অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার দুদিন পর দর্শনার্থীদের জন্য আবারো উন্মুক্ত হলো সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি।

শুক্রবার দুপুরে জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম এক দর্শনার্থীর হাতে প্রবেশ টোকেন দিয়ে কাছারি বাড়িতে প্রবেশের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। কাছারিবাড়িতে প্রবেশ উন্মুক্ত করায় দর্শনার্থীরা ভেতরে ঢুকতে পেরে আনন্দ প্রকাশ করেন। এর আগে প্রবেশ টোকেন নিয়ে প্রবাসী এক দর্শনার্থীর সঙ্গে স্টাফদের গণ্ডগোলের জেরে বন্ধ করা হয় প্রবেশ অধিকার।

জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে কোনোপ্রকার হামলার ঘটনা ঘটেনি। সম্পূর্ণ অক্ষত রয়েছে কাছারিবাড়ি। হামলা হয়েছে মূলত কাছারিবাড়ির পাশেই অবস্থিত অডিটোরিয়ামে। সেটাও কাছারিবাড়িকে টার্গেট করে নয়। কোনও মৌলবাদ বা কোনও রাজনৈতিক কারণে এ ঘটনা ঘটেনি। সেইসঙ্গে রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে আর কোনও নিরাপত্তার ঘাটতি নেই উল্লেখ করে সব দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।

দুপুরে উন্মুক্ত করার সময় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) শেখ কামাল হোসেন, সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার মো.

ফারুক হোসেন, শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান, সহকারী কমিশনার মো. মুশফিকুর রহমান, উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ইকবাল হোসেন হিরু, উপজেলা জামায়াত আমির অধ্যাপক মিজানুর রহমান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাজী শওকত হোসেন উপস্থিত ছিলেন। দর্শনার্থীদের প্রবেশ উন্মুক্ত করে তারাও কাছারিবাড়ি পরিদর্শন করেছেন।

তদন্ত কমিটির প্রধান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) শেখ কামাল হোসেন বলেন, ইতোমধ্যেই তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। শিগগিরই ঘটনার বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি হবে। তদন্ত রিপোর্ট দেখে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পুলিশ সুপার মো. ফারুক হোসেন জানান, পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর সহায়তায় কবিগুরুর কাছারিবাড়িতে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। আর কোনও অপ্রীতিকর ঘটনার সম্ভাবনা নেই। ঘটনায় সাথে জড়িত জুবায়ের, আশিকুর রহমান, সজীব, রিমন, তানভীর, সারদুল, আব্দুস সালামসহ আটজনকে আটক করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত (৮ জুন) প্রবাসী শাহনেওয়াজ নামের এক দর্শনার্থী পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কাছারিবাড়ি পরিদর্শনে গেলে পার্কিং ফি নিয়ে গেটের এক কর্মচারীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ওই দর্শনার্থীকে অডিটোরিয়ামের ভেতরে আটকে মারধর করে এবং পিটিয়ে আহত করে। পেটানোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভুক্তভোগী শাহনেওয়াজ বাদী হয়ে শাহজাদপুর থানায় ওইদিন রাতেই কাস্টোডিয়ান হাবিবুর রহমানকে ১ নম্বর আসামি করে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। ঘটনার দুইদিন পরও কার্যকর কোনও ব্যবস্থা থানা পুলিশ না নেওয়ায় ওই ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয়রা গত (১০ জুন) শাহজাদপুর প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন। পরে উত্তেজিত জনতা কাছারিবাড়িতে প্রবেশ করে অডিটোরিয়ামের দরজা, জানালা ভাঙচুর করে। খবর পেয়ে পুলিশ ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মুশফিকুর রহমান ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

এরপর বুধবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কাছারিবাড়িতে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। বুধবার দুপুরে মন্ত্রণালয়ের ৩ সদস্যের একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

একই দিনে কাছারিবাড়ির কাস্টোডিয়ান হাবিবুর রহমান বাদী হয়ে ভাঙচুর ও মারধরের ঘটনায় থানায় মামলা করেন। মামলায় ১০ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ৫০-৬০ জনকে আসামি করা হয়। মামলার পর পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর সহায়তায় গত দুদিনে আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গ্রেপ্তা‌রদের আদালতের মাধ্যমে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে শাহজাদপুর থানার ওসি মোহাম্মদ আসলাম আলী শুক্রবার বিকেলে সমকালকে জানিয়েছেন।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স র জগঞ জ রব ন দ র ক ছ র ব র রহম ন প রব শ র জন য ঘটন র

এছাড়াও পড়ুন:

পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে

অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।

১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’

এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।

পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।

পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।

আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)

সম্পর্কিত নিবন্ধ