বিরুদ্ধে ফেসবুকে কুরুচিপূর্ণ ও শিষ্টাচার–বহিভূর্ত মন্তব্য করায় গতকাল রাতে বিশ্বনাথ উপজেলার লামাকাজী ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আবেদুর রহমানকে (আছকির) সাময়িক বহিষ্কারের পাশাপাশি সাত দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলেছে জেলা বিএনপি। এ ছাড়া অনলাইন গণমাধ্যমে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী বক্তব্য দেওয়ার জন্য জেলা বিএনপির সহসভাপতি ফখরুল ইসলামকে (ফারুক) সতর্কীকরণ নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
জেলা বিএনপির বিবৃতিতে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট জেলা বিএনপির আওতাধীন কিছু ইউনিটের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কার্যক্রমে অনভিপ্রেত ও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে বিশ্বনাথ উপজেলা, বিশ্বনাথ পৌরসভা ও ওসমানীনগর উপজেলা বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতা-কর্মীর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য, কটূক্তি ও বিভাজন সৃষ্টিকারী পোস্ট প্রচারিত হয়েছে। যা দলীয় শৃঙ্খলা ও ঐক্যের পরিপন্থী।
বিএনপি সব সময় সংগঠনের ঐক্য, শালীনতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের রাজনীতি বিশ্বাস করে উল্লেখ করে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, দলের কোনো পর্যায়ের নেতা বা কর্মীর কাছ থেকে বিভেদমূলক আচরণ, বিদ্বেষ ছড়ানো বা প্রকাশ্যে অপপ্রচার কখনোই কাম্য নয়। অতএব জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সব ইউনিটের নেতা-কর্মীদের কঠোরভাবে সতর্ক করা হচ্ছে, যেন ভবিষ্যতে তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দায়িত্বহীন, অশালীন বা বিদ্বেষপূর্ণ পোস্ট, মন্তব্য বা শেয়ার থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকেন।
যোগাযোগ করলে জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি ফেসবুকে কিছু নেতা-কর্মীকে একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে দেখা গেছে। এ অবস্থায় জেলা বিএনপি একটি নির্দেশনা দিয়েছে। তা অমান্যকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।