রংপুরে হামলার শিকার পরিবারগুলো আতঙ্কে, বাড়ির মালামাল সরিয়ে নিচ্ছে
Published: 28th, July 2025 GMT
রংপুরের গঙ্গাচড়ায় মহানবী হজরত মুহাম্মদকে (সা.) কটূক্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার এক কিশোরের বাড়িসহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ১৪টি বসতঘরে হামলা ও ভাঙচুরের পর পুরো এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে।
আজ সোমবার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, হামলার শিকার পরিবারগুলোর ঘরবাড়ি লন্ডভন্ড। আতঙ্কে পরিবারগুলো গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি ও অন্য মালামাল ভ্যানে করে সরিয়ে নিচ্ছেন। অনেকে গরু, ছাগল ও ধান বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। আলদাদপুর নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ও ভেতরে অবস্থান করছে সেনাবাহিনী। কাছাকাছি খিলালগঞ্জ বাজারেও পুলিশ ও সেনা সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে।
গঙ্গাচড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল এমরান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ওই কিশোর ফেসবুকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার রাত আটটার দিকে কিশোরকে থানায় নেওয়ার পর তার বিচারের দাবিতে উত্তেজিত জনতা মিছিল নিয়ে তার বাড়ির সামনে যায়। রাত ১০টার দিকে দ্বিতীয় আরেকটি মিছিল এসে তার এক স্বজনের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, গতকাল রোববার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আবারও উত্তেজিত জনতা কয়েকটি বাড়িঘরে হামলা চালায়। পুলিশ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে সংঘর্ষ হয় এবং এতে পুলিশের এক কনস্টেবল গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
কথা হয় কমলাকান্ত রায় নামের এক বাসিন্দার সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁরা সারা রাত ঘুমাননি। সকাল থেকে বাড়ির মালপত্র সরাচ্ছেন। ১০-১২ মণ ধান ছিল। সেগুলো বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছেন। কমলাকান্তের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন নারী জানান, তারাগঞ্জ থেকে তারা স্বজনদের দেখতে এসেছেন। তবে নাম প্রকাশ করতে চাননি। একজন বলেন, ‘ওরা না খেয়ে আছে। ভাত খাওয়ানোর কথা বললে বলে, ভেতরে ভাত যাইব না।’
হামলার শিকার পরিবারগুলো বলছে, বাড়িঘর ভাঙচুরের পাশাপাশি তাদের মালামাল লুট হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ রায় নামের একজন বলেন, তাঁর স্ত্রীর এক ভরি স্বর্ণ কাপড়-চোপড় ও জমির কাগজপত্র লুট হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে কথা হয় তাঁর স্ত্রী রোহেলা রানীর সঙ্গে। তিনি বলেন, যদি আবার আগুন দেয়, তবে আর কিছু থাকবে না। কাঁথা-বালিশ, তোশক—সব তাঁর ভাই নিয়ে গেছে। হরিশচন্দ্র বলেন, এখানে তাঁর শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়িতে গরু-ছাগল পালন করা হতো। এখন গন্ডগোলের কারণে চন্দনপাটে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন।
সকাল থেকে বাড়ির মালপত্র সরাচ্ছেন তারাউৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ