কুড়িগ্রামের রাজারহাটে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। সেই সঙ্গে উত্তরের হিমেল হাওয়া ও কনকনে ঠান্ডায় জনজীবনে নেমে এসেছে স্থবিরতা। কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে চারদিক। গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মতো পড়ছে কুয়াশা। ঘন কুয়াশার কারণে আজ রোববার সকাল সাড়ে আটটার দিকে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে।

আজ সকাল ১০টার দিকে সূর্যের কিছুটা দেখা মিললেও বাতাসের আর্দ্রতা ও হিমেল হাওয়ার কারণে বেশি শীত অনুভূত হচ্ছে। বাতাসের সঙ্গে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন।

কুড়িগ্রামের আবহাওয়া দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার প্রথম আলোকে বলেন, আকাশে মেঘ থাকার কারণে তাপমাত্রা কমে গেছে। আজ দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্র কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ১০ দশমিক ২ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী কয়েক দিন তাপমাত্রা আরও কমতে পারে।

তীব্র শীতে অতিদরিদ্র, শ্রমজীবী ও নদীতীরবর্তী চরাঞ্চলের লোকজন কষ্টে পড়েছেন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বের হচ্ছেন না। গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। জেলার হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা। এর মধ্যে শিশু ও বয়স্কদের সংখ্যাই বেশি। এক সপ্তাহে কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে প্রায় সাড়ে ৪০০ ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।

নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য তাজেল উদ্দিন বলেন, শীতের কারণে চরাঞ্চলের মানুষের কষ্ট বেড়েছে। দিন এনে দিন খাওয়া এসব মানুষ কর্মহীন হয়ে খুব কষ্টে আছেন। সরকারিভাবে ত্রাণ সহায়তা ও কম্বল তাঁদের এলাকায় এখনো পৌঁছায়নি।

আজ সকালে চিলমারী জোড়গাছ হাটের পাশের ব্রহ্মপুত্র নদের বালুচরে বাদাম শুকানোর কাজ করছিলেন রেপুনি বেওয়া (৬০)। তিনি বলেন, ‘কনকনে ঠান্ডায় হাত-পা বরফ হয়া যায়। বাদাম হাত দিয়ে ধরে আলাদা করমু, সেই শক্তি থাকে না। দিনে তাও যেমন-তেমনভাবে থাকা যায়, রাইত হইলে শীতে জান বেড়ে যাবার চায়।’

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন ঠেকাতে গ্রামবাসী বানালেন ‘প্রাকৃতিক বাঁধ’

উজানের ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রবল স্রোতে ব্রহ্মপুত্র নদসহ অর্ধশতাধিক নদ-নদীর পানি বেড়ে দেখা দেয় ভাঙন। মাটির সঙ্গে ভেসে যায় বসতভিটা, ফসলি জমি, কখনো স্কুল বা মসজিদ। প্রতিবছর এই ভাঙনে নিঃস্ব হয় অসংখ্য পরিবার। সরকারি বাঁধ বা প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি মিললেও বাস্তবে কাজের গতি নেই।

এমন অবস্থায় এবার নিজেরাই নিজেদের রক্ষার পথ খুঁজে নিয়েছেন চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের খেরুয়ার চরের বাসিন্দারা। সরকারি সহায়তার অপেক্ষা না করে নিজেদের টাকায় ও স্বেচ্ছাশ্রমে তাঁরা ব্রহ্মপুত্রের তীরে গড়ে তুলছেন এক ‘প্রাকৃতিক বাঁধ’।

প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদীতীরে লাগানো হয়েছে কলাগাছ, কাশফুল, কলমিলতা ও স্থানীয় ঘাসজাতীয় গাছের চারা। এসব গাছের বিস্তৃত শিকড় নদীতীরের মাটি আঁকড়ে ধরে রাখবে, এমন ধারণা থেকেই এই উদ্যোগ।

খেরুয়ার চরের বাসিন্দা দুলাল জোয়াদ্দার বলেন, ‘প্রতিবছর ভাঙনে ঘরবাড়ি হারাই। কেউ সাহায্য করে না। তাই ভাবলাম, গাছ লাগালেই যদি কিছুটা মাটি টিকে থাকে তাতেই লাভ।’

সম্প্রতি সরেজমিনে নয়ারহাট ইউনিয়নের খেরুয়ারচর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে জেগে ওঠা বালুচরের দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে স্থানীয় বাসিন্দারা কাশফুলের চারা লাগাচ্ছেন। কিছু দূর পরপর কলাগাছ ও কলমিলতার চারাও লাগানো হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সবাই এ কাজে হাত লাগিয়েছেন। কেউ বালুচরে প্রাকৃতিক বাঁধ তৈরির কাজ করছেন, তো কেউ সেই বাঁধের জন্য কাশফুলের চারা ও কলমিলতার জোগান দিচ্ছেন। বসে নেই এলাকার নারীরাও, পুরুষের পাশাপাশি তাঁরা হাত লাগিয়েছেন পানি সরবরাহকাজে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য সানোয়ার হোসেন বলেন, আগেও সীমিত পরিসরে গাছ লাগানো হয়েছিল, কিন্তু এবার মানুষ অনেক বেশি সংগঠিত হয়েছে। তাই ব্যাপক পরিসরে লাগানো হচ্ছে। ‘মানুষ নিজেরাই টাকাপয়সা দিয়েছে, দল বেঁধে গাছ লাগিয়েছে। আমরা পাশে আছি’, বলেন তিনি।

ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে

নয়ারহাট ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরেই বজরা দিয়ারখাতা, দক্ষিণ খাউরিয়ার চর ও ফেইচকা এলাকায় অন্তত ২০০ পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। শতাধিক পরিবার বসতবাড়ি হারিয়ে অন্যের জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। ভাঙনের ঝুঁকিতে ইউনিয়নের একমাত্র আশ্রয়ণ প্রকল্প, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় বাজার।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, এ বছর নদীভাঙনে জেলার ১ হাজার ৫০০ পরিবার তাদের বসতি হারিয়েছে। এ ছাড়া গত ছয় বছরে ১৬ হাজার পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়েছে এবং ১৫৩ হেক্টর কৃষিজমি বিলীন হয়েছে।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান বলেন, ব্রহ্মপুত্রের গভীরতা ও প্রবল স্রোতের কারণে এ ধরনের উদ্যোগ দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর না–ও হতে পারে। তবে স্থানীয়দের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ ইতিবাচক। এভাবে প্রাকৃতিক বাঁধ তৈরি হলে ভাঙনের ঝুঁকি কমে আসবে। জেলার প্রতিটি চরে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর এভাবে বাঁধ দিলে ভূমিক্ষয় ও ভাঙনের ঝুঁকি কমবে।

জলবায়ুর প্রভাব ও অভিযোজন

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর চরাঞ্চলে নদীভাঙন বেড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে গিয়ে নদীতীর দুর্বল হয়, আর বর্ষায় প্রবল স্রোতে দ্রুত ক্ষয় ঘটে।

জেলা জলবায়ুকর্মী মার্জিয়া মেধা বলেন, চরাঞ্চলের এই উদ্যোগকে ছোট করে দেখা ঠিক হবে না। কলা, কাশফুল ও কলমি—সবই এমন উদ্ভিদ, যেগুলোর শিকড় মাটি ধরে রাখে। এটি একধরনের সবুজ বর্ম, যা ভাঙন রোধে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তিনি আরও বলেন, এটি আসলে কমিউনিটিভিত্তিক জলবায়ু অভিযোজনের উদাহরণ। সরকার যদি বৈজ্ঞানিক পরামর্শ, উপযুক্ত প্রজাতির গাছ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সহায়তা দেয়, তবে এটি ব্রহ্মপুত্র তীর রক্ষার একটি টেকসই মডেল হয়ে উঠবে।

নদীগবেষক ও রিভারাইন পিপলের পরিচালক তুহিন ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙন রোধে বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা করে মানুষের জমি ও বসতভিটা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের গ্রহণ করা উচিত ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র সেখানে ব্যর্থ হয়েছে। স্থানীয় মানুষ নিজেদের বাঁচানোর তাগিদে কখনো বাঁশ-কাঠ দিয়ে, আবার কখনো কাশফুলের চারা দিয়ে প্রতিরোধব্যবস্থা করেছে। তিনি আরও বলেন, নদীতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ অনেক সময় জীব ও পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলে, জলবায়ু সংকট তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। সেদিক বিবেচনায় স্থানীয় মানুষের এই প্রাকৃতিক বাঁধ ব্রহ্মপুত্র নদের তীর রক্ষার একটি টেকসই মডেল হয়ে উঠতে পারে।

চিলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সবুজ কুমার বসাক বলেন, ‘স্থানীয়দের প্রাকৃতিক বাঁধ নির্মাণ একটি প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা। এ বছর বন্যায় নদীভাঙনের পর সেখানে স্থায়ী বাঁধের জন্য আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে চিঠি দিয়েছি। এ ছাড়া স্থানীয়দের কাজকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য আমরা তাদের পাশে রয়েছি।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ