এসেছিস যখন দাগ রেখে যা– কথাটা রামকৃষ্ণ বলার আগেই মানুষ দাগ রাখতে শুরু করেছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার ফুট উপরে শ্রীলঙ্কার পবিত্র মালয় পাহাড়ে পাওয়া গেছে প্রাচীন পদচিহ্ন। প্রতিটি ধর্মের মানুষ মনে করেন এটি তাদের ধর্মের মহাপুরুষের পদচিহ্ন। সনাতনধর্মীরা মনে করেন শিবের, বৌদ্ধরা মনে করেন গৌতমের আর কেনান ধর্মের মানুষেরা বিশ্বাস করেন এটি প্রথম মানব অ্যাডামের পদচিহ্ন। এক পদচিহ্নকে স্থানীয়রা বলেন শ্রীপদ বা পবিত্র পা। এ পদচিহ্নকে সম্মান করেন প্রতিটি ধর্মের অনুসারীগণ। পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষ তার পূর্বপুরুষের যে কোনো স্মৃতিচিহ্নকে ভালোবাসে। হোক সে পায়ের দাগ বা যে কোনো স্মৃতিবাহী কিছু।
আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছবি এঁকে দাগ রেখে গেছেন গুহার ভেতর, পাথরের গায়ে। নিজেদের কথা রেখে গেছেন গল্প গসপেল প্যারাবল, রূপকথায়। মানুষ সেগুলো যত্নে আগলে রেখেছে, হৃদয়ে বহন করে চলেছে পরম মমতায়। এর কোনো কোনো স্মৃতি একান্ত নিজের, পরিবারের, আবার কোনো কোনোটি পুরো একটি সম্প্রদায় বা জাতি রাষ্ট্রের। যেনবা এ জগতে হারায় না কিছুই। মায়া রেখে যায়।
মানুষ বড় স্মৃতিকাতর জীব। অবশ্য অন্যান্য প্রাণীর খবর আমরা জানি না। সম্ভবত তাদের স্মৃতি মানুষের মতো এত দীর্ঘস্থায়ী নয়। অনেকে বিশ্বাস করেন কেউ কেউ নাকি পূর্বজন্মের স্মৃতিও বহন করে চলেন। বাংলা ভাষায় জাতিস্মর শব্দটি রয়েছে। মানুষের স্মৃতি বহন করার এই কাজটি যে সব সময় সুখকর, এমনটি নয়। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুঃখের। মানুষ দুঃখ বিয়োগ বেদনার স্মৃতিই বেশি বহন করে। আর কবিদের প্রধান কাজই স্মৃতি নিয়ে।
২.
রাঙা মামিমার সাঁকো হয়ে ভোর রাতে দেশত্যাগ করার কবিতাটি তো অনেকেরই জানা। তিনি সাঁকো পার হয়ে চলে গেছেন কিন্তু রাঙা পায়ের দাগ রেখে গেছেন সাঁকোর গায়ে। সে দাগের বেদনা ভুলতে পারেননি ফেলে যাওয়া স্বজন। সে না হয় অন্য দেশে যাওয়া। কিন্তু প্রিয় মানুষের যাওয়া যদি হয় চিরতরের, তাহলে সে দাগ কি ভুলে যাওয়ার?
না। প্রিয়জন হারানোর দাগ মানুষের মন থেকে সহজে মুছে যায় না। বহন করতে হয়।
আমার জীবনেও প্রিয়জন হারানোর স্মৃতি অনেক।
খুব ছোটবেলায় যাকে হারিয়ে প্রথম গভীর কষ্ট পেয়েছিলাম, সে ছিল একটি লাল কুকুর। লালু। শিশু অবস্থায় তাকে কোথা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল, আমার ঠিক জানা নেই। তাকে আমিই বড় করতে থাকি। সে আমার শৈশবের সঙ্গী হিসেবে বড় হতে থাকে। তার জন্য আলাদা খড়ের জাজিম বানানো হয়, খাবারের বাটি বরাদ্দ করা হয়। আমি যেখানে যাই সে পিছু পিছু ছোটে। একসাথে স্নানও করা হয় গ্রামের পুকুরে। শীতের দিনের সকালে কুয়াশায় ভিজে শস্যভরা মাঠ থেকে জমির আল ধরে দুজনে ফিরি একসাথে। তারপর একদিন আমার কলেজ হোস্টেলে চলে যাওয়ার দিন আসে। সে আমাকে বিদায় দিতে রিকশার পিছু পিছু গ্রামের বাজার পর্যন্ত আসে। মন খারাপ করে দুজনে দু’দিকে ছুটি।
আম্মার স্ট্রোক করেছিল তাঁর অল্প বয়সেই। ফলত তাঁর চলাফেরা সীমিত হয়ে পড়েছিল। লাঠির সাহায্য নিয়ে চলাফেরা করতে হতো তাঁকে। বেশির ভাগ সময়ই তিনি বারান্দায় বসে সামনের সুপারি বাগানের দিকে তাকিয়ে সময় কাটাতেন। বাড়িতে লোকজন ছিল কম। তারপর দুই সন্তানের মধ্যে আমরা দুজনই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ায় তিনি একদম নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। লালু সে সময় তাঁর সঙ্গী হয়ে ওঠে। আম্মার পায়ের কাছে বসে থাকত সারাক্ষণ। তাদের মধ্যে কথাবার্তাও চলত। কী কথা হতো তা অন্য কারও বোঝার সাধ্য হয়তো ছিল না। কিন্তু লালুর একসময় বয়স হতে থাকে। সে অ্যাজমায় আক্রান্ত হয় শেষ বয়সে। তারপর মারা যায় এক শীতে।
আমরা তাকে সমাহিত করি সুপারি বাগানে। যেন আম্মা বারান্দায় বসে তার কবরটি দেখতে পান। তারপর আম্মা প্রায় সময়ই চেয়ে থাকতেন লালুর কবরের দিকে। আর চোখের পানি ফেলতেন। আমরা ঠিক জানি না লালু কত কত স্মৃতিচিহ্ন রেখে গিয়েছিল আম্মার মনে।
দ্বিতীয় কষ্টটি পাই যাঁর জন্য, তিনি আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ ছিলেন না। ছিলেন একজন উদ্বাস্তু মানুষ। তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে এসেছিলেন দূরের এক বানভাসি জেলা হতে। এখানে এসে উদ্বাস্তু হিসেবেই ভেসে বেড়াচ্ছিলেন নানা জলা জঙ্গলায়। তাঁর মূল পেশা ছিল মাটি কাটা। তাঁর স্ত্রী নানা গৃহস্থ কাজ করতেন। একসময় তিনি আমাদের ঘরের কাজ শুরু করেন। সে সূত্রে আমার দয়াবান পিতা তাদের আমাদের উঠানের ওপারে সুপারি বাগানের ভেতর ঘর করে থাকতে দেন। তাঁর ছিল অনেক ছেলেমেয়ে। সংসারে অভাব আর হানাহানি লেগেই থাকত। তিনি নিজে ছিলেন খানিকটা উন্নাসিক প্রকৃতির। পরিবারের সমস্যা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতেন না। মাটি কাটার কাজ তো আর নিয়মিত থাকত না। থাকলেও তিনি নিয়মিত যেতেন না। প্রায় সারাদিনই খুপরি ঘরে শুয়ে বসে থাকতেন। মাঝে মাঝে কাঁধে গামছা নিয়ে বের হতেন। কলতলায় গিয়ে কল চাপতেন।
তারপর খুব যত্ন করে অনেকক্ষণ ধরে হাতমুখ ধুতেন। গা মুছে আশেপাশে পায়চারি করতেন আর গামছা দিয়ে গায়ের মাছি তাড়াতেন। এমন করে হুসহাস করে মাছি তাড়াতেন আর কথা বলতেন যেন মাছিরা তার গায়ে বসে খুবই অপরাধ করেছে। তারপর একসময় বিরক্ত হয়ে বলতেন, বাউরে, তুনগো জ্বালায় আই বাইছতাম নো। আমরা খুব মজা পেতাম তার কথাবার্তায়। এমনিতেই তিনি খুব ভদ্র সজ্জন মানুষ ছিলেন। ঝগড়াটে হয়ে উঠতেন সন্ধ্যার পর স্ত্রী পুঁটলিতে করে একটু খাবার নিয়ে আসার পর। তাঁর স্ত্রী সারাদিন কাজ করে নিজের বরাদ্দ খাবারটুকুই হয়তো পুঁটলিতে করে ঘরে নিয়ে যেতেন। সে খাবার তো আর তাঁর মন মতন হবার কারণ ছিল না। সেটা নিয়ে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে উঠতেন। তারপর ঘরে সদস্যসংখ্যা ছিল বেশি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মারামারি, চিৎকার শুরু হতো। তাদের এ সবটুকু আমাদেরও জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল। একদিন ভরসন্ধ্যায় তাদের বাসায় কান্নার রোল শোনা গেল। এ কান্নার ধরন আলাদা। আমরা ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি তিনি মারা গেছেন। জানা গেল তিনি মুরগির কলিজা দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী কীভাবে যেন সে ব্যবস্থাও করেছিলেন। তিনি কলিজা মুখে দিয়ে অর্ধেক গিলার আগেই মারা যান। তাঁর স্ত্রী সুর করে রোদন করতে করতে সে কথাগুলো বারবার বলছিলেন। মৃতের গোর কাফনের সব ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হয়। এই প্রথম আমি কাউকে শেষ যাত্রার জন্য প্রস্তুতি চোখের সামনে দেখতে পাই। মনে প্রচণ্ড দাগ কাটে। তাঁকে সমাহিত করা হয় দিঘির পাড়ে। তাঁর চিহ্ন অনেক দিন থেকে যায় আমার বুকে। আজও হয়তো মুছেনি বলেই লিখছি।
আমরা দুই ভাই। আমাদের কোনো বোন ছিল না। চিরকাল চাচাতো বোন শিল্পী আপাকেই আপন বোন বলে জানতাম। চাচা চাকরি করতেন চা বাগানে। তাঁর শৈশব কেটেছিল চা বাগানেই। আমরা শীতে চা বাগানে বেড়াতে গেলে বোনের স্নেহের স্বাদ অনুভব করতাম। তিনি সম্ভবত নবম শ্রেণিতে ওঠার পর আমাদের বাড়িতে আসেন এখানকার স্কুলে ভর্তি হওয়া উপলক্ষে। আমরা পিঠাপিঠি ভাইবোন হিসেবে বড় হতে থাকি। একসময় তাঁর বিয়েও হয়ে যায়। দুটো কন্যাসন্তানও হয়। হঠাৎ একদিন তাঁর ক্যান্সার ধরা পড়ে। নানান হাসপাতালে চিকিৎসা চলতে থাকে। একসময় চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেন তাঁর শরীরের কিছু অংশ কেটে বাদ দিতে হবে।
অপারেশন হওয়ার আগে তিনি বলেন, আমি মরে গেলে কী হবে রে?
‘কিছুই হবে না। আমরা নিচে কফিন কিনে রেখেছি। চা পাতা আর বরফও রেডি। মরামাত্রই কফিনে ভরে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাব’– আমার এই সপ্রতিভ জবাব শুনে তিনি হাসেন। এর কয়েক বছর পর একটা সময় আসে, যখন তিনি বুঝতে পারেন তাঁকে সত্যিই চলে যেতে হবে। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে সিলেটের একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। তিনি মারা যান। তাঁকে সমাহিত করা হয় আমাদের গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে। আমি ঢাকা থেকে দ্রুত যাই। কিন্তু তাঁর মুখখানা শেষ দেখা হয়নি। আমি তাঁর মায়াবী মুখখানা এখনও বহন করি সর্বদা, বেদনাভরে।
আমার পিতা খুব স্নেহবৎসল ছিলেন। আমার এখনও মনে আছে, আমি তখন বেশ বড়। শারীরিক উচ্চতায় পিতাকে ছাড়িয়েছি। সে সময় আমার খুব জ্বর হলো। আব্বা আমাকে কোলে নিয়ে হাঁটার চেষ্টা করেছিলেন। আমার পা মাটিতে লেগে যাচ্ছিল, তাও তিনি নিয়ে হাঁটার চেষ্টা করেছিলেন। যখন আমার এসএসসি ফল বের হলো। আব্বা বেশ রাতে বাজার থেকে বাড়ি এসেছেন। আমি ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছি। তিনি শিয়রে বসে থাকলেন আমার ফল জানাবেন বলে। যেন তিনিই বায়েজিদ বোস্তামী।
শেষ বয়সে আব্বা অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ঢাকায় চিকিৎসা নিতে প্রায় সময় আসতেন। একবার ফুসফুসে পানি জমে গেল। জ্বরসহ ঢাকায় নিয়ে এলাম। রাতে আব্বার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে থাকলে তিনি কেবল শীত শীত করতে থাকলেন। আমি বাসায় থাকা সব লেপ-কম্বল তাঁর গায়ের ওপরে দিলাম। কিন্তু আব্বার শীতের অনুভূতি গেল না। তারপর নিজে তাঁর ওপর শুয়ে পড়লাম। আব্বা জ্বরের ঘোরে কেবল বলতে থাকলেন তোমারনু ঠান্ডা লাগব, শোয়াইব (তোমার তো ঠান্ডা লেগে যাবে)।
আম্মা খুব অল্প বয়সে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন। আব্বার শুধু চিন্তা ছিল তিনি আগে মারা গেলে আম্মার অযত্ন হবে কিনা। আম্মাকে আদর করে প্রায় সময় বলতেন, আমি মরলে তোমার কী হবে বুড়ি!
আব্বা কথা রেখেছিলেন। আম্মার মাত্র একদিন আগে মারা গিয়েছিলেন। আব্বা যেদিন মারা যান, আকাশজুড়ে কালো মেঘ জমে ছিল। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল দেশজুড়ে। আব্বার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে বাড়ি থেকে ফোন পেয়ে তখনই রওনা দিই। আমাদের গাড়িটি যখন হবিগঞ্জের মাধবপুর বাঁক পার হচ্ছিল, তখন হঠাৎ আকাশ চিরে যায়। বিদ্যুৎ ঝলকে। আমি পাশে বসে থাকা জেসমিনকে বলি, আব্বা গেলেন। জেসমিন আমার হাত চেপে ধরে রেখেছিল। পরে জেনেছি আব্বা সত্যিই সেই ক্ষণটিতেই মারা গিয়েছিলেন। আম্মা পরদিন সকালে হাসিমুখে কথা বলতে বলতে চলে গিয়েছিলেন। সত্যিই এগুলো অলৌকিক ঘটনা ছিল।
আম্মা সারাজীবন অসম্ভব শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করে গেছেন। খুব অল্প বয়স থেকেই লাঠিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করতেন। শেষদিকে পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। পিঠে বেড সোর হতে শুরু করেছিল। কিন্তু কখনও তিনি কোনো শারীরিক যন্ত্রণার অভিযোগ করতেন না। মাঝে মাঝে শুধু বলতেন, আল্লায় কিতার লাগি আমারে এত পরীক্ষা কররা?? (আল্লাহ কেন আমাকে এত পরীক্ষা করছেন?)। কিন্তু আম্মা কখনও পরীক্ষায় হার মানেননি। শুয়ে শুয়েই ইশারায় নামাজ আদায় করতেন। কোনো কষ্টের কথা উচ্চ স্বরে মাবুদকেও জানাতেন না।
আজ আমি আমার পিতার অ্যাজমার শ্বাসকষ্ট আক্ষরিক অর্থে অনুভব করি। অনুভব করি মায়ের শারীরিক ব্যথার কষ্ট। তারা তাদের কষ্টগুলো নিয়ে পাশাপাশি কবরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাদের কষ্টগুলোর স্মৃতি আমাকে জাগিয়ে রাখে। কষ্ট দেয়।
আব্বাকে খাটিয়ায় তুলে শেষ যাত্রা যখন যায়, আমি খাটিয়ার পেছনে পেছনে হাঁটছিলাম। মসজিদের বড় গিলাফে তাঁর দেহ আবৃত করা ছিল। কিন্তু সাদা কাফনে মোড়ানো তাঁর পা দুটো আমি পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। তাঁর এ পা দু’খানি একদিন আমার শরীরের ভর বহন করেছিল। আমাদের সুখের জন্য পৃথিবীর মাটিতে অস্থির বিচরণ করেছিল। তিনি তাঁর সে চরণ দু’খানি নিয়ে সমাহিত হয়েছেন। কিন্তু দৃশ্যের স্মৃতি রেখে গেছেন, চিরতরে। তা মোছার নয়। আমার বুকে সে চরণ চিহ্নের দাগ মালয় পাহাড়ের পাথরের দাগের মতোই, মায়াময়।
(কবি আজিজুন মাগফুরাকে অকালে হারানোর দাগ এ লেখায় যুক্ত করা হলো না। কালের খেয়ার পাঠক আগেই পড়েছেন।)
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: কর ছ ল র জন য বলত ন একদ ন ত রপর করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন
কমলাপুর রেলস্টেশনের ভাঙাচোরা প্ল্যাটফর্মে বোতল কুড়িয়ে কিংবা হাত পেতে খাবার জুটত হাসান আলী মুসাফিরের। বয়স তখন পাঁচ কিংবা ছয়। রাতে স্টেশনের পাশে ঘুমিয়ে থাকলে মাঝে মাঝেই তাড়িয়ে দিত পুলিশ।
এক রাতে স্টেশনের ইঞ্জিনের ছাদে উঠে পড়ে সে-তার ছোট্ট বন্ধুও সঙ্গে ছিল। বন্ধুকে টানতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় সে। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসার সময় খোঁজ নেওয়া হয় তার পরিবারের, কিন্তু কোনো সন্ধান মেলে না।
একপর্যায়ে দায়িত্ব নেয় অলাভজনক সংগঠন লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এলইইডিও)। তখন থেকেই তাদের আশ্রয়ে বড় হয় হাসান। এখন নবম শ্রেণির ছাত্র সে। শিখেছে গ্রাফিক ডিজাইনসহ নানা হাতের কাজ। স্বপ্ন-একদিন পুলিশ হয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে।
দুই দশকে ৩০-৩৫ হাজার শিশুর পুনর্বাসন
হাসানের মতো হাজারো শিশুর জীবনের বাঁক ঘুরেছে এলইইডিও-র হাত ধরে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় আড়াই দশকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার সুবিধাবঞ্চিত ও পরিবারহারা শিশুকে উদ্ধার করে পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছে তারা। কেউ কেউ ফিরে গেছে পরিবারের কাছে, আবার কেউ থেকে গেছে সংগঠনের আশ্রয়ে-গড়ে তুলেছে নিজের ভবিষ্যৎ।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) এমন ৩০০ শিশু-কিশোরকে নিয়ে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী আনন্দভ্রমণের। স্থান ছিল ঢাকার ধামরাইয়ের মোহাম্মদী গার্ডেন। সকাল থেকে চলেছে চকলেট দৌড়, পিলো পাসিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সব মিলিয়ে উৎসবমুখর এক দিন।
পথ থেকে আশ্রয়ে
এলইইডিওর সংগঠকরা জানান, ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল পাচার, নিখোঁজ ও ভাসমান শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়ন। কর্মীরা প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। যেসব শিশুর পরিবারের সন্ধান মেলে না, তাদের উদ্ধার করে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যদি পরিবারের হদিস না মেলে, প্রথমে নেওয়া হয় ‘শেল্টার হোমে’, পরে ‘পিস হোমে’।
ঢাকার কমলাপুর ও কদমতলীতে রয়েছে দুটি শেল্টার হোম, আর ওয়াশপুরে একটি পিস হোম। শেল্টার হোমে প্রায় ২৫ জন ও পিস হোমে প্রায় শতাধিক শিশুর থাকার ব্যবস্থা রযেছে। শেল্টার হোমে থাকা শিশুদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলতে থাকে, ব্যর্থ হলে পাঠানো হয় সরকারি ছোট মনি নিবাসেও। পিস হোমে থাকা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়, শেখানো হয় বিভিন্ন কারিগরি কাজ।
এছাড়া ঢাকার কদমতলী, সদরঘাট, এয়ারপোর্ট, মিরপুর, কমলাপুর ও তেজগাঁওয়ে ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’ নামে ছয়টি মুক্ত বিদ্যালয় পরিচালনা করছে সংগঠনটি। খোলা আকাশের নিচে বসে পথশিশুরা সেখানে শেখে অক্ষর আর জীবনের নতুন দিশা।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পথশিশুরা
‘এলইইডিও’র উদ্যোগে এই শিশুরাই অংশ নিয়েছে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও। ২০২২ সালে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপে, আর ২০২৩ সালে ভারতে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে। সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলার গৌরবও অর্জন করেছে তারা।
বিশেষ শিশুর গল্প: মালেকা আক্তার
কুড়িগ্রামের রাজারহাট থেকে ট্রেনে উঠে ঢাকায় চলে এসেছিল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু মালেকা আক্তার। স্মৃতিশক্তি দুর্বল, জন্মগতভাবে এপিলেপসিতে আক্রান্ত। তাকে উদ্ধার করে ‘এলইইডিও’।
এখন সে সংগঠনের পিস হোমে থাকে, স্কুলে যায়। শেখানো হয়েছে সেলাই ও ক্রাফটের কাজ। একসময় হাঁটতেও কষ্ট হতো তার, এখন নিয়মিত চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ। হাসতে হাসতে বলল, “এখানে আমি নিরাপদ, নিজের মতো করে বাঁচতে পারি।”
যে স্কুলে পড়েছেন, এখন সেই স্কুলেই শিক্ষক
মো. নিজাম হোসেনের গল্প যেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। রায়েরবাজারের ছেলেটি বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর ঘরহারা হয়। একসময় ভাসমান জীবনে জড়িয়ে পড়ে। ‘এলইইডিও’র কর্মীরা খুঁজে পেয়ে তাকে ভর্তি করান স্কুলে। এরপর পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়।
বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগে পড়ছেন নিজাম। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের লর্ডস স্টেডিয়ামে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলেছেন। এখন ‘এলইইডিও’র স্ট্রিট স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।
নিজামের ভাষায়, “আমি যে স্কুলে পড়েছি, আজ সেই স্কুলেরই শিক্ষক। এখানে ভাসমান শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি করাই।”
তার আঁকা ছবি সংগ্রহ করেছেন ফুটবলার হামজা চৌধুরী, ছাপা হয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্যালেন্ডারেও। ভবিষ্যতে জাতিসংঘে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
দিনভর হাসি, আনন্দ
বিকেলের দিকে মঞ্চে পুরস্কার বিতরণ। মাইকে নাম ঘোষণা হতেই শিশুদের উল্লাস-পিলো পাসিংয়ে কমলাপুরের বিজয়, চকলেট দৌড়ে হাবিবা, পিস হোম থেকে শামীম। মাঠ জুড়ে হাততালি আর হাসি।
প্রতি বছরই এমন আয়োজন করে ‘এলইইডিও’। অংশ নেয় ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’-এর শিক্ষার্থী, শেল্টার ও পিস হোমের শিশুরা।
এদিন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন, বোর্ড সদস্য তুষার আহমেদ ইমরান, এবং ফ্রেন্ডস অব স্ট্রিট চিলড্রেনের চেয়ারম্যান মাইক শেরিফ।
ফরহাদ হোসেন বলেন, “আড়াই দশক ধরে আমরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে আছি। এবার ৩০০ শিশুকে নিয়ে এসেছি। রাষ্ট্র যদি আমাদের সঙ্গে এগিয়ে আসে, এই শিশুরাই ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের সম্পদ হয়ে উঠবে।”
শেষে সাংস্কৃতিক পর্বে শিশুরা গেয়েছে দেশাত্মবোধক ও জনপ্রিয় গান। অতিথি মাইক শেরিফ গাইলেন ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’ শিশুদের করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো মাঠ। বিকেলের রোদে সবার যৌথ ছবি তোলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসবের দিনটি- ভাসমান শিশুরা ফিরল মুখভরা হাসি নিয়ে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে।
ঢাকা/এস