নতুন বছরে প্রথম বিদেশ সফরে আগামী ২১ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডে যাবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। 

বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মো. রফিকুল আলম এ তথ্য জানিয়েছেন।

সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূস সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেবেন। আগামী ২০ থেকে ২৪ জানুয়ারি এ সম্মেলন হবে। 

২১ থেকে ২৪ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডে থাকবেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় সম্মেলনে অংশ নেওয়া ছাড়াও কয়েকটি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান, সংস্থা প্রধান, বিভিন্ন কোম্পানির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী এবং উদ্যোক্তার সঙ্গে বৈঠক ও সাক্ষাৎ করবেন তিনি।

আগামী ২৪ জানুয়ারি দাভোস থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার।

গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে বিদেশ সফর শুরু করেন ড.

মুহাম্মদ ইউনূস। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেন তিনি। দ্বিতীয় সফরে নভেম্বরে আজারবাইজানে কপ-২৯ সম্মেলনে যোগ দেন সরকারপ্রধান। বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে প্রধান উপদেষ্টা ডি-৮ সম্মেলনে যোগ দিতে মিশর সফর করেন। তিনটি সফরেই বহুপক্ষীয় ফোরামের অংশগ্রহণ ছিল। 

ঢাকা/হাসান/রফিক

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেন: আমাদের স্মৃতির পথযাত্রা

আজ ৩ নভেম্বর তিনি ৯২ বছরের চৌকাঠ টপকালেন। জন্মেছিলেন ১৯৩৩ সালে। দীর্ঘ জীবন তাঁর—শুধু দীর্ঘ বললে অন‍্যায় হবে, একটি অনন‍্যসাধারণ, অভাবনীয়, বিস্ময়কর জীবন তাঁর। সে জীবনের তুলনা মেলা ভার কোন সৃষ্টিতে, প্রাপ্তিতে বা অবদানে। না, সেসব বিষয়ে আমি বলছি না—সেসব বিধৃত আছে নানান বিদগ্ধজনের লেখায়, আলাপচারিতায়, তাঁর ওপরে তৈরি জীবনচিত্রে। অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেনের অতুলনীয় কীর্তির কথা সারা বিশ্ব জানে।

আমি শুধু ভাবি আমার অভাবনীয় সৌভাগ্যের কথা। প্রায় তিন দশক সময়ে কাজের সূত্রে শতবার দেখা হয়েছে, একত্রে কাজ করেছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেছে নিউইয়র্কে, বোস্টনে, কেমব্রিজে নানান বিষয়ের আলোচনায়, বিতর্কে। আমাদের সময়কার এক বিস্ময়কর প্রতিভার খুব কাছাকাছি থাকার সুযোগ হয়েছে আমার।

অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেনের নামের সঙ্গে আমার পরিচয় ষাটের দশকের শেষ প্রান্তে—যখন আমি বিশ্ববিদ‍্যালয়ের ছাত্র। তাঁর যে বইটি প্রথম আমার হাতে আসে, তার নাম ছিল ‘চয়েস অব টেকনিক’। খুব সম্ভবত তাঁর স্নাতক-উত্তর অভিসন্দর্ভের ওপরে ভিত্তি করে লেখা। সে বইয়ের বেশির ভাগই বুঝিনি—বোঝার কথাও নয় অর্থনীতির প্রথম বর্ষের একজন শিক্ষার্থীর। কিন্তু তাঁর বিশ্লেষণের ধার এবং তাঁর যুক্তির শাণিত ভাষা বুঝতে পেরেছিলাম।

তারপর আমার ছাত্রজীবনে, বিদেশে উচ্চশিক্ষাকালে এবং আমার শিক্ষকতা জীবনে আমাদের প্রজন্মের আরও অনেকের মতো আমাকে দ্বারস্থ হতে হয়েছে তাঁর গবেষণা এবং বিদ‍্যায়তনিক লেখার কাছে। আমাকে মুগ্ধ করেছিল তাঁর মানুষকেন্দ্রিক চিন্তাচেতনা; ব‍্যক্তিমানুষ এবং মানবগোষ্ঠীর সক্ষমতা, সুযোগ এবং তাঁর চয়ন ও কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার প্রয়াস; অর্থনীতিকে দর্শনের সঙ্গে সম্পৃক্তকরণ; এবং সমতা, বৈষম‍্য এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর তীক্ষ্ণ লেখা।

অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেনের সঙ্গে আমার চাক্ষুষ পরিচয় ১৯৯২ সালে নিউইয়র্কে ড. মাহবুব উল হকের ঘরে যখন আমি জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরে যোগদান করি। অধ‍্যাপক সেন, মাহবুব উল হক এবং অধ‍্যাপক রেহমান সোবহান সতীর্থ বন্ধু ছিলেন কেমব্রিজে। তারপর দীর্ঘ এক যুগ তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করা মানব উন্নয়ন বিষয়ে। কাজ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা আর তর্কবিতর্কের বৈঠক বসত মূলত মাহবুব উল হকের ঘরে। কখনো কখনো অধ‍্যাপক সেন আমার ঘরে চলে আসতেন গল্প করতে বা আমার বাংলা বইয়ের পাতা ওলটাতে।

আমার কেন যেন মনে হতো, তিনি বাংলায় গল্প করতে চাইতেন। তিনি গল্প করতেন কালোর চায়ের দোকানের কথা, সাইকেলে শান্তিনিকেতনে টই টই করে ঘোরা, পৌষ মেলার কথা, শান্তিনিকেতনে তাঁর পৈতৃক নিবাস ‘প্রতীচীর’ কথা। তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন যে তাঁর বন্ধু মীনাক্ষী দত্ত (বুদ্ধদেব বসুর কন্যা) একবার তাঁকে তুলনা করেছিলেন ‘খাঁটি জিলেট ব্লেডের মতো ধারালো বলে’ এবং বলেছিলেন যে প্রেসিডেন্সিতে অধ‍্যাপক সেনকে দেখা যেত গোটানো হাতা আর জামার পাশের পকেটে গোল করে মোড়ানো দু-নম্বরি খাতা নিয়ে।

হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধার্ঘ‍্য ঢেলে দিয়ে তাঁকে আমি বলি, ‘শুভ জন্মদিন, অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেন। আপনি শুধু আমাদের বাতিঘর নন, আপনি আমাদের ধ্রুবতারা। আপনি জ্বল জ্বল করতে থাকুন দীর্ঘদিন ধরে আমাদের পথ দেখানোর জন্য, দিকনির্দেশ করার জন্য।’

নব্বইয়ের দশকে অধ‍্যাপক সেন যখন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার হলেন, তখন আমাদের অনেক বৈঠক বসত মাস্টারস লজে। কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে ড. হক, আমি এবং অন্যরা বাড়ির পেছনের বাগানে বেড়াতাম। মনে আছে, একবার এমা (অধ্যাপক এমা রথসচাইল্ড, অধ্যাপক সেনের স্ত্রী) এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। ইতিহাসবিদ এমা জানিয়েছিলেন যে ওই বাড়িটি একসময় রঙ্গমঞ্চ ছিল।

বাগানের দেয়ালে দেয়ালে তার ছাপ। আমি অনেক সময় এমার অফিসে বসেও কাজ করেছি। মনে আছে, প্রথমবার যখন মাস্টার্স লজে যাই, তখনো সেন পরিবার সেখানে ওঠেনি। আমি সেখানে এক রাত ছিলাম। স্বল্প আলো, নিউটনের চেয়ার, দেয়ালের ছায়া সব মিলে এক রহস‍্যময় ভৌতিক আবহ সৃষ্টি হয়েছিল। সে রাতের কথা আমি কখনো ভুলতে পারব না।

আরও পড়ুনবর্তমান সংকটে হবস, রবীন্দ্রনাথ ও অমর্ত্য সেন যেখানে প্রাসঙ্গিক১৩ জুন ২০২৫

১৯৯৮ সালে মাহবুব হক প্রয়াত হলেন। তার বছর তিনেক পরে আমি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ‍্য বিভাগের পরিচালক পদে বৃত হলাম। অধ‍্যাপক সেনের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের যোগসূত্রটি একটু ক্ষীণ হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের অন‍্য সম্পর্কগুলো রইল অটুট।

১৯৯৮ সালে অধ‍্যাপক সেন যখন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবর পেলেন, তখন তিনি নিউইয়র্কে। সকালেই তিনি চলে এলেন আমার ঘরে—কী উত্তেজনা, কী উন্মাদনা আমাদের সবার। সেদিনকার সব অনুষ্ঠানের আয়োজন আমাদের সহকর্মীরাই করল। অধ‍্যাপক সেনের কাজের ওপরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিল আমার তাঁর সহকর্মী হিসেবে। সে বছরেই জাতিসংঘ আয়োজিত ড. হকের স্মরণসভায় অপূর্ব একটি বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন বন্ধুর স্মৃতিতে।

বেণু (রাশেদা সেলিম, আমার প্রয়াত প্রথম স্ত্রী) এসেছিল সে অনুষ্ঠানে। কী যে খুশি হয়েছিলেন তিনি বেণুকে দেখে। অনেক মমতায় আদর করেছিলেন ওকে। বেণু বলেছিল যে ও মাছের ঝোল রেঁধে তাঁকে খাওয়াবে। কী যে উত্তেজিত হয়েছিলেন তিনি। বারবার বলেছিলেন যে বরফ দেওয়া মাছ হলে চলবে না, তাঁর তাজা মাছ চাই। না, সেটা আর হয়ে ওঠেনি কোনো দিন। বেণু চলে যাওয়ার কয়েক মাস আগে অধ‍্যাপক সেন নিউইয়র্কে এলে বেণুকে দেখতে চেয়েছিলেন—আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আমাদের মধ‍্যাহ্নভোজে।

আরও পড়ুনবাংলাদেশের বাজেট যে কারণে অমর্ত্য সেনের উন্নয়নতত্ত্বের পরিপন্থী২২ আগস্ট ২০২৪

জাতিসংঘের কাছে ‘পাম’ রেস্তোরাঁয় আমরা কাটিয়েছিলাম বেশ কটি ঘণ্টা। চলে যাওয়ার আগে নিজে বলে ছবি তুলেছিলেন বেণুর সঙ্গে, ওর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। বেণুর এবং আমার কারও চোখ তখন শুকনো ছিল না। বেণুর প্রয়াণের পরে অধ‍্যাপক সেন আমাকে দীর্ঘ একটি হৃদয়স্পর্শী ব‍্যক্তিগত চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে কৈশোরে তাঁর প্রাণঘাতী অসুস্থতা এবং কলকাতা নীলরতন হাসপাতালে সে যুগের চিকিৎসার কথা তিনি উল্লেখ করেছিলেন।

তার কিছুদিন পরে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। বারবার আমাকে বলে দিয়েছিলেন যে ঢাকায় তিনি ‘বেণুর মেয়েকে’ দেখতে চান। মতি ভাইয়ের (প্রথম আলো সম্পাদক) উদ্যোগে তাঁর শত ব‍্যস্ততার মধ্যেও অধ‍্যাপক সেন আনিয়ে নিয়েছিলেন সদ্য মা-হারা আমাদের জ্যেষ্ঠ কন‍্যা রোদেলাকে। রোদেলা এখনো বড় মমতার সঙ্গে তাঁর স্নেহ-আদরের কথা বলে। তারও বছর বারো আগে আমাদের কনিষ্ঠ কন‍্যা মেখলা এসেছিল নিউইয়র্কে তাঁর এক বক্তৃতায়। আমি পরিচয় করিয়ে দিতেই কী যে খুশি হয়েছিলেন তিনি! মেখলার সঙ্গেও ছবি আছে ওঁর।

আরও পড়ুনঅমর্ত্য সেনকে মনে করালো ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা০৬ নভেম্বর ২০২০

আমার শ্বশ্রুপিতা, বেণুর বাবা, জাতীয় অধ‍্যাপক কবীর চৌধুরীর সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে তাঁর। তাঁদের দুজনার মধ‍্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা বোধ ছিল অত্যন্ত বেশি। অধ‍্যাপক চৌধুরীর সম্ভবত ৮০তম জন্মবার্ষিকীর একটি স্মরণিকার জন্য অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেন একটি শুভেচ্ছাবাণী দিয়েছিলেন বাংলায়। সেটার পরিমার্জন, পরিশোধন এবং পরিশীলনে অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেন যে কতখানি সময় ও শ্রম দিয়েছিলেন, তা সাধারণ মানুষের অনুধাবনের অগম‍্য। সেটার একটা খসড়া আমার কাছে আছে।

একটা হাসির কথা মনে পড়ল। জাতিসংঘে আমার পদবি কী, আমি যে জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক প্রতিবেদনের সঙ্গে জড়িত, তার সবটাই অধ‍্যাপক চৌধুরীর জানা। কিন্তু সাহিত‍্যের লোক বলে তাঁর হয়তো ঠিক পরিষ্কার ধারণা নেই যে তাঁর জামাতা আসলেই কী করে, কী তার কাজ। হার্ভার্ডে এক সভায় দুজনেই মঞ্চোপবিষ্ট—আমার শ্বশ্রুপতা সভাপতি, অধ‍্যাপক অমর্ত‍্য সেন প্রধান অতিথি। কিছুক্ষণ পরে সভাপতি প্রধান অতিথিকে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা, আপনি কি জানেন, আমার জামাইটি ঠিক কী করে?’ ততোধিক নিচুস্বরে প্রধান অতিথি জবাব দেন, ‘সেলিম? ও যে কী করে তা আমি জানি না।’ সেই সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ‘সেলিম যে কী করে, তা কেউ জানে বলে মনে হয় না। ‘ঘটনাটি জেনে সবার যে কী হাসি!

অমর্ত‍্য সেন ও সেলিম জাহান

সম্পর্কিত নিবন্ধ