সংরক্ষিত কোটার অপব্যবহার করে রাজউকের প্লট বরাদ্দের ঘটনা নতুন নয়। তবে বিগত সরকারের আমলে তা সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, এতেও সন্দেহ নেই। হাসিনা সরকার পতনের পর রাজউকের তিনটি প্রকল্পে অনিয়ম করে প্লট বরাদ্দের ঘটনাগুলো থেকেই সামনে আসছে। হালে একটি সহযোগী দৈনিকে প্রতিবেদন আসার আগেও জানা গিয়েছিল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারভুক্তরা নিয়েছেন ১০ কাঠার ছয়টি প্লট। তথ্য গোপন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে এটা করা হয় বলে মামলাও হয়েছে। নিতান্ত রাজনৈতিক বিবেচনায় প্লট বিতরণেও তারা ছিলেন ‘উদারহস্ত’। মন্ত্রী-এমপি থেকে নিয়ে পেশাজীবীদের মধ্যে গত সাড়ে ১৫ বছরে এভাবে প্লট বরাদ্দের কিছু ঘটনা আগেও সামনে আসে এবং সমালোচিত হয়। তারপরও এ ক্ষেত্রে নিয়মনীতি মেনে চলার কোনো প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়নি। হাসিনা সরকার পতনের পর এসব খতিয়ে দেখতে হাইকোর্ট একটি কমিটি করে দিয়েছেন। এতে আশা করা যায়, এর একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র আমরা পাব। 

রাজউকের সিংহভাগ প্লট অবশ্য বরাদ্দ হয় লটারির মাধ্যমে। প্লটের তুলনায় আবেদনকারীর সংখ্যা বেশি থাকায় এ পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে দীর্ঘদিন। লটারির মাধ্যমে প্লট বরাদ্দ নিয়েও অভিযোগ কম নেই। তবে কোটায় প্লট বরাদ্দ নিয়েই সমালোচনা বেশি। এ ধরনের কোটা থাকলে এবং সরকারের প্রধান নির্বাহীর এ ক্ষেত্রে একক নির্ধারক ভূমিকা থাকলে ক্ষমতাটির অপব্যবহার হবেই– এমন মত রয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে রাজনৈতিকভাবে অনুগত ব্যক্তি, এমনকি তাঁর পোষ্যদের মাঝে বেপরোয়াভাবে প্লট বরাদ্দের যেসব খবর মিলছে, তাতে ওই মত জোরদার হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত বিধিমালার বিশেষ ধারাটি বাতিল করেছে। সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা হালে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এখন থেকে কেবল লটারির মাধ্যমে প্লট বরাদ্দ করা হবে।

এ দেশে মানুষের তুলনায় জমি অনেক বেশি রয়েছে, তা কিন্তু নয়। ঘটনা বরং উল্টো। যেসব জরুরি কাজে জমি ব্যবহৃত হয়, সেগুলো সম্পাদনে টানাটানি চলছে বরং। কৃষিজমি চলে যাচ্ছে আবাসন, শিল্প; এমনকি ছোট-বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেও উপকূলীয় জমি হারাচ্ছি আমরা। নদীভাঙনেও মানুষ হচ্ছে বাস্তুচ্যুত। তাদের ন্যূনতম থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা বরং নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থিত। এতে মনোনিবেশের বদলে নগর সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের নামে কাদের কল্যাণে সরকার বেশি নিয়োজিত, সে প্রশ্নও এ প্রসঙ্গে উঠতে পারে। 

রাজউক বা এ ধরনের সংস্থা অবশ্য পরাধীনকাল থেকেই সক্রিয়। স্বাধীনতার এত বছর পরও তার ভূমিকা কী হওয়া উচিত– সে প্রশ্ন উঠতে পারে। রাজধানীর আশপাশ থেকে কৃষিজমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন করে এক শ্রেণির হাতে তুলে দেওয়ার ভেতর দিয়ে কী লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে– উঠতে পারে সে প্রশ্নও। নামমাত্র দামে অধিগ্রহণের নামে যাদের কার্যত উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্লট বরাদ্দে সংস্থাটির অনীহার কথাও কিন্তু কম জানা যায় না। উত্তরোত্তর বেশি আগ্রহ বরং দেখা যাচ্ছে ক্ষমতাবান ও সম্পদশালীদের মধ্যে প্লট বরাদ্দে। রাজনৈতিকভাবে অনুগতদের দ্রুত বিত্তশালীতে পরিণত করতেও এ অস্ত্র বেশি করে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতীয় জীবনে তাদের ‘অসামান্য অবদান’-এর নামেই আবার করা হচ্ছে এটা, যা কার্যত ভয়াবহ অনাচার। 

রাজউকের প্লট বরাদ্দের বিধিমালায় বিশেষত সংরক্ষিত কোটায় সময়ে সময়ে যে পরিবর্তন আনা হয়েছিল, তাতে খারাপ উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট। নব্বইয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের পরও একেকটি সরকার পাল্লা দিয়ে নিজেদের ‘পল্লি’ গড়ে তুলেছে রাজধানীর প্রান্তে। এ নিয়ে তখনও কম প্রতিবেদন হয়নি। সমালোচনা তীব্র হয়ে উঠলে এ ধরনের প্লট বরাদ্দে কিছু সংশোধনী আনা হলেও প্রক্রিয়া থেমে থাকেনি। এ ধারাতেই অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো প্লট বরাদ্দেও বিগত সরকার ছাড়িয়ে গেছে সব সীমা। শর্ত ভঙ্গসহ জালিয়াতির প্রবণতাও তীব্র হয়ে উঠেছে বিশেষ কোটায় প্লট বরাদ্দে। এর মধ্যে রয়েছে রাজধানীতে বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট থাকা সত্ত্বেও প্লট পাওয়া; একই পরিবারভুক্ত একাধিক ব্যক্তির নামে প্লট বরাদ্দ; একই ব্যক্তির নামে একাধিক প্লট ইত্যাদি। 

মন্ত্রী-এমপি, দলীয় নেতা, আমলা, ব্যবসায়ী, পেশাজীবীসহ যাদের নামে প্লট বরাদ্দ হয়েছে, তাদের সিংহভাগ আবার সম্পদশালী। তারা আরও পাওয়ার লোভ সামলাতে পারেনি। সরকার তাদের ‘পুরস্কৃত’ করতে আরও ব্যগ্র। জনগণের অর্থসম্পদ লুটের এ আরেক প্রক্রিয়া, যা থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারও দূরে থাকতে পারেনি। 

বিগত তিনটি ভুয়া নির্বাচনের আগে-পরেও বিশেষ কোটায় রাজউকের প্লট বরাদ্দে কিছু প্রশ্নবিদ্ধ ঘটনা ঘটে। এতে মূলত সচিব পর্যায়ের লোকদের তুষ্ট করা হয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পেশার মানুষের মাঝে তাদের ‘অসামান্য অবদান’-এর কথা বলে প্লট বরাদ্দের উদ্দেশ্যও পরিষ্কার। রাষ্ট্রে আনুগত্য ও তোষামোদির সংস্কৃতি বিস্তারে এ ধরনের পদক্ষেপের প্রভাব এখন স্বভাবতই বেশি করে আলোচিত হচ্ছে। এটাও লক্ষ্য করব, শুধু প্লট বরাদ্দে নয়; একই গোষ্ঠী মনোনয়ন, পদোন্নতি, ব্যবসা, ঋণ ও করের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা লাভ করেছে। সে জন্য এ প্রশ্নটি বেশি করে আলোচিত হচ্ছে– প্লটসহ কোনো ক্ষেত্রেই ‘বিশেষ সুবিধা’ প্রদানের সুযোগ রাখা সংগত কিনা। বিগত শাসনামলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিম্নপদস্থ লোকজনও রাজউকের প্লট পেয়েছে এ বোধগম্য কারণেই। এদের কতজনের প্লট এখন সরকার ক্ষমতাবলে ফিরিয়ে নিতে পারবে– সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। শর্ত বা নিয়মনীতি ভঙ্গের স্পষ্ট প্রমাণ না মিললে ব্যবস্থা গ্রহণ করা কঠিন। অনিয়ম করে পাওয়া প্লট দ্রুত বেচে দিয়ে সে অর্থ অন্য কাজেও ব্যবহার করে ফেলেছে অনেকে। তা উদ্ধার হবে কীভাবে? 

রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে এক শ্রেণির মানুষের ‘অসামান্য অবদান’ থাকে বৈকি। তার যথাযথ মূল্যায়ন আর স্বীকৃতিও প্রয়োজন। সে জন্য কাউকে এক খণ্ড জমিই উপহারস্বরূপ দিতে হবে– এমন কোনো কথা নেই। সে জমি সংগ্রহ করা হচ্ছে কার কাছ থেকে? জমি অধিগ্রহণের এমন ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়েছে ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করতেও নয়। বহু মানুষ ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারে। এমন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যই আসলে দেওয়া হয়েছে এ ক্ষমতা। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় অর্থে রাজউকের গোটা ‘প্লট বাণিজ্য’ নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে। এত দিন ধরে চললেও এটা এখন বন্ধ হওয়া প্রয়োজন নয় কি? এর বদলে প্রতিষ্ঠানটি বরং হয়ে উঠতে পারে পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার কাজে বিধিবদ্ধ নজরদারি প্রতিষ্ঠান। আবাসন ব্যবসা করুক বেসরকারি খাত আর তাতে থাকুক রাজউকের দক্ষ নজরদারি। এ ধরনের সংস্কারের দাবি জোরদার হোক সামনে; নির্বাচিত সরকারের আমলে। অন্তত তারা আর ফিরিয়ে না আনুক রাজউকের প্লট বরাদ্দে ‘সংরক্ষিত কোটা’। লটারিতে বরাদ্দের ব্যবস্থা থাকলেও এ ক্ষেত্রে অধিগ্রহণ ও জমির দাম নির্ধারণে বাজারের চলতি দর হোক ভালোভাবে বিবেচিত। জমির সংকটের দেশে প্লটের বদলে ফ্ল্যাট বানিয়ে বরাদ্দ করাও হতে পারে গ্রহণযোগ্য বিকল্প। 

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব যবহ র এ ধরন র মন ত র ব যবস ক ষমত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলা

রবিবার বিকেল থেকে ইরানজুড়ে নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

রবিবার রাতে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ খাতিবজাদেহ ইসরায়েলি হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি জানান, রবিবার রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।

এক্স-পোস্টে সাইদ বলেছেন, “ইসরায়েলের অপরাধী শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে ইচ্ছাকৃত এবং নির্মম হামলা চালিয়েছে।”

আরো পড়ুন:

ইসরায়েলের নতুন হামলায় ইরানের আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত

ইসরায়েলে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান, তেল আবিব ও হাইফাতে সরাসরি আঘাত

উপ-মন্ত্রী আরো বলেন, “এই হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও আহত হয়েছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”

সাইদ বলেন, “এটি আরো একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর চলমান ও নিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসন অভিযানের অংশ।”

এর আগে শনিবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তেহরানের অস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানের আইআরজিসি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রবিবার নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।

বিবৃতিতে  বলা হয়, এই হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), গার্ডস কুদস ফোর্স এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, ইরানজুড়ে অসংখ্য অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে। 

ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলায় আইআরজিসিরি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং তার সহকারী হাসান মোহাকিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোহসেন বাঘারি নামে আইআরজিসির আরো একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। এর প্রতিশোধ নিতে রবিবার রাতে ইসরায়েলে ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে ইরান।

ইসরায়েলের ফায়ার ও রেসকিউ সার্ভিসের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলে দুটি এবং হাইফায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানার খবর পেয়েছে তারা।

ইসরায়েলি জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সাতজন আহত হয়েছেন। এছাড়া কিরিয়াত গাটের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরে একজন আহত হয়েছেন।

এ ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির ইরানের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একটি বিবৃতি জারি করে ইসরায়েরি সেনাপ্রধান বলেছেন, “আমরা আমাদের অভিযান তীব্রতর করে যাব এবং এটি করে, আগামী বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা জোরদার করব। আমরা জানতাম এর একটি মূল্য দিতে হবে এবং এটিই বোঝায় যে, আমরা কেন এখনই পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অনেক দেরি হওয়ার আগেই।”

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ২২৪ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ৩৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ