শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক এমনভাবে বাড়ানো হয়েছে, যা কিছুটা আশ্চর্যজনক। এটা প্রধানত দুই কারণে। এক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা সরকারের কাছ থেকে এমন পদক্ষেপ অপ্রত্যাশিত। দুই, অর্থবছরের মধ্যভাগে এসে এত পণ্য ও সেবায় একযোগে কর বাড়ানোর এমনতর ঘটনা আর নেই বলেই জানা যাচ্ছে। 

নতুন বছরের প্রথম দিনে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাসের খবরও ছিল হতাশার। অনেকে তবু আশা করেছিলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার হয়তো কিছু স্পর্শকাতর ক্ষেত্রে অন্তত সংশোধনী আনবে। তেমন কিছুই করা হয়নি। যেমন ওষুধের দামও কিছুটা বাড়বে এ ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়ানোর ফলে। গত ক’বছরে দফায় দফায় বেশ কিছু ওষুধের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কিন্তু আলোচনা কম হয়নি। এটা কমিয়ে আনার সুযোগ থাকলে তা গ্রহণের ওপর বরং জোর দেওয়া হচ্ছিল। নতুন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবায় কোনো ধরনের উন্নতির খবরও অনুপস্থিত। 

রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি খারাপ বটে; কারণও জানা। আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় দ্বিতীয় দফা বাড়িয়েও মনে হয় না সুফল মিলবে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে আয়ের পরিস্থিতি ভালো নয়। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার না হলে আয় বাড়বেই-বা কীভাবে? তবে যথাযথভাবে আয়কর আদায়ে ব্যর্থতা এবং এ ক্ষেত্রে উভয় দিক থেকে দুর্নীতিও রয়ে গেছে। আশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার আয়কর আদায়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়ে রাজস্ব বাড়াবে। এটা বৈষম্য কমানোর অঙ্গীকারের সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ হতো। বাস্তবে এর বদলে রাজস্ব ঘাটতি কমাতে প্রচলিত কাঠামো ধরেই এগিয়েছে সরকার। 

রাজনৈতিক সরকারগুলোর আমলেও আমরা দেখতাম, সর্বসাধারণের ওপর প্রযোজ্য হয় এমন সব ক্ষেত্র থেকে সহজে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে চাইত সরকার। জনস্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে সরকারের অর্থ সংকট দূর করাই ছিল লক্ষ্য। হালে যেসব পণ্য ও সেবার ওপর কর বাড়ানো হলো, তাতে ‘কেবল মধ্যবিত্ত কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ বলে প্রচারের চেষ্টা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে ব্যাপক জনসাধারণ আসবে এর আওতায়। গত পাঁচ মাসে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও না হয় কথা ছিল। প্রকৃতপক্ষে এটা আগের অবস্থাতেই রয়ে গেছে; কোনো কোনো মাসে ঘটছে অবনতি। 

উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হলেও মূল্যস্ফীতি দ্রুত কমে আসার কারণ নেই– নতুন গভর্নর এটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। এ অবস্থায় কেবল আহরণ বাড়ানোর তাগিদ থেকে শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক আরোপের যে পদক্ষেপ নেওয়া হলো, তাতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ার আশঙ্কা। এটা কমিয়ে আনার লক্ষ্যের কী হবে? গভর্নর বলেছিলেন, ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট উন্নত পরিলক্ষিত হবে। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাস অতিক্রান্ত। কর বৃদ্ধির এমন পদক্ষেপের পর চলতি অর্থবছরের বাকি ছয় মাসেই-বা মূল্যস্ফীতি হ্রাস প্রক্রিয়া জোরদার করা হবে কীভাবে? 
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী, ‘অধিকতর সংস্কারে’ যেতে হলে সরকার আগামী বছরের মধ্যভাগ পর্যন্তও থাকতে পারে। আর ‘অল্প সংস্কার’ করে নির্বাচনে গেলে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। দ্বিতীয় ক্ষেত্রেও সরকার আরও প্রায় ১২ মাস থাকবে। এ অবস্থায় নতুন বাজেট দিতে হবে তাকে। প্রশ্ন এসে যায়, তখনও কি এ ধরনের করের ওপর বেশি নির্ভর করবে সরকার? নাকি তা কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নেওয়া হবে? 

আমাদের হতাশাজনক কর-জিডিপি অনুপাত নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। এটা বাড়ানোর শর্তও রয়েছে আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচিতে। সেটি পরিপালন করা গেলে সামগ্রিক সক্ষমতাও বাড়বে। প্রশ্ন হলো, কর-রাজস্ব বাড়ানো হবে কীভাবে? ভ্যাটের মতো ক্ষেত্রে তো সর্বসাধারণের ওপর চাপ গিয়ে পড়ে। আইএমএফ কিন্তু বলেনি– একই পণ্য বা সেবায় আরও ভ্যাট আরোপ করে রাজস্ব বাড়াও! আহরণ বাড়ানোর পদ্ধতিটা বেছে নিতে হয় সরকারকেই। আর এতে প্রকাশ পায় তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট আরোপের ঘটনায় বৈষম্য হ্রাসের দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু দেখা গেল না। কিছু ক্ষেত্রে কর বাড়ানো হয়েছে; এমনকি তিন গুণ! চলতি বাজেটে একবার বাড়ানোর পর একই ক্ষেত্রে নতুন করে কর আরোপের ঘটনাও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির শিকার মানুষের জীবনে এর অভিঘাত ভেবে দেখার ফুরসত কেন হলো না– বোধগম্য নয়। 

সরকার আইএমএফের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতির চেয়ে কিছুটা বেশি ঋণ চাইছে। যে অর্থনীতি তারা হাতে পেয়েছে, সেটা সামলাতে এর প্রয়োজন রয়েছে হয়তো। এ অবস্থায় সংস্থাটি শর্ত পালনে আরও কঠোর হতে পারে। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি এবং এখান থেকে উত্তরণের জটিলতাও তাদের না জানার কথা নয়। সেটা তাদের বোঝানোও যেত। এ সক্ষমতায় সরকারে ঘাটতি রয়েছে বলেও মনে হয় না। 
দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকে আবার শোনা যাচ্ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার ‘পরিচালন ব্যয়’ কমাবে। বড় মাপে এডিপি কাটছাঁটের কথাও বলা হচ্ছিল। সত্যি বলতে, এডিপি বাস্তবায়নের সামর্থ্য এখন আরও কম। এ অবস্থায় এতটা অস্থির হয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ কেন নিতে হলো– সে প্রশ্নটিই বরং উঠবে বেশি করে। সরকার তার দায়দেনা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়েছে বলে খবর রয়েছে। কিন্তু প্রশাসন পরিচালন ব্যয় কমাতে পারছে বলে মনে হয় না। বিগত সরকারের মতো মহার্ঘ ভাতা দিয়ে সরকারি কর্মচারীদের খুশি রাখার প্রবণতাও লক্ষণীয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় সেটা প্রয়োজন হয়তো। কিন্তু দেশের সিংহভাগ কর্মজীবী তো বেসরকারি খাতে নিয়োজিত। এর মধ্যে বিরাটভাবে উপস্থিত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। এসব ক্ষেত্রে বেতন বা মজুরি বৃদ্ধির হার কি উল্লেখযোগ্য? তারা মূল্যস্ফীতির অভিঘাত মোকাবিলা করছে কীভাবে? শতাধিক পণ্য ও সেবায় কর বৃদ্ধির সর্বসাম্প্রতিক পদক্ষেপে এদের মনে প্রতিক্রিয়াই-বা কী? 

ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোয় বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সংকুচিত হওয়ার প্রক্রিয়া জোরদার হবে বলে ধারণা। করের চাপে পণ্য ও সেবার দাম বাড়লে বিপুলসংখ্যক মানুষ ভোগ কমিয়ে চলতে চায়। এতে কমে যায় ‘কার্যকর চাহিদা’। তার প্রভাব পড়তে পারে অনেক পণ্য উৎপাদন ও সেবা সরবরাহে। যেমন বেকারি পণ্যের দাম আরও বাড়লে বিশেষত নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে এর চাহিদা কমার শঙ্কা। এ খাতে রপ্তানিও কমতে পারে। রেস্তোরাঁয় তিন গুণ ভ্যাট কার্যকর হলে কমে যাবে ভোক্তা। এ অবস্থায় ভ্যাটের আওতায় না থাকা স্ট্রিট ফুডের ব্যবসা বাড়লে একই খাতের দুই গ্রুপে বিরোধও হবে উপস্থিত। এদিকে আবাসিক হোটেলে ব্যয় বাড়লে ব্যাহত হবে ট্যুরিজম। আর সেলফোন সেবায় আরও কর বৃদ্ধি সব শ্রেণির মানুষকে ফেলবে সংকটে। সেলফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রবণতা এতে আরও কমতে পারে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটেও প্রথমবারের মতো বসানো হয়েছে সম্পূরক শুল্ক। এক ক্ষেত্র থেকে আরেক ক্ষেত্রে গিয়ে ব্যয় সীমিত রাখার সুযোগও দেখা যাচ্ছে অনুপস্থিত! সেলফোন ও ইন্টারনেটনির্ভর ছোটখাটো ব্যবসায়িক উদ্যোগও কি এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? বর্তমান কর্মসংস্থান পরিস্থিতিও কি এ ধরনের ব্যয় বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত? 

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

খেলাপি ঋণে বাংলাদেশ এশিয়ায় কেন শীর্ষে

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে মন্দ বা খেলাপি ঋণ অনেক দিনের বিরাট সমস্যা। শুরুতে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় এ ব্যাধি বিদ্যমান হলেও পরবর্তী সময়ে বৃহৎ ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকেও ছড়িয়ে পড়ে। এটি, তথা ঋণখেলাপির সংস্কৃতি ধীরে ধীরে এক মহিরুহ আকার ধারণ করেছে।

গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের লুকানো খেলাপি ঋণ বের হয়ে আসছে। আবার অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ও তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের ঋণও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। তাতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ এক বছরের ব্যবধানে মোট ঋণের ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি এখন খেলাপি।

 সম্প্রতি প্রকাশিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শীর্ষে উঠে আসার বিষয়টি সামনে এসেছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর আর্থিক বিভিন্ন সূচকের অবস্থা নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। অবশ্য খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে ২০২৩ সালের তথ্য। তাতেই বাংলাদেশ শীর্ষে। এটি যে ২০২৫ সালে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তা আমরা জানি।

আগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কায়দায় বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হতো। অন্যদিকে সহজে ঋণ পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠন করার কারণেও খেলাপি ঋণ কম ছিল। এখন ঋণমানে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করা শুরু হয়েছে। আবার ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা ও আওয়ামী রাজনীতি–সমর্থিত ব্যক্তিদের ব্যবসা খারাপ হয়ে পড়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

খেলাপি ঋণ এভাবে বাড়তে থাকলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, সন্দেহ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে উদ্যোগ নিতে হবে। যাঁরা ভালো ব্যবসায়ী, তাঁরা যেন আবার ব্যবসা শুরু করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। সেটি নিয়ে সরকার কাজও করছে।

 এডিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। ২০২৩ সাল শেষে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল থেকে প্রতিবছরই বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে। ২০২১ সালে এই হার ছিল ৮ শতাংশ, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মতো ২০২১ সাল থেকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কার।

দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর খেলাপি ঋণ কমেছে। যেমন ভুটানের খেলাপি ঋণের হার ২০২০ সালে ছিল ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০২২ সালে কমে হয়েছে ৩ শতাংশ। ভারতের খেলাপি ঋণের হার ২০২০ সালে ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কমে হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। মালদ্বীপের খেলাপি ঋণ এই সময়ে ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। একই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম খেলাপি ঋণ তাইওয়ান ও কোরিয়ার। দেশ দুটির খেলাপি ঋণের হার যথাক্রমে শূন্য দশমিক ১ ও শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০২৪ সাল শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ছিল ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২৫ সালের জুন শেষে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকায়, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের চার ভাগের এক ভাগের বেশি খেলাপি হয়ে গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বলতে শুনেছি, গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। আগেই বলেছি, ঋণখেলাপি হওয়ার নিয়ম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণেও দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যেসব ঋণ নবায়ন করা হয়, তার অনেকগুলো আদায় হচ্ছে না। অনিয়মের কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ। এতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা সামনে আরও বাড়তে পারে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন, বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নিয়ে যাচ্ছেন, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।

সূত্রগুলো বলছে, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ও বহুল সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলোর ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে। এই পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই কাজ বাস্তবায়ন করতে এরই মধ্যে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্তও হয়ে গেছে। পাশাপাশি সরকারি খাতের জনতা ও রূপালী এবং বেসরকারি খাতের ইউসিবি, আইএফআইসি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ট্রাস্ট ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে।

পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, খেলাপি হয়ে পড়া প্রায় ১ হাজার ২৫০ প্রতিষ্ঠান বিশেষ ব্যবস্থার অধীন ঋণ পুনর্গঠনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়মিত করার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন একটি বিস্তৃত নীতিমালা তৈরি করে ব্যাংকগুলোকে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দিতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানা গেছে, এই নীতিমালায় নির্দিষ্ট অর্থ জমা দিয়ে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হবে। তবে ঋণ পরিশোধে যতটা সময় অবকাশ পাবে, ওই সময়ে সুদ পরিশোধ করতে হবে। এর ফলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলে আশা করছেন অনেকে। তবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী না করলে কিংবা ব্যবসা পরিচালনায় মনোযোগী না হলে তার উল্টোটাও ঘটতে পারে। সুযোগের অসৎ ব্যবহারের উদাহরণ বাংলাদেশে অনেক।

সামগ্রিক ঋণখেলাপির সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে গেলে আমাদের দুষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি তথা স্বজনতোষী পুঁজিবাদ থেকে যেমন বেরিয়ে আসতে হবে, তেমনি ঋণ সম্প্রসারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। কমাতে হবে পরিচালকদের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ।

মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ