মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক–খড়্গের মুখেও অনড় অবস্থানে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দেশবাসীকে স্থানীয় পণ্য কেনার আহ্বান জানিয়ে তাঁর প্রশাসন ইঙ্গিত দিয়েছে, রাশিয়া থেকে তেল কেনা অব্যাহত থাকবে।

ব্লুমবার্গকে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ভারতীয় তেল শোধনাগারগুলোকে রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধের নির্দেশনা দেয়নি মোদি সরকার। কেনা বন্ধ করা হবে কি না, তা নিয়েও এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সরকারি ও বেসরকারি—দুই ধরনের শোধনাগারই নিজেদের পছন্দমতো উৎস থেকে তেল কেনার অনুমতি পায়। অপরিশোধিত তেল কেনার সিদ্ধান্ত হয় মূলত বাণিজ্যিক বিবেচনা থেকে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। খবর ইনোকমিক টাইমসের

গত সপ্তাহে ভারতীয় রপ্তানিপণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর নানা জল্পনা–কল্পনা চলছে। গত সপ্তাহের শেষভাগে উত্তর প্রদেশের এক সমাবেশে মোদি বলেন, অনিশ্চিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা জরুরি। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতিতে নানা শঙ্কা বিরাজ করছে—একধরনের অস্থিরতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এখন থেকে আমরা যা-ই কিনব, তার একটাই মানদণ্ড হবে—ঘাম ঝরিয়ে কোনো ভারতীয় যা তৈরি করেছে, আমরা তা–ই কিনব।’

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ইউক্রেনে যুদ্ধ শেষ করতে চাপ দিতে গিয়ে ট্রাম্পের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে ভারত। গত সপ্তাহে ট্রাম্প ভারতকে তীব্র সমালোচনা করে বলেন, দেশটি ব্রিকস জোটে যুক্ত হয়েছে এবং রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখছে—‘তারা চাইলে একসঙ্গে নিজেদের মৃত অর্থনীতি ডুবিয়ে দিতে পারে।’

এ মন্তব্যের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে নাটকীয় পরিবর্তন দেখা গেছে। এত দিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় চীনের প্রভাব মোকাবিলায় ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে গিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ক উপেক্ষা করে এসেছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে ব্যর্থ হয়ে পুতিনের ওপর চাপ বাড়াতে ট্রাম্প সেই কৌশল ত্যাগ করতেও প্রস্তুত।

গতকাল রোববার ট্রাম্পের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ স্টিফেন মিলার অভিযোগ করেন, ভারত মার্কিন পণ্যে ‘বিপুল’ শুল্ক আরোপ করছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসনব্যবস্থার সঙ্গে ভারত ‘প্রতারণা’ করেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

মিলারের ভাষ্য, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক চান এবং সব সময়ই ভারতের সঙ্গে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে, তাঁর অসাধারণ সম্পর্ক ছিল। তবে আমাদের বাস্তবতায় ফিরতে হবে—এ যুদ্ধের অর্থায়ন মোকাবিলা করতেই হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধ নিয়ে কূটনৈতিক, আর্থিক বা অন্য সব ধরনের পদক্ষেপই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিবেচনায় আছে—শান্তি প্রতিষ্ঠাই আমাদের লক্ষ্য।’

গত সপ্তাহে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ‘শুনেছেন, ভারত আর রাশিয়া থেকে তেল কিনবে না’—তাঁর ভাষায় এটি ‘ভালো পদক্ষেপ’। ব্লুমবার্গের খবরে বলা হয়, তেল শোধনাগারগুলোকে বিকল্প উৎস থেকে কেনার পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, এটি ছিল মূলত সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি—যদি রুশ তেল অপ্রাপ্য হয়ে পড়ে, সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি।

বাজার–বিশেষজ্ঞ সংস্থা কেপলারের পরিসংখ্যান বলছে, জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে ভারত রাশিয়া থেকে কম তেল আনলেও তার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের হুমকির সম্পর্ক নেই। প্রতিবছরই বর্ষার সময়ে রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যা ও বৃষ্টির জন্য চাহিদা কমে যায়, আর সে কারণে তেল কেনা কমায় নয়াদিল্লি। চলতি বছরেও তা করা হয়েছে। তবে বেসরকারি সংস্থার থেকে সরকারি সংস্থাগুলোর তেল আমদানি বেশি হারে কমে যাওয়ায় বিষয়টি অনেকের চোখেই লেগেছে। বিষয়টিকে অনেকেই মার্কিন হুমকির ‘ফল’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। কিন্তু বিষয়টি ঘটেছে পুরো জুলাই মাস ধরে, যেখানে ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন জুলাইয়ের শেষ প্রান্তে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের সামনে এখন দুই ধরনের বিপদ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট চান না ভারত মস্কো থেকে তেল আনুক। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পক্ষ থেকে আগামী বছর জানুয়ারি থেকে যে নিষেধাজ্ঞা চালু করার কথা রয়েছে, তাতে হয় ভারতকে রুশ তেল কেনা বন্ধ করতে হবে, না হলে ইউরোপ ছেড়ে বিকল্প বাজারের সন্ধান করতে হবে। এতে ভারতের তেল আমদানি ব্যয় অনেকটা বেড়ে যেতে পারে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

গুলিতে নিহত ছেলের জামা-জুতা আগলে দিন কাটে নাছিমার

ছেলে সাদ আল আফনানের কথা উঠলেই নাছিমা আক্তারের চোখ পানিতে টলমল হয়ে উঠে। একমাত্র ছেলেটি নেই, তা যেন ভাবতে পারেন না তিনি। ঘরে থাকা ছেলের বই-খাতা, জামাকাপড়, জুতা সবকিছুই যত্নে সাজিয়ে রেখেছেন। এসব নিয়েই দিন কাটে তাঁর।

গত বছরের ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সাদ আল আফনান (১৯)। ওই দিন কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে পুরো লক্ষ্মীপুর শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে নিহত হন ৪ শিক্ষার্থীসহ ১২ জন, আহত হন শতাধিক ব্যক্তি। টানা ছয় ঘণ্টা ধরে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করেন তৎকালীন সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সালাহ উদ্দিনসহ তাঁর বাহিনী।

নিহত আফনান লক্ষ্মীপুর ভিক্টোরি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি লক্ষ্মীপুর শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে। আফনান নিহত হওয়ার মাত্র দুই মাস আগেই অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয় নাছিমার স্বামী সালেহ আহমেদের। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেকে ঘিরেই ছিল নাছিমার জগৎ। তবে স্বামীর মৃত্যুশোক না কাটতেই হারাতে হয় ছেলেকেও।

ওর রুমটা আমি ঠিক আগের মতোই রাখি। ওর বইগুলো, ওর জামাটা, এমনকি ওর শেষ পরা স্যান্ডেলটাও। জানি, আমার ছেলেটা আর আসবে না, তবু মন মানে না, বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে।নাছিমা আক্তার, সাদ আল আফনানের মা

সম্প্রতি বাড়িতে গিয়ে কথা হয় নাছিমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, একাকী ঘরে ছেলের জামাকাপড়, বই খাতা নিয়ে বেশির ভাগ সময় কাটে তাঁর। ছেলের ব্যবহৃত জিনিসগুলো যত্নের সঙ্গে ঘরে সাজিয়ে রেখেছেন। ছেলে নেই, তা ভাবতে পারেন না তিনি। কাঁদতে কাঁদতে নাছিমা বলেন, ‘রাত হলে বুক ফেটে কান্না আসে। চোখে ঘুম আসে না। প্রতিদিন ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুতে হয়। ছেলের ছবিটা বুকে নিয়ে রাত কাটে’।

নাছিমা আরও বলেন, ‘ওর রুমটা আমি ঠিক আগের মতোই রাখি। ওর বইগুলো, ওর জামাটা, এমনকি ওর শেষ পরা স্যান্ডেলটাও। জানি, আমার ছেলেটা আর আসবে না, তবু মন মানে না, বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে।’

গত বছরের ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুরে গুলিতে নিহত অন্য তিন শিক্ষার্থী হলেন মো. ওসমান পাটোয়ারী, কাইছার হোসেন ও সাব্বির হোসেন। হত্যাকারীদের বিচার হবে সেই আশায় রয়েছেন তাঁদের স্বজনেরা।

নিহত মো. ওসমান পাটোয়ারীর ভাই ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছোট ভাইকে হারিয়ে আম্মু এখনো ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। আমাদের প্রত্যাশা হত্যাকারীদের বিচার হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিচারের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি’।

নিহত সাব্বির হোসেনের বাবা আমির হোসেন বলেন, সন্তানকে এক মুহূর্তের জন্য তিনি ভুলতে পারেননি। সন্তানের হত্যাকারীরাই কেবল নয়, এর নির্দেশদাতাসহ জড়িত সবার বিচার দাবি করেন তিনি।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গত বছরের ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুর শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। শহরের তেহমনী এলাকা থেকে তোলা

সম্পর্কিত নিবন্ধ