পেরুর ইনকা ট্রেইলের প্রাইভেট এ ক্যাম্পসাইটটি আদিবাসী কেচোয়া কৌমের গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে, গাছপালায় সমাচ্ছন্ন বনানীতে। গোত্রপতি গোছের মানুষজন এখানে তাঁবু প্রভৃতি খাটানোর বন্দোবস্ত করে দেন বটে, তবে তারা চান না, পর্যটকরা তাদের গ্রামে আওয়ারা ঘুরে বেড়াক, কিংবা কারণে অকারণে সেলফিতে ছবি তুলে আমোদ পাক। সাইটটি ইনারা চালাচ্ছেন সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে। মুসাফিরদের নিরাপত্তা এরা বিধান করেন বটে, তবে পোর্টার-মারফত বয়ে আনা তাঁবু যেমন খাটানো যায় না, তেমনি নিজ উদ্যোগে রান্নাবান্না করাটাও সম্পূর্ণ নিষেধ। সুতরাং তাদের খাটানো তাঁবু ভাড়া করে বিশ্রাম করতে করতে ইনতেজার করতে হয়, কখন আদিবাসীদের হেঁশেল থেকে জোগান দেওয়া হবে খানাপিনার।

আজও আমরা প্রত্যাশিত যাত্রাপথের অর্ধেকটা অতিক্রম করেছি। বনানীর আবডালে আব্রু করা তাঁবুতে তাঁবুতে, সাফসুতরো বিছানাপত্তর দেখতে পেয়ে আমার সহযাত্রীরা ঝিমিয়ে নিচ্ছেন। ভ্রমণসঙ্গী কেভিনের টেন্ট থেকে শোনা যাচ্ছে, অনুনাসিক স্বরে নাক ডাকানোর অনুচ্চ শব্দ। অন্য ভ্রমণসাথি গ্রেইসও পদ্মাসনে বসে বোধ করি মেডিটেশনের পুষ্পক রথে পাড়ি দিচ্ছে, মহাশূন্যের অলীক কোনো তেপান্তর।

না, বিশ্রাম নিতে পারি না আমি। সমগ্র সত্তাজুড়ে জলবিছুটির প্রদাহের মতো অজানা এক অস্থিরতা আমাকে উত্যক্ত করলে, চুপিসারে বেরিয়ে আসি টেন্টের বাইরে। চরাচরে হালকা রোদ, আকাশে মৃদুলয়ে ভেসে যাচ্ছে নীলচে-সাদা মেঘদল, তাতে ঝোপ-ঝাড়ে চলমান ছায়া যেন বুলাচ্ছে কালচে-ধূসর চামর; সন্ধ্যার এখনো ঢের বাকি।

অপরাহ্ণের তামা ঝলসানো রুশনিতে ছুটির ঘণ্টা পড়া বালক-বালিকাদের মতো কলকল করে ফুটে ওঠছে চারদিকে, মিরাবিলিস জালাপা নামে এক ধরনের বর্ণিল ফুল। পাশ্চাত্যের উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা এ পুষ্পের আদিনিবাস হিসাবে পেরুকে শনাক্ত করে উনিশ শতকের পয়লা দিকে এর নামকরণ করেছিলেন ‘মার্ভেল অব পেরু’ বলে, ঠিক বুঝতে পারি না—কোন প্রক্রিয়ায়, কার জাহাজে চড়ে এটি আমার স্বদেশে এসে রূপান্তরিত হলো সন্ধ্যামালতীতে।

একসাথে হাজারখানেক সন্ধ্যমালতীর কোরক বিষ্ফোরিত হয়ে ফুটে ওঠার সন্মোহনে আমার তব্দা লেগে যাওয়ার উপক্রম হয়! দেখতে দেখতে এদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে, আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বেরিয়ে আসা বিপ্লবী গেরিলাদের মতো এক ঝাঁক প্রজাপতি। এরা অ্যাগ্রেসিভভাবে হুল ফুটিয়ে সংগ্রহ করছে মধুরিম নেক্টার। একাকী বসে বসে হুলভারে প্রকম্পিত ফুলদলের দিকে খামোকা চেয়ে থাকতে ভালো লাগে না। ইচ্ছা হয় পুরো এলাকাটা ঘুরেফিরে চষে ফেলতে। আমার অস্থিমজ্জা ও পেশিতে চনমনে এনার্জির অনুরণন টের পেয়ে সচেতন হই যে, ঘণ্টাখানেক আগে কেভিনের দেওয়া ডেকসিড্রিন ড্রাগটি শোণিতে তৎপর হয়ে উঠেছে, অর্থাৎ আপাতত বিশ্রাম নেওয়া যাবে না, আই মাস্ট বি ডুয়িং সামথিং।

ভাবি, খানিকটা সামনে হেঁটে গিয়ে স্প্যানিশ নারী এল-নোরাকে হ্যালো বলা যায়। এ ক্যাম্পসাইটে ঢোকার মুখে তাকে তাঁবুর দোরগোড়ায় বসে থাকতে দেখেছি, তার ডার্ক চকোলেটের সাপ্লাই ফুরিয়েছে, কয়েকটি চকোলেট-বার নিয়ে গেলে সম্পর্ক মজবুত হয়।

ওর সঙ্গে মিলেঝুলে আমি লিমা নগরীতে ওয়ারি গোত্রের নির্মিত একটি পিরামিড দেখতে গিয়েছিলাম। তখন কথাবার্তায় জানতে পারি, এল-নোরা মাদ্রিদ পুলিশের ক্রাইম ডিপার্টমেন্টে স্কেচ আর্টিস্ট হিসাবে কাজ করছে। অপরাধীদের বর্ণনা শুনে সে কম্পিউটার স্ক্রিনে ফুটিয়ে তুলতে পারে তাদের মুখচ্ছবি।

এ ধরনের চাকুরীতে ঝুঁকি অনেক এবং স্ট্রেসও প্রচুর। চাপ প্রবল হলে এল-নোরা কোনো না কোনো দেশে বেড়াতে যায়। আজকাল ঘুরে বেড়ানোর বিবরণ দিয়ে সে ট্রাভেল এথনোগ্রাফি ধাঁচের গবেষণা-ভিত্তিক ভ্রমণগদ্যও লিখতে শুরু করেছে। তুরস্কের কাপাডোকিয়া অঞ্চলে ভ্রমণ নিয়ে সে একটি লেখার ড্রাফট আমাকে পড়তে দিয়েছে। আমি ব্যাকপ্যাকে তা পুরে নিয়ে উঠে পড়ি।

হাঁটতে হাঁটতে আমি এল-নোরার নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ও তার পরিবারের আদিনিবাস নিয়ে ভাবি। সাংস্কৃতিক পরিচয়ে এল-নোরা স্পেনের বাস্ক্ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। ইউরোপের বাস্ক্ নৃগোষ্ঠীর মানুষজন বসবাস করে, স্পেন ও ফ্রান্সে বিস্তৃত পিরোনিজ পর্বতমালার পাদদেশে। এল-নোরার প্রপিতামহের পারিবারিক বাড়িটি ছিল ‘গোয়েরনিকা’ নামক একটি ছোট্ট শহরে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার বছর দুয়েক আগে, স্পেন দেশে স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্র্যাংকোর বিরুদ্ধে দানা বেঁধেছিল তুমুল প্রতিরোধ। এ গৃহযুদ্ধে ফ্র্যাংকোর সহায়তায় এগিয়ে আসে হিটলারের নাৎসি বাহিনী। তারা প্রতিরোধে শরিক হওয়া, স্বাধিকার-প্রিয় বাস্ক্দের ‘সমুচিত শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য বেসামরিক শহর গোয়ারনিকায় বর্ষণ করে বেধড়ক হারে বোমা, তাতে নিহত হয়েছিল ১,৬৪৫ এবং আহত হয়েছিল ৮৮৯ জন মানুষ। এদের অন্তর্ভুক্ত ছিল এল-নোরার পরিবারে তার পিতামহসহ মোট তিনজন নিকটাত্মীয় ও তাদের পাড়ার ৫৭ জন বাস্ক্ মানুষ।

যুদ্ধ-বিরোধিতার আইকন হিসাবে পরিচিত, পাবলো পিকাসোর (১৮৮১-১৯৭৩) আঁকা চিত্রকর্ম ‘গোয়ারনিকার’ সঙ্গে অনেক বছর ধরে আমার পরিচয়। এ নামে বাস্ক্ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত একটি শহরের কথাও শুনেছিলাম, ওখানকার কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হবে, তা কখনো কল্পনাও করিনি।

তাঁবুতে বসে এল-নোরা.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এল ন র

এছাড়াও পড়ুন:

আজ টিভিতে যা দেখবেন (১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫)

এশিয়া কাপে আজ মুখোমুখি শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তান। চ্যাম্পিয়নস লিগে মাঠে নামবে ম্যানচেস্টার সিটি, নাপোলি, বার্সেলোনা।

সিপিএল: কোয়ালিফায়ার-১

গায়ানা-সেন্ট লুসিয়া
সকাল ৬টা, স্টার স্পোর্টস ২

এশিয়া কাপ ক্রিকেট

আফগানিস্তান-শ্রীলঙ্কা
রাত ৮-৩০ মি., টি স্পোর্টস ও নাগরিক

অ্যাথলেটিকস

বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ
বেলা ৩টা, স্টার স্পোর্টস সিলেক্ট ১

উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ

কোপেনহেগেন-লেভারকুসেন
রাত ১০-৪৫ মি., সনি স্পোর্টস ২

ম্যানচেস্টার সিটি-নাপোলি
রাত ১টা, সনি স্পোর্টস ১

নিউক্যাসল-বার্সেলোনা
রাত ১টা, সনি স্পোর্টস ২

ফ্রাঙ্কফুর্ট-গালাতাসারাই
রাত ১টা, সনি স্পোর্টস ৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ