খাইয়ে-দাইয়ে ১৬ ‘পাহাড়িয়া’ পরিবারকে হাসি মুখে উচ্ছেদ
Published: 4th, September 2025 GMT
আগামীকাল শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) রাজশাহীর মোল্লাপাড়া এলাকার ‘আদিবাসী পাড়ায়’ বিরাট এক ভোজের আয়োজন হতে চলেছে। ‘পাহাড়িয়া’ গোত্রের ১৬টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবারের সবাইকে আনন্দের সাথে ভরপেট খাসীর মাংস দিয়ে খাওয়ানো হবে। চারিদিকে ধুমধাম একটা খুশির পরিবেশ।
তবে সেই আনন্দের একদিন পরই বাসিন্দাদের জন্য থাকছে দুঃসহ বাস্তবতা। রবিবার (৭ সেপ্টেম্বর) ৫৩ বছর ধরে বসবাস করে আসা ভিটা-বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে তাদের। চলে যেতে হবে অন্য কোথাও। হাসি মুখে উচ্ছেদ হতে হচ্ছে অসহায় পরিবারগুলোকে।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মোল্লাপাড়ায় ৫৩ বছর আগে ১৬ কাঠা জমির ওপর বাড়ি করেছিলেন পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের ছয়টি পরিবার। তিন প্রজন্মের ধারাবাহিকতায় ছয়টি বাড়ি এখন দাঁড়িয়েছে ১৬টিতে। স্থানীয়রা এই জায়গাকে চেনে ‘আদিবাসী পাড়া’ নামে।
বর্তমানে সেই জমির মালিকানা দাবি করেছেন সাজ্জাদ আলী নামের এক ব্যক্তি। কয়েক কোটি টাকার এ জমি দখলে নিতে তিনি সব আয়োজন সম্পন্ন করেছেন। সাজ্জাদের চাপে তিনটি পরিবার এরইমধ্যে চলে গেছে। বাকি ১৩টি পরিবারকেও আগামী রবিবার চলে যেতে হবে।
পাড়ার বাসিন্দারা জানান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবার ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর ফিরে এসে বাড়িঘর না পেয়ে তারা এখানে আশ্রয় পান। ইন্দ্র ধুপি নামের এক ব্যক্তি নিজের ১৬ কাঠা জমিতে ছয়টি পরিবারকে থাকার অনুমতি দেন।
ইন্দ্র ধুপি মারা যাওয়ার বহু বছর পর সাজ্জাদ আলী দাবি করেন, তিনি ইন্দ্রের কাছ থেকে জমিটি কিনেছেন। মহল্লার জন্য সিটি করপোরেশন একটি নলকূপ ও দুটি পাকা শৌচাগারও তৈরি করে দিয়েছে। অথচ এখন সেসব বাসিন্দাদের উচ্ছেদের মুখে পড়তে হচ্ছে!
বাসিন্দা মিশ্র রাম বর্মণ (৪০) বলেন, ‘‘দুই বছর আগে সাজ্জাদ আলী বাড়ি ছাড়তে বললে তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম সাজ্জাদের কাগজপত্র দেখে বলেছিলেন, দলিল জাল। তখন কৌশলে পালিয়ে যান সাজ্জাদ। এরপর কিছুদিন চুপ ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন দিন পর আবার এসে বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দেন। পরে টাকার প্রলোভন দেন।’’
তিনি জানান, সাজ্জাদ প্রথমে প্রতিটি পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। পরে ছয় লাখ টাকায় রাজি করান। এখন প্রতিটি বাড়ির জন্য ছয় লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে। বাড়িতে যদি তিন ছেলে থাকে, তবে প্রতিজন দুই লাখ টাকা পাচ্ছেন। এ টাকাই তাদের পুনর্বাসনের মূল ভরসা।
বাসিন্দাদের দেওয়া সময়ও বারবার কমিয়ে আনা হয়েছে। শুরুতে তিন মাস সময় দেওয়া হলেও পরে ১৫ দিন, ৭ দিন, ১০ দিন করে সময় বেঁধে দেওয়া হয়। সর্বশেষ দেওয়া ১০ দিনের সময় শেষ হবে শুক্রবার। সেদিন খাসি জবাই করে খাওয়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন সাজ্জাদ আলী। এরপর রবিবারের মধ্যে সবাইকে জায়গা ছাড়তে হবে।
আদিবাসী পাড়ার প্রথম দিকের বাসিন্দাদের মধ্যে বেঁচে আছেন কেবল ফুলমনি বিশ্বাস (৮০)। বুধবার দুপুরে বাড়ির সামনে বসে বিষণ্ন কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘‘কোথায় যাব? আমরা তো এখন আন্ধার ঘরে হাইতড়াই পাছি ন্যা। ওই রকম আমরাও কিছু খুঁইজে পাছি ন্যা।’’
ফুলমনির মেয়ে সরলা বিশ্বাস (৪৫) বলেন, ‘‘এখানেই জন্ম, এটাই ছেড়ে চলে যেতে হবে। এটা অন্যায় মনে হলেও কিছু করার নেই। জায়গাটা এখন ফাঁকা হচ্ছে, দালান উঠবে।’’
এরইমধ্যে রুবেল বিশ্বাস, শান্ত বিশ্বাস ও রিংকু বিশ্বাস নিজেদের ঘরবাড়ি ভেঙে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে গেছেন। অন্য পরিবারগুলোও প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে অনেকে জানাচ্ছেন, গ্রামের দিকে সামান্য জমি কিনলেও বাড়ি করার মতো অর্থ তাদের হাতে নেই।
পাড়ার গর্ভবতী বাসিন্দা পার্বতী রানী কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘‘আমি পুয়াতি, এখন কার বাড়িতে গিয়ে উঠব?’ তরুণ শিপেন বিশ্বাস, যিনি এবার উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন, জানালেন- এখানেই জন্ম তার বাবা টুনু বিশ্বাসের। তিনিও রবিবারের পর পরিবারসহ ঘর ছাড়বেন।
এ বিষয়ে সাজ্জাদ আলী বলেন, ‘‘জমি আমার কেনা। তাদের টাকা দিয়েছি, পুনর্বাসন করছি। কাউকে জোর করছি না। সুন্দরভাবে বিদায় দিচ্ছি।’’
কত সালে জমি কিনেছেন- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘এখন মনে নাই।’’ সাবেক কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম দলিল জাল বলেছিলেন কি না জানতে চাইলে সাজ্জাদ বলেন, ‘‘এটা মিথ্যা।’’ বিষয়টি জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাবেক কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।
নগরের কাশিয়াডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল বারী বলেন, ‘‘বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করা হয়, পাহাড়িয়ারা চাইলে আমাদের কাছে আসতে পারে। আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’’
ঢাকা/কেয়া/এস
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স জ জ দ আল পর ব র রব ব র
এছাড়াও পড়ুন:
এদের কোনো দিন শিক্ষা হবে না
আগের পর্বআরও পড়ুন‘বাংলাদেশের কি সুপারফোরে ওঠার চান্স আছে?’১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫