Samakal:
2025-08-01@22:27:11 GMT

চরণ চিহ্ন ফেলে

Published: 23rd, January 2025 GMT

চরণ চিহ্ন ফেলে

এসেছিস যখন দাগ রেখে যা– কথাটা রামকৃষ্ণ বলার আগেই মানুষ দাগ রাখতে শুরু করেছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার ফুট উপরে শ্রীলঙ্কার পবিত্র মালয় পাহাড়ে পাওয়া গেছে প্রাচীন পদচিহ্ন। প্রতিটি ধর্মের মানুষ মনে করেন এটি তাদের ধর্মের মহাপুরুষের পদচিহ্ন। সনাতনধর্মীরা মনে করেন শিবের, বৌদ্ধরা মনে করেন গৌতমের আর কেনান ধর্মের মানুষেরা বিশ্বাস করেন এটি প্রথম মানব অ্যাডামের পদচিহ্ন। এক পদচিহ্নকে স্থানীয়রা বলেন শ্রীপদ বা পবিত্র পা। এ পদচিহ্নকে সম্মান করেন প্রতিটি ধর্মের অনুসারীগণ। পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষ তার পূর্বপুরুষের যে কোনো স্মৃতিচিহ্নকে ভালোবাসে। হোক সে পায়ের দাগ বা যে কোনো স্মৃতিবাহী কিছু। 
আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছবি এঁকে দাগ রেখে গেছেন গুহার ভেতর, পাথরের গায়ে। নিজেদের কথা রেখে গেছেন গল্প গসপেল প্যারাবল, রূপকথায়। মানুষ সেগুলো যত্নে আগলে রেখেছে, হৃদয়ে বহন করে চলেছে পরম মমতায়। এর কোনো কোনো স্মৃতি একান্ত নিজের, পরিবারের, আবার কোনো কোনোটি পুরো একটি সম্প্রদায় বা জাতি রাষ্ট্রের। যেনবা এ জগতে হারায় না কিছুই। মায়া রেখে যায়। 
মানুষ বড় স্মৃতিকাতর জীব। অবশ্য অন্যান্য প্রাণীর খবর আমরা জানি না। সম্ভবত তাদের স্মৃতি মানুষের মতো এত দীর্ঘস্থায়ী নয়। অনেকে বিশ্বাস করেন কেউ কেউ নাকি পূর্বজন্মের স্মৃতিও বহন করে চলেন। বাংলা ভাষায় জাতিস্মর শব্দটি রয়েছে। মানুষের স্মৃতি বহন করার এই কাজটি যে সব সময় সুখকর, এমনটি নয়। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুঃখের। মানুষ দুঃখ বিয়োগ বেদনার স্মৃতিই বেশি বহন করে। আর কবিদের প্রধান কাজই স্মৃতি নিয়ে। 
২.


রাঙা মামিমার সাঁকো হয়ে ভোর রাতে দেশত্যাগ করার কবিতাটি তো অনেকেরই জানা। তিনি সাঁকো পার হয়ে চলে গেছেন কিন্তু রাঙা পায়ের দাগ রেখে গেছেন সাঁকোর গায়ে। সে দাগের বেদনা ভুলতে পারেননি ফেলে যাওয়া স্বজন। সে না হয় অন্য দেশে যাওয়া। কিন্তু প্রিয় মানুষের যাওয়া যদি হয় চিরতরের, তাহলে সে দাগ কি ভুলে যাওয়ার? 
না। প্রিয়জন হারানোর দাগ মানুষের মন থেকে সহজে মুছে যায় না। বহন করতে হয়। 
আমার জীবনেও প্রিয়জন হারানোর স্মৃতি অনেক। 
খুব ছোটবেলায় যাকে হারিয়ে প্রথম গভীর কষ্ট পেয়েছিলাম, সে ছিল একটি লাল কুকুর। লালু। শিশু অবস্থায় তাকে কোথা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল, আমার ঠিক জানা নেই। তাকে আমিই বড় করতে থাকি। সে আমার শৈশবের সঙ্গী হিসেবে বড় হতে থাকে। তার জন্য আলাদা খড়ের জাজিম বানানো হয়, খাবারের বাটি বরাদ্দ করা হয়। আমি যেখানে যাই সে পিছু পিছু ছোটে। একসাথে স্নানও করা হয় গ্রামের পুকুরে। শীতের দিনের সকালে কুয়াশায় ভিজে শস্যভরা মাঠ থেকে জমির আল ধরে দুজনে ফিরি একসাথে। তারপর একদিন আমার কলেজ হোস্টেলে চলে যাওয়ার দিন আসে। সে আমাকে বিদায় দিতে রিকশার পিছু পিছু গ্রামের বাজার পর্যন্ত আসে। মন খারাপ করে দুজনে দু’দিকে ছুটি। 
আম্মার স্ট্রোক করেছিল তাঁর অল্প বয়সেই। ফলত তাঁর চলাফেরা সীমিত হয়ে পড়েছিল। লাঠির সাহায্য নিয়ে চলাফেরা করতে হতো তাঁকে। বেশির ভাগ সময়ই তিনি বারান্দায় বসে সামনের সুপারি বাগানের দিকে তাকিয়ে সময় কাটাতেন। বাড়িতে লোকজন ছিল কম। তারপর দুই সন্তানের মধ্যে আমরা দুজনই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ায় তিনি একদম নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। লালু সে সময় তাঁর সঙ্গী হয়ে ওঠে। আম্মার পায়ের কাছে বসে থাকত সারাক্ষণ। তাদের মধ্যে কথাবার্তাও চলত। কী কথা হতো তা অন্য কারও বোঝার সাধ্য হয়তো ছিল না। কিন্তু লালুর একসময় বয়স হতে থাকে। সে অ্যাজমায় আক্রান্ত হয় শেষ বয়সে। তারপর মারা যায় এক শীতে। 
আমরা তাকে সমাহিত করি সুপারি বাগানে। যেন আম্মা বারান্দায় বসে তার কবরটি দেখতে পান। তারপর আম্মা প্রায় সময়ই চেয়ে থাকতেন লালুর কবরের দিকে। আর চোখের পানি ফেলতেন। আমরা ঠিক জানি না লালু কত কত স্মৃতিচিহ্ন রেখে গিয়েছিল আম্মার মনে।   
দ্বিতীয় কষ্টটি পাই যাঁর জন্য, তিনি আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ ছিলেন না। ছিলেন একজন উদ্বাস্তু মানুষ। তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে এসেছিলেন দূরের এক বানভাসি জেলা হতে। এখানে এসে উদ্বাস্তু হিসেবেই ভেসে বেড়াচ্ছিলেন নানা জলা জঙ্গলায়। তাঁর মূল পেশা ছিল মাটি কাটা। তাঁর স্ত্রী নানা গৃহস্থ কাজ করতেন। একসময় তিনি আমাদের ঘরের কাজ শুরু করেন। সে সূত্রে আমার দয়াবান পিতা তাদের আমাদের উঠানের ওপারে সুপারি বাগানের ভেতর ঘর করে থাকতে দেন। তাঁর ছিল অনেক ছেলেমেয়ে। সংসারে অভাব আর হানাহানি লেগেই থাকত। তিনি নিজে ছিলেন খানিকটা উন্নাসিক প্রকৃতির। পরিবারের সমস্যা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতেন না। মাটি কাটার কাজ তো আর নিয়মিত থাকত না। থাকলেও তিনি নিয়মিত যেতেন না। প্রায় সারাদিনই খুপরি ঘরে শুয়ে বসে থাকতেন। মাঝে মাঝে কাঁধে গামছা নিয়ে বের হতেন। কলতলায় গিয়ে কল চাপতেন। 


তারপর খুব যত্ন করে অনেকক্ষণ ধরে হাতমুখ ধুতেন। গা মুছে আশেপাশে পায়চারি করতেন আর গামছা দিয়ে গায়ের মাছি তাড়াতেন। এমন করে হুসহাস করে মাছি তাড়াতেন আর কথা বলতেন যেন মাছিরা তার গায়ে বসে খুবই অপরাধ করেছে। তারপর একসময় বিরক্ত হয়ে বলতেন, বাউরে, তুনগো জ্বালায় আই বাইছতাম নো। আমরা খুব মজা পেতাম তার কথাবার্তায়। এমনিতেই তিনি খুব ভদ্র সজ্জন মানুষ ছিলেন। ঝগড়াটে হয়ে উঠতেন সন্ধ্যার পর স্ত্রী পুঁটলিতে করে একটু খাবার নিয়ে আসার পর। তাঁর স্ত্রী সারাদিন কাজ করে নিজের বরাদ্দ খাবারটুকুই হয়তো পুঁটলিতে করে ঘরে নিয়ে যেতেন। সে খাবার তো আর তাঁর মন মতন হবার কারণ ছিল না। সেটা নিয়ে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে উঠতেন। তারপর ঘরে সদস্যসংখ্যা ছিল বেশি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মারামারি, চিৎকার শুরু হতো। তাদের এ সবটুকু আমাদেরও জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল। একদিন ভরসন্ধ্যায় তাদের বাসায় কান্নার রোল শোনা গেল। এ কান্নার ধরন আলাদা। আমরা ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি তিনি মারা গেছেন। জানা গেল তিনি মুরগির কলিজা দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী কীভাবে যেন সে ব্যবস্থাও করেছিলেন। তিনি কলিজা মুখে দিয়ে অর্ধেক গিলার আগেই মারা যান। তাঁর স্ত্রী সুর করে রোদন করতে করতে সে কথাগুলো বারবার বলছিলেন। মৃতের গোর কাফনের সব ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হয়। এই প্রথম আমি কাউকে শেষ যাত্রার জন্য প্রস্তুতি চোখের সামনে দেখতে পাই। মনে প্রচণ্ড দাগ কাটে। তাঁকে সমাহিত করা হয় দিঘির পাড়ে। তাঁর চিহ্ন অনেক দিন থেকে যায় আমার বুকে। আজও হয়তো মুছেনি বলেই লিখছি।
আমরা দুই ভাই। আমাদের কোনো বোন ছিল না। চিরকাল চাচাতো বোন শিল্পী আপাকেই আপন বোন বলে জানতাম। চাচা চাকরি করতেন চা বাগানে। তাঁর শৈশব কেটেছিল চা বাগানেই। আমরা শীতে চা বাগানে বেড়াতে গেলে বোনের স্নেহের স্বাদ অনুভব করতাম। তিনি সম্ভবত নবম শ্রেণিতে ওঠার পর আমাদের বাড়িতে আসেন এখানকার স্কুলে ভর্তি হওয়া উপলক্ষে। আমরা পিঠাপিঠি ভাইবোন হিসেবে বড় হতে থাকি। একসময় তাঁর বিয়েও হয়ে যায়। দুটো কন্যাসন্তানও হয়। হঠাৎ একদিন তাঁর ক্যান্সার ধরা পড়ে। নানান হাসপাতালে চিকিৎসা চলতে থাকে। একসময় চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেন তাঁর শরীরের কিছু অংশ কেটে বাদ দিতে হবে। 
অপারেশন হওয়ার আগে তিনি বলেন, আমি মরে গেলে কী হবে রে? 
‘কিছুই হবে না। আমরা নিচে কফিন কিনে রেখেছি। চা পাতা আর বরফও রেডি। মরামাত্রই কফিনে ভরে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাব’– আমার এই সপ্রতিভ জবাব শুনে তিনি হাসেন। এর কয়েক বছর পর একটা সময় আসে, যখন তিনি বুঝতে পারেন তাঁকে সত্যিই চলে যেতে হবে। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে সিলেটের একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। তিনি মারা যান। তাঁকে সমাহিত করা হয় আমাদের গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে। আমি ঢাকা থেকে দ্রুত যাই। কিন্তু তাঁর মুখখানা শেষ দেখা হয়নি। আমি তাঁর মায়াবী মুখখানা এখনও বহন করি সর্বদা, বেদনাভরে।
আমার পিতা খুব স্নেহবৎসল ছিলেন। আমার এখনও মনে আছে, আমি তখন বেশ বড়। শারীরিক উচ্চতায় পিতাকে ছাড়িয়েছি। সে সময় আমার খুব জ্বর হলো। আব্বা আমাকে কোলে নিয়ে হাঁটার চেষ্টা করেছিলেন। আমার পা মাটিতে লেগে যাচ্ছিল, তাও তিনি নিয়ে হাঁটার চেষ্টা করেছিলেন। যখন আমার এসএসসি ফল বের হলো। আব্বা বেশ রাতে বাজার থেকে বাড়ি এসেছেন। আমি ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছি। তিনি শিয়রে বসে থাকলেন আমার ফল জানাবেন বলে। যেন তিনিই বায়েজিদ বোস্তামী।
শেষ বয়সে আব্বা অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ঢাকায় চিকিৎসা নিতে প্রায় সময় আসতেন। একবার ফুসফুসে পানি জমে গেল। জ্বরসহ ঢাকায় নিয়ে এলাম। রাতে আব্বার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে থাকলে তিনি কেবল শীত শীত করতে থাকলেন। আমি বাসায় থাকা সব লেপ-কম্বল তাঁর গায়ের ওপরে দিলাম। কিন্তু আব্বার শীতের অনুভূতি গেল না। তারপর নিজে তাঁর ওপর শুয়ে পড়লাম। আব্বা জ্বরের ঘোরে কেবল বলতে থাকলেন তোমারনু ঠান্ডা লাগব, শোয়াইব (তোমার তো ঠান্ডা লেগে যাবে)।
আম্মা খুব অল্প বয়সে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন। আব্বার শুধু চিন্তা ছিল তিনি আগে মারা গেলে আম্মার অযত্ন হবে কিনা। আম্মাকে আদর করে প্রায় সময় বলতেন, আমি মরলে তোমার কী হবে বুড়ি!
আব্বা কথা রেখেছিলেন। আম্মার মাত্র একদিন আগে মারা গিয়েছিলেন। আব্বা যেদিন মারা যান, আকাশজুড়ে কালো মেঘ জমে ছিল। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল দেশজুড়ে। আব্বার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে বাড়ি থেকে ফোন পেয়ে তখনই রওনা দিই। আমাদের গাড়িটি যখন হবিগঞ্জের মাধবপুর বাঁক পার হচ্ছিল, তখন হঠাৎ আকাশ চিরে যায়। বিদ্যুৎ ঝলকে। আমি পাশে বসে থাকা জেসমিনকে বলি, আব্বা গেলেন। জেসমিন আমার হাত চেপে ধরে রেখেছিল। পরে জেনেছি আব্বা সত্যিই সেই ক্ষণটিতেই মারা গিয়েছিলেন। আম্মা পরদিন সকালে হাসিমুখে কথা বলতে বলতে চলে গিয়েছিলেন। সত্যিই এগুলো অলৌকিক ঘটনা ছিল। 
আম্মা সারাজীবন অসম্ভব শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করে গেছেন। খুব অল্প বয়স থেকেই লাঠিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করতেন। শেষদিকে পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। পিঠে বেড সোর হতে শুরু করেছিল। কিন্তু কখনও তিনি কোনো শারীরিক যন্ত্রণার অভিযোগ করতেন না। মাঝে মাঝে শুধু বলতেন, আল্লায় কিতার লাগি আমারে এত পরীক্ষা কররা?? (আল্লাহ কেন আমাকে এত পরীক্ষা করছেন?)। কিন্তু আম্মা কখনও পরীক্ষায় হার মানেননি। শুয়ে শুয়েই ইশারায় নামাজ আদায় করতেন। কোনো কষ্টের কথা উচ্চ স্বরে মাবুদকেও জানাতেন না। 
আজ আমি আমার পিতার অ্যাজমার শ্বাসকষ্ট আক্ষরিক অর্থে অনুভব করি। অনুভব করি মায়ের শারীরিক ব্যথার কষ্ট। তারা তাদের কষ্টগুলো নিয়ে পাশাপাশি কবরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাদের কষ্টগুলোর স্মৃতি আমাকে জাগিয়ে রাখে। কষ্ট দেয়। 
আব্বাকে খাটিয়ায় তুলে শেষ যাত্রা যখন যায়, আমি খাটিয়ার পেছনে পেছনে হাঁটছিলাম। মসজিদের বড় গিলাফে তাঁর দেহ আবৃত করা ছিল। কিন্তু সাদা কাফনে মোড়ানো তাঁর পা দুটো আমি পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। তাঁর এ পা দু’খানি একদিন আমার শরীরের ভর বহন করেছিল। আমাদের সুখের জন্য পৃথিবীর মাটিতে অস্থির বিচরণ করেছিল। তিনি তাঁর সে চরণ দু’খানি নিয়ে সমাহিত হয়েছেন। কিন্তু দৃশ্যের স্মৃতি রেখে গেছেন, চিরতরে। তা মোছার নয়। আমার বুকে সে চরণ চিহ্নের দাগ মালয় পাহাড়ের পাথরের দাগের মতোই, মায়াময়।

(কবি আজিজুন মাগফুরাকে অকালে হারানোর দাগ এ লেখায় যুক্ত করা হলো না। কালের খেয়ার পাঠক আগেই পড়েছেন।) 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: কর ছ ল র জন য বলত ন একদ ন ত রপর করত ন

এছাড়াও পড়ুন:

মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ, সভ্যতার তিন শত্রুকে ঠেকাব কী করে

ইউভাল নোয়াহ হারারি তাঁর বহুল আলোচিত হোমো ডিউস বইয়ে যুক্তি দিয়েছেন, মানবজাতিকে ধ্বংসের মুখে ফেলেছে তিনটি প্রধান বিপদ। এক. মহামারি, দুই. দুর্ভিক্ষ, এবং তিন. যুদ্ধ।

হারারির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে আমরা প্রথম দুটি বিপদ (মহামারি ও দুর্ভিক্ষ) অনেকটাই জয় করেছি।

মহামারির ইতিহাস নিঃসন্দেহে ভয়ংকর ও বিভীষিকাময়। কিন্তু আশার কথা হলো, আধুনিক মাইক্রোবায়োলজির সাফল্যে আমরা কোভিড-১৯-এর মতো প্রাণঘাতী ভাইরাসকে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছি।

ম্যালেরিয়া মশার কামড়ে ছড়ায়—রোনাল্ড রস ও তাঁর সহকর্মীরা কীভাবে তা আবিষ্কার করেন, ছেলেবেলায় আমরা সেই গল্প পাঠ্যবইয়ে পড়েছি। তার আগে বহু মানুষ ম্যালেরিয়ার জন্য সন্ধ্যার বাতাস বা অলৌকিক কারণকে দায়ী করতেন। কুসংস্কার ছিল মানুষের একমাত্র ব্যাখ্যা। অথচ প্রকৃতিতেই ছিল প্রতিষেধক—দক্ষিণ আমেরিকার সিঙ্কোনা গাছের ছাল থেকে তৈরি কুইনাইন।

আরও পড়ুনগাজা থেকে ইউক্রেন—যে কারণে এত যুদ্ধ২১ জুলাই ২০২৫

কলেরাকে একসময় বলা হতো ‘ওলা ওঠা’; শরৎচন্দ্রের রচনায় ‘ওলাদেবী’র মতো পৌরাণিক চরিত্রের কথা আমরা পড়েছি, যিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়ে প্রাণ হরণ করেন। অথচ এই মরণব্যাধির মূল কারণ ছিল দূষিত পানি। আজ এক চিমটি লবণ, এক মুঠো গুড় ও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে বানানো ওরস্যালাইনই সেই ‘ওলাদেবী’কে হার মানিয়েছে।

টাইফয়েড, প্লেগ, ব্ল্যাক ফিভার, সিফিলিস ইত্যাদি বহু রোগ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল স্মলপক্স বা বসন্ত, যা দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী জনপদকে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল।

আজ বিজ্ঞান সে রোগকেও চিরতরে বিলুপ্ত করেছে—বসন্ত এখন কেবল গবেষণাগারের বিষয়।

হারারির দ্বিতীয় শত্রু—দুর্ভিক্ষ। মানব ইতিহাসে হাজারো দুর্ভিক্ষ নথিবদ্ধ  আছে। কিন্তু গত ১৫০ বছরে দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৭ থেকে ১২ কোটি মানুষ। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল একটির কারণ, তবে যুদ্ধ, প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক অবহেলা ছিল আরও বড় কারণ।

আরও পড়ুনমহামারি ও যুদ্ধ অপুষ্টি বাড়িয়েছে৩১ জানুয়ারি ২০২৪

আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি, খাদ্যশস্যের অধিক উৎপাদন, গুদামজাতকরণ ও বৈজ্ঞানিক বিতরণব্যবস্থা আজ দুর্ভিক্ষকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এনেছে।

তৃতীয় বিপদ—যুদ্ধ। ১৮০০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। হারারি মনে করেন, যুদ্ধের পেছনের যুক্তিগুলো আজকাল আর তেমন কার্যকর নয়। একসময় যুদ্ধ হতো জমি, সম্পদ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য। কিন্তু আধুনিক যুগে সেই প্রয়োজন অনেকটাই বিলুপ্ত।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, যদি চীন আমেরিকার সিলিকন ভ্যালি সামরিক শক্তি দিয়ে দখল করতে চায়, তবে তার খরচ হবে বিপুল। বরং সেখানে বিনিয়োগ করলে লাভ হবে বহুগুণ। আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো ‘মানব মেধা’, যা অস্ত্র দিয়ে জবরদস্তিমূলকভাবে দখল করা যায় না।

এই যুক্তিতে হারারি আশাবাদী যে হোমো স্যাপিয়েন্স একসময় রূপ নেবে ‘হোমো ডিউস’ বা এক প্রকার দেবতুল্য প্রজাতিতে। তারা বিজ্ঞানের সহায়তায় শত শত বছর বাঁচবে এবং শুধু বড় দুর্ঘটনাতেই তাদের মৃত্যু হবে।

আরও পড়ুনগাজা নিয়ে ‘গণহত্যামূলক সাংবাদিকতা’ করছে নিউইয়র্ক টাইমস২৬ জুলাই ২০২৫

কিন্তু বাস্তবতা এই আশাবাদের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। বইটি প্রকাশের পরপরই শুরু হয়েছে ইসরায়েল-হামাস সংঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি এখন আর অলীক নয়, বাস্তবতার অংশ। রাশিয়া পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, তাদের অস্তিত্ব যদি হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে তারা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে।

এমন কিছু ঘটে গেলে, হারারির পূর্বাভাস যে ভুল প্রমাণিত হবে, তা বলাই বাহুল্য। যদিও তা দেখার মতো তখন কেউ থাকবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

ইরান যদি ইসরায়েলের ওপর বড় ধরনের হামলা চালায়, তাহলে ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না—এমন নিশ্চয়তা নেই। হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধে ইসরায়েলের গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং তারা মিসরের ওপর পারমাণবিক হামলার চিন্তা করছিল।

সেই পরিস্থিতিতে তিনি জরুরি ভিত্তিতে ইসরায়েলকে অস্ত্র ও বিমান সরবরাহ করেন।
বিশ্ব রাজনীতির আরেক উদ্বেগজনক দিক হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় পরিবর্তন। ৯/১১-পরবর্তী সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের বিখ্যাত ঘোষণা ছিল—‘যদি তুমি আমাদের সঙ্গে না থাকো, তাহলে তুমি আমাদের শত্রু’। এটি শুধু রাজনৈতিক বার্তা নয়, বরং একধরনের বৈশ্বিক দম্ভ ও আধিপত্যবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।

অর্থনৈতিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের দৈন্য এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব যুক্তরাষ্ট্রকে এমন এক আগ্রাসী ভূমিকা নিতে বাধ্য করেছে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে ইউক্রেন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে চলছে অস্থিরতা, সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয়। শান্তি যেন এখন শুধুই এক কৌশলগত বিলাসিতা।

মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ—মানব ইতিহাসের এই তিন মহাশত্রুর বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম এবং বিজ্ঞানের সাহায্যে মানবজাতির অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে অনন্য এক অধ্যায়। তবে যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে কৌশলগত স্থিতিশীলতা ও টেকসই শান্তির ভিত্তি রচনা করাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

নইলে ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া হোমো ইরেক্টাস, হোমো হ্যাবিলিস কিংবা নিয়ান্ডারথালের মতো আমরাও, মানে আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্স একদিন হারিয়ে যেতে পারি সময়ের গর্ভে, অসীম শূন্যতায়।

তুষার কান্তি চাকমা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ, সভ্যতার তিন শত্রুকে ঠেকাব কী করে