আলোচনা

মো. নাজমুল আহসান

উপাচার্য, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় 

চিংড়িশিল্প বাংলাদেশের অন্যান্য খাতের চেয়ে ভিন্ন। এটি কৃষিশিল্প হলেও অন্যান্য ফসলের মতো নয়। এখানে মৌসুমি বৈচিত্র্যের পরিবর্তে মাইক্রো সিজন থাকে। ১৫ দিনের মধ্যে কখনো উৎপাদন বেড়ে যায়, হঠাৎ শ্রমিকের চাহিদা বেড়ে যায়। ফলে প্রচলিত নীতিমালা কার্যকর হয় না।

একসময় এ শিল্পের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান চালু থাকলেও এখন টিকে আছে মাত্র নয়টি। উৎপাদন না বাড়ালে শিল্প টেকসই হবে না। চাষি ও শ্রমিকেরা বিকল্প খুঁজে নিচ্ছেন—রুই, কাতলা বা তেলাপিয়া চাষ করছেন। ভেনামাই চিংড়ি পরীক্ষামূলকভাবে আনা হলেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য মেলেনি।

উপকূলীয় ভূপ্রকৃতির প্রাকৃতিক গতিশীলতা নষ্ট হওয়ার ফলে উৎপাদন কমছে। কাঁকড়া রপ্তানি শুরু হলেও নিঃশেষ হওয়ার আশঙ্কা আছে। অথচ অভ্যন্তরীণ বাজারেই কোটি কোটি টাকার চাহিদা রয়েছে, কিন্তু আমরা কেবল ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানির দিকে ঝুঁকছি।

শ্রমিকসংকট বড় সমস্যা। মাত্র নয়টি কারখানা টিকে থাকায় কর্মসংস্থান কমেছে। নারী শ্রমিকদের জন্য লাইসেন্সিং, প্রশিক্ষণ ও নিবন্ধন জরুরি। ক্রেতাদেরও দায়িত্ব নিতে হবে—সেরা পণ্য কিনতে হলে সঠিক দাম দিতে হবে।

সবশেষে অভ্যন্তরীণ বাজার ও সংরক্ষণব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। মিষ্টি পানির মাছের পাশাপাশি সার্ডিন, ম্যাকারেল, চুনার মতো সামুদ্রিক মাছকে মূলধারায় আনতে হবে।

আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, উপকূলীয় শিল্পকে আমরা কোন পথে নিতে চাই। কেবল চিংড়ির ওপর নির্ভর না করে বৈচিত্র্যময় ও টেকসই পথ বেছে নিতে হবে। নারী শ্রমিকদের জন্য উন্নত কর্মপরিবেশ ও প্রশিক্ষণ, খাতভিত্তিক ভর্তুকি এবং অভ্যন্তরীণ বাজারের উন্নয়নই হতে পারে ভবিষ্যতের সমাধান।

সানতাজ বিল্লাহ

উপমহাপরিদর্শক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, খুলনা

খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট—এই তিন জেলায় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সীমিত জনবল দিয়েই অঞ্চলের শ্রম পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। রপ্তানিমুখী ফিশ প্রসেসিং ইউনিটগুলো কমপ্লায়েন্সে সচেতন, তাই সেখানে বড় ধরনের আইনভঙ্গ কম দেখা যায়। তবে কিছু নির্দিষ্ট অংশে ভায়োলেশন পাওয়া যায়।

প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে থাকায় হ্যাচারি, মাছের ঘের ও মৎস্য আহরণকেন্দ্রগুলো (মর্চা) এখনো তদারকির আওতায় আসেনি। যদি শ্রমবিধিমালায় ঘেরগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলে সেগুলোর ওপর কার্যকর নজরদারি সম্ভব হবে। অনেক মর্চা এখনো নিবন্ধনবিহীন, ফলে শ্রমিকদের তথ্য সংগ্রহ করা যায় না।আউটসোর্সিং ব্যবস্থাও একটি বড় সমস্যা। নিবন্ধিত ঠিকাদার না থাকলে তাঁদের সরবরাহ করা কর্মীদের বেতন ও পাওনার তথ্য মনিটর করা যায় না। মজুরির বিষয়ে সমস্যা বেশি দেখা যায় অস্থায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে। যেহেতু তাঁদের জন্য ন্যূনতম মজুরির গেজেট নেই, তাই অনেক প্রতিষ্ঠান কম বেতন দেয়। নিয়োগপত্র ও কর্মশর্ত স্পষ্ট না থাকায় তাঁরা নানা অসুবিধায় পড়েন। মৌসুমি শ্রমিকেরা ঘন ঘন প্রতিষ্ঠান বদল করেন, ফলে তাঁদের তথ্য ট্র্যাক করা কঠিন। জনবলের স্বল্পতার কারণে সব বিধান বাস্তবায়ন কঠিন। অনেক সময় দুর্বল প্রতিষ্ঠানের ওপর অতিরিক্ত চাপ দিলে তারা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে মজুরিকাঠামো নির্ধারণে সরকার যদি অস্থায়ী শ্রমিকদের জন্য আলাদা গেজেট প্রকাশ করে, তাহলে মালিকেরা নিয়মিত মজুরি দিতে বাধ্য হবেন।

আরেকটি সমস্যা হলো শ্রমিকদের সেক্টর বদল। মাছের মৌসুমে ইটভাটা বা অন্য খাতে ভালো মজুরি পাওয়া গেলে তাঁরা সেদিকে ঝুঁকে পড়েন। যদি সব খাতে মজুরি সমপর্যায়ে আসে, তবে শ্রমিকেরা স্থিতিশীলভাবে এক খাতে থাকতে আগ্রহী হবেন।

এস হুমায়ুন কবির

সাবেক সহসভাপতি, বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন

একসময় দেশের মৎস্যশিল্পে প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন মানুষ যুক্ত ছিলেন, যার মধ্যে চিংড়িশিল্পেই ছিল প্রায় এক মিলিয়ন মানুষের কর্মসংস্থান। এখনো এই খাতে শ্রমবৈষম্য প্রকট। একজন পুরুষ শ্রমিক ৫০০ টাকা মজুরি পেলেও একজন নারী শ্রমিক পান তার অর্ধেক বা তারও কম।

২০০৬ সালে সরকার শ্রম আইন পাস করলেও এর বিধিমালা আসে ২০১৫ সালে। আইন বাস্তবায়নে নানা বাধা থাকায় এখন সময় এসেছে এটিকে যুগোপযোগীভাবে হালনাগাদ করার। নারী-পুরুষ উভয় শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নারী শ্রমিকদের জীবনযাপন কষ্টকর। শীতের রাতেও নারীরা বরফঠান্ডা পানিতে হাত ডুবিয়ে চিংড়ির খোসা ছাড়ান ও গ্রেডিং করেন। তাই তাঁদের জীবনমান উন্নয়ন সময়ের দাবি। শ্রমবৈষম্য দূর করা এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা জরুরি।

চিংড়িশিল্পে আরেকটি বড় সমস্যা হলো হ্যাচারিগুলোর অনৈতিক কর্মকাণ্ড। ‘প্যাথোজেন ফ্রি’ বলে যে বীজ কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হয়, তার অন্তত ৪০ শতাংশই আসলে প্যাথোজেন ফ্রি নয়। অবৈধভাবে মুনাফা অর্জনের জন্য এসব হ্যাচারি মান ভঙ্গ করছে। সরকারকে এই খাতে মনিটরিং জোরদার করতে হবে।

এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এবং মৎস্যশিল্পের টেকসই বিকাশে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মালিকপক্ষকে সেমিনার ও আলোচনায় বাধ্যতামূলকভাবে অংশ নিতে হবে, যাতে সমাধানমূলক পদক্ষেপ নেওয়া যায়। উপকূলীয় মৎস্যশিল্প আজ টিকে আছে নারীদের পরিশ্রমে, অথচ তাঁরা সবচেয়ে অবহেলিত। ন্যায্য মজুরি, স্বচ্ছ ভর্তুকি এবং হ্যাচারির সঠিক তদারকি নিশ্চিত করতে পারলেই এই শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

শেখ মহিদুর রহমান

শ্রম পরিদর্শক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, খুলনা

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কাছে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে বেশির ভাগ অভিযোগ আসে মূলত বকেয়া বেতন, সার্ভিস বেনিফিট ও মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ নিয়ে। অভিযোগ পেলে আমরা নোটিশ দিয়ে তদন্ত করে এবং সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ করি। তবে দেখা যায়, কিছু প্রতিষ্ঠান আর্থিক দুরবস্থায় থাকায় সমস্যা মেটাতে পারে না। অন্যদিকে অনেক শ্রমিক অভিযোগের পথ জানেন না, ফলে নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকের মধ্যে একধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। শ্রমিকেরা সরাসরি ম্যানেজমেন্টে না গিয়ে আমাদের কাছে আসেন। ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে তাঁরা প্রায়ই বলেন, ‘আমরা জানতাম না কোথায় অভিযোগ দিতে হয়’।

এই শিল্পে অনেক প্রতিষ্ঠানই কর্মীদের আনুষ্ঠানিক নিয়োগপত্র দেয় না, চাকরির শর্তও স্পষ্ট থাকে না। আরেকটি বড় সমস্যা হলো লাইসেন্সবিহীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ। অনেক প্রতিষ্ঠান অপ্রাতিষ্ঠানিক ঠিকাদারের কাছ থেকে কর্মী নেয়, ফলে নিয়োগ ও মজুরিসংক্রান্ত তদারকি জটিল হয়। এ কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, ঠিকাদার নিয়োগের সময় তাদের ডাইফির লাইসেন্স আছে কি না, তা যাচাই করতে।

প্রশিক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহ নিয়েও নতুন উদ্যোগ চলছে। রাজশাহীতে স্থাপিত হয়েছে ন্যাশনাল অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, যা শিগগিরই কার্যক্রম শুরু করবে। পাশাপাশি সারা দেশের শ্রমিকদের তথ্যভান্ডার তৈরির জন্য এলইএমএস সফটওয়্যার চালু করেছে ডাইফি, যেখানে শ্রমিকদের রেকর্ড রাখা হবে।

সবশেষে বলা যায়, অভিযোগের সমাধান ও শ্রমিক-নিয়োগকর্তা সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি নিয়োগপত্র প্রদান, নিরসন ও লাইসেন্সধারী ঠিকাদারি ব্যবস্থার মাধ্যমে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকে আরও সুশৃঙ্খল করা জরুরি।

নুজহাত জাবিন

কান্ট্রি ডিরেক্টর, ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ

উপকূলীয় মৎস্যভিত্তিক শিল্পের রপ্তানি সম্ভাবনা আছে এবং এটি ইউরোপীয় বাজারে যায়, তাই এখানে কাজ করা জরুরি। গার্মেন্ট খাত ইতিমধ্যে পরিপূর্ণ, সেখানে অনেক সংস্থা ও গবেষক কাজ করছেন। কিন্তু জাতীয় সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও মৎস্য প্রক্রিয়াজাত সেক্টরটি তেমন আলোচনায় আসে না। এখান থেকেই আমাদের কাজের সূচনা।

কর্মজীবী নারী শ্রমিকদের কল্যাণ ও অধিকার নিয়ে কাজ করে। শুরুতে আমরা শ্রমিকদের সচেতনতা, সংগঠিতকরণ ও মালিকদের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নিই। ন্যূনতম মজুরি ও ট্রেড ইউনিয়ন নিয়েও গবেষণা করেছি। কিন্তু বুঝেছি, কেবল শ্রমিকদের নিয়েই কাজ করলে হবে না—কারণ, তাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। শ্রমিকদের যেমন মাতৃত্বকালীন সুবিধা, উপযুক্ত পিপিই, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা ও মজুরিবৈষম্যের সমস্যা আছে, তেমনি মালিকদেরও নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাই প্রত্যেক পক্ষের করণীয় আছে—এ কারণেই এই আলোচনার আয়োজন।

এই আলোচনা ঢাকায় করার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু খুলনায় এসে সরাসরি সবার কথা শোনার সিদ্ধান্ত নিই। পাশাপাশি আমরা সিপিডির সঙ্গে একটি বিস্তৃত গবেষণার কাজ শুরু করেছি, যেখানে দেখা হবে এই খাত ইউরোপীয় বাজারে টিকে থাকার জন্য কতটা প্রস্তুত।

কয়েক দশকের পুরোনো এই শিল্পে এখনো মালিক, ম্যানেজমেন্ট ও কর্মীদের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব রয়ে গেছে। শ্রম আইন অনুযায়ী অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটি থাকা বাধ্যতামূলক, কিন্তু তা প্রায়ই নিষ্ক্রিয়। কেন এখনো নিয়োগপত্র নেই বা কর্মঘণ্টা নির্ধারিত নয়—এসব মৌলিক প্রশ্ন রয়ে গেছে।

ক্রিশ্চিয়ান এইড প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছে এবং কয়েক বছর ধরে এই শিল্পের শ্রমিকদের সঙ্গেও কাজ করছে। আমরা চাই, সবাই মিলে এর জন্য একটি সম্মিলিত রোডম্যাপ তৈরি করি এবং মৎস্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পটি তার পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাক।

সানজিদা সুলতানা

অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক, কর্মজীবী নারী

কর্মজীবী নারী উপকূলীয় মৎস্যভিত্তিক শিল্প খাতে কাজ শুরু করেছে অনেক দিন আগে। প্রথম দিকে শ্রমিকদের স্ট্রাকচার, ফুল ভ্যালু চেইন ও দায়িত্ব নির্ধারণ বোঝা কঠিন ছিল। এর আগে খুলনা ও ঢাকায় আমরা কয়েকটি আলোচনা সভা করেছি, যার উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় সম্ভাবনাময় খাতটি কেন প্রস্ফুটিত হচ্ছে না, তা বোঝা। সেই প্রেক্ষাপটে শ্রম অধিকার নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করি।

যদিও ব্যবসায়িক দিক থেকে এটি কৃষি খাতের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু এখানে বড় শ্রম সেক্টর কাজ করে; তাই এককভাবে কৃষি খাতে সীমাবদ্ধ থাকা যথাযথ নয়। মৎস্য ও পশুসম্পদ, কৃষি, শ্রম ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়—এই চারটি মন্ত্রণালয়কে সমন্বয়ে এগোতে হবে।

ভিয়েতনামের ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান অনুসরণের প্রেরণা থেকে আমরা চাই একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে, যেখানে সব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করবেন। শুধুই ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ নয়, শ্রম অধিকার ও মানবাধিকার মানতে হবে। নতুন প্রযুক্তি, দক্ষতা উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনের বিষয়গুলো নিয়েও পরিকল্পনা প্রয়োজন। খাতটি শুধু ব্যবসা নয়, বরং এটি একটি জনশক্তি কাজে রূপান্তরের ক্ষেত্র।

অনেক বছর ধরে অনেক শ্রমিক অস্থায়ী অবস্থায় একই কারখানায় কাজ করছেন। ন্যূনতম বেতন না পেলে তাঁরা একসঙ্গে একাধিক ফ্যাক্টরিতে চলে যান। এটি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ও আইএলওর ডিসেন্ট এজেন্ডার পরিপন্থী। অধিকাংশ আউটসোর্সিং হচ্ছে সুপারভাইজারের মাধ্যমে, যারা নিবন্ধিত নয়। ফলে অস্থায়ী শ্রমিক ও কম মজুরির সমস্যা চলতে থাকে, যা জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত।

শ্রমিকদের সুরক্ষা, মজুরি, নিয়োগপত্র ও কার্যকর কমিটির ব্যবস্থা না হলে এই খাতের সম্ভাবনা পূর্ণতা পাবে না। প্রয়োজন যৌথ উদ্যোগ, যেখানে ডাইফি, ব্যাংকিং চ্যানেল এবং সংশ্লিষ্ট সবাই অংশ নেবে। এভাবে শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করলে এ খাতের সার্বিক সম্ভাবনা বাস্তবায়ন সম্ভব।

সুজন আহমেদ

সেক্রেটারি জেনারেল, সি ফুড এক্সপোর্ট বায়িং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ

বাংলাদেশের মৎস্য অবকাঠামোতে থাকা সিস্টেমগুলো যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না, যার কারণে ব্যবসা ও শ্রমিক উভয়ই ভুক্তভোগী। বিদেশি বায়ার আনার সময় দেখা যায়, ডে-কেয়ার সেন্টার বা কল-ফ্যাসিলিটি শুধু প্রদর্শনের জন্য সাময়িকভাবে প্রস্তুত হয়। পরের দিন আবার যা তা-ই। বায়ার লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়, কিন্তু আর্থিক সাপোর্টের অভাব ব্যবসায়িক ক্ষতি বৃদ্ধি করছে। ভিয়েতনাম ও ইন্ডিয়ার তুলনায় বাংলাদেশে ভেনামি চাষ ও উৎপাদন প্রযুক্তি উন্নত হয়নি, যার ফলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে।

প্রোডাকশন বোনাস ও দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা না থাকায় শ্রমিকদের উদ্যম কম। শ্রমিকেরা প্রাথমিক ট্রেনিং পান না; সবই অভ্যাসের ওপর নির্ভর। সরকারি সংস্থা এফআইকিউসি যদি স্থানীয় সমন্বয় ও তত্ত্বাবধান নিয়ে কাজ করত, উৎপাদন ও রপ্তানি উন্নত হতো।

মালিকপক্ষের দায় ও কমিটমেন্টের অভাবও বড় সমস্যা। ব্যাংকঋণ সঠিকভাবে ব্যবহার হয় না; কোম্পানি বন্ধ বা অন্য ব্যবসায় রূপান্তরিত হচ্ছে। বিদেশি বায়ারের অভিযোগে মালিকেরা একত্রে সাড়া দেয় না, ফলে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এফআইকিউসি ও মৎস্য ডিপার্টমেন্টের তত্ত্বাবধানও পর্যাপ্ত নয়।

সমাধান সম্ভব যদি সরকারি ও বেসরকারি পক্ষ যৌথভাবে নজরদারি, প্রযুক্তি উন্নয়ন, শ্রমিক প্রশিক্ষণ ও সমন্বিত উৎপাদন ও রপ্তানি ব্যবস্থা নিশ্চিত করে।

মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন

পরিচালক, বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন

বাংলাদেশে শতাধিক হ্যাচারি থাকলেও শুধু তিনটিতে এসপিএফ বা প্যাথোজেন ফ্রি পোনা উৎপাদন হচ্ছে। বাকিগুলো থেকে চাষিদের দেওয়া পোনা প্রায় সব মারা যাচ্ছে, যার কারণে চিংড়ির উৎপাদন কমছে। সেক্টরের এক্সপোর্ট কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে এসপিএফ পোনার অভাব এবং খাল ও পানি ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা। খাল খনন ও সঠিক পানি সরবরাহের মাধ্যমে উৎপাদন চার-পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে।

দেশে চিংড়ি চাষের জমি ২ লাখ ৭৩ হাজার হেক্টরের বেশি। যদি সঠিক প্রযুক্তি, এসপিএফ পোনা ও পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়, তবে উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। কৃষিভিত্তিক হিসেবে সেক্টরটি গণ্য করা হলে ইলেকট্রিসিটি বিল কমবে ও ব্যাংক সুদের সুবিধা পাওয়া যাবে, যা এক্সপোর্ট বাড়াবে।

তবে ভেনামি চাষ সরকারি অনুমোদন পায়নি, তাই উৎপাদন সীমিত। অন্য দেশ যেমন ভিয়েতনাম, ইকুয়েডর অনেক বেশি উৎপাদন করে, কিন্তু বাংলাদেশের চাষে সম্পূর্ণ দেশীয় পণ্য দিয়ে অর্থ আসে।

সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে এসপিএফ পোনা উৎপাদন সম্প্রসারণ, খাল ও পানিব্যবস্থার উন্নয়ন, শ্রমিক প্রশিক্ষণ, বৈষম্য দূরীকরণ এবং কৃষিভিত্তিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি। সঠিক পদক্ষেপে এই সেক্টর ৪ হাজার থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার এক্সপোর্ট সম্ভাবনা অর্জন করতে পারে।

খালিদ হোসেন

সভাপতি, জাতীয় শ্রমিক জোট বাংলাদেশ

বাংলাদেশের মৎস্যশিল্পে শ্রমিকদের স্বার্থ ও শিল্পের টেকসই উন্নয়ন অঙ্গীকারের সঙ্গে জড়িত। শিল্প যদি না বাঁচে, শ্রমিকও বাঁচবে না—এটি মূল সত্য। তবে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করার অভিজ্ঞতা তিক্ত। একসময় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ ছিল না, যাঁরা তা করার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের চাকরি হারাতে হয়েছে।

বর্তমানে কিছু ইন্ডাস্ট্রিতে শ্রমিকদের ভূমিকা উন্নত হয়েছে, তবে বেতনকাঠামো এখনো নিম্নমানের। ইন্ডাস্ট্রির আয় সীমিত থাকলেও শ্রমিক, মালিক ও রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করা জরুরি। এক দিকে ঘেরে শ্রমিক, অন্য দিকে ডিপসি মাছ সংগ্রহের শ্রমিক—তাঁদের অধিকাংশই কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে কাজ করেন, নারী শ্রমিকদের জন্য আলাদা সুবিধা নেই। শিশুশ্রম এবং অমানবিক কাজের পরিবেশ এখনো বিদ্যমান। গর্ভবতী শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় ছুটি বা সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয় না। ফ্যাক্টরিতে বায়ারের উপস্থিতি কেবল অস্থায়ী ব্যবস্থা নিয়ে আসে; বায়ার চলে গেলে আগের অবস্থায় ফিরে যায়।

শিল্প রক্ষা ও শ্রমিক সংরক্ষণের সমন্বয়ে নীতিমালা গ্রহণ করলে শিল্পের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব এবং শ্রমিকদের জীবনমান বৃদ্ধি পাবে। উৎপাদনশীলতা ও মানবাধিকার রক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারি পর্যায়ে কার্যকর তত্ত্বাবধান এবং বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় অপরিহার্য। শিল্প ও শ্রমিকের এই দুই দিকের সমন্বয়েই বাংলাদেশের মৎস্য খাতের ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

মো.

মজিবর রহমান

আহ্বায়ক, খুলনা মহানগর শ্রমিক দল

খুলনার শিল্পনগরী এখন মৃত শিল্পে পরিণত হয়েছে। একমাত্র মৎস্য কারখানাগুলো বেঁচে আছে, তাও মাত্র নয়টি চালু রয়েছে। ফলে শ্রমিকদের কাজের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। শিল্প যদি বাঁচাতে না পারি, তবে এই অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন

হবে। খুলনা ও উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্য উৎপাদন, আহরণ ও রপ্তানির সম্ভাবনা থাকলেও রাষ্ট্রের সুশাসন ও জবাবদিহি কার্যকর নয়। বিদ্যুতের উচ্চ মূল্য, খাল খনন ও পানি সরবরাহের অনিয়ম এবং রাষ্ট্রকাঠামোর অনিয়ম শিল্পের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে।

বিদেশি বায়ারের সঙ্গে তুলনায় বাংলাদেশি রাষ্ট্রের তৎপরতা অপর্যাপ্ত। শিল্প চালু রাখা, শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা ও বেতনকাঠামো উন্নত করা অত্যাবশ্যক। খুলনার শ্রমিকদের অবস্থার কিছু উন্নতি হলেও আগে তারা ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের সুযোগই পেতেন না; যাঁরা তা করেছিলেন, তাঁদের চাকরি হারাতে হয়েছে। শ্রমিকদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কার্যক্রমেও বাধা সৃষ্টি হয়েছে।

শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সময়মতো নীতি বাস্তবায়ন প্রয়োজন। সার্বিকভাবে খুলনার শিল্প ও শ্রমিক উভয়ের টেকসই উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা, বিদ্যুৎ ও খাল ব্যবস্থাপনার সংস্কার, শ্রমিক অধিকার সংরক্ষণ এবং মালিকদের দায়িত্বশীল অংশগ্রহণ জরুরি।

রওনক হাসান রণ

সহকারী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষার মাধ্যমে মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করা প্রয়োজন। তরুণদের সঠিকভাবে মোটিভেট করে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি, নতুন প্রযুক্তি ও গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা গেলে এই খাতের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।

জনসচেতনতা বাড়াতে স্থানীয় পর্যায়ে মাসকট, পোস্টার, পথনাট্য ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম আয়োজন করা যেতে পারে, যা জেলে ও স্থানীয়দের মৎস্যসম্পদ রক্ষা শেখাবে। এ ছাড়া সুন্দরবন ও উপকূলীয় অঞ্চলে জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরি।

খুলনার মৎস্যসম্পদ রক্ষা ও সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজন প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা, প্লাস্টিক ও রাসায়নিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ, কীটনাশক ব্যবস্থাপনা, তরুণদের শিক্ষাগত ও গবেষণামূলক অন্তর্ভুক্তি, স্থানীয় জনগণ ও জেলেদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা। এগুলো বাস্তবায়ন করলে উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্য খাতের সম্ভাবনা টেকসই ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে।

মশিউর রহমান

প্রোগ্রাম অফিসার, সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক

দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়িশিল্প ও কৃষি উৎপাদনের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখনো চলমান। লবণপানি নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে; কেউ চায় ঢুকুক, কেউ চায় না। বাস্তবতা হলো, জোয়ার-ভাটা থামানো সম্ভব নয়। দুই দশক আগে নদী ও খাল যথাযথভাবে কাজ করেছিল, লবণ দ্রুত চলে যেত। এখন পানির সঠিক প্রবাহ না থাকায় সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। চিংড়ি চাষের জন্য জোনিং সিস্টেম প্রয়োজন। চিংড়ির জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চল, ধানের ও অন্যান্য শস্যের জন্য আলাদা অঞ্চল চিহ্নিত করা উচিত।

চিংড়িশিল্পের এক্সপোর্ট ও প্রোডাকশন কমছে, প্রসেসিং ফ্যাক্টরিগুলো তাদের ক্যারিং ক্যাপাসিটির অর্ধেকও কাঁচামাল পাচ্ছে না। প্রোডাকশন বাড়াতে ইনলেট-আউটলেট ও ড্রেনেজ সুবিধাসহ ফিজিক্যাল স্ট্রাকচার উন্নয়ন জরুরি। দক্ষিণাঞ্চলের চিংড়িশিল্প ও সম্পর্কিত উপকূলীয় উৎপাদনকে অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সমাজবান্ধবভাবে এগিয়ে নিতে একটি সুনির্দিষ্ট মাস্টারপ্ল্যান জরুরি, যাতে সব সেক্টরের প্রযুক্তি ও সম্পদ কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়।

মোসফিকুর রহমান

ব্যবস্থাপক, ক্রিশ্চিয়ানএইড বাংলাদেশ

কর্মজীবী নারী ও ক্রিশ্চিয়ানএইড দীর্ঘদিন ধরে নারী ও নারী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে। উপকূলীয় অঞ্চলে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ আছে—জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও দক্ষতা উন্নয়নের চাহিদা। ফ্যাক্টরিতে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে স্থানীয় সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর সঙ্গে শ্রমিকদের সংযোগ তৈরি করা হয়েছে, যাতে তাঁরা প্রয়োজনীয় সেবা ও দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ পেতে পারেন। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কর্মপরিবেশ উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ আয়োজনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

চিংড়িশিল্পে উন্নত দেশগুলো বেশ আগে থেকেই শিল্পের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।  আমাদেরও চিংড়িশিল্পের সম্ভাবনা ও সংকট নিয়ে সব স্টেকহোল্ডারের সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করে আলোচনার একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং একটি অ্যাকশনপ্ল্যান হাতে নেওয়ারও কোনো বিকল্প নেই।

তামিম আহমেদ

সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, সিপিডি

বাজারে অংশগ্রহণে মৎস্যশিল্পের মূল চ্যালেঞ্জ তিনটি—জলবায়ু পরিবর্তন, গ্র্যাজুয়েশন এবং টেকসই উৎপাদন। টেকসই উৎপাদন মানে পরিবেশ, সমাজ, প্রযুক্তি ও অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন। সামাজিক টেকসই উৎপাদনে শ্রমিক ও মানবাধিকার রক্ষা এখন প্রতিযোগিতার মূল নির্দেশক।

জাতিসংঘভিত্তিক ‘ইউনাইটেড ন্যাশনাল গাইডিং প্রিন্সিপাল’ অনুযায়ী ব্যবসাকে ‘বিজনেস হিউম্যান রাইটস’ হিসেবে দেখতে হবে। শ্রমিক অধিকার, পরিবেশ রক্ষা ও দূষণমুক্ত উৎপাদন নিশ্চিত না করলে মানবাধিকার লঙ্ঘন ধরা হবে।

২০২৬ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিএস ট্রিপল ডি কার্যকর হবে, যা ২০৩১-৩২ সালের মধ্যে পূর্ণ বাস্তবায়িত হবে। এটি দায়িত্বশীল উৎপাদন নিশ্চিত করবে এবং ক্রেতাকে দায়ী করার সুযোগ দেবে। বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুতির সময় এখন। কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে শিল্পকে শক্তিশালী করা সম্ভব।

প্রেমা হাজরা

উদ্যোক্তা, রেডি টু কুক

করোনার সময় সাতক্ষীরার কিছু চাষি আমাদের জানান—মাছ উৎপাদন হয়েছে, কিন্তু লকডাউনের কারণে বাজারে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। চাষিদের এমন সমস্যায় প্রায়ই পড়তে হয়। ফিশারিজ পটভূমি থাকায় চাষিদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল, সেই চাহিদা থেকেই তৈরি হয় সরাসরি ডেলিভারি সার্ভিস।

উপকূলীয় মৎস্যভিত্তিক শিল্পের ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের কর্মীর প্রায় ৬০ শতাংশ নারী। তবে কাজের ধরন ও দায়িত্ব এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে সবাই অংশ নিতে পারে। সামাজিক ট্যাবুগুলো ভাঙতে নারীরা সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।

চাষি থেকে শুরু করে প্রসেসিং, সরবরাহ ও রপ্তানি—সব পর্যায়ে সমস্যা রয়েছে। আমরা উপকূলীয় মৎস্যশিল্পকে শক্তিশালী করতে চাই, শ্রমিকদের অধিকার ও দক্ষতা উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চাই, এবং স্থানীয় জনগণকে অন্তর্ভুক্তিমূলকভাবে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করতে চাই।

শারমিন কবীর

সাধারণ সম্পাদক, কর্মজীবী নারী

মৎস্যভিত্তিক শিল্প শুধু ব্যবসা নয়, উপকূলীয় মানুষের টিকে থাকার অবলম্বন। কিন্তু আজ নদী দূষিত, পানির গুণগত মান নষ্ট; মাছ উৎপাদন কমছে। একসময় প্রাকৃতিকভাবে যে চিংড়ি ধরা যেত, এখন তা প্রায় হারিয়ে গেছে। আমরাই সব শেষ করে ফেলেছি।

যদি শিল্প না থাকে, শ্রমিক বাঁচবে কীভাবে? নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব শ্রমিকের টিকে থাকার পথ হলো এই শিল্পকে বাঁচানো। কিন্তু সংকট গভীর: উৎপাদন কমে যাওয়া, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিকল্প জীবিকার অভাব, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত—সব মিলিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তবু এখান থেকেই উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে।

আগে মালিকেরা শ্রমিকের কথা ভাবতেন না, এখন ভাবতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, বাস্তবতা বদলেছে। মালিকদের মানবিক হতে হবে, হিউম্যান রাইটসের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব। আমরা চাই, এই সেক্টর পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাক, শ্রমিক–মালিক একসঙ্গে কাজ করুক। এই আলোচনা  নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করুক।

করণীয়

উৎপাদন টেকসই রাখতে এসপিএফ (প্যাথোজেন ফ্রি) পোনা সরবরাহ ও পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন জরুরি।

নারী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, প্রশিক্ষণ ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে।

শ্রমিকদের জন্য নিয়োগপত্র, ন্যূনতম মজুরি গেজেট ও লাইসেন্সধারী ঠিকাদার ব্যবস্থাপনা চালু করতে জরুরি ভিত্তিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসতে হবে।

শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন।

উপকূলীয় অঞ্চলে খাল খনন ও জলপ্রবাহ পুনঃস্থাপন করতে হবে, যাতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও চাষের উপযোগিতা ফিরে আসে।

এই সেক্টরের সার্বিক উন্নয়নে জরুরি ভিত্তিতে আন্তমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন করে প্রশাসনিক জটিলতা দূর করতে হবে।

এ ছাড়া গোলটেবিল বৈঠকে আরও অংশগ্রহণ করেন:

রিনা আমেনা, প্রকল্প সমন্বয়ক, কর্মজীবী নারী;

কাজী গুলশান আরা দীপা, প্রকল্প সমন্বয়ক, কর্মজীবী নারী;

শেখ রুবেল আহমেদ, প্রকল্প কর্মকর্তা, কর্মজীবী নারী;

রাজীব কুমার সাহা, ফিল্ড ফ্যাসিলিটেটর, কর্মজীবী নারী;

টুম্পা আক্তার মীম, ফিল্ড ফ্যাসিলিটেটর, কর্মজীবী নারী;

রোমানা আক্তার, ফিল্ড ফ্যাসিলিটেটর, কর্মজীবী নারী;

উত্তম মণ্ডল, খুলনা প্রতিনিধি, প্রথম আলো।

সঞ্চালনা:

ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন শ চ ত করত দ শ র মৎস য ম নব ধ ক র ন শ চ ত কর উপক ল য় ম ন য় গপত র বড় সমস য গ রহণ কর এই শ ল প র জন য ন দ র জন য ব যবস য় ক জ করছ ব সরক র ন য নতম ক র যকর সরবর হ স রক ষ পর য য় এই খ ত দ র কর থ কল ও পর ব শ ক জ কর উদ য গ র কর ম ক ত কর ন বন ধ আম দ র র রহম ইউর প সমন ব র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

সুনামগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে স্মারকস্তম্ভ নির্মাণ, সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ-প্রতিবাদ

পুকুরপাড়ে ছায়াঘেরা চত্বর। চত্বরের মাঝখানে কিছু জায়গায় চারদিকে পাকা দেয়াল। উত্তর পাশের দেয়ালের মাঝামাঝি সবুজ বৃত্তের মধ্যে লাল সূর্য। লাল-সবুজের সামনেই বেদি। এটি সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের শহীদ মিনার। ভাষা শহীদদের স্মরণে ১৯৬৬ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল।

প্রায় ৬০ বছরের পুরোনো এ শহীদ মিনার এখন ভেঙে ফেলা হচ্ছে। সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে একটি স্মারকস্তম্ভ। বিষয়টি জানাজানির পর ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কলেজের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। কলেজ ছাত্রদলের পক্ষ থেকে স্মারকস্তম্ভ নির্মাণকাজ বন্ধ এবং শহীদ মিনার আগের অবস্থায় পুনঃস্থাপনের দাবিতে অধ্যক্ষের কাছে গতকাল মঙ্গলবার স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। আজ বুধবার একই দাবিতে কলেজ ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করবেন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।

সুনামগঞ্জ পৌর শহরের হাছননগর এলাকায় ১৯৪৪ সালে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। সরকারীকরণ করা হয় ১৯৮০ সালে। কলেজের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০২০ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী উৎসব হয়। এ উৎসবের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তখন ক্যাম্পাসে একটি স্মারকস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর এটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। সরকারি কলেজে স্মারকস্তম্ভ নির্মাণকাজ শুরু হয় মাসখানেক আগে।

এখন শহীদ মিনার ভাঙার প্রতিবাদে অনেকেই সরব হওয়ায় কলেজ কর্তৃপক্ষ এর দায় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছে। আর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, তারা কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করে দেওয়া স্থানে এটি নির্মাণ করছে। স্থান নির্ধারণে তাদের কোনো ভূমিকা নেই।

সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের ১৯৭৩-৭৪ সালে সহসভাপতি (ভিপি) ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুর রহমান। শহীদ মিনার ভাঙার খবর পেয়ে গতকাল বিকেলে ছুটে যান কলেজে; কথা বলেন অধ্যক্ষের সঙ্গে। তিনি জানান, ভাষাশহীদদের স্মরণে ১৯৬৬ সালে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে এ শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। এটিই জেলায় ভাষাশহীদদের স্মরণে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী এটি ভেঙে ফেলে। দেশ স্বাধীনের পর ছাত্রনেতারা এটি আবার নির্মাণ করেন।

সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই শহীদ মিনারেই আমরা সভা–সমাবেশ করতাম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর আবেগ, স্মৃতি জড়িয়ে আছে এটির সঙ্গে। কলেজে এত জায়গা থাকতে শহীদ মিনার ভেঙে তার ভেতরে কেন স্মারকস্তম্ভ নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, এটিই বুঝতে পারছি না। এতে খুবই মর্মাহত হয়েছি।’

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুজ্জামান জানান, ‘সুনাম ফলক’ নামের এ স্মারকস্তম্ভের নকশা করেছেন ভাস্কর হামিদুজ্জামান। একইভাবে সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চবিদ্যালয়ের ১২৫ বছর পূর্তির একটি স্মারক নির্মাণ করা হয়েছে। এখন শহরের সরকার সতীশ চন্দ্র বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের ৭৫ বছর পূর্তির দুটি স্মারকস্তম্ভ নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি কলেজের স্মারকটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬ লাখ টাকা।

কামরুজ্জামান বলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষই স্থানটি নির্ধারণ করেছে। কলেজে আরেকটি শহীদ মিনার নির্মাণ করায় পুরোনোটা ভেঙে সেখানে স্মারকস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত কলেজ কর্তৃপক্ষের। এখানে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের কোনো ভূমিকা নেই। তাঁদের পরামর্শ ছিল কলেজের প্রধান ফটকের পাশে ভেতরে উত্তর পাশে এটি নির্মাণের, কিন্তু এতে কলেজ কর্তৃপক্ষ রাজি হয়নি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়াও তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। এরপর কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এটি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর করছে। তারাই স্থান নির্ধারণ করেছে। এ বিষয়ে শিক্ষা প্রকৌশলীর মন্তব্য জানানোর পর তিনি আবার বলেন,‘আসলে আমরাই তাদের বলেছি, এখানে কাজ করা যাবে কি না। তারা রাজি হওয়ায় এখন কাজ হচ্ছে। এত দিন কেউ কিছু বলেনি। এখন অনেকেই কথা বলছে। আমি ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে নই। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলব।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ