অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থের উৎস গোপনের অভিযোগে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড পিএলসির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী পরিচালক (সিইও) মোহাম্মদ মনিরুল মাওলাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।
 
সোমবার ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন গালিবের আদালত এ আদেশ দেন। এদিন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে আসামিকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন সংস্থাটির উপপরিচালক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো.

ইয়াসির আরাফাত। 

এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, এটা যেহেতু দুর্নীতি দমন কমিশনের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১ এ দায়ের করা মামলা। তাই ঢাকায় এ মামলার জামিন বা রিমান্ড শুনানি করার সুযোগ নেই। ঢাকার আদালত আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন। এ মামলার জামিন বা রিমান্ড বিষয়ে শুনানি চট্টগ্রামের আদালতে হবে।
 
এর আগে গত ২২ জুন দিবাগত রাত সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় মনিরুল মাওলার নিজ বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। 

মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, মনিরুল মাওলার বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে নিজেরা লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে নথিপত্র তৈরি ও তা ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি ইসলামী ব্যাংকের মোট ১ হাজার ৯২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন এবং আত্মসাৎকৃত অর্থের প্রকৃত উৎস ও প্রকৃতি গোপন করতে তিনি অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং করেছেন।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসল ম ব য ক মন র ল

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রীলঙ্কা পেরেছে, বাংলাদেশ কেন পারছে না

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক দৃশ্যপটের সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতার মিল আর অমিল খুঁজে দেখার চেষ্টা করেন অনেকে। আদতে দুটি দেশের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে ক্ষীণ সাদৃশ্য থাকলেও গভীরের অমিলের দিকগুলো মোটাদাগের। 

গত প্রায় পাঁচ দশকে সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা শ্রীলঙ্কা শিক্ষাদীক্ষা, মানবিক উন্নয়ন, সামাজিক সাম্য, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক চর্চাসহ নানা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনো দেশের তুলনায় অগ্রগামী। ক্ষেত্রবিশেষে ইউরোপের বহুল আলোচিত কল্যাণ রাষ্ট্র ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত অনেক রাষ্ট্রের চেয়ে শ্রীলঙ্কার বাস্তবতা অগ্রবর্তী।

এ রকম ইতিবাচক অবস্থানে থাকার পরও দেশটি ২০২২ সালে গভীর সংকটে কেন পড়ল? যে সংকট গণআন্দোলনে রূপ নিল, যার পরিণতিস্বরূপ তৎকালীন সরকারের পতন পর্যন্ত হয়ে গেল। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ল; রাষ্ট্রীয় কোষাগার তলানিতে গিয়ে ঠেকল; কোষাগার সংকটে প্রয়োজনীয় জ্বালানি এবং জরুরি চিকৎসা সামগ্রী আমদানি থমকে গিয়েছিল; দেশের হাসপাতালগুলোর সেবা কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়েছিল; শিল্পকারখানা, সেচ ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়ল; পরিবহন ব্যবস্থা হোঁচট খেল। এ রকম অবস্থা থেকে দেশটি ঠিক ঠিক দুই বছরের মাথায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে। 
সংকটের সময় দেশটি বাংলাদেশ থেকেও ঋণ গ্রহণ করেছিল। ঠিক প্রায় একই সময়ের মাথায় ২০২৪ সালে বাংলাদেশ অনেকটা শ্রীলঙ্কার মতো সংকটের মুখে পড়ে গেল কেন? অবস্থাটা এ রকম– শ্রীলঙ্কার সংকটের সারা আর বাংলাদেশের সংকটের শুরু। 

শ্রীলঙ্কায় সেই সময়ে জনমনে অসন্তোষ, বৈদেশিক ঋণের চাপ, সরকারের বিরুদ্ধে বিশেষ করে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং মাহিন্দা রাজাপাকসে পরিবারের দুর্নীতি; রুয়ান্ডা ও অস্ট্রেলিয়ায় মুদ্রা পাচারের অভিযোগ উল্লেখযোগ্য। অধিকন্তু ওই সময়ে করোনা অতিমারির ধাক্কার মধ্যে মূল্যস্ফীতির চাপে শ্রীলঙ্কার মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছিল। 
এমন প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ অনুরাধা বান্দারা নামে ২৮ বছরের এক তরুণ ফেসবুকে ‘#গোতাগোহোম’ বা ‘বাড়ি যাও গোতা’ নামে হ্যাশট্যাগ প্রচারণা শুরু করেন। পরদিন পুলিশ অনুরাধাকে গ্রেপ্তার করে। এর প্রতিবাদে দলমত নির্বিশেষে তরুণ, ছাত্র, বয়স্কসহ সর্বস্তরের মানুষ রাজধানী কলম্বোর প্রেসিডেন্টের বাসভবনের সামনে জমায়েত হয়ে রাতদিন শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু করে। বিক্ষোভকারীরা শামিয়ানা আর তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান শুরু করে।

এমন প্রেক্ষাপটে মন্ত্রিসভার ২৬ জন সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন। পরে যদিও এদের কয়েকজনকে পুনরায় পদায়ন করা হয়। দাবি ওঠে প্রেসিডেন্টসহ সরকারের পদত্যাগ। এমনকি দেশটির সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন আয়োজনের দাবিও ওঠে। সেই সঙ্গে দাবি ওঠে ১৯৭৮ সালে প্রবর্তিত নির্বাহী রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে মন্ত্রিপরিষদ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের। এ আন্দোলন ২০২২ সালের এপ্রিলে শুরু হয়ে নভেম্বর পর্যন্ত চলে।  

এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্টের পরামর্শে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করেন। তাঁর স্থলে প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন দেন। এই সময় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা সাজিথ প্রেমাদাসাকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। তিনি রাজি হননি।  
রনিল উচ্চবিত্ত রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে আসা নেতা। তিনি এর আগে বিভিন্ন মেয়াদে পাঁচবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। পেশায় আইনজীবী রনিলের রয়েছে অর্থ, প্রতিরক্ষাসহ জনগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা। এ রকম একজন নেতা রাজনীতির গহ্বরে নিমজ্জিত কণ্টকাকীর্ণ বাস্তবতাও দেখে এসেছেন।   

২০১৯ সালে রনিলের সম্মিলিত জাতীয় দল ন্যাশনাল ইউনাইটেড পার্টি (ইউএনপি) ভেঙে যায়। দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে সাজিথ প্রেমাদাসা সম্মিলিত জনশক্তি বা ইউনাইটেড পিপলস পাওয়ার নামে নতুন দল গঠন করেন। ২০২০ সালের নির্বাচনে নবগঠিত দলটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৯৬ আসনের মধ্যে ৫৬ আসন লাভ করে বিরোধী দলের মর্যাদা পায়।  
অন্যদিকে রনিলের দল ১টি আসনেও জিততে ব্যর্থ হয়। মাহিন্দা রাজাপাকসের দল শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি (এসএলএফপি) ১৪৫ আসনে জিতে যায়। নির্বাচনে দলের এমন ভরাডুবির পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক কেউ কেউ রনিলকে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই রনিল এসএলএফপির সহযোগিতায় সংসদের ২৯টি মনোনীত আসনের মধ্যে ১টি গ্রহণ করে সংসদে প্রবেশ করেন। এর দুই বছরের মাথায় শাসনতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক চরম বিশৃঙ্খল মুহূর্তে প্রথমে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, এক পর্যায়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পলায়নের পর একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে নিজে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর একসময়ের বামপন্থি রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতাচ্যুত রাজাপাকসে পরিবারের দল এসএলএফপির বিদায়ী সরকারের নেতা দীনেশ গুণবর্ধনের দলটির সংসদীয় নেতা নির্বাচিত হন। তারপর তিনি দলটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন এবং সংসদে ভোটাভুটিতে নির্বাচিত হয়ে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট রনিলের সঙ্গে সংকট উত্তরণে আত্মনিয়োগ করেন।

চরম ওই অরাজক মুহূর্তে দেশটির মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত হয়; প্রেসিডেন্ট পালিয়ে সিঙ্গাপুর চলে যান। বিক্ষুব্ধ জনতা রাজাপাকসের পরিবারের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করে; ভাঙচুর হয় রনিলের বাসভবনও। রনিল দৃঢ় প্রত্যয়ে দুটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেন– এক. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং দুই. অর্থনীতিকে খাদের কিনার থেকে তুলে আনা। বাকি সব ক্ষেত্রে চলমান স্থিতি ধরে রাখা ছিল দেশটির অন্তর্বর্তী প্রশাসনসহ সব রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত প্রত্যয়। 

সামাজিক সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত শ্রীলঙ্কার জনজীবন অনেকটা কৃষিনির্ভর। আমদানির বড় খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বালানি, চিকৎসা সামগ্রী, রাসায়নিক দ্রব্য। দৈনন্দিন জীবন খুব একটা আমদানিনির্ভর নয়। রাজাপাকসে সরকারের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল পারিবারিক স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি। ওই পরিবারের এক ভাই প্রেসিডেন্ট, আরেক ভাই প্রধানমন্ত্রী, বাকি ভাই-ভাতিজা মিলে আরও তিনজন মন্ত্রীর আসনে ছিলেন। সংসদে ঢুকেছেন ১০ জনের মতো পারিবারিক সদস্য। এর বাইরে পরিবারের নানাজন সরকারের নানা দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করেছেন। দুর্নীতির অভিযোগ ছিল মূলত রাজাপাকসে পরিবারের বিরুদ্ধে। তাদের দল, দেশের সরকার এমনকি প্রতিষ্ঠানগুলো সেই অর্থে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েনি। যে কারণে রাজাপাকসের পরিবারের প্রস্থানের পর রনিলের সরকারকে পরিস্থিতি সামলাতে অতিরিক্ত প্রতিকূল অবস্থায় পড়তে হয়নি।  

শ্রীলঙ্কার সংকটকালে বিদায়ী সরকারের মন্ত্রিসভা ও প্রেসিডেন্ট বদল হয়েছে। জাতীয় সংসদ, বিচারালয়, প্রশাসনসহ আর কোথাও রদবদলের উদ্যোগ নেননি রনিল। সংসদে বিদায়ী সরকারের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ থাকলেও তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করে গেছে। দেশটির সংসদ অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী বাছাই প্রক্রিয়ায় সংবিধানের দেখানো পথে এগিয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত দলটির সঙ্গে বোঝাপড়া করেই অন্তর্বর্তী প্রশাসন অগ্রসর হয়েছে। তার মানে এই নয়, প্রশাসনে বসেই নিজ দলের প্রতি পক্ষপাত করেছে বা অন্য দলের প্রতি বিরাগের বশবর্তী হয়েছে। বরং এতে করে সাংবিধানিক সংকট এবং বাড়তি সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের খরচ এড়াতে পেরেছে। রাজনৈতিক উত্তরণের সংবিধানসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য এই প্রক্রিয়া বহির্বিশ্বের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়ন এবং চুক্তি সম্পাদনেও ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। দেশটির কোনো নাগরিককে বিদেশে বসে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হয়নি। দেশের ভেতরে ও বাইরে সবাই একাট্টা ছিল সংকটের গহ্বর থেকে দেশকে উদ্ধার করায়।    
দেশটির মধ্যে বিভাজনের রাজনীতিকে উৎসাহ দেওয়া হয়নি। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে নির্বাহী রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা বিলোপের দাবি থাকলেও, এই দাবিতে তারা অনড় থাকেনি। দেশটির সংসদ ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনের সময়সীমা এসে গিয়েছিল। শেষতক দেশে কাগজের অপ্রতুলতা এবং অর্থনৈতিক সংকটে কৃচ্ছ্রসাধনে সব দলের সম্মতিতে স্থানীয় নির্বাচনের আয়োজন পিছিয়ে দেওয়া হয়। সেই মেয়াদোত্তীর্ণ স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচন গত মাসে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল।  

শ্রীলঙ্কায় গণঅভ্যুত্থানের পর স্থানীয় নির্বাচন স্থগিত রেখে জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কোনো দল বা রাজনৈতিক নেতাকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সংবিধান বদলানোর আওয়াজ তোলা হয়নি। বিগত সরকারের ‘দালাল’ চিহ্নিত করার প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়নি। সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা বাড়তি কোনো দাবি ও দফা নিয়ে হাজির হননি। তারা নতুন কোনো দলও গঠন করেননি। সবারই প্রত্যাশা সংকট থেকে উত্তরণ ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা। 

শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকটের দৃশ্যত বড় একটি কারণ ছিল চীনের সঙ্গে বিদেশি ঋণনির্ভর বৃহৎ কতগুলো প্রকল্প। এতে অর্থনীতি চাপে পড়ে যায়। দেশের মানুষও ভয় পেয়ে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আস্থা ফেরাতে ভারতের কূটনৈতিক সহযোগিতা সংকট থেকে বেরিয়ে আসার গতি ত্বরান্বিত করেছে। সংকটকালে দেশটির রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ছিল সাকল্যে ২ কোটি মার্কিন ডলারেরও কম। সেই কোষাগারে এখন ৬.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বছরের শেষ নাগাদ লক্ষ্যমাত্রা ৭ বিলিয়ন ডলার।  

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাম্যবাদী সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির অনুসারী ৫৬ বছর বয়সী অনুরা কুমার দেশনায়েক জয়ী হন; বিরোধীদলীয় নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা, অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে এবং গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত দল শ্রীলঙ্কা মুক্তি দলের প্রার্থী নমাল রাজাপাকসেকে হারিয়ে। একই বছর নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ২২৫ আসনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট অনুরার দল ১৫৯ আসনে, বিরোধীদলীয় নেতা সাজিথের দল ৪০ আসনে, রনিলের দল পাঁচ আসনে এবং নমাল রাজাপাকসের দল তিনটি আসনে জয়ী হয়। 
নবগঠিত সরকার তাদের বাজেটে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ও নবগঠিত প্রশাসন উভয় গোষ্ঠীই প্রতিহিংসার পথ পরিহার করেছে। জনকল্যাণ ও মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে শক্তি জুগিয়েছে। এ জন্য তাদের ঐকমত্য কমিশন গঠন করতে হয়নি।

রাজনৈতিক ডামাডোলে ও পরিবর্তনের ডাকে যাদের ঝরে পড়ার কথা, তারা ভোটের রায়েই প্রস্থানের পথ পেয়ে গেছেন। তাই বলে তাদের ফিরে আসার পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। দেশের মানুষ চাইলে সামনের নির্বাচনে তাদের কেউ কেউ ফিরে আসতেও পারেন। কার্যকর গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রের এটি এক ভারসাম্যমূলক অগ্রসর অবস্থান। 
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের বাস্তবতাকে কেউ কেউ আরব বসন্ত বিশেষত তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিসর ও সিরিয়ার সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করেন। আবার কেউ কেউ শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মেলাতে চান।  

আদতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট অনেকটা আরব বসন্তের সঙ্গে মিলে যেতে পারে। এ রকম আভাস আন্দোলনের পক্ষ ও বিপক্ষের তরফে অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে উচ্চারিত হয়। বিশেষত মার্কিন সাহায্য সংস্থার ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক নানা কুশীলবের সংযোগের কথাও শোনা যায়। এর মধ্যে বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান ভলকার তুর্কের স্বীকারোক্তি উল্লেখযোগ্য। 
নানা পক্ষের বয়ান যা-ই থাকুক, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের আম জনতার আকাঙ্ক্ষা ছিল দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা। সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু বাংলাদেশ সেই আকাঙ্ক্ষার জন্য প্রতিবেশী দেশটির দেখানো পথে হেঁটেছে? নাকি সেই পথে হাঁটার কোনো পূর্বাভাস আমরা দেখতে পেয়েছি? 

শ্রীলঙ্কায় সংকটের পর শুধু রাষ্ট্রীয় কোষাগার নয়, ঘুরে দাঁড়ানোর উদ্যোগের ফলে দেশটির কোনো সূচকই অবনতির দিকে যায়নি। কোনো কারখানা বন্ধ হয়নি। মানুষ নতুন করে বেকার হয়নি। প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেনি। প্রতিহিংসা ও মামলা বাণিজ্যের নামে শত শত মানুষকে কারাগারে ঢোকানো হয়নি। বিনা কারণে কাউকে গ্রেপ্তর বা মামলার আসামি করা হয়নি। একজন সাংবাদিকেরও অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল হয়নি। নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেননি। রপ্তানি বাণিজ্যে ধস নামেনি।  

শ্রীলঙ্কায় সাংস্কৃতিক অবকাঠামোতে ভাঙচুর চালানো হয়নি। প্রশাসন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তছনছ করা হয়নি। কোনো পেশাজীবীকে, রাজনৈতিক নেতাকে হয়রানি করা হয়নি। মব সন্ত্রাস হয়নি। কেউ ফেসবুকে প্রচারণা শুরু করেনি– ‘আমরা রনিল বিক্ৰমাসিংহেকে আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই’। তিনি নিজে চেয়েছেন ক্ষমতায় থাকতে। সে জন্য নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন, হেরেছেন; তা মেনেও নিয়েছেন। 
শ্রীলঙ্কার জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার মিল ছিল বটে, তবে দুই দেশের দৃশ্যমান বাস্তবতার বিরাট ফারাক। আমাদের দেশের চলমান বাস্তবতার মোটাদাগের মিল অনেকটা আরব বসন্ত বা আফগানিস্তানের সঙ্গে। ভয়টা এখানেই।

আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা স্পষ্টতই শ্রীলঙ্কার দেখানো পথে হাঁটেননি। বাংলাদেশের ১১০ জন সংসদ সদস্য কারাগারে। কয়েকশ সাংবাদিক হয়েছেন হত্যা মামলার আসামি; কয়েক ডজন কারাগারে। এই মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী সাম্প্রতিক তিন বছরের মধ্যে হাল অর্থবছরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের অর্থ জমা সর্বোচ্চ; গত বছরের চেয়ে ৩৩ শতাংশ ঊর্ধ্বমুখী। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না!

যাই হোক, ভিনদেশি বসন্ত আমাদের কাম্য নয়। ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য নিয়ে আমরা স্বনির্ভর ও সুখী থাকতে চাই। সব আশঙ্কার মুখে চুনকালি মেখে বাংলাদেশ তার অক্ষরেখায় ফিরে আসুক। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধে দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা অবারিত হোক, জনজীবনে নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক, সবার মাঝে স্বস্তি আসুক। আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াক, যেমনটা শ্রীলঙ্কায় ঘটেছে।

আনিসুর রহমান: কবি ও নাট্যকার; সুইডিশ লেখক সংঘের পরিচালনা পরিষদ সদস্য
anisur.rahman@studieframjandet.se
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ