রিকশার প্যাডেলে পা রাখা জীবনের সঙ্গে নগরের অনেক মানুষই পরিচিত নন, পরিচিত নন জীবিকার তাগিদে, তিন বেলার খাবারের টাকা জোগাড় করতে, পরিবারের অসুস্থ মানুষটির ওষুধ কেনার কষ্টের গল্পগুলোর সঙ্গেও। শহরের প্রত্যেক রিকশাচালকের গল্পই যেন একেকটা উপন্যাস, সুখ-দুঃখে ভরা বাস্তব গল্পের সিনেমা। সেই গল্পটিই পর্দায় তুলে এনেছেন নির্মাতা অমিতাভ রেজা।
আয়নাবাজির মতো ব্যবসাসফল সিনেমার নির্মাতা রিকশা গার্ল-এর দুঃখ-বেদনা আর আনন্দকে একত্র করে বানিয়েছেন ‘রিকশা গার্ল’। যে সিনেমায় শহরের যাপিত এক জীবনের প্রতিচ্ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন নান্দনিক সিনেগ্রাফি; যেখানে রয়েছে সম্পর্ক, দায়িত্বশীলতা, আতঙ্ক আর প্রেমের প্রতিচ্ছবি। রয়েছে বুনো শালিকের দল, শহুরে রাস্তার কুকুরও। নির্মাতা জানালেন, সিনেমার পুরোটা জুড়ে রিকশা পেইন্টিংয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রতিটি ফ্রেমে আলো ও রঙের পরীক্ষায় উৎরে যাওয়ার চেষ্টাও রয়েছে।
আয়নাবাজির ৯ বছর পর.
..
প্রথম সিনেমা দিয়ে বাজিমাত করেছিলেন অমিতাভ রেজা চৌধুরী। ২০১৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল তাঁর পরিচালিত ‘আয়নাবাজি’। এরপর কেটে গেছে প্রায় ৯ বছর। এ ৯টি বছর কেবল রিকশা গার্ল সিনেমাটি নিয়ে বসেছিলেন তা কিন্তু নয়। বানিয়েছেন ওটিটি কনটেন্ট ও বহু বিজ্ঞাপন। সিনেমাটির শুটিংও করোনা মহামারির আগে শেষ হয়েছিল। পরে ২০২০ সালে মুক্তির কথা থাকলেও বদলে যায় পরিকল্পনা। দেশে মুক্তি না দিলেও বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় সিনেমাটি। বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে পুরস্কারও জিতেছে রিকশা গার্ল। এবার আগামীকাল সারা দেশে মুক্তি পাচ্ছে ‘রিকশা গার্ল’।
নারীর ক্ষমতায়ন ও রিকশা পেইন্টিংয়ের ঐতিহ্য
‘রিকশা গার্ল’ ছবির গল্প নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে। বাংলাদেশের মেয়ে নাইমা। পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করেন। পুরুষের বেশে অসুস্থ বাবার রিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হন। এক দুর্ঘটনায় বাবার প্রিয় রিকশাটি ভেঙে যায়। রিকশার ভেঙে যাওয়া অংশ ঠিক করতে শুরু হয় নাইমার নতুন সংগ্রাম। এ সিনেমার মাধ্যমে সমাজের কঠিন কাজ রিকশা চালানোর মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নকেই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। সঙ্গে বাংলাদেশের চিরায়ত পেইন্টিংয়ের ঐতিহ্যের দিকটাও তুলে আনা হয়েছে। অমিতাভ রেজা এখানে বলেছেন, ‘‘ছবির চরিত্র নাইমা বেশ শিল্পমনা। ছবি আঁকতে পছন্দ করে। দরিদ্র সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবা হঠাৎ অসুস্থ হলে স্রোতের প্রতিকূলে লড়াই শুরু হয় তার। উপায়ান্তর না পেয়ে রিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হয়। ‘রিকশা গার্ল’ ছবির মাধ্যমে রিকশা পেইন্টিংয়ের ঐতিহ্য আর ধারণাকে তুলে ধরারও চেষ্টা ছিল।’’
যেভাবে রিকশা গার্ল হয়ে ওঠা
ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের লেখিকা মিতালি পারকিনসের কিশোর সাহিত্য ‘রিকশা গার্ল’ বইটি ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সর্বাধিক বিক্রি হয়েছিল। এ উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে চিত্রনাট্য লিখছেন শর্বরী জোহরা আহমেদ। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া অভিনীত যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘কোয়ান্টিকো’র চিত্রনাট্যকারদের একজন তিনি। কাজেই সিনেমাটির প্রধান চরিত্রে যে অভিনয় করবেন তাঁকে প্রস্তুতি নিয়েই নামতে হবে মাঠে। নেমেছেনও। সিনেমাটির প্রধান নাইমা। তিনিই মূলত ‘রিকশা গার্ল’। চরিত্রটি ফুটে উঠেছে নভেরা চৌধুরীর মাধ্যমে। বাস্তব জীবনে তিনি অভিনেত্রী মোমেনা চৌধুরীর মেয়ে। অভিনয় যার রক্তে তিনি যে পুরোপুরি রিকশা গার্ল হয়ে উঠতে পারবেন সে বিশ্বাস নির্মাতা অভিতাভ রেজার ছিল। সে বিশ্বাস ভাঙেনি। এ সিনেমায় নভেরা থেকে নাইমা হয়ে উঠতে বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়েছে অভিনেত্রীকে। নভেরার মুখেই শুনি, ‘নভেরা থেকে নাইমা হওয়ার জার্নিটি বেশ অদ্ভুত ছিল। মনে আছে, নিকেতনপাড়ার ভেতর আমি এক মাস রিকশা চালিয়েছি। আমার পেছনে ইডিরা বসে থাকত আর আমি রিকশা চালাতাম। পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে অনেক বছর থাকতে হয়েছে। সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে ঢাকাকে খুব গভীরভাবে দেখার সুযোগ হয়েছে। শুধু ঢাকা নয়, পাবনাতেও এর দৃশ্য ধারণ হয়েছে। সেখানের রাস্তার রিকশাচালকদের সঙ্গে মিলেমিশে রিকশা চালিয়েছি। নির্মাতা, অভিনশিল্পী– সবার জন্য এটি কষ্টের প্রজেক্ট ।’
আঁকিয়েদের অনুপ্রেরণা দেবে
অমিতাভ রেজা চৌধুরী বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের লেখক মিতালি পারকিনসের উপন্যাস অবলম্বনে হলেও ‘রিকশা গার্ল’ নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের পটভূমিতে। আমাদের দেশের রিকশা পেইন্টিংয়ের মতো দারুণ একটা শিল্পকে সারা বিশ্বের দর্শকের সামনে তুলে ধরা হয়েছে সিনেমায়। আমাদের কিশোর-কিশোরী, যারা ছবি আঁকতে চায়, তাদের অনুপ্রাণিত করবে সিনেমাটি। আশা করি অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের সিনেমাটি দেখার সুযোগ করে দেবেন।’’ বিভিন্ন চরিত্রে সিনেমাটিতে আরও অভিনয় করেছেন চম্পা, মোমেনা চৌধুরী, নরেশ ভূঁইয়া, অ্যালেন শুভ্রসহ অনেকেই।
ত্রিশটিরও বেশি আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রদর্শন
মুক্তির আগেই বিশ্বের ৩০টির বেশি আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রদর্শিত হয় সিনেমাটি। এরমধ্যে ব্রাসেলসে ১৬তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ফিলেম’অন কিডস অ্যাওয়ার্ড জিতেছে, শিকাগো ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেনস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ৩৯তম আসরের ‘বেস্ট অব ফেস্ট’ পুরস্কার পাওয়াসহ জাপানের ওসাকা এশিয়ান চলচ্চিত্র উৎসব ২০২৪-এ প্রদর্শিত হয়েছে। পাশাপাশি ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ১৮ রাজ্যের ৫২টি শহরে চলচ্চিত্রটি দেখানো হয়।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬০ দিন পর শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা, উৎসবের আমেজ
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) দীর্ঘ ১৬০ দিন পর একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে টানা বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসেছেন। সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে বইছে উৎসবের আমেজ।
সকালে কুয়েট ক্যাম্পাসে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস। ছাতা মাথায় দল বেঁধে ছুটছেন ক্লাসরুমের দিকে। কখনো এক ছাতার নিচে দু-তিনজন। কারও সঙ্গে অভিভাবকও এসেছেন। সকাল নয়টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি শিক্ষাবর্ষের প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী ক্লাসে যোগ দেন। নতুন উপাচার্য অধ্যাপক মাকসুদ হেলালী বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে শ্রেণি কর্মসূচি পর্যবেক্ষণ করেন।
ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (ইসিই) বিভাগের ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী দীপ্ত বলেন, ‘আমাদের প্রায় এক সেমিস্টার নষ্ট হয়ে গেছে। এই সময়টা খুব অস্বস্তিতে কেটেছে। ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে, তবে এখন আবার ক্লাস শুরু হওয়াটা ইতিবাচক দিক। আমরা আশাবাদী।’ একই ব্যাচের শিক্ষার্থী আম্মান বলেন, ‘অনেক দিন জীবনটা থেমে ছিল। আজকের দিনটা বিশেষ মনে হচ্ছে। ঠিক যেন স্কুলজীবনের প্রথম দিনের মতো। সব হতাশা কাটিয়ে আমরা অনেকটা নতুন করে শুরু করছি।’
হুমায়ুন কবির নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার ছেলে বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়ে। পাঁচ মাস ধরে ক্লাস বন্ধ থাকায় ও মানসিকভাবে খুব চাপের মধ্যে ছিল। একসময় অসুস্থও হয়ে পড়ে। কুয়েটে এমন পরিস্থিতি আগে দেখিনি। কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলে হয়তো আগেই খুলে যেত। তারপরও এখন অন্তত খুলেছে, এটা বড় স্বস্তি।’
কুয়েটের ছাত্র পরিচালক আবদুল্লাহ ইলিয়াস আক্তার বলেন, আজ থেকে কুয়েটে ক্লাস শুরু হয়েছে। তবে এখনো সব শিক্ষার্থী আসেননি। যাঁদের কেবল ক্লাস রয়েছে, তাঁরা অংশ নিচ্ছেন। যাঁদের পরীক্ষা ছিল, তাঁরা প্রস্তুতির জন্য কিছুটা সময় চেয়েছে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন হবে ১৪ আগস্ট, ক্লাস শুরু ১৭ আগস্ট।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। ওই রাতেই তৎকালীন উপাচার্য ও কয়েকজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ ওঠে। এরপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২৬ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মাছুদ ও সহ-উপাচার্য অধ্যাপক শরিফুল আলমকে অব্যাহতি দেয়। ১ মে চুয়েটের অধ্যাপক হজরত আলীকে অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনার বিচার দাবিতে ৪ মে থেকে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দেয় শিক্ষক সমিতি। এরপর কোনো শিক্ষকই ক্লাসে ফেরেননি। শিক্ষক সমিতির বিরোধিতার মুখে হজরত আলী দায়িত্ব পালন করতে না পেরে ২২ মে পদত্যাগ করেন।
এরপর ১০ জুন নতুন উপাচার্য নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয় সরকার। সেই ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার কুয়েটের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মাকসুদ হেলালী। পরদিন শুক্রবার তিনি খুলনায় এসে দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় আন্দোলন কর্মসূচি তিন সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে ক্লাসে ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে গতকাল সোমবার ক্লাস শুরুর নোটিশ জারি করা হয়।