Samakal:
2025-11-03@05:42:07 GMT

এখানে বসা নিষেধ

Published: 3rd, July 2025 GMT

এখানে বসা নিষেধ

নির্বিকার একাডেমির ততদিন পর্যন্ত বেশ ভালোই চলছিল যতদিন না এই অলক্ষুনে লোকটা কোনো সার্টিফিকেট ছাড়াই হাজির হয়েছিল। সার্টিফিকেট তো দূরের কথা, লোকটা একেবারেই বকলম– কোনো নিয়মকানুন না জেনেই সে বড় হয়েছে। তার নাকি কোনো নামই নেই। এসেই কী যে একটা ঝামেলা পাকিয়ে দিল ব্যাটা! লোকটার মাঝে এক অদ্ভুত নীরবতা ছিল। সে কথা বলত না, তর্ক করত না, শুধু বসে থাকত শিরীষ গাছটার ছায়ায়। একাডেমির পাঠ্যক্রমের বাইরে এমন একটা ভাষা ছিল তার চোখে; যা সেখানকার কেউই পড়তে পারত না।
পৃথিবীর এমন একটা দেশের গল্প এটা, যেখানে প্রতিষ্ঠানে যা শেখানো হয় তাকেই চূড়ান্ত সত্য বলে বিবেচনা করা হয়। এ দেশে মানুষ জন্মায় কেবল শেখার জন্যই। মৃত্যুর আগেই সে তার প্রয়োজনীয় সবকিছু শিখে ফেলে, জীবদ্দশায় তা অক্ষরে-অক্ষরে কাজে লাগায়। বাস্তব জীবনে কাজে দেয়– এমন ধরনের শিক্ষাই এখানে সিলেবাসভুক্ত। আর যার হাতে পাঠের এই গুরুভার, তার নামই নির্বিকার একাডেমি।
এটা কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়– এক ধরনের প্রকল্পও। যার মূল উদ্দেশ্য হলো এমন সব প্রজন্ম তৈরি করা; যারা বিনয়ী হবে আর জোটবদ্ধ থাকবে। একাডেমিক ভবনগুলোর মতোই শক্তিশালী এর সিলেবাস– একেবারে প্রাসঙ্গিক আর মূলানুগ। এখানে শেখানো হয় কীভাবে ভাবতে হয় না, কীভাবে প্রশ্নাতীতভাবে বিশ্বাস করতে হয় এবং কীভাবে সন্দেহ আর কৌতূহলের দরজায় চিরস্থায়ীভাবে পেরেক ঠুকে দেওয়া যায়। শিক্ষকগণ এমনভাবে শিক্ষার্থীদের মগজধোলাই করেন যে তারা সিলেবাসের বাইরে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারে না। এই প্রতিষ্ঠানে চর্চার মুখ্য বিষয় হচ্ছে ‘চিন্তাশূন্য অনুসরণ’। ক্লাসে শেখানো হয় ‘তর্ক মানেই ত্রুটি’, ‘উৎসাহ হচ্ছে বিচ্যুতি’, ‘সন্দেহ একটা নৈতিক ব্যাধি’, ‘নিজস্বতা এক ধরনের অলীক কল্পনা’, ‘ভিন্নতা এক ধরনের বিলাসিতা’ আর ‘কর্তৃত্বই চূড়ান্ত সত্য’।
প্রশিক্ষণের সূচনা হয় নিষ্পাপ শিশুদের নিয়ে। শুরুতেই তাদের শেখানো হয় ‘আমি’– নিজেকে চেনার ভাষা। সেই আমিকে তারা চিনতে শেখে একটা কাঠামোর ভেতর দিয়ে। তারপর আসে দ্বিতীয় ধাপ– ‘আমরা’। এই ‘আমরা’ কোনো বন্ধনকে নয়, বরং একটা সম্মিলিত সত্তাকে নির্দেশ করে। শিশুরা শিখে নেয় কীভাবে ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’তে নিজেকে বিলীন করে দিতে হয়। ধীরে-ধীরে ‘আমি’ হয়ে ওঠে এক অপরাধের নাম, এক ধরনের বিপথগামিতা।
পাঠ্যপুস্তকে স্পষ্টভাবে নির্দেশ থাকে– ‘চেনা পথের বাইরে যেয়ো না, হারিয়ে যাবে।’ শিক্ষার্থীরা প্রথম কয়েক বছরেই শিখে যায়– বিকল্প ভাবনা মানেই অনিয়ম, অনিয়মে জন্মায় অস্থিরতা আর অস্থিরতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ধীরে-ধীরে তারা এও শিখে যায়, সবচেয়ে নিরাপদ অবস্থান হলো শ্রোতা হয়ে থাকা আর প্রশ্নহীনভাবে মাথা ঝাঁকানো।
এই একাডেমির সর্বোচ্চ স্বীকৃতির নাম ‘পূর্ণ নির্বিকারতা’। একটা স্বর্ণপদক, সাথে একটা সনদ আর ঠান্ডা একটা মগজ যা আদ্যোপান্ত অনুভূতিহীন। এই মগজ কখনও কাঁদে না, হাসে না, বিস্মিত হয় না, ভালোবাসে না। ‘পূর্ণ নির্বিকারতা’ হলো সেই একাডেমির শিক্ষার্থীদের আরাধ্য এমন এক শিখর যেখানে পৌঁছলে আর কোনো প্রশ্ন থাকে না। আধুনিক বিশ্বের যোগ্য মডেল নাগরিকে রূপান্তর হলেই এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়া যায় আর বিজয়ের মুকুট ছিনিয়ে আনতে হয় কঠোর প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে। এই পুরস্কার কেবল সফলতার নয়, বরং সবচেয়ে দক্ষ শাসনব্যবস্থার শ্রেষ্ঠ হাতিয়াররূপেও স্বীকৃত।
নিশ্ছিদ্র নিয়মে বাঁধা এমন এক বিশুদ্ধতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় যখন আচমকাই এমন একটা অপদার্থের আগমন ঘটে, তখন তা স্বভাবতই পুরো কাঠামোর ভারসাম্য বিপন্ন করে তোলে। সে-কারণে একাডেমির অধ্যক্ষ বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। এই অনধিকার প্রবেশ শিক্ষার্থীদের আচরণে স্খলন ঘটাতে পারে, সে-আশঙ্কায় তিনি দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হলেন। নির্দেশ এলো– প্রত্যেকেই যেন লোকটিকে উপেক্ষা করে, কেউ যেন তার সঙ্গে কোনো কথাবার্তা বা ভাবের আদানপ্রদান না করে। তার বিরুদ্ধে জারি হলো একরকম নিঃশব্দ সামাজিক বয়কট। তবে কেবল ব্যাপারটাকে উপেক্ষাতেই সীমাবদ্ধ রাখা হলো না, তাকে পর্যবেক্ষণেও রাখা হলো– তার চালচলন, কথাবার্তা, কার কাছে সে ঘোরাফেরা করছে,
কী লক্ষ্য তার– এসব নিয়ে নীরব নজরদারি চলতে থাকল। কিন্তু দিন কয়েকেই হাঁপিয়ে উঠল সবাই। লোকটা কোনো কথা তো বলেই না, কারও কাছে তো যায়ই না, কেবল একাডেমিক ভবন ১-এর ডানপাশ দিয়ে বয়ে চলা শান্ত নদীটার ধারের শিরীষ গাছের ছায়ায় ততোধিক শান্ত হয়ে বসে থাকে সে। তবু কেমন অনিয়ন্ত্রিত লাগে। তার এই নিয়মবহির্ভূত উপস্থিতিতে বিরক্তি বাড়তে থাকে। শেষমেশ অধ্যক্ষ নিজেই ঘোষণা করলেন, ‘‘এই ব্যক্তি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিসরে এক ‘পাঠ্যবহির্ভূত প্রক্ষেপ।’’ ফলে একটা বিশেষ অধ্যাদেশও জারি হলো, ‘যে-ব্যক্তি শেখেনি তাকে জিজ্ঞেস কোরো না, কারণ তার নিরুত্তরতা একটি বিক্ষোভ। আর বিক্ষোভ শিক্ষাব্যবস্থায় অবৈধ।’
তবু কিছু ছাত্র গোপনে তার কাছে যেত। সে কোনো শিক্ষক ছিল না, ছিল না পদাধিকারী কেউ; ক্ষমতাবান হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না যে নম্বরের প্রত্যাশায় শিক্ষার্থীরা যাবে তার কাছে। তাকে তো কেউ নিয়োগই দেয়নি! সে-কারণে কেউ-কেউ তাকে প্রত্যাখ্যানও করতে পারেনি। তাই তারা শিরীষ গাছের তলায় যাওয়া শুরু করল। সে কিছু বলত না, তবু তারা শুনত তার চুপ করে থাকার মধ্যে বিশেষ অনুরণন, এমন এক অশ্রুতপূর্ব সংগীত যা স্তব্ধতার দেয়াল ধসিয়ে তাদের শেখাত নতুন এক ভাষা। সে কিছু শেখাত না, তবু তারা শিখত– ‘না শেখা’র সম্ভাবনাকে। এই শিক্ষার্থীরা জানত, তারা কোনো উত্তরের খোঁজে নয়, বরং প্রশ্নের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছে। তারা ধীরে-ধীরে বুঝে ফেলেছিল, শেখার আরেক নাম ভুলে যাওয়া– সেই ‘চোখ বুজে মেনে চলা’র নিয়মাবলি। কোনো শিক্ষা কিংবা নির্দেশনা না দিয়েই, এমনকি একটা বাক্যও না বলে লোকটা তাদের কাছে হয়ে উঠেছিল এক জীবন্ত আয়না, যেখানে তারা আবার ‘আমরা’ থেকে ‘আমি’ হয়ে উঠছিল। তার চুপ করে থাকাটা হয়ে উঠেছিল অজস্র না-বলা কথার জটলা আর তার উপস্থিতি হয়ে উঠেছিল ভিন্ন ধারার আরেক সিলেবাসের উন্মোচন। 
বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেল একসময়। ধীরে-ধীরে ছড়িয়ে পড়ল খবর– কিছু ছাত্র নিয়ম ভেঙে সেই নিষ্কর্মা মানুষটার কাছে যাচ্ছে। সে কিছু শেখাচ্ছে না, অথচ শিক্ষার্থীরা শিখে নিচ্ছে। কথা না বললেও অনেক কিছু নাকি শোনা যায় তার কাছ থেকে। এ দেখি মহাবিপদ! নড়েচড়ে বসল পুরো প্রতিষ্ঠান। ঘটনাটির নাম দেওয়া হলো ‘নীরব যোগাযোগ’। এজন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর কমিটি রিপোর্ট পেশ করল, ‘এই নীরব যোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের জন্য হুমকিস্বরূপ।’
শিক্ষার্থীদের পথে ফেরাতে ‘ভ্রান্ত অভিভাষণ তত্ত্ব’ নামে নতুন কোর্স চালু হলো। নীরবতা, চোখের ভাষা ইত্যাদির প্রতিকার কীভাবে করা যায় তার পদ্ধতি শেখানোই ছিল এই কোর্সের উদ্দেশ্য। শিক্ষার্থীদের শেখানো হলো– চোখে চোখ রাখা বিপজ্জনক, নীরবতা সন্দেহজনক আর অনুভব মানেই অবাধ্যতা। জানালাবিহীন ঘরে চলতে থাকল প্রশিক্ষণ। প্রতিষ্ঠান ভাবল, সবকিছু আবার নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে। কিন্তু ততদিনে সমস্যার শেকড় অনেক গভীরে পৌঁছে গেছে। সেই অশিক্ষিত মানুষটার নিঃশব্দ উপস্থিতি শিক্ষার্থীদের সুসংহত মগজে একটা সূক্ষ্ম ছিদ্র তৈরি করে ফেলেছে এর মধ্যেই। আর ঠিক সেই ছিদ্রপথ দিয়েই প্রবেশ করেছে ভাবনার বীজ, যদিও তা ভুল ভাবনা। কী ভাবতে হবে তা তারা শিখছিল না, বরং শিখছিল কীভাবে ভাবা যায়– ভুলভাল ভাবনা হলেও। আর এই ভুলভাল ভাবার অধিকারই ছিল একাডেমির চোখে সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ ভুল ভাবনা মানে প্রশ্ন আর অনিশ্চয়তা যা একবার জন্মালে ইহজগতে আর দমন করা যায় না। এই একটুখানি ফাঁকই প্রতিষ্ঠানের শতাব্দীপ্রাচীন কাঠামোকে কাঁপিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট হয়ে উঠছিল।
পরিস্থিতি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে জরুরি ভিত্তিতে একটি সভা ডাকা হলো। একাডেমি তার শীতল আর ধাতব নীরবতা ভেঙে হঠাৎ এক অশরীরী আলোড়নের মুখোমুখি হলো যেন। সভাকক্ষে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা, উদ্বেগ আর অজানা শঙ্কা নিয়ে নীতিনির্ধারকেরা বসে আছেন। মেজাজ হারিয়ে, সংযম ভেঙে অধ্যক্ষ স্পষ্ট ও কঠিন সুরে বললেন, ‘‘আমাদের এখনই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শিক্ষার মান ও বিশুদ্ধতার ঐতিহ্য যদি আমরা রক্ষা না করি তবে আমাদের ওপর চেপে বসবে ‘মূর্খের অজ্ঞতা’। এই একাডেমি হয়ে উঠবে চিন্তার শৃঙ্খলার বদলে বিকারগ্রস্তের উন্মাদনার ক্ষেত্র।”
এই ঘোষণার পর প্রশাসনিক মহল থেকে পরবর্তী দিকনির্দেশনা এলো– লোকটিকে আর সহ্য করা যাবে না, তাকে সরিয়ে ফেলতেই হবে। তবে শুধু শারীরিকভাবে অপসারণ নয়– তার অস্তিত্ব, স্মৃতি, এমনকি তার নামটুকুও মুছে ফেলতে হবে একাডেমির সামগ্রিক তথ্যব্যবস্থা থেকে। তাকে দেখানো হলো এক আত্মবিধ্বংসী ব্যক্তিত্ব হিসেবে, যে নিজের পাশাপাশি পরিবেশকেও ধ্বংস করে দেয়। সেই যুক্তিতে তার উপস্থিতি ধরা হলো এমন একটা ভাইরাসের মতো যা একাডেমির কাঠামোতে ঢুকে পড়ে তার নীতিনৈতিকতাকে ধ্বংস করছে প্রতিনিয়ত। তার নাম, পরিচয়, রেজিস্ট্রেশন নম্বর– যেগুলো পরবর্তীকালে শিক্ষার্থীদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল– সবকিছু নিখুঁতভাবে মুছে ফেলা হলো সমস্ত ডেটাবেজ থেকে, যেন সে কখনোই ছিল না। তার উপস্থিতিকে ‘মায়াজাল’ হিসেবে ঘোষণা করা হলো। যেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী অর্থাৎ গোটা একাডেমি মিলে এক জাদুর ফাঁদে আটকা পড়ে গিয়েছিল– যে-জাদু কেটে এখন তারা মুক্ত।
কিন্তু বিলয়ের পরেও লোকটার উপস্থিতি বিলীন হলো না– কোথায় যেন রেশ রয়ে গেল তার! তার শূন্যতা, তার নীরবতা, তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণার কারণ– এসবই ধীরে-ধীরে পাঠের বাইরের পাঠ হয়ে উঠতে লাগল। বহু ছাত্র এখন ক্লাসে প্রশ্ন করে, ‘‘এই যে ‘কেউ ছিল না’, সে তো আমাদের চিন্তা করার ইচ্ছেটুকু দিয়েছিল, তা-ই না?’’
শিক্ষকেরা চুপ থাকেন। কারণ, সিলেবাসে এর কোনো উত্তর নেই। একাডেমি পড়ল মহাবিপদে। ছাত্রদের ভেতরে যে-ক্ষীণ চিন্তার রেখা অঙ্কিত হচ্ছিল, তাকে আর হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। কেননা, সেটা দিনদিন কেমন যেন ছোঁয়াচে হয়ে উঠছিল। একই রকম প্রশ্ন করছিল করছিল পাশের শিক্ষার্থীও। বলছিল, ‘চিন্তা কেন করা যাবে না?’ সেই নীরব মানুষটার সেই নিঃশব্দ আর ভুল শিক্ষা শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার উৎসাহ জোগাচ্ছিল ধীরে-ধীরে।
ব্যাপারটাকে ভয়ংকর হুমকি হিসেবে দেখল একাডেমি, তারপর মরিয়া হয়ে গ্রহণ করল সেই সিদ্ধান্ত যা একেবারে দেয়ালে পিঠ ঠেকে না গেলে কর্তৃপক্ষ নেয় না। তারা প্রয়োগ করল তাদের সর্বশেষ অস্ত্র–আবেগ-নিরাময় ডোজ। এটা ছিল শৃঙ্খলা ফেরাতে একাডেমির চূড়ান্ত পদক্ষেপ। এটা এক ধরনের ইনজেকশন; যা মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়ার কেন্দ্রগুলোকে চিরতরে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এর প্রভাবে হারিয়ে যায় উত্তেজনা, উদ্বেগ, বিস্ময়, প্রেম, ভয় কিংবা কৌতূহলের মতো মৌলিক অনুভূতিগুলো।
দেওয়া হলো ডোজ। যাক, শান্তি! কর্তৃপক্ষ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। একাডেমি যেন দীর্ঘ এক দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠল। শৃঙ্খলা ফিরে এলো সব জায়গায়। ক্লাসরুমগুলো নিঃশব্দ, করিডোরে সীমিত চলাফেরা, লাইব্রেরিতে শুধুই সিলেবাসভিত্তিক বই এবং শিক্ষার্থীদের চোখে নেই আর কোনো অনাহুত দীপ্তি। এখন আর কেউ এমন প্রশ্ন করে না যার উত্তর সিলেবাসে নেই।
তবু চলতে ফিরতে হঠাৎ-হঠাৎ দেখা যায়, শিরীষ গাছটার ছায়ায় কেউ একজন এখনও বসে থাকে– অদৃশ্য আর নিস্তব্ধ। নতুন ছাত্রদের কাছে সে-ব্যক্তি এক রহস্যময় সত্তা, যার নাম কেউ জানে না, যার মুখ কেউ চেনে না। তারা শুধু শুনেছে, গাছটির ছায়ায় বসা নিষেধ এবং নিষেধ অমান্য করার শাস্তি সম্পর্কে তাদের সতর্ক করা হয়েছে।
এখনও কিছু-কিছু ঝিম-মারা দুপুরে, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে একজন-দুজন যায় শিরীষ গাছটার তলায়; যদিও তারাও জানে যে এখানে বসা নিষেধ। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গল প র উপস থ ত এক ধরন র এমন একট এক ড ম র ব যবস থ এমন এক র জন য ন রবত

এছাড়াও পড়ুন:

বিএনপি ও জামায়াতের কাছে কেন আরপিওর ২১ ধারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল

নির্বাচনের আগেই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এ নিয়ে গত ছয় দিনে দল দুটির পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যেই নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন আরপিওর ২১ ধারার সংশোধনীর পরিবর্তন। জামায়াত মনে করে, সরকার বিএনপির চাপে নতি স্বীকার করে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত খসড়া সংশোধনী বাতিল করেছে। আর বিএনপি মনে করে, জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সরকার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশের খসড়ায় ২১ ধারার পরিবর্তন করে; যা গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদিত হয়। আরপিওর ২১ ধারা সংশোধনীর ওই পরিবর্তন বহাল থাকলে কোনো দল জোটগত নির্বাচন করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে বাধ্য ছিল। ৩০ অক্টোবর সেটি আবার পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত হয়। তাতে জোটগত নির্বাচন করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা থাকছে না। এতে জামায়াত বেশ ক্ষুব্ধ হয়।

যদিও সরকারের দিক থেকে এই নতুন সিদ্ধান্তের তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে সরকার-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সেটি শুধু বিএনপির দাবির কারণে নয়, ছোট বিভিন্ন দলেরও দাবি ছিল।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার নিশ্চিত করেছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবেই। আমরা সরকারের কথায় বিশ্বাস করি। সুতরাং এখন থেকে আমাদের সব কার্যক্রম নির্বাচনকেন্দ্রিক। এখন সরকার তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কীভাবে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে, সেটি তাদের বিষয়। তবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারকে যতটুকু সহযোগিতা দেওয়া দরকার, সেটা বিএনপি করবে।’

বাংলাদেশের শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যতই সময় যাচ্ছে...একটা পুরোপুরি নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চলছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

এ দিকে আজ সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির নিয়মিত সভা হবে। তবে অন্য দিন রাতে সভা হলেও আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় সভা বসবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আজকের সভায় আলোচ্যসূচিতে প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করার বিষয় থাকবে। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন–সংক্রান্ত বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে।

হঠাৎ কেন সামনে এল আরপিওর সংশোধনী

আরপিওর ২১ ধারার সংশোধন বিএনপি ও জামায়াতের কাছে হঠাৎ করে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫–এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন হয়। আরপিওর ২১ ধারার এই সংশোধনীর ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো। এতে জামায়াত খুশি হলেও বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো অস্বস্তিতে পড়েছিল। এ কারণে এর পরিবর্তন চেয়ে বিএনপি নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও আইন উপদেষ্টাকে পৃথক চিঠি দেয়। এর পরেই সরকার আরপিওর ২১ ধারার পরিবর্তন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, নতুন সিদ্ধান্তে বিএনপি উপকৃত হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো, এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ভোটের হিসাব-নিকাশে ক্ষতিগ্রস্ত হতো বিএনপি। অন্য দিকে এতে লাভবান হয় জামায়াতসহ তার মিত্র দলগুলো। এর হিসাবটা হচ্ছে, ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আছে একসঙ্গে নির্বাচন করার জন্য এবং সংসদ সদস্য পদে জোটের প্রার্থী হওয়ার আশায়। সে ক্ষেত্রে বিএনপির ‘ধানের শীষ’ প্রতীককে ছোট দলগুলোর নেতারা জয়ের ক্ষেত্রে ‘ভরসা’ হিসেবে দেখেন।

...যে কারণে ফ্যাসিজমের যে রাস্তা, আমরা সংস্কারে বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, এগুলো ওনারা বন্ধ করতে দিচ্ছে না। সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের নায়েবে আমির, জামায়াত

এখন জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হলে ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করতে খুব আগ্রহী হবে না। এর কারণ দুটি। প্রথমত, বিএনপির সমর্থন পেলেও ব্যক্তি জনপ্রিয়তা না থাকলে ছোট দলগুলোর নেতাদের নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে জেতা কঠিন হয়ে পড়বে। অন্য দিকে জোটের প্রার্থী হিসেবে বিএনপি আসন ছাড় দিলেও দলের কেউ বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলে ভোটে জেতা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে বিদ্রোহীকে সরাতে বিএনপির নেতৃত্ব কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সে প্রশ্নও আছে।

এ ছাড়া এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতে যে আটটি দল আছে, তারা আরপিওর ওই ধারা পরিবর্তনের পক্ষে। অর্থাৎ দলগুলো জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে—এর পক্ষে। এর জন্য দলগুলো যৌথ কর্মসূচিও করছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জামায়াত যে নির্বাচনী জোট বা নির্বাচনী সমঝোতা করতে চাইছে, সে দলগুলো পরস্পর আস্থাশীল। তাদের কাছে ‘দাঁড়িপাল্লা’ বা ‘হাতপাখা’ বা ‘রিকশা’ প্রতীক কোনো বিষয় নয়। সমঝোতা হলে সবাই ওই প্রতীকের পক্ষে এক হয়ে কাজ করবে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা নেই। অন্যদিকে বিএনপির জোটের ক্ষেত্রে ভাবনা হচ্ছে, ধানের শীর্ষ প্রতীক না দিলে ভোটের আগেই আসন হারানোর আশঙ্কা থাকবে।

গতকাল সকালে এক বিবৃতিতে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার দাবি করেন, একটি দলের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে সরকার আরপিওর সর্বশেষ সংশোধনী বাতিল করেছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) বাতিল করা হলে সেটি ন্যক্কারজনক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হবে।

আরপিওর ২১ ধারার এই সংশোধনীর ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো। এতে জামায়াত খুশি হলেও বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো অস্বস্তিতে পড়েছিল। এ কারণে এর পরিবর্তন চেয়ে বিএনপি নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও আইন উপদেষ্টাকে পৃথক চিঠি দেয়।

ঐকমত্য কমিশন সুপারিশের পর থেকেই উত্তাপ

২৮ অক্টোবর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সুপারিশ জমা দেয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে—সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। এই সময়ের মধ্যে সংবিধান সংশোধন না করলে আপনা–আপনি সেটা সংবিধানে যুক্ত হবে। এ ছাড়া গণভোট কবে, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিন নাকি তার আগে—সেটা ঠিক করবে সরকার।

চরম অনৈক্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত ছিল, তারা কীভাবে হারানো ঐক্য ফিরে পেতে পারে, সেটি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা দরকার।অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ

বিএনপি প্রথমত ক্ষুব্ধ হয় বাস্তবায়নের সুপারিশ থেকে ভিন্নমত বাদ দেওয়ায়। এ ছাড়া সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন, ২৭০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া, সেটা না হলে আপনা-আপনি সংবিধানে যুক্ত হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে দলটির আপত্তি আছে। দলটি গণভোট আগে নয়, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে চায়। জামায়াতের অবস্থান এর পুরো বিপরীত।

এসব নিয়ে পরস্পরকে লক্ষ্য করে দল দুটির রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতি ক্রমেই বাড়তে থাকে। জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে এটা আসছে যে জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এমন বক্তব্য অবশ্য বিএনপি আরও আগে থেকেই দিয়ে আসছে।

গতকাল দুপুরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা দেখছি যে বাংলাদেশের শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যতই সময় যাচ্ছে, ততই বাংলাদেশে একটা অ্যানার্কিক সিচুয়েশন, একটা পুরোপুরি নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চলছে।’

জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে এটা আসছে যে জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এমন বক্তব্য অবশ্য বিএনপি আরও আগে থেকেই দিয়ে আসছে।

এর আগের দিন শনিবার বিএনপির মহাসচিব জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নির্বাচনকে যতটা বাধা সৃষ্টি করেছেন, সেটা আপনারা করেছেন।’

পাল্টা বক্তব্য এসেছে জামায়াতের দিক থেকেও। দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের গতকাল বিকেলে ঢাকায় এক সেমিনারে বলেছেন, ‘বিএনপি ভেতরে-ভেতরে আবার ফ্যাসিস্ট হওয়ার একটা খায়েশ আছে মনে হচ্ছে। যে কারণে ফ্যাসিজমের যে রাস্তা, আমরা সংস্কারে বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, এগুলো ওনারা বন্ধ করতে দিচ্ছেন না।’

অবশ্য সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে বিএনপিকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপি যতই উসকানি দিক, জামায়াত বিএনপির সঙ্গে বিরোধে জড়াতে চায় না। মানুষের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক আছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দূর করে স্পষ্ট করা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। সুতরাং আসুন আমরা সব ভুলে আলোচনায় বসি।’

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে এই মুখোমুখি অবস্থা চলতে থাকলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে। অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, একটা চরম অনৈক্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত ছিল, তারা কীভাবে হারানো ঐক্য ফিরে পেতে পারে, সেটি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা দরকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ